উপন্যাস- ত্রিকালদর্শী- লুবনা নিগার- লেখক ডট মি

উপন্যাস- ত্রিকালদর্শী

0

ত্রিকালদর্শী

লুবনা নিগার

শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘ ভেলার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে । ঘাসের ডগা গুলো সতেজ । নদীর তীরে ফুটেছে কাশ ফুল । শরণখোলা গ্রামে চলছে দুর্গা পূজার প্রস্তুতি চলছেদেবী দুর্গা কৈলাস থেকে এই শরৎ কালে মর্তলোকে আসেন। লক্ষ্য তার অসুর নিধন। স্বর্গের দেবতারা অসুরের সাথে পরাজিত হয়ে যে অকাল বোধন করেছিলেন, তাদের প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে সন্তানদের রক্ষার্থে মাতঙ্গী সমর রঙ্গে মেতে ওঠেন । রকিব পূজার ছুটিতে গ্রামে এসেছে। আসার পথে দেখেছে গ্রামের একমাত্র মন্দিরে পূজা মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে। দুর্গার মূর্তি গড়েন সমর কাকা । রকিবের বাবার সাথে একই স্কুলে লেখাপড়া করতেন। দেশভাগের সময় সমর কাকার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য ভারতে চলে যায়। কিন্তু সমর কাকার বাবা তার স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে শরণখোলা গ্রামে থেকে যান। পাকিস্তান যুগে তাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।

দেশভাগের আগে অর্থাৎ ইংরেজ আমলে গ্রামে জমিদারি প্রথা প্রচলিত ছিল। রকিব তার নানা ওসমানের কাছে শুনেছে শরণখোলার তৎকালীন জমিদারের নাম ছিল অমরেন্দ্রনাথ চৌধুরী। তিনি বাস করতেন কলকাতায়। শরণখোলার স্থানীয় প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের জন্য সমগ্র জমিদারি কিছু অংশে বিভক্ত করে পত্তনিদার নিয়োগ করেছিলেন। প্রত্যেক পত্তনিদার আবার তার অংশের জমি কয়েক জন রায়তদের মধ্যে বিলি বন্দোবস্ত করে দিত। এভাবে জমিদার ও করদাতা কৃষকের মাঝখানে কয়েক স্তর বিশিষ্ট মধ্যসত্ত্বভোগী শ্রেনীর উদ্ভব হয়। ওসমান মৃধার বাবা ছিলেন এমনি একজন রায়ত। যতদিন জমিদারি প্রথা বহাল ছিল ততোদিন মহা সমারোহে দূর্গা পূজা করা হতো। যদিও গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দা ছিল মুসলমান। কুমোর পাড়ায় বাস করতেন সমর কাকার পরিবার। পূজা পার্বনের সময় তারা জমিদারের কাছ থেকে দক্ষিনা পেতেন। তখন তাদের সমৃদ্ধির পাশাপাশি গ্রামে প্রতিপত্তি ছিল।

ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো রকিব। গতকাল মোবাইল ফোনে মায়ের সাথে কথা হয়ছে। তখন তাকে রকিব বলেছিল, সে রাতের ট্রেনে গ্রামে আসবে। স্টেশনে পরিচিত কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কেউ তাকে নিতে আসবে এমন আশা রকিব করেনি। আজ বুধবার। ফ্যাক্টরিতে কর্ম দিবস চলছে। শুক্রবার থেকে সোমবার পর্যন্ত টানা চারদিন কারখানা পূজার ছুটিতে বন্ধ থাকবে। রকিবের বাবার নাম রহমতউদ্দীন। তিনি নরসিংদীর সূতাকলে কাজ করেন। শুক্রবারের আগে বাবার সাথে রকিবের দেখা হবে না। স্টেশন থেকে রকিবদের বাড়ি প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে। গ্রামের রাস্তায় এখন রিক্সা ভ্যান সবই চলে। রকিব তবু চিন্তা করছিল এই পথটুকু পায়ে হেটেঁ যাবে কিনা। স্টেশনে দেখা হলো সুশীলের সাথে। সুশীল সমর কাকার ছোট ছেলে। রকিবের সমবয়সী।

স্কুলে পড়া অবস্থায় সুশীল লেখাপড়া ছেড়ে দেয়। উঠতি বয়সী মাস্তানদের সাথে মিশে গাজাঁ খাওয়া শুরু করে। মাস্তানিতে বিশেষ পারদর্শিতার জন্য প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নেক নজরে পড়তে তার দেরী হয়নি। এখন নাকি স্থানীয় এমপির সাথে ঠিকাদারি ব্যবসা করে। রকিব কে দেখে সুশীল এগিয়ে আসে। হাতে স্মার্টফোন , অদূরে তার মোটর সাইকেল দাড়ঁ করানো। একগাল হেসে রকিব কে জিজ্ঞাসা করলো, এই যে গুডবয়, গ্রামে কবে আসা হলো?

সুশীলের পরিবর্তন রকিবের দৃষ্টি এড়ায়নি। তবে মুখে বললো, রাতের ট্রেনে আসলাম। তোদের খবর কি? সমর কাকা ভালো আছে? সঙ্গে সঙ্গে সুশীলের মুখ কালো হয়ে গেলো। বললো, ঐ বুড়োর কথা জিজ্ঞাসা করিস না। শিল্প শিল্প করে তার মাথাটা গেছে। সে বলে, আমি নাকি অসৎ পথে উপার্জন করি। আমার টাকা স্পর্শ করবে না। টাকার আবার সৎ অসৎ কি? বাবার কথা শুনে চলতে গেলে তার মতো না খেয়ে থাকতে হবে। রকিব প্রশ্ন করলো, তুই সমর কাকার থেকে আলাদা থাকিস? সুশীল উত্তর দেয়, আমি পৃথক হতে চাই নি। বাবা বের করে দিয়েছে। ভালোই হয়েছে। ঐ কুড়ে ঘরে মানুষ থাকতে পারে? তুই এখন কোথায় থাকিস? আর সুমিত্রার খবর কি? রকিব প্রশ্ন করে। হেসে ওঠে সুশীল, আপাতত ঢাকায় আছি। আমি এখন হাত বাড়ালে বহু সুমিত্রা কে পেতে পারি। মদ বা নারী কোনোটার অভাব আমার নেই। সুশীলের সাথে রকিবের আর কথা বলার প্রবৃত্তি হচ্ছে না। সে বললো, বেলা বাড়ছে। এখন আমি বাড়ি যাই । পরে তোর সাথে কথা বলবো।

স্টেশন থেকে মূল সড়কের শুরু। রাস্তাটি পাকা করা। প্রধান সড়ক শেষ হয়েছে গ্রামের অভ্যন্তরে অবস্থিত মীরপুর হাইস্কুলের প্রান্তে। ব্রিটিশ যুগে যেমন জমিদারদের প্রাধান্য ছিল তেমনি পাকিস্তান যুগে জমিদারি প্রথা রদ হয়ে গেলেও গ্রামাঞ্চলে জোতদার শ্রেনী শক্তিশালি হয়ে ওঠে। শরণখোলা গ্রামের হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মীর আলী ছিলেন এমনি একজন জোতদার। দেশভাগের পর গ্রামের অধিকাংশ হিন্দু পরিবার ভারতে চলে যায়। তাদের পরিত্যাক্ত সম্পত্তি দখল করে মীর আলীর মতো জোতদাররা গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোয় ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে। রকিব এই স্কুলে দশম শ্রেনী পর্যন্ত পড়েছে। নানার কাছে শুনেছে মীর আলী খুব ধর্মপরায়ন ছিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছিল দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। হিন্দু মুসলমান দুই জাতি। এই ধরণের রাষ্ট্রে ধর্মের প্রবল প্রাধান্য থাকবে সেটা তো বলা বাহুল্য। কিন্তু যুগের পরিবর্তনের সাথে সমাজেও পরিবর্তন আসে। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের চারটি মূলনীতির মধ্যে অন্যতম ছিল ধর্ম নিরপেক্ষতা। পরবর্তীতে সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম করা হলেও বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে উদার ও সহিষ্ণু অবস্থান বিরাজ করছে।

রকিব যখন স্কুলে পড়তো তখন কখনো মনে হয়নি হিন্দু মুসলমান বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। শ্রেনীকক্ষের লাস্ট বেঞ্চে সে আর সুশীল একসাথে বসতো। স্কুলের ফুটবল টিমে নয়জন মুসলমান ছেলের সাথে দুইজন হিন্দু ছেলে ছিল। ওরা এগারো জন একসাথে খেলতো। মীরপুর হাইস্কুলে ক্লাস এইটে ইংরেজি পড়াতেন বারি স্যার। রকিব তখন অষ্টম শ্রেনীর ছাত্র। একদিন ক্লাসে ইংরেজি ট্রান্সসেলেশন করাচ্ছেন স্যার। তিনি বোর্ডে একটা বাক্য লিখলেন, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণ করে। স্যার বলেছিলেন, বাক্যটি চিরন্তন সত্য। এই বিষয়টি আবিষ্কার করেছিলেন কোপারনিকাস। বিজ্ঞানী গ্যালিলিও নিজ হাতে দূরবীন যন্ত্র তৈরী করে মহাকাশ পর্যবেক্ষন করেন। তিনি তত্ত্বটির সত্যতা প্রমান করেন। সপ্তদশ শতকে বিজ্ঞানী ব্রুনো তত্ত্বটি প্রচার করলে প্রকাশ্য জনসম্মুখে তাকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। স্যার বলেছিলেন, ব্রুনোর মতো সত্য সাধকরা যুগে যুগে মানুষের জন্য জ্ঞানের আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে গেছেন।

