আহলে হাদীস কারা —২

0

আহলে হাদীস কারা —২

আগে পড়ুন-

📗 আহলে হাদীস হওয়ার শর্ত

ইবনে তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ হাদিসের উপর আমল করার শর্তের পূর্বে আরও তিনটি শর্ত লাগিয়েছেন। ১. দৃঢ়ভভাবে হাদীস মুখস্থকরণ, ২. গভীর থেকে হাদিসের মা’রিফাত অর্জন, ৩. হাদিসের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ বুঝ অর্জন।

 

এগুলো প্রত্যেকটি এমন শর্ত যে এর থেকে কেবল একটি শর্ত (আমল) উপস্থিত থাকলে আহলে হাদিস বলা তো দূরের কথা, বরং কেবল একটি শর্ত উপস্থিত না থাকলেও তাকে আহলে হাদিস বলা যাবে না। অর্থাৎ যদি তিনটি শর্ত উপস্থিত রয়েছে কেবল একটি শর্ত উপস্থিত নেই তবুও তাকে আহলে হাদিস বলা যাবে না।

 

কেউ যদি বলে, এই শর্তগুলোর প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র শর্ত; কারো মধ্যে একটি শর্ত বিদ্যমান থাকলেই তাকে আহলে হাদিস বলা হবে— তাহলে আমার প্রশ্ন, কারো মধ্যে যদি কেবল প্রথম ও দ্বিতীয় শর্ত উপস্থিত থাকে অর্থাৎ কেউ যদি হাদিস মুখস্থ করেছে এবং হাদিসের মা’রিফাতও অর্জন করেছে কিন্তু তার মধ্যে চতুর্থ শর্ত উপস্থিত নেই, অর্থাৎ সে হাদিস অনুযায়ী আমল করে না— তো তাকেও কি আহলে হাদিস বলা হবে? আশা করি লা-মাযহাব বন্ধুরা এখন ‘না’ বলবেন। কিন্তু আমি বলি, তার মধ্যে তো একটি নয় বরং দুইটি শর্ত পাওয়া গেছে তবুও কেন তাকে আহলে হাদিস বলা হবে না?

কারো মধ্যে দুটি শর্ত থাকার পরেও যখন আহলে হাদিস বলা যাবে না, তাহলে আমাদের লা-মাযহাব বন্ধুরা কীভাবে “কেবল একটি শর্ত (আমল) থাকলেই তাকে আহলে হাদিস বলে দাবি করে?

📗 ব্যাকরণগত তাহকীক

এবার ব্যাকরণগত দিক থেকে লক্ষ্য করা যাক: উক্ত বক্তব্যে উল্লিখিত প্রত্যেকটি শর্ত যে স্বতন্ত্র নয় বরং সামগ্রিক অর্থাৎ প্রত্যেকটা শর্ত একটা আরেকটার পরিপূরক- এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হচ্ছে- ইবনে তায়মিয়্যাহ রহ. প্রত্যেকটি শর্তের সাথে সংযোজক অব্যয় و (এবং) ব্যবহার করেছেন, او (অথবা) নয়। যদি তিনি সংযোজক অব্যয় হিসেবে او (অথবা) ব্যবহার করতেন তখন প্রত্যেকটি শর্ত আলাদা আলাদা ধরা যেতো; আরবি ব্যাকরণ সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা বিষয়টি ভালো বুঝবেন।

 

আমাদের অনেক বড় দুর্ভাগ্য যে, আমরা প্রতিপক্ষ হিসেবে এমন এক দলকে পেয়েছি যারা আরবী বোঝে না, অনুবাদ করতে জানে না, অনুবাদ করে ভুলভালভাবে, অনুবাদের ভেতর জালিয়াতি করে। যেন তাদের মূলধনই হচ্ছে ভুল ও জাল অনুবাদ। খুবই দুঃখ লাগে, তাদের কোনো একটা লেখা খণ্ডন করতে গেলেই হাজার হাজার শব্দের বাক্যব্যয় করা লাগে তাদের ভুল ও জাল অনুবাদের পিছনে। এখানে আসলে তাদের কোনো দোষ বরং এটা আমাদেরই বদ নসীব!

📗 এবার আসুন আমলের বিষয়ে: [اتباعه باطنا وظاهرا]

সকল শর্ত বাদ দিয়ে আমরা যদি কেবল আমলের শর্তটিকেও গ্রহণ করে নিই তবুও কি সাধারণ লোকেরা আহলে হাদিস হতে পারবে?