রকিব প্রধান সড়ক ছেড়ে এবার কাচাঁ রাস্তায় নেমে পড়লো। রাস্তার দুই পাশে সর্ষে খেত। এই অঞ্চলে আউস, আমন এবং ইরি ধানের পাশাপাশি রবি শস্য এবং সর্ষের চাষ হয়। সর্ষে খেতে যখন ফুল ফোটে তখন সমস্ত মাঠ সোনার মতো বর্ণ ধারন করে। বাতাসে ভেসে বেড়ায় মিষ্টি সুগন্ধ। রকিব খেয়াল করলো সর্ষে খেতের পাশে মৌমাছির চাক। কৃষকরা খেতের পাশে মৌমাছি পালন করে। মৌমাছির চাক দেখতে গিয়ে সিরাজ চাচার সাথে দেখা হয়ে গেলো। চাচা ছোট এক বোতল মধু নিয়ে রাস্তা দিয়ে আসছিলেন। রকিব কে দেখে ডাক দিলেন। খুশি হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, রকিব নাকি? পূজার ছুটিতে গ্রামে এসেছো? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছো। খুব ভালো কথা। রকিব সালাম জানিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, আপনারা ভালো আছেন চাচা? সিরাজ চাচা বললেন, আমাদের আর ভালো থাকা। এই বছর ঝড়ে ফসলের খুব ক্ষতি হয়েছে। জমি চাষের খরচ উঠবে না। বাবু গৃহস্থালির কাজে লেগে গেছে। বাবু সিরাজ চাচার মেজ ছেলে। গতবার রকিব যখন গ্রামে আসে তখন সে এস এস সি পরীক্ষার্থী। বিস্মিত হয়ে রকিব প্রশ্ন করে, বাবু কলেজে ভর্তি হয় নি? সিরাজ চাচা বিষন্নভাবে মাথা নেড়ে বললেন, তিনটা পরীক্ষা দিয়ে আর পরীক্ষা দিলো না। বললো, এসএসসি পাস করতে পারবে না। কোচিং টিচার তো কোনো দিন ছিল না। গরীবের আবার লেখাপড়া। কামলার ছেলে। এখন গৃহস্থালির কাজ করে। বৈশাখ মাসে মাঠে ধান কাটে।

রকিবের মনে পড়লো, বাবু লেখাপড়ায় ভালো না হলেও পরিশ্রম করতো। লেগে থাকতে পারলে ছেলেটা আরও অগ্রসর হতো। কিন্তু কি আর করা যাবে। শহরের উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুদের মতো কৃষক, শ্রমিকের ছেলেমেয়েরা সমান সুযোগ সুবিধা পায় না। ফলে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ তাদের কাছে অধরা রয়ে যায়। সিরাজ চাচা কে বিদায় জানিয়ে রকিব এগিয়ে চললো। একটা বিষয় তাকে শৈশব থেকে ভাবিত করে। আর বিষয়টা হলো, সমাজে বিদ্যমান অসমতা। রকিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানে অনার্স পড়ে। এই বিষয় নিয়ে পড়তে গিয়ে সে জেনেছে, বাংলাদেশে ক্ষুদ্র একটা শ্রেনীর হাতে দেশের অধিকাংশ সম্পদ জড়ো হয়ে গেছে। সমাজের বেশিরভাগ মানুষ দরিদ্র। এই দুই শ্রেনীর সদস্যদের জীবনযাত্রা পদ্ধতি, দৃষ্টিভঙ্গী প্রভৃতি বিষয়ে আকাশ পাতাল পার্থক্য। সিরাজ চাচা কামলার কাজ করেন। তারঁ পাচঁ সন্তান। মেয়েগুলো কে একটু বড় হলে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। ছেলেরা খেত মজুর বা ভূমিহীন শ্রমিক হিসেবে সূতাকলে কাজ করে। একটা সন্তান কে তিনি লেখাপড়া করাবার চেষ্টা করেছিলেন। লেখাপড়া শিখে সে চাকরি পেলে মধ্যবিত্ত শ্রেনীতে উন্নীত হতে পারতো। কিন্তু অর্থাভাবে সেটা সম্ভব হলো না। অথচ সুশীল কতো সহজে টাকা পয়সার মালিক হয়ে গেছে। মানুষের জীবনের প্রয়োজন মিটিয়েও ভোগবিলাসের ব্যবস্থা করতে পারছে। এই ব্যবস্থা কে লেনিন বলেছিলেন, প্রতিটা জাতির মধ্যে দুইটা জাতি থাকে। প্রতিটা সংস্কৃতির মধ্যে দুইটা সংস্কৃতি থাকে। শ্রেনী ভেদাভেদ , ধনী দরিদ্রের বৈষম্য মানুষ কে দুই অংশে বিভক্ত করে ফেলে।

রকিব বাড়ি পৌছাঁলো মধ্যাহ্নের পরে। সদর দরজা পার হতেই মায়ের সঙ্গে দেখা হলো তার। রাতে মোবাইলে রকিবের সাথে কথা বলার পর থেকে আমেনা বেগম উদগ্রীব ভাবে ছেলের জন্য অপেক্ষা করছেনসারা রাত ভালো ঘুম হয় নি তার। সকালে উঠে রফিক কে পাঠিয়েছেন বাজার করতে। রফিক আমেনা বেগমের মেজ ছেলে। রকিবের চেয়ে বছর দুয়েকের বড়। বিয়ে করে ইতোমধ্যে সংসারি হয়ে গেছে। দুটো ছেলেমেয়ের পিতা। মা রকিবের জন্য তার প্রিয় খাবার রান্না করেছেন। লাল শাক ভাজি আর রুই মাছের মাথা দিয়ে মুড়ি ঘন্ট। মাংসের পদটা শুক্রবারে রান্না হবে। ঐ দিন রকিবের বাবা বাড়ি আসবে। সবাই একসাথে বসে খাবে। রান্নার সময় মায়ের মনে পড়ছিল ছোট্ট রকিবের কথা। পাড়ার ছেলেদের সাথে ডাঙ্গুলি খেলে সন্ধ্যাবেলা বাড়ি আসতো। তারপর হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসতো। মা অনেক দিন শাড়ির আচঁলে রকিবের মুখের ঘাম মুছে দিয়েছেন। ঘরে বৈদ্যুতিক পাখা ছিল না। সেই রকিব এখন অনার্স পড়ে। ভাবতেই মায়ের মনটা আনন্দে ভরে যায়।

এমন সময় তার চোখে পড়লো রকিব আঙ্গিনায় দাড়িঁয়ে আছে। রান্নাঘর থেকে দৌড়েঁ বের হন আমেনা। বললেন, ট্রেন তো সকালে এসেছে। বাড়ি আসতে তোর এতো দেরী হলো? রকিব বললো, স্টেশন থেকে হেটেঁ এসেছি। গ্রামটা অনেক বদলে গেছে। এই রোদে এতোটা পথ হেটেঁ এসেছিস? দেখো তো কান্ড। রাতে জ্বর না আসে? মায়ের কন্ঠে উদ্বেগের ছাপ। রকিব মায়ের দিকে তাকায়। ছোটখাট, মধ্যবয়সী, শীর্নকায় নারী। যখন তিনি পুত্রবধু বা জা দের সাথে মুরগীর ডিম নিয়ে ঝগড়া করেন, তখন কে বলবে তার অন্তর এতো স্নেহশীল। দারিদ্র্যের সর্বগ্রাসী প্রভাব মানুষের সহজাত মানবিক বোধ কে সবসময় নিঃশেষ করতে পারে না। রকিব দুষ্টুমির হাসি হেসে বলে, চিন্তা করো না। ঐটুকু মাত্র পথ।তোমাদের খবর কি? নানার শরীর টা ভালো আছে? বলতে বলতে রকিব চকলেট আর ফলের পার্সেল দুটো মায়ের হাতে দেয়। শহরে টিউশনির টাকা বাচিয়ে ওগুলো কিনে এনেছে। ইতোমধ্যে পাচঁ ছয়টি বাচ্চা ছেলেমেয়ে রকিব কে ঘিরে ধরেছে। তাদের মধ্যে রফিকের ছেলে মেয়ে দুটো আছে।

রফিক দূর থেকে রকিব কে দেখতে পেলেও ভাইয়ের কাছে আসে নাই। ভোর বেলা মা যখন তাকে বাজারে যাবার জন্য তাড়া দেয় তখন রফিক বিরক্ত হয়ে বিড় বিড় করে বলছিল, আবার আদ্যিখেতা শুরু হলো। ছেলে ঢাকায় লেখাপড়া করে। লেখাপড়া করে কি হবে? চাকরি পেয়ে ভদ্রলোক হবে। তারপর গরীবদের ঘৃণা করবে। রকিব আর রফিক দুই ভাই কে একসাথে স্কুলে ভর্তি করা হলেও রফিক কিছুদিনের মধ্যে লেখাপড়া ছেড়ে দেয়। অভাবের সংসারে একজন সদস্য বসে খাবে এইরকম সামর্থ্য রহমতের ছিল না। বাবা তাই রফিক কে মাটি কাটার কাজে লাগিয়ে দেয়। অপর দিকে রকিব লেখাপড়ায় লেগে রইলো। এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। রকিবের প্রতি রফিকের মনে একটা সুক্ষ্ণ ঈর্ষা বোধ আছে।

নানা বারান্দায় জায়নামাজের উপর বসেছিলেন। আটাত্তর বছর বয়সী অশতীপর বৃদ্ধ ওসমান মৃধা। তিনি শৈশবে বৃটিশ যুগে জমিদারদের জৌলুস আর আভিজাত্যের বিপরীতে সাধারন কৃষকদের উপর নিপীড়ন হতে দেখেছেন। জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত পাকিস্তান ভাগ হতে দেখেছেন। পাকিস্তান যুগে শোষণের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষের প্রতিরোধের সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করেছেন। আর এখন দেখছেন স্বাধীন বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দারিদ্র্য এবং সর্বত্র মূল্যবোধের অবক্ষয়। তিনি যেন এক ত্রিকালদর্শী প্রাজ্ঞ যিনি ক্রমাগত প্রত্যক্ষ করে চলেছেন, রাষ্ট্র ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়। কিন্তু এর কাঠামো বদলায় না। রকিব আসার খবর তিনি আগেই পেয়েছিলেন। এখন আঙ্গিনায় শব্দ শুনে বাইরে এসে দাড়াঁলেন। লম্বা, ছিপছিপে গড়নের রকিব কে তিনি দুই চোখ ভরে দেখলেন। রকিব নানা কে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে সালাম করে। আশীর্বাদের ভঙ্গীতে ওসমান মৃধা বললেন, দীর্ঘজীবী হও বাবা। তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোটা অশ্রু।

রাতে খাবার পর বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে রকিব নানার সাথে গল্প করছে। মা তখনো রান্নাঘরে। রকিবের জন্য ভাপা পিঠা তৈরী করছেন। হারিক্যানের আলোয় রকিব নানা কে রবি ঠাকুরের দুই বিঘা জমি কবিতাটি পড়ে শোনায়,

শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে।

বাবু বলিলেন, বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।

বৃদ্ধ ওসমান তার নাতির মুখের দিকে তাকায়। রকিব তার ছোট মেয়ের মেজ ছেলে। ওসমান জিজ্ঞাসা করে, নানুভাই রবি ঠাকুর এই কথা লিখেছেন? রকিব বলে, হ্যাঁ নানা, কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা। ওসমান আবার প্রশ্ন করে, উপেন কি হিন্দু ছিল? রকিব তার সদ্য তারুণ্যের উদার মানসিকতা থেকে বলে, হিন্দু আর মুসলমানে পার্থক্য কি? গরীবের পরিচয় গরীবই। রাজার লোভ যখন কাঙ্গালের ধন গ্রাস করে তখন কোনো ধর্ম মানে না। ওসমান এখনো তার জন্ম তারিখ স্মরণ করতে পারে। ব্রিটিশ যুগে যখন দাঙ্গা বাধঁলো, শয়ে শয়ে মানুষ মরলো ওসমান তখন নিতান্ত বালক। কতো দিন আগের কথা। অথচ ঘটনাগুলো তার স্বৃতিপটে এখনো সজীব।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল- কলকাতা- ব্রিটিশ ভারতের স্থাপত্য নিদর্শন- লেখক ডট মি
ছবিঃ  ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা। ব্রিটিশ ভারতের স্থাপত্য নিদর্শন।

চল্লিশের দশকঃ ব্রিটিশ রাজত্বের অবসান।

পুকুর থেকে মাছ ধরে ফিরছে ওসমান আর অমল। ওসমানের বয়স আট বছর। মাছ ধরতে সে বিশেষ পটু নয়। সারা শরীর কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে। তাছাড়া শিং মাছটা ধরার সময় ওটা ধাই করে ওসমানের হাতে কাটাঁ ফুটিয়ে দিয়েছে। হাতটা যন্ত্রনা করছে। তবে মাছগুলো ধরতে পেরে ওসমান খুব খুশি। গত কয়েক দিন ধরে মা শুধু পাট শাক আর নিরামিষ রান্না করে। মাছ মাংসের বালাই নেই। বাবা বেশ কিছু দিন ধরে বাজার করে না। আজ মাকে বলবে শোল মাছটা রান্না করার জন্য। মায়ের রান্নার হাতটা দারুন। কথাটা মনে হতে নিজের অজান্তে হেসে ফেলে ওসমান। অমল দেখতে পেয়ে বলে, খুব যে হাসছিস। মাছ পেয়ে আনন্দ লাগছে? অমল ওসমানের চেয়ে তিন বছরের বড়। বংশ পরম্পরায় ওরা কুমোর। ওসমান বলে, সত্যি দাদা, অনেক দিন মাছ খাই না। বাবা বলেছে এবার ফসল ভালো হয় নাই। জমিদারের খাজনা দিতে সমস্যা হবে। বাবা বাজারও করে না।

অমল বলে, তুই আমাদের বাড়ি আসতে পারিস। মন্দিরে পূজার পরে অনেক প্রসাদ পড়ে থাকে। সন্দেশ, মিষ্টি যতো খুশি খাও। ওসমান দেখেছে ঠাকুরের পূজার সেকি জাকজমক পূর্ণ আয়োজন। জমিদার অমরেন্দ্রনাথ চৌধুরীর নির্দেশে দেবী দূর্গাকে সত্যিকারের স্বর্নালংকারে সাজানো হয়। তবে ইতর বিশেষ কয়েকজন জমিদারের কৃপা লাভ করলেও, অন্যান্য প্রজাদের অস্থি মজ্জা পর্যন্ত জমিদার শুষে নেয়। ওসমানের বাবা গত বছর খাজনা দিতে পারে নি। এই বছর খাজনা বকেয়া থাকলে জমিসহ জমিদার তার ভিটে বাড়ি ক্রোক করবে। এতো কিছু বোঝার সামর্থ্য ওসমানের এখনো হয়নি। তবে জন্মের পর থেকে অনাহার আর নির্মমতা দেখে দেখে দারিদ্র্য সম্পর্কে তার সম্যক ধারণা হয়ে গেছে।

দুটো বালক মনের আনন্দে রাস্তা দিয়ে কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। এমন সময় তাহেরের সাথে দেখা হলো। তাহের জমিদারের নায়েব। খাস নফর। নিচ প্রকৃতির, কুটিল চরিত্রের লোক। বকেয়া খাজনার জন্য জমিদার যখন কোনো প্রজার জমি ক্রোক করে তখন তার লাঠিয়াল বাহিনীর নেতৃত্ব দেয় তাহের। তাহেরের আজকের দিনটা ভালো যায়নি। জমিদারের অনুপস্থিতে যে কয়েক জন মধ্যসত্বভোগীর কাছ থেকে খাজনা আদায় করা হয়, তার তদারক করে তাহের। বলাবাহুল্য, নিজের জন্য মোটা অংকের অর্থ রেখে বাকি টাকা সে খাজাঞ্চিখানায় জমা দেয়। কোষাধ্যক্ষ সুখেন দাস যে বিষয়টা জানে না তা নয়। কিন্তু নিজের ভাগের বখরা কম হয়ে যাবার জন্য তাহেরের সাথে তার দ্বন্ধ বেধেঁছে। সুখেন দাস এই বলে তাহের কে শাসিয়েছে, বাবু গ্রামে আসলে সব কথা ফাসঁ করে দেবো।তাহের আপন মনে গজ গজ করছিল। ভারি আমাকে ভয় দেখায়। বাবু গ্রামে এসে বাগানবাড়িতে নেশা করে পড়ে থাকবে। কলকাতায় যেমন বাঈজী বাড়ি পড়ে থাকে। আর তার মেয়েমানুষ যোগাড় করে দিতে হবে আমাকে। বাবুর সময় কোথায় হিসাব দেখার?

এমন সময় তাহের রাস্তায় বালক দুটো কে দেখতে পায়। তার কারো প্রতি রাগ প্রকাশ করা দরকার ছিল। সে গর্জে উঠে জিজ্ঞাসা করে, এই তোরা কে রে? কোন পুকুর থেকে মাছ ধরেছিস? শরণখোলা গ্রামের সবচেয়ে বড় পুকুরের নাম রাজপুকুর। জমিদার অমরেন্দ্রনাথ চৌধুরীর মাতা রানী চন্দ্রাবলীর নির্দেশে পুকুরটি খনন করা হয়। রানী চন্দ্রাবলীর দানশীলতার কথা এখনো গ্রামবাসী স্মরণ করে। প্রজাদের পানীয় জলের অভাব দূর করার জন্য রানী ঐ নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে পুকুরে মাছ ধরলে সবচেয়ে বড় মাছটা জমিদার বাড়িতে পাঠাবার নিয়ম রয়েছে। ছোট্ট ওসমান এতো কিছু জানে না। সে দীর্ঘ সময় মাছ ধরে ক্লান্ত। এখন তাহেরের গর্জন শুনে ভয় না পেয়ে রেগে গেলো। ওসমান বললো, যেখান থেকে মাছ ধরি, তাতে কার কি আসে যায়? তাহের ধমকে উঠে বলে, ছোট মুখে বড় কথা। নিশ্চয় রাজপুকুর থেকে মাছ ধরেছিস। বড় মাছগুলো দে। জমিদারের নজরানা। রাগ এবং অসহায়ত্ব এই দুই মনোভাব ওসমান কে গ্রাস করে। সে জানে রাজপুকুর থেকে মাছ ধরলেও তাদের যৌথ পরিবারে এই মাছ তিন ভাগে ভাগ হবে। সেখান থেকে একভাগ ওসমানের পরিবার পাবে। এখন যদি বড় মাছগুলো জমিদারের নজরানায় দিয়ে দেয়, তাহলে আর অবশিষ্ঠ থাকে কি? কচি হাতে খালুইটা দৃঢ়ভাবে আকড়েঁ ধরে বললো, মাছ আমি ধরছি। আমি দেবো না।