আমল কেমন হতে হবে ইবনে তায়মিয়্যাহ রহ. সেটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন— اتباعه باطنا وظاهرا মানে, হাদিসের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অর্থের উপর আমল করতে হবে। অর্থাৎ মন খুশিমতো আমল করলেই হবে না যে- একটা হাদিস পেলাম আর ওমনি হাদিসের আগে গোড়া ও ভেতর-বাহির না বুঝে আমল শুরু করে দিলাম- বরং হাদীসের অভ্যন্তরীণ মর্ম এবং বাহ্যিক অর্থ উভয়টা বুঝেই আমল করতে হবে।

তাদের জালিয়াতি:

তারা ইবনে তাইমিয়ার বক্তব্য থেকে কেবল আমলের কথা উল্লেখ করলেও আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অর্থের কথা উল্লেখ করে না। কারণ এ বিষয়টি উল্লেখ করলে তারা আহলে হাদিস হতে পারবে না, কেননা, তারা তো কেবল বাহ্যিক অর্থের উপর আমল করে, বাতেনী বা আভ্যন্তরীণ অর্থের উপর আমল করে না। অথচ তিনি তো আমলের জন্য বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ উভয় অর্থকে শর্ত সাব্যস্ত করেছেন।

📗 আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়: [ظاهرا و باطنا এবং باطنا و ظاهرا]

যখন তিনি হাদীস বোঝার কথা বলেছেন তখন তিনি فهمه ظاهرا وباطنا মানে “বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ বুঝ” এভাবে বলেছেন। অর্থাৎ প্রথমে “বাহ্যিক” শব্দটি উল্লেখ করেছেন পরে “আভ্যন্তরীণ”। এর মাধ্যমে মূলত তিনি হাদীস বোঝার ক্ষেত্রে প্রথমে বাহ্যিক বুঝ অর্জন করাকে প্রাধান্য দিয়েছেন, পরে আভ্যন্তরীণ। এখান থেকে একটা উসুল বের হয়, হাদিস বোঝার ক্ষেত্রে আগে প্রকাশ্য বা বাহ্যিক অর্থটা জানতে হবে, পরে গোপন বা আভ্যন্তরীণ মর্ম উদ্ধার করতে হবে। এটা হচ্ছে হাদিস বোঝার পদ্ধতি।

কিন্তু আমলের ক্ষেত্রে তিনি এর বিপরীত বলেছেন। তিনি বলেছেন— اتباعه باطنا وظاهرا মানে, “অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অর্থের উপর আমল করা”। অর্থাৎ তিনি প্রথমে “আভ্যন্তরীণ” শব্দটি উল্লেখ করেছেন পরে “বাহ্যিক” শব্দটি। এর মানে হচ্ছে, তিনি আমলের ক্ষেত্রে বাহ্যিক অর্থের চেয়ে অভ্যন্তরীণ মর্মের উপর আমল করাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। আর এটাই হচ্ছে সাধারণত আমলের পদ্ধতি।

সারকথা হলো, ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. তাঁর বক্তব্যে আমলের ক্ষেত্রে বাহ্যিক অর্থের উপর আভ্যন্তরীণ অর্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

এটিকে হাদিস শাস্ত্রের একটি উসুল হিসেবেও গ্ৰহণ করা যেতে পারে, হাদিস বোঝার সুবিধার্থে আগে বাহ্যিক অর্থটা জানতে হবে পরে অভ্যন্তরীণ মর্ম উদ্ধার করবে। কিন্তু আমল করার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ মর্মটাকে বাহ্যিক অর্থের উপর প্রাধান্য দিতে হবে।

কিন্তু আফসোস! আমাদের লা-মাযহাব ভাইয়েরা আমলের ক্ষেত্রে হাদীসের আভ্যন্তরীন মর্মের চেয়ে বাহ্যিক অর্থটাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন, বরং আভ্যন্তরীণ অর্থটা তারা স্বীকারই করে না। দেখা যাচ্ছে, তারা এক্ষেত্রেও ইবনে তাইমিয়া রহ. এর বক্তব্য অনুধাবন করতে অক্ষম। তো যারা ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ’র বক্তব্য অনুধাবন করতে অক্ষম তারা হাদিস কিভাবে অনুধাবন করবে?

📗 আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট:

তিনি হাদীস বোঝা ও আমলের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় উল্লেখ করেছেন- باطنا و ظاهرا অর্থাৎ ১. আভ্যন্তরীণ মর্ম ২. বাহ্যিক অর্থ।

 

এর মানে হলো, হাদিসের বাহ্যিক অর্থ একটা থাকতে পারে কিন্তু আভ্যন্তরীণ মর্ম অন্যটা হওয়া অসম্ভব নয়; আর আমলের ক্ষেত্রে আভ্যন্তরীণ মর্মটাই অগ্রগণ্য। যদি একটা হাদিসের দুইটা অর্থ (বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ) না থাকতো, তাহলে ইমাম ইবনে তাইমিয়া কেনো “অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক” এই দুটো বিষয়ে উল্লেখ করেছেন। তিনি যে باطنا و ظاهرا বলেছেন, এর অর্থই বা কী? হাদিসের ‘বাতেনী’ আমল কী? আমরা কি লা-মাযহাব বন্ধুদের কাছ থেকে এর ব্যাখ্যা পেতে পারি?

 

আবারো শত আফসোস লা-মাযহাব বন্ধুদের জন্য, তারা নিজেদেরকে ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ’র অনুসারী দাবি করলেও একটা হাদিসের যে বাহ্যিক অর্থে পাশাপাশি আভ্যন্তরীণ অর্থও থাকতে পারে তারা তা কল্পনাও করতে পারে না। অথচ ইবনে তাইয়ামিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ কত স্পষ্ট ভাবে বলেছেন যে আহলে হাদীস হওয়ার জন্য হাদিসের আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অর্থের উপর আমল থাকতে হবে।

📗 একজন সাধারণ লোক কি হাদিসের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ মর্ম বুঝতে সক্ষম?

এই যে, তিনি বলেছেন হাদিসের আভ্যন্তরীণ মর্ম ও বাহ্যিক অর্থের উপর আমল করার কথা। তো একজন সাধারণ মানুষ কি এই দুটি বিষয় (আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অর্থ) বুঝতে পারে?

 

একটা হাদিসের আভ্যন্তরীণ মর্ম বাতেনী অর্থ কি যে কোনো সাধারণ ব্যক্তি বুঝতে পারে, নাকি তা বোঝার জন্য কুরআন হাদীসের গভীর জ্ঞান থাকতে হয়? অবশ্যই এর জন্য কুরআন হাদীসের গভীর জ্ঞান থাকতে হয়। আর বাহ্যিক অর্থ জানতে হলেও তো কমপক্ষে আরবি ভাষাটুকু জানতে হয় নইলে বাহ্যিক অর্থটুকুও তো জানা যায় না! কারণ, অনেক সময় দেখা যায় অনুবাদক/শায়খ নিজের মনমতো (ভুলভাল) অনুবাদ করে। তো একজন সাধারণ লোক হাদিসের বাহ্যিক অর্থটাও জানতে পারলো না, আর অভ্যন্তরীণ অর্থটা তো জানতে পারলোই না, তাহলে সে আমলটা করবে কীভাবে?

অবশেষে ফলাফল এই যে, যেহেতু একজন সাধারণ লোক ইমাম ইবনে তাইমিয়ার শর্ত অনুযায়ী আমল করতে পারে না, সেহেতু সে আহলে হাদিসও হতে পারবে না।

📗 ইবনে তায়মিয়্যাহ রহ. এর বক্তব্যের সমর্থন

ইমাম ইবনে তাইমিয়ার উক্ত বক্তব্যের সমর্থনে রয়েছে আহমাদ বিন হাম্বলের বক্তব্য। আহমদ বিন হাম্বলের দৃষ্টিতেও যারা কেবল হাদীস শুনে ও লেখে এবং আমল করে তাদেরকে আহলে হাদীস বলা হয় না; বরং আহলে হাদীস হতে হলে উপরিউক্ত সকল গুণের সাথে সাথে হাদীস শাস্ত্রের ব্যুৎপত্তিও অর্জন করতে হবে।

 

চলবে…

 

লুবাব হাসান সাফওয়ান

আরো পড়ুন- 


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

0

লুবাব হাসান সাফ‌ওয়ান

Author: লুবাব হাসান সাফ‌ওয়ান

লুবাব হাসান সাফ‌ওয়ান। ঠিকানা: নোয়াখালী। কর্ম: ছাত্র। পড়াশোনা: আল-ইফতা ওয়াল হাদীস [চলমান] প্রতিষ্ঠান: মাদরাসাতু ফায়দ্বিল 'উলূম নোয়াখালী।

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

কবিতা আল কোরআনের প্রতীক আফছানা খানম অথৈ

আল কোরআনের প্রতীক আফছানা খানম অথৈ মা আমেনার গর্ভেতে জন্ম নিলো এক মহামানবের, নাম হলো তার মুহাম্মদ রাসুল আসলো ভবের

ফোরাত নদীতে স্বর্নের পাহাড় আফছানা খানম অথৈ

ফোরাত নদীতে স্বর্নের পাহাড় আফছানা খানম অথৈ ইমাম মাহাদী (আ:) আগমনের পূর্বে ফোরাত নদীর তীরে স্বর্নের পাহাড় ভেসে উঠা কেয়ামতের

কবিতা দাজ্জাল আফছানা খানম অথৈ

দাজ্জাল আফছানা খানম অথৈ কেয়ামতের পূর্বে দাজ্জাল আসবে নিজেকে খোদা বলে দাবি করবে, কাফের মুনাফিক যাবে তার দলে ঈমানদার মুমিন

গল্প হযরত মুহাম্মদ (সা:) জীবনের গল্প আফছানা খানম অথৈ

জন্ম:হযরত মুহাম্মদ (সা:) বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত মক্কা নগরীর কুরাইশ গোত্রে বনি হাশিম বংশে ৫৭০ খৃষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন।তার পিতার

Leave a Reply