তাহেরের রাগ এবার সীমা ছাড়ালো। হাত বাড়িয়ে বললো, হারামজাদা, তোর সব মাছ কেড়ে নেবো। অমল এতোক্ষণ ব্যপারটা দেখছিল। তাহেরের ক্রূতার কথা সে জানে। এবার ভয় পেয়ে অমল অনুনয় করে বললো, তাহের কাকা ছেড়ে দেন। ওসমান ছোট মানুষ । না বুঝে এইসব কথা বলে ফেলেছে। কিন্তু তাহেরের রাগ তখন সপ্তমে চড়ছে। অমলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ওসমানের দিকে এগিয়ে গেলো। এমন সময় গম্ভীর অথচ সৌম্য কন্ঠে কে যেন পশ্চাত থেকে ডেকে ওঠে, তাহের। শিকারী বাঘের মুখ থেকে তার শিকার করা জন্তু কেড়ে নিলে যে প্রতিক্রিয়া হয়, তাহের ঠিক সেই ভঙ্গীতে ঘুরে দাড়াঁয়। কিন্তু দন্ডায়মান মানুষটি কে দেখে তটস্থ হয়ে গেলো। সম্মুখে সৌমেন্দ্রনাথ দাড়িঁয়ে আছেন। সৌমেন্দ্রনাথ জমিদার বাবুর ছোট ছেলে।বাবা এবং বড় ভাই কলকাতায় থাকলেও ছোটকর্তা লেখাপড়া শেষ করে এসে গ্রামে থাকেন। সৌমেন্দ্রনাথ স্বয়ং তাহের কে নিবৃত্ত করছেন। সে বুঝলো এই বেলা তার কপালে ভোগান্তি আছে। ধূর্ত তাহের জমিদার বাবু আর তার কর্মচারীদের যতো সহজে বুঝতে পারে এবং তাদের কাছ থেকে যেভাবে সুবিধা আদায় করতে পারে, সৌমেন্দ্রনাথের সাথে তা পারে না। অবশ্য ছোটকর্তা জমিদারি বা অর্থ সম্পদের প্রতি উদাসীন। জমিদারের ছেলে অথচ মদ নারী স্পর্শ করে না। কি সব স্বদেশী আন্দোলন নিয়ে চিন্তায় মেতে থাকে। তাহেরের এইসব বিষয়ে কোনো আগ্রহ নেই। তার মনে হয় ছোটকর্তার মাথায় নিশ্চয় গোলমাল আছে। এতো লেখাপড়া শিখলে কি মাথা ঠিক থাকে? তবে একমাত্র তাকে তাহের মনে মনে ভয় পায়।

এখন তাকে দেখতে পেয়ে তাহের গলার স্বর পরিবর্তন করে ফেলে। মুখে সমীহ ভাব ফুটিয়ে তুলে বলে, ছোটবাবু, আপনি এই রোদের মধ্যে কি করছেন? আমাকে ডেকে পাঠালে আমি নিজেই আপনার সেবায় হাজির হতাম। তাহেরের তোষামুদি কে পাত্তা না দিয়ে সৌমেন্দ্রনাথ আগের মতো গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করেন, ছেলে দুটো কে ধমক দিচ্ছো কেনো? তাহের বললো, আর বলবেন না বাবু। রাজপুকুর থেকে মাছ ধরেছে। অথচ জমিদার বাড়িতে নজরানা পাঠাবে না। সৌমেন্দ্র বালক দুই জনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের নাম কি? বিপদের আশঙ্কায় ইতোমধ্যে তাদের ভয় ধরে গেছে। তবু অমল সাহস করে উত্তর দিলো, আমি অমল। আর ওর নাম ওসমান। সৌমেন্দ্র স্নেহের সুরে বললেন, রাজপুকুর থেকে মাছ ধরলে জমিদার বাড়িতে তো নজরানা পাঠাতে হয়। ওসমান সৌমেন্দ্র কে চেনে না। তবু অপরিচিত আগুন্তকের কন্ঠের স্নেহ তার মন কে স্পর্শ করে। সে কান্না জড়িত কন্ঠে বললো, দেখো না কাকা, সেই ভোর থেকে মাছ ধরছি। এই মাছ বাড়ি নিয়ে গেলে চাচাদের মধ্যে তিন ভাগ হবে। জমিদার বাবু কে দিলে আমাদের থাকে কি? তাহের বলে উঠলো, এইসব ছোট জাতের ছেলেদের কথা বিশ্বাস করবেন না, ছোটবাবু। নজরানা ফাকিঁ দেবার জন্য ওরা বানিয়ে বানিয়ে অনেক মিথ্যা কথা বলে। সৌমেন্দ্রর মুখে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে। তিনি বললেন, ছেলে দুটো কে মাছ নিয়ে বাড়ি যেতে দাও। নজরানা লাগবে না।

তাহের আপত্তি জানিয়ে বললো, কিন্তু ছোটবাবু এটা তো নিয়ম। যা বলছি তাই করো। আদেশের সুরে বললেন সৌমেন্দ্র। তাহের অসন্তুষ্ট হলো ঠিকই। কিন্তু আদেশ না মেনে তার উপায় ছিল না। ছেলে দুটো কে সে যেতে দেয়। ওরা চলে গেলে সৌমেন্দ্রর মুখের চিন্তার রেখাটি আরও গভীর হলো। কলকাতায় লেখাপড়া করার সময় তিনি ভারতবর্ষের সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে জেনেছেন। ১৭৯৩ সনে তৎকালীন ইংরেজ গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথার প্রচলন করেন। এই প্রথায় সমগ্র বাংলার জমি কে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে কিছু জমিদার কে বংশপরম্পরায় সেই জমির মালিক করে দেয়া হয়। আর কৃষকরা জমিদারের প্রজায় পরিণত হয়। জমিদাররা জমি চাষের পদ্ধতির কোনো উন্নতি না করে নিত্য নতুন কর আরোপ করতে শুরু করে। করের ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে কৃষকদের উপর নেমে আসে চরম দূর্দশা। অনহারক্লিষ্ট কৃষকদের শোষণ করে জমিদাররা বিলাস বহুল জীবনযাপন করতো। ওসমানের পরিবারের দারিদ্র্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফল। আরেকটু বিশদ ভাবে বলা যায় ব্রিটিশ শাসনের অভিশাপ। ভাবতে ভাবতে সৌমেন্দ্রনাথ জমিদার বাড়ির প্রাঙ্গনে এসে পৌছাঁলেন। তাহের সুযোগ বুঝে আগেই কেটে পড়েছে।

জমিদার বাড়ির ছাদটি গম্বুজ আকৃতির। তিন তলা প্রাসাদের ন্যায় বাড়িতে অন্দরমহল ছাড়াও আরও কয়েকটি মহল রয়েছে। বৈঠকখানার দেয়াল ও শ্বেত পাথর দ্বারা নির্মিত। দাস দাসীদের থাকার স্থানটি অন্দর মহলের বাইরে অবস্থিত। বাড়ির প্রাঙ্গনে বিশাল ফুলের বাগান। বাগানে গোলাপ বা বেলী ফুলের পরিবর্তে চন্দ্রমল্লিকা , মাধবীলতা, হাসনা হেনা ইত্যাদি ফুল গাছের প্রাধান্য দেখা যায়। বাগানে সৌমেন্দ্র নিজ হাতে গাছের পরিচর্যা করেন। সৌখিন ফুল গাছের চেয়ে স্থানীয় গাছগুলো তার বেশি পছন্দ। আজ বাগানে ঘুরতে বেরিয়েছেন কমলিনি। সৌমেন্দ্রর ছোট বোন। সঙ্গে আছেন দীপাবলী। দীপাবলী দিব্যেন্দুর স্ত্রী। জমিদারবাবুর পুত্রবধূ। কমলিনির গায়ের রঙ দুধে আলতা বর্ণের। কোমর পর্যন্ত দীর্ঘ ঘন, কালো চুল। লম্বা, একহারা গড়নের কমলিনির পাশে দীপাবলী অনেকটাই ম্লান। শুধু শ্যামবর্ণ গায়ের রঙ নয়, তার মুখমন্ডল জুড়ে গভীর বিষাদের ছাপ। আজ কমলিনি কে সাজিয়ে দিয়েছেন দীপাবলী। বাসন্তী রংয়ের পাটভাঙ্গা শাড়ি। গাঢ় লাল জরির পাড়। কমলিনির সর্বাঙ্গে স্বর্নালংকারে ভূষিত হলেও খোপাঁয় শোভা পাচ্ছে বাগানের সদ্য প্রস্ফটিত ফুল। বের হবার আগে নিজে কে আয়নায় কয়েকবার দেখলো কমলিনি। এই সাজে সে সন্তুষ্ট নয়। বৌদির দিকে ফিরে অসন্তোষের সুরে বললো, এটা কি রকম সাজ হলো? স্মিত হেসে দীপাবলী বলে, কেন? খুব সুন্দর তো দেখাচ্ছে। কমলিনির সেকথায় মান ভাঙ্গলো না। বললো, কলকাতা থেকে আনা নীল বেনারশিটা পড়তে চেয়ে ছিলাম। তুমি এই শাড়িটা পড়তে বললে।উল্লেখ্য যে কমলিনি সকালে এবং বিকালে দুই বার সাজসজ্জা পরিবর্তন করে। মাঝে স্নানপর্ব তো আছে। দীপাবলী সহজ সুরে বললো, ঠিক আছে, তোমাকে কাল আরও সুন্দর করে সাজিয়ে দেবো। ইতোমধ্যে পায়ে আলতা পড়া হয়ে গেছে। কমলিনি দীপাবলীর সাথে বাগানে ঘুরতে বের হলো।

সকালে কমলিনির ফুল তোলার পর্বটি সংক্ষিপ্ত। বরং বিকালে সে অধিক সময় বাগানে কাটায়। সঙ্গে থাকে জমিদারবাড়ির দুই দাসী। তারা সব সময় কমলিনির রূপের প্রসংশা করে। আর সে আনন্দে পুলকিত হয়। এই সময় দীপাবলী বললো, নায়েব মশাই বলছিলেন এইবার জমিদারির আয়ে সারা বছরের খরচ চলবে না। অনাবৃষ্টির কারণে ফসল ভালো হয়নি। প্রজারা খাজনা দিতে পারছে না। কমলিনি আত্নপ্রসাদের সুখ কল্পনায় বিভোর হয়ে ছিল। এই প্রসঙ্গে কথা উঠায় সে বিরক্ত হলো। কমলিনি বললো, অনাবৃষ্টি হলে জমিদারের কি যায় আসে? নায়েব মশাই জানেন খাজনা কিভাবে আদায় করতে হয়। প্রয়োজনে লাঠিয়াল ব্যবহার করা হবে।দীপাবলী বললো, জোরের ফল সব সময় ভালো হয় না। তাছাড়া কলকাতায় স্বদেশী আন্দোলন চলছে। তার প্রভাব প্রজাদের উপর পড়তে পারে। কমলিনি কলকাতার থিয়েটারে নতুন মঞ্চস্থ হওয়া নাটক সম্পর্কে জানলেও স্বদেশী আন্দোলন সম্পর্কে তার কোনো আগ্রহ নেই। সুন্দর মুখখানা বঙ্কিম ভঙ্গী করে বললো, ওসব আন্দোলনের খবর দিয়ে আমাদের কি দরকার? মেয়েমানুষের কাজ হলো হেসেল সামলানো আর সন্তান জন্ম দেয়া। তুমি নিজের কাজটা ঠিক ভাবে করলে পারো।

দীপাবলী চার বছর আগে এই বাড়ির বধূ হয়ে আসে। এখনো তার সন্তানাদি হয় নাই। ইতোমধ্যে অন্দরমহলে রটে গেছে বউ বন্ধ্যা। দিব্যেন্দু বছরের বেশির ভাগ সময় কলকাতায় থাকে। বাঈজী বাড়ি যাওয়া ছাড়াও সেখানে তার রক্ষিতা আছে। এদের পিছনে সে জলের মতো টাকা খরচ করে। কমলিনির কথার সুক্ষ্ণ ইঙ্গিতটুকু বুঝতে দীপাবলীর অসুবিধা হলো না। তিনি নীরব হয়ে রইলেন। দীপাবলী পাশের গ্রামের সম্ভ্রান্ত হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে। শৈশবে অর্থ সম্পদের অভাব তার ছিল না। বাবা ছিলেন উদার প্রকৃতির মানুষ। তার উৎসাহে বাড়িতে কিছু লেখাপড়া তিনি শিখেছেন। দিব্যেন্দুর সাথে তার বিয়ে হয় মোটা অঙ্কের যৌতুকের বিনিময়ে। অর্থের লোভে জমিদার বাবু দিব্যেন্দুর সাথে দীপাবলীর বিয়ে দেন। দিব্যেন্দু তাকে পছন্দ বা অপছন্দ কোনোটাই করে না। তার একটা স্ত্রীর দরকার ছিল। সেটা সে পেয়েছে। ব্যাস তার প্রয়োজন মিটে গেছে। এখন আগের মতোই মদ্যপ এবং বিলাসী জীবন যাপন করে। দীপাবলী প্রথম দিকে স্বামীর আচরণের প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিলেন। পরিণামে জুটেছে দৈহিক নির্যাতন। শাশুড়ির কড়া নির্দেশে অলংকার আর সাজের আড়ালে আঘাতের কালশিটে দাগগুলো ঢাকতে হয়েছে। অত্যাচারের কথা তিনি কাউকে বলতে পারেন নাই। জমিদার বাড়ির শ্বেত পাথরের দেয়ালে দীপাবলীর কান্না প্রতিধ্বনিত হয়ে তার কাছে ফিরে এসেছে।

কেবল সৌমেন্দ্রনাথ বিষয়টা নিয়ে কথা বলেছিলেন। জমিদার বাড়ির ঐতিহ্য অনুযায়ী, বধূ নির্যাতনের কথা তিনি জানতেন। কিন্তু সৌমেন্দ্রনাথের প্রতিবাদে কোনো কাজ হয়নি। উল্টো তাকে কলঙ্কের ভয় দেখিয়ে নীরব করার চেষ্টা করা হয়েছে। সৌমেন্দ্রনাথ দেবতূল্য ব্যক্তি। এইসব মালিন্য তাকে স্পর্শ করে না। তবে স্বদেশের অন্য সব সমস্যার মতো নারী জাতির বন্দীদশা তাকে আহত করে। রাজা রামমোহন রায়ের চেষ্টায় সতীদাহ প্রথা বিরোধী আইন পাস হয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ প্রচলন এবং মেয়েদের মধ্যে লেখাপড়া প্রসারের জন্য আন্দোলন করেছেন। কিন্তু সমাজে এইসব সংস্কার আন্দোলনের প্রভাব কতোটুকু পড়েছে? এখনো বাংলার ঘরে ঘরে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে মেয়েরা নিপীড়ন, অত্যাচারের শিকার হয়ে নিঃশব্দে কাদঁছে।

এইসব বিষয় সম্পর্কে ভাবতে ভাবতে সৌমেন্দ্র জমিদার বাড়ি এসে পৌছাঁন। অপরাহ্ন পার হয়ে গেছে। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। বাইরে মৃদুমন্দ্ বাতাস বইছে। তাপমাত্রা স্নিগ্ধ। বৈঠকখানায় প্রবেশ করে দেখতে পান, নিখিল বসে আছে। সৌমেন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন, নিখিল কখন এসেছো? তোমার ছাত্রীর লেখাপড়া কেমন চলছে? নিখিল মৃদু কন্ঠে বললো, কিছুক্ষণ আগে এসেছি। তবে কমলিনির পড়ার বিষয়ে সন্তোষজনক জবাব দিতে পারছি না। শুনে সৌমেন্দ্র মৌন হয়ে রইলেন। নিখিল আর সৌমেন্দ্র উভয়ে কলকাতার হিন্দু কলেজ থেকে পাস করেছেন। নিখিল ইংরেজি সাহিত্যের তুখোর ছাত্র। ইচ্ছা করলে সে আইসিএস বা সেই ধরণের কোনো চাকরি পেতে পারতো। কিন্তু ইংরেজ সরকারের অধীনে আমলা হতে তার মন সায় দেয়নি। তাই এই অজ পাড়াগায়েঁ স্কুল শিক্ষকের চাকরি সে বেছে নিয়েছে। নিখিলের জীবনের ব্রত দেশ মাতৃকার সেবা করা। স্কুলের চাকরির অবসরে সপ্তাহে দুই দিন কমলিনি কে পড়িয়ে যায়। কাজটা সে করে সৌমেন্দ্রর অনুরোধে

প্রসঙ্গ পরিবর্তনের জন্য সৌমেন্দ্র বললেন, তোমার হাতে দেখছি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বই। নিখিল বলে, বইটির নাম পথের দাবী। ইংরেজ সরকার বইটি নিষিদ্ধ করেছেন। সৌমেন্দ্র বললেন, আমি বইটি পড়েছি। সব্যসাচীর বৈপ্লবিক চরিত্রটি অসাধারন। নিখিল একটু হেসে বলে, সব্যসাচীর ভূমিকা নিঃসন্দেহে অসাধারন। কিন্তু তিনি মধ্যবিত্ত শ্রেনীর প্রতিনিধি। তিনি যা চান , তা হলো মধ্যবিত্তের অধিক বিকাশের সুযোগ। সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি এইভাবে আসবে না। সৌমেন্দ্র বলেন, কিন্তু তুমি স্বীকার করবে , ইংরেজদের ঔপনেবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্তি এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। নিখিল বললো, কিন্তু স্বাধীনতা আসবে কোন পথে? ভিক্ষা করে স্বাধীনতা পাওয়া যায় না। তাকে অর্জন করতে হয়। কংগ্রেস স্বাধীনতার কথা বলছে। মুসলিম লীগও তাই বলছে। জিন্নাহ সাহেব বলছেন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগ হবার কথা। ধরো যদি এইভাবে আমরা স্বাধীনতা পাই তার ফলাফল কি হবে? ভারত এবং পাকিস্তান উভয়ই বুর্জোয়া রাষ্ট্রে পরিণত হবে। ক্ষুদ্র একটা শ্রেনীর হাতে অধিকাংশ সম্পদ কেন্দ্রীভুত হবে। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাগ্যে জুটবে শোষণ, বঞ্চনা আর অত্যাচার। নিখিলের কথার প্রতিবাদ করতে গিয়ে থেমে যান সৌমেন্দ্র। ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস তার জানা। বিপ্লবের ফলে সামন্তবাদ ধ্বংস হয়েছিল। এক হাজার বছরের মধ্যযুগের অবসান হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতা এক শ্রেনীর হাত থেকে আরেক শ্রেনীর হাতে চলে যায়। গিলোটিনের জায়গায় আসে প্যান অপটিক্যান। বুর্জোয়ারা হলো নতুন রাজাধিরাজ।

তাদের কথপোকথনের মধ্যে কমলিনি এসে উপস্থিত হলো। নিখিল কে দেখে প্রশ্ন করলো, মাস্টার মশাই, বেশি দেরী হয়ে গেছে বুঝি? উত্তর দিলো সৌমেন্দ্র, তোমার লেখাপড়ার প্রতি আরও মনোযোগী হওয়া উচিত। উপদেশটা কমলিনির কর্ণে প্রবেশ করলেও মনে স্থান পায় না। বৈঠকখানার পাশের ঘরে নিখিল কমলিনিকে পড়াতে বসেছে। আজ সে সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করছে। ১৮৫৭ সালে সমগ্র ভারতবর্ষে সিপাহী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এই বিদ্রোহ ছিল দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম। তবে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী সিপাহী বিদ্রোহ কে সমর্থন করে নাই। তারা ছিল সুবিধাভোগী। নিখিল বলছিল, ঝাসিঁর রানী লক্ষ্ণী বাঈয়ের কথা। নানাসাহেব, তাতিয়াটোপীর মতো তিনিও বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর তারঁ মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে ব্রিটিশ সরকার।

বিস্মিত কমলিনি প্রশ্ন করে, পাগল নাকি? ইংরেজদের বিতাড়িত করতে চায়? ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা কি আদৌ সম্ভব? নিখিল একটু হেসে বলে, পাগলরাই এমন চিন্তা ও কাজ করতে পারে। কমলিনির বিরক্ত লাগছিল। মাস্টার মশাই ব্যক্তিটি তরুন এবং সুদর্শন। অথচ তার সাথে রঙ্গ করে দুটো কথা বলা যায় না। সব সময় শুধু জ্ঞানের কথা বলেন। যদিও ব্যরিস্টার নির্মল ব্যানার্জির সাথে কমলিনির বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। তবু অবসরের ফাকেঁ নিখিলের সাথে তার ভাব জমাতে বাধা কোথায়? ঠোটেঁর কোণে মুচকি হাসি ফুটিয়ে কমলিনি প্রশ্ন করে, মাস্টার মশাই আপনার ইতিহাস বিষয়ে শুধু যুদ্ধ আর বিদ্রোহের কথা লেখা থাকে। নিখিল বলে, আর কোন বিষয়ে জানতে চাও? কমলিনি হাসিটি ধরে রেখে বললো, কেন? রাধা কৃষ্ণের প্রেম, বৃন্দাবনের রাসলীলা এইসব বিষয়ে আলোচনা নেই? নিখিল গম্ভীর ভাবে বললো, আজকের মতো পাঠ এইখানে সমাপ্ত হোক।

বাড়ি ফেরার পথে নিখিল ভাবছিল, কমলিনিকে সে আর পড়াতে যাবে না। মেয়েটার লেখাপড়ার প্রতি সত্যি কোনো আগ্রহ নেই। নিখিল ঘরে ফিরে দেখতে পায়, তার পড়ার টেবিলের উপর একটা চিঠি রাখা আছে। চিঠিটা বাবার। খাম খুলে চিঠি পড়তে পড়তে নিখিলের মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়। বাবা লিখেছেন, গ্রামে দ্রব্য সামগ্রীর দাম খুব বেড়েছে। প্রায় দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থা। নিখিলের পাঠানো টাকায় আট সদস্যের পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। সে যেন এই মাসে অতিরিক্ত কিছু টাকা পাঠায়। বাবা পেশায় ছিলেন পোস্ট মাস্টার। অবসর গ্রহণের পর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। চিঠিতে তিনি আরও লিখেছেন, তাদের মতো নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য হয়ে রাজনীতি বা বিপ্লবের জন্য কাজ করা বিলাসিতা মাত্র। চিঠিটা পড়ে নিখিল তক্তপোষের উপর কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। কেবল আত্নস্বার্থ বা আত্ন প্রতিষ্ঠার জন্য বেচে থাকতে তার মন সায় দেয় না। কিন্তু এই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের অবস্থা শোচনীয়। নিজের চিন্তায় মগ্ন থাকায় নিখিলের ঘরের দিকে চোখ পড়েনি। ঘরে এক খানা তক্তপোষ আর টেবিল চেয়ার ছাড়া কিছু নেই। টেবিলের উপর নিখিলের বইপত্র থাকে। পুরো ঘরটা গোছানো। কিন্তু টেবিলের বইগুলো বেশ এলোমেলো। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে কেউ সেখানে হাত দিয়েছে। নিখিল জগৎ বাবুর বাড়িতে জায়গীর থাকে। জগৎ বাবু পেশায় ব্যবসায়ী। পাটের ব্যবসা ছাড়াও তিনি সুদের কারবার করেন। নিখিল এই বাড়িতে থাকা খাওয়ার বিনিময়ে জগৎ বাবুর দুই ছেলেকে পড়ায়। নিখিলের দেখাশোনার ভার সুষমার উপর। জগৎবাবুর বোনের মেয়ে। পিতৃ মাতৃহীন মেয়েটি এই পরিবারে আশ্রিতা। আরও বিশদভাবে বললে বিনা পয়সার ঝি। নিখিল তাকে কখনো ভালো করে লক্ষ্য করেনি। এখন টেবিলের বিশৃংখল অবস্থা দেখে কাজটা কে করেছে দেখার জন্য নিখিল বাইরে বের হলো।

আঙ্গিনায় কারো সাথে দেখা হলো না। বাড়ির অন্দর মহলের দরজা বন্ধ। শুধু ঠাকুর ঘরে আলো জ্বলছে। নিখিল কি ভেবে ঠাকুর ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। এইবার সে স্পষ্ট দেখতে পায় ঠাকুর ঘরের দরজার সামনে সুষমা বসে আছে। হাতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের বই। বইটির নাম দেবী চৌধুরানী। সুষমা গভীর মনোনিবেশ সহকারে বইটি পড়ছে। বিস্মিত নিখিল প্রশ্ন করে, সুষমা, তুই এই বই দিয়ে কি করছিস? চমকে উঠে তাকায় সুষমা। তার সামনে মাস্টারবাবু দাড়িঁয়ে আছে। সুষমার চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ পড়ে। সে থর থর করে কেপেঁ ওঠে। কিন্তু বইটা তার হাত থেকে পড়লো না। নিজেকে সামলে সুষমা উত্তর দেয়, পড়ছি। নিখিল প্রশ্ন করে, তুই পড়তে পারিস? জবাবে সুষমা ইতিবাচক মাথা নাড়ে। বইটা হাতে নিয়ে নিখিল একটা পরিচ্ছদ বের করে সুষমাকে বলে, এই অংশটুকু পড় দেখি। সুষমা শুদ্ধ উচ্চারণে নির্ভুলভাবে পরিচ্ছদটি পড়ে শোনায়। নিখিল জিজ্ঞাসা করে, তুই কার কাছে লেখাপড়া শিখেছিস? সুষমা বললো, আমার বাবা পাঠশালার পন্ডিত ছিলেন। তিনি আমাকে লেখাপড়া শেখান। শৈশবে দুই বছর পাঠশালায় পড়েছি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের বই পড়ে তুই বুঝতে পারিস? নিখিল প্রশ্ন করে। সুষমা মাথা নেড়ে বললো, কিছু বুঝি। তবে উপন্যাসের সমাপ্তির অংশটা আমার ভালো লাগে নাই। প্রফুল্ল এতো জ্ঞান অর্জন করে তিন সতীনের সংসারে বাসন মাজার জন্য ফিরে আসলো কেন? তার তো আপোসহীন বিদ্রোহী থাকা উচিত ছিল।

বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে নিখিল সুষমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বা বেগম রোকেয়ার সংগ্রাম ব্যর্থ হতে পারে না। মেয়েরা সত্যি একদিন জেগে উঠবে। নিখিল বললো, দিদিভাই, আমার টেবিলে বেশ কিছু বই আছে। তোমার যখন মন চায় বই নিয়ে পড়তে পারো। আর কোনো বই দরকার হলে বলবে, আমি এনে দেওয়ার ব্যবস্থা করবো। নিখিল চলে গেলে তার অপসৃয়মান পথের দিকে সুষমা চেয়ে রইলো। বহুদিন তার সাথে কেউ এমন আন্তরিকভাবে কথা বলে নাই।

আজ জমিদার বাড়িতে সাজ সাজ রব। জমিদারবাবু আর তার বড় পুত্র দিব্যেন্দু দুপুরের পরে নৌকায় করে কলকাতা থেকে গ্রামে এসেছে। তাহেরের কাজের চাপ বেড়েছে। জমিদারবাবুর মুখখানা অস্বাভাবিক রকম গম্ভীর। অন্য দিনের মতো বিশ্রাম না নিয়ে বৈঠকখানায় নায়েব এবং খাজাঞ্চি রুকুনদ্দিনের সাথে সম্পত্তির হিসাব করতে বসেছেন। তাহের ভাসা ভাসাভাবে শুনেছে, ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হতে চলেছে। কলকাতায় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যাবে। দেশ স্বাধীন হবে। তবে ভারতবর্ষ ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র হিসেবে আত্নপ্রকাশ করবে। জমিদার অমরেন্দ্রনাথ চৌধুরি পরিবার সমেত কলকাতায় চলে যাবেন। যাওয়ার আগে পূর্ব বাংলায় গ্রামে যে তার সম্পত্তি আছে সেগুলো পানির দামে বিক্রি করে যাবেন। বলা বাহুল্য, এই শেষের বিষয়টি তাহেরের কাছে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ। সে এতোদিন কেচোঁ হয়ে ছিল। এখন সময় হয়েছে সাপের মতো ফণা তোলার।

দিব্যেন্দুর আসার খবর গতকাল জমিদার বাড়িতে এসে পৌছেছেঁ। তারপর থেকে দীপাবলী স্বামীর দর্শন লাভের জন্য অধীর হয়ে আছেন। রাত যেন তার কাটতে চায় না। বিগত ছয় মাস দিব্যেন্দু বাড়ি আসে নাই। দীপাবলী আজ খুব ভোরে উঠেছেন। তার তদারকে পুরো বাড়ি গোছানো হয়েছে। তারপর গেছেন রান্নাঘরে। স্বামীর জন্য আজ তিনি নিজ হাতে রান্না করেছেন। দুপুরের পর স্নান সেরে পড়েছেন নতুন পাটভাঙ্গা নীলাম্বরী শাড়ি। খোপাঁয় বেলী ফুলের মালা। তারপর নিজ কক্ষে বিছানায় বসে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছেন। প্রতীক্ষার প্রহর যেন শেষ হয় না। দিব্যেন্দু ঘরে এলো সন্ধ্যার পর। দেখেই বোঝা যায় সে নেশাগ্রস্থ। স্বামী কে দেখে দীপাবলী ত্রস্ত্য পদক্ষেপে এগিয়ে আসেন। দিব্যেন্দু তার দিকে ফিরেও তাকায় না। বিছানায় গিয়ে সটান শুয়ে পড়ে। দীপাবলী একটু ইতস্তত করে পায়ে পায়ে স্বামীর কাছে এগিয়ে যান।বিছানার পাশে বসে স্বামীর কপালে হাত রেখে বললেন, পথে খুব ধকল গেছে বুঝি? দিব্যেন্দু চোখ না খুলে বিরক্ত কণ্ঠে বললো, সরে যাও। দীপাবলী চলে গেলেন না। দিব্যেন্দুর হাতটা ধরে বললেন, আপনি আমার দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন। দিব্যেন্দু হাত টেনে সরিয়ে নিয়ে বললো, এ তো জ্বালিয়ে মারলো। বললাম না সরে যেতে। নিচে গিয়ে অম্বা কে পাঠিয়ে দাও। অম্বা জমিদার বাড়ির খাস দাসীর মেয়ে। রূপ লাবণ্যে অনন্যা। দিব্যেন্দুর সেবার কাজে নিযুক্ত। বাড়িতে থাকলে দিব্যেন্দু অম্বার সাথে রাত কাটায়। অম্বার নাম শুনে দীপাবলী স্তব্ধ হয়ে গেলেন। থমথমে কন্ঠে বললেন, অম্বা আসবে না। আমি আমার শয়ন কক্ষে স্বামীর সাথে সহবাসের জন্য অন্য নারী কে ডাকতে পারবো না। দিব্যেন্দু বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়াঁয়। বলে, তাহলে আমি যাই অম্বার কাছে। পথরোধ করলেন দীপাবলী। স্বামীর পা জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল স্বরে বললেন, আমি মিনতি করছি। আপনি যাবেন না। দিব্যেন্দুর রাগ এবার সপ্তমে চড়লো। দীপাবলী কে লাথি মেরে সরিয়ে দিয়ে বললো, বাজাঁ মেয়েমানুষ। একে স্পর্শ করতেও ঘৃনা লাগে।

আঙ্গিনার এক কোণে বসে আছে ওসমান। বাবা কে অনেক অনুরোধ করার পর সে এখানে বসার সুযোগ পেয়েছে। সন্ধ্যার পর তাদের আঙ্গিনায় সভা বসেছে। সভায় নিখিল, সৌমেন্দ্র, ওসমানের বাবা ছাড়াও আরও আট জন গ্রামবাসী উপস্থিত আছেন। এদের বেশির ভাগই বয়সে তরুণ। ওসমান সবার কথা বুঝতে পারছে না। তবু মন দিয়ে তাদের কথা শুনছে। এখন কথা বলছেন সৌমেন্দ্র। তিনি বলছেন, কলকাতায় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়েছে। শয়ে শয়ে মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। আমাদের গ্রামটা পশ্চিমবঙ্গের কাছে অবস্থিত। এখানে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়তে পারে। কথাটা ওসমানের বাবার কাছে পরিষ্কার হয় না। সে বলে, হিন্দু মুসলমানে দাঙ্গা বাধঁবে কেন? গরীবের পরিচয় তো গরীবই। তার আবার জাত ধর্ম কি? নিখিল বলে, ইউনুস ভাই, এইসব হলো ইংরেজ সরকারের কূটচাল। ইংরেজরা মুসলিম শাসকদের পরাজিত করে তাদের হাত থেকে রাজদন্ড কেড়ে নেয়। পরাজিত মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশদের প্রতি ছিল তীব্র ক্ষোভ। ইংরেজরাও মুসলমানদের বিশ্বাস করতো না। কেরানী তৈরীর অভিপ্রায়ে ইংরেজরা ভারতবর্ষে আধুনিক শিক্ষা প্রচলন করে। রাজ ভাষা হয় ইংরেজি। হিন্দুরা প্রথম এই শিক্ষা গ্রহণের জন্য এগিয়ে আসে। তাদের মধ্য থেকে হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেনী গড়ে ওঠে। বিলম্বে হলেও মুসলমানরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে শুরু করে। চাকরির ক্ষেত্রে তারা হিন্দুদের সাথে প্রতিযোগিতা আরম্ভ করে। মধ্যবিত্ত শ্রেনীর এই প্রতিযোগিতা থেকে দ্বন্ধের সূত্রপাত। যা পরবর্তী কালে হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গায় রূপ নেয়। আর এই দ্বন্ধে ইন্ধন জুগিয়েছে ইংরেজরা।

সৌমেন্দ্র বললো, দাঙ্গা প্রতিরোধে আমাদের এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে, গ্রামে যেন এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি বিনষ্ট না হয়। ওসমান অবাক হয়ে সভায় উপস্থিত বক্তাদের কথা শুনছিল। অধিকাংশ কথা সে বুঝতে পারেনি। তবে এইটুকু বুঝেছে যে , হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ আসন্ন। তাহলে তার আর অমলের মধ্যে দ্বন্ধ শুরু হবে। এটা ঠিক যে, অমলের সাথে খেলার সময় মাঝে মাঝে ঝগড়া হয়েছে। কিছুক্ষণ পর আবার ভাব হয়ে গেছে। এখন কি তারা একে অপরের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিবে? ওসমান আর ভাবতে পারে না।

তাহের পড়েছে মহা সংকটে। বিকাল বেলা হিসাবপত্র পরীক্ষা শেষ হলে জমিদার বাবু বাগান বাড়িতে এসে উঠেছেন। তিনি এখন বিশ্রামরত। বিশ্রাম নেয়ার আগে তাহের কে জানিয়ে দিয়েছেন, সন্ধ্যাবেলা বাগানবাড়িতে জলসা বসবে। তাহের যেন সব ব্যবস্থা করে রাখে। আর রাত্রি যাপনের জন্য জমিদার বাবুর নতুন নারী চাই। পেশাদার বাঈজীর প্রতি তার বিতৃষ্ণা ধরে গেছে। তাহের ভেবে পায় না এত স্বল্প সময়ের মধ্যে সে আনকোরা নতুন নারী কোথায় পাবে? অন্য সময় হলে ভাবনার কিছু ছিল না। পাইক বরন্দাজ নিয়ে কোনো কৃষক পরিবারের কুলবধূ কে উঠিয়ে আনতে পারতো। কিন্তু এখন অবস্থা ভিন্ন রকম। শুধু দাঙ্গা নয়, জমিদারের বিরুদ্ধে কৃষকদের ক্ষোভ বাড়ছে। ভেবেচিন্তে কাজ না করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। ভাবতে ভাবতে ক্ষেতের আল দিয়ে হাটঁছিল তাহের। অদূরে জগৎবাবুর বাড়ি। তাহের কিছুক্ষণ সেই বাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর সেই বাড়ি লক্ষ্য করে হাটঁতে শুরু করে। জগৎ বাবু বৈঠকখানায় ছিলেন। সেদিনের মতো তার কাজ শেষ। হিসাবপত্র গুছিয়ে তিনি অন্দরমহলে যাবার আয়োজন করছেন। এমন সময় তাহের এসে উপস্থিত হলো। কুশল বার্তা হিসেবে তাহের জিজ্ঞাসা করে, জগৎ বাবুর শরীরটা ভালো আছে? জগৎ বাবু বিনয়ে বিগলিত হয়ে বলেন, কি সৌভাগ্য। আমার বাড়িতে আপনি এসেছেন। আর শরীরের কথা বলছেন। তা ভগবান ভালো রেখেছেন। তাহের জানে অমরেন্দ্রনাথ চৌধুরীর সাথে জগৎ বাবুর সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে মামলা চলছে। উভয়ের মধ্যে দ্বন্ধ এবং রেষারেষি থাকলেও অলিখিত সাদৃশ্য আছে। জমিদার বাবু যেমন খাজনা দিতে না পারলে প্রজাদের জমি ক্রোক করে। তেমনি জগৎ বাবু সুদ সহ কৃষকদের জমি ধার দেয়। তারপর সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারলে কৃষকদের সর্বশান্ত করে। তাহের ধীরে সুস্থে অগ্রসর হয়। মুখে বলে, শুনলাম কলকাতায় হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়েছে। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হবে। পূর্ব বাংলা হবে পূর্ব পাকিস্তান। জগৎ বাবু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাহেরের দিকে তাকিয়ে থাকে। ব্যাটার মতলবখানা কি?

জগৎ বাবু মুখে বললো, ভাসা ভাসা খবর আমিও শুনেছি। আমরা ছা পোষা মানুষ। রাজনীতি বুঝি না। তাহের এইবার আসল কথায় আসে, জমিদার বাবু স্থায়ীভাবে কলকাতায় চলে যাবার কথা ভাবছেন। যাবার আগে গ্রামের সম্পত্তি পানির দামে বিক্রি করে দিয়ে যাবেন। জগৎ বাবুর চোখ দুটো লোভে চকচক করে উঠে। সে বলে, পীরগঞ্জের তালুক দুটো যদি তিনি বিক্রি করেন আমি কিনতে পারি। তাহের বলে, শুধু তালুক কেন? সমগ্র জমিদারি এখন সংকটের মুখে। আমি আপনাকে খবরটা দিলাম। আমার কথাটা মনে রাখবেন। এখন তাৎক্ষণিকভাবে আমার একটা উপকার দরকার। আপনার ভাগ্নিটি বেশ ডাগর হয়েছে। মাঠে ছাগল চড়াবার সময় ওকে কয়েকবার দেখেছি। হঠাৎ প্রসঙ্গ পরিবর্তিত হওয়ায় জগৎবাবু থতমত খেয়ে তাহেরের দিকে তাকালেন। তাহের আবার বলে, জমিদারবাবু বাগান বাড়িতে আছেন। পেশাদার বাঈজীর প্রতি তার বিতৃষ্ণা ধরে গেছে। আপনার ভাগ্নিটি কে আজ রাতে বাগান বাড়ি পাঠিয়ে দেন। কথা দিচ্ছি বাবু ওকে সোনায় মুড়ে দেবেন।

প্রস্তাবটা শুনে জগৎবাবু কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন। এটা ঠি যে, তিনি বিশ্বাস করেন, টাকা স্বর্গ, টাকা ধর্ম। আর সুষমার প্রতি তার কোনো অনুভূতি নেই। তবু একটু বাধ বাধ ঠেকছিল। কিন্তু শীঘ্রই তিনি দূর্বলতা ঝেড়ে ফেললেন। জলে বাস করে কুমীরের সাথে বিবাদ করা যায় না। তাহের কে কথা দিলেন আজ রাতে তার লোকজন সুষমা কে বাগান বাড়ি দিয়ে আসবে।

এখন মধ্য রাত। সারাদিন পরিশ্রমের পর ক্লান্ত গ্রামবাসী যার যার গৃহে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঝি ঝি ডাকা গভীর রাতের স্তব্ধতা ভঙ্গ করে হঠাৎ শোনা যায় চীৎকার আর শোরগোলের শব্দ। কারা যেনো ভয়ার্তভাবে জোরে জোরে কথা বলছে আর দৌড়েঁ পালাচ্ছে। ওসমান বাবার পাশে ঘুমিয়ে ছিল। হট্টগোলের শব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। বাড়ির সবাই আগে উঠে পড়েছে। এক দৌড়েঁ রাস্তায় বেড়িয়ে এসে শুনতে পায়, জমিদার বাড়িতে আগুন লেগেছে। জমিদার বাড়ি ওসমানদের বাড়ির অদূরে অবস্থিত। রাস্তায় নেমে সে দেখ আগুনের লেলিহান শিখা। শত শত বছরের নিপীড়িতের অভিশাপ আর হাহাকার যেনো শেষ বিচারের অগ্নি রূপে সমগ্র বাড়িটি গ্রাস করেছে। আগুন লাগার কারণ জানা গেলো এক সপ্তাহ পর। জমিদার বাড়ি থেকে যারা প্রাণে বেচে ফিরে আসতে পেরেছে, তারা গ্রামবসীদের জানায়, দীপাবলী নিজ কক্ষে গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্নহত্যা করেন। ক্রমে সেই আগুন সমগ্র বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে। দাসদাসী কর্মচারীরা প্রাণ নিয়ে পালাতে পেরেছে। দিব্যেন্দু মাতাল অবস্থায় যে কক্ষে ছিল সেখান থেকে বের হতে পারে নাই। গ্রামবাসীর সহযোগিতায় বাড়ির ধ্বংসস্তুপ থেকে দিব্যেন্দুর অর্ধ ভস্মীভুত লাশ উদ্ধার করা হয়।

এই ঘটনার পর একমাস অতিবাহিত হয়েছে। আজ ভোরে নদীর ঘাটে দাড়িঁয়ে আছে নিখিল। নৌকার জন্য অপেক্ষা করছে। তার পাশে দাড়িঁয়ে আছে ছোট্ট ওসমান। ওসমানের চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত। মাস্টার মশাই চিরকালের জন্য গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। ভারত এবং পাকিস্তান দুটো পৃথক রাষ্ট্র রূপে স্বাধীনতা লাভ করেছে। পূর্ব বাংলা এখন পূর্ব পাকিস্তান। সৌমেন্দ্র তার পরিবারের সাথে সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে কলকাতায় চলে গেছেন। সেখানে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। সৌমেন্দ্র নিখিল কে চিঠি লিখেছেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, কমিউনিস্ট পার্টি বলছে, লাখ ইনসান ভুখা হ্যায়, ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়। নিখিল এখনো তার গন্তব্য ঠিক করতে পারেনি। জমিদার বাবুর পরিবার কলকাতায় চলে গেছে। ব্যারিস্টার নির্মল পালিতের সাথে কমলিনির বিয়ে হয়েছে। গ্রাম সম্পর্কে নিখিলের কোনো সুখ স্বৃতি নেই। কেবল একটি ঘটনা সে ভুলতে পারছে না।

একমাস আগে সেই কালরাতে জগৎবাবুর লোকজন সুষমা কে জোরপূর্বক বাগানবাড়িতে রেখে আসে। সুষমা মামার পা জড়িয়ে ধরে বহু অনুনয় করেছিল। কিন্তু জগৎবাবুর মন টলেনি। রাতে বাগানবাড়িতে জলসা বসে। জমিদার অমরেনদ্রনাথ একসময় সুষমার কক্ষে প্রবেশ করেন। তিনি নেশাগ্রস্থ ছিলেন। সুষমা তাকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। লাঠিয়ালদের ভাষ্যমতে, সুষমার পিছু নিলে সে নদীর জলে ঝাপঁ দেয়। তাকে আর খুজেঁ পাওয়া যায়নি। জমিদারবাবু প্রাণে বেচে গেলেও বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন। নিখিলের ভাবতে ইচ্ছা করে সুষমা ঠিক তার পথ খুজেঁ পেয়েছে। যে পথে পূর্বে গেছেন ঝাসীঁর রানী লক্ষ্ণী বাঈ এবং প্রীতিলতা। নিখিলের নৌকা চলে এসেছে। ওসমানের মাথায় হাত দিয়ে বিদায় নেবার সময় তিনি বললেন, কাদঁছিস কেন ওসমান? মুক্তির পথ সব সময় বন্ধুর হয়। আমাদের আরেকটা যাত্রা শুরু হলো। শুধু আমরা জানি না এই যাত্রার গন্তব্য কোথায়?

পাকিস্তানের সীমান্ত- লেখক ডট মি
ছবিঃ  পাকিস্তানের সীমান্ত

পাকিস্তান যুগঃ ষাটের দশক।

চারটি মেয়ে স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরছে। ওরা প্রতিদিন দলবদ্ধভাবে স্কুলে যাওয়া আসা করে। এখন মধ্যাহ্ন। সূর্য ঠিক মাথার উপর অবস্থান করছে। এই শীতের দিনেও রোদের তাপের ফলে আবহাওয়া উষ্ণ বলে অনুভূত হচ্ছে। দলের সামনের তিনটি মেয়ের নাম যথাক্রমে তাপু, ফাতেমা আর তাহেরা। ওদের বয়স দশ থেকে বার বছরের মধ্যে। আমেনা একটু পিছিয়ে পড়লেও সবার সাথে জোর কদমে হাটাঁর চেষ্টা করছে। আর কান খাড়া করে অন্যদের কথা শুনছে। একমাস আগে তারা পাচঁ জন দল বেধেঁ স্কুলে যেতো। দুই সপ্তাহ আগে আনু বুর বিয়ে হয়ে গেছে। দলের বড় তিনটি মেয়ে সেই বিষয়ে কথা বলছে। ফাতেমা বলে, আমরা প্রথমে বুঝতে পারি নাই। বিকালে মাঠে সবাই বউচি খেলছি। আনু দম বন্ধ করে দৌড়াঁচ্ছে। এমন সময় ওর বড় ভাই এসে হাজির। বলে সন্ধ্যাবেলা ওকে দেখতে আসবে। তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে। আনু কিছুতে যাবে না। শেষে আকরাম ভাই ওর পিঠে দুটো কিল মেরে টানতে টানতে নিয়ে গেলো

তাপু আনুদের পাশের বাড়ি থাকে। সে বলে, চাচী আমাকে ঘরে ঢুকতে দেয় নাই। জানালা দিয়ে লুকিয়ে দেখি পাত্রপক্ষ বসে আছে। মিষ্টি খাচ্ছে। পড়ে শুনেছি ইয়া বড় গোফঁআলা লোকটি নাকি বর। বয়স ঠিক অমল কাকার মতো হবে। একটু পড়ে চাচী আর ফুফু মিলে আনু কে পাত্রপক্ষের সামনে এনে হাজির করে। আনুর পরনের শাড়িটি এতো বড় যে তাকে একটা কাপড়ের স্তুপের মতো লাগছিল। সেই অবস্থায় পাত্রপক্ষ তাকে পরখ করা শুরু করে। ফাতেমা কৌতুহলভরে জিজ্ঞাসা করে , ওরা কি প্রশ্ন করছিল? ফাতেমা বলে, প্রথমে তো দেখে গায়ের রং, চুলের দৈর্ঘ, হাত পায়ের গড়ন। তারপর শুরু করে প্রশ্নবান, তরকারি রান্না করতে জানো? দুধ কতোক্ষণ ধরে জ্বাল দিতে হয়? আনুর প্রায় কান্না এসে গিয়েছিল।

তাহেরা একটু ভয়ে ভয়ে বলে, বিয়ের জন্য এতো কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়? ফাতেমা বলে, মেয়ে হয়ে জন্মেছি। সংসার তো করতে হবে। এটা আমাদের ভাগ্যলিপি। আমেনা এতোক্ষণ সবার কথা শুনছিল। এবার সে বলে, মুকুল আপা তো কলেজে পড়ে। চাচাজান বলেন তার মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। সবাই আমেনার দিকে ঘুরে তাকায়। কেউ কোনো উত্তর দেয় না।

আমেনা বাড়ি ফিরে দেখে মা চুলায় দুপুরের রান্না চড়িয়ে দিয়েছে। তার কোলে সেলিম। আমেনাদের চার ভাই বোনের মধ্যে সেলিম সবার ছোট। মায়ের কোলে ট্যাঁ ট্যাঁ করে কাদঁছে। মা আমেনা কে দেখে বলে, নবাবের বেটির এখন বাড়ি আসা হলো। ইস্কুলে খাওয়ার ছুটি দেয়। তখন কইছি ছাগল দুইটা মাঠে বান্ধে আসতে। আইজ বাড়ি আসিসনি কেন? আমেনার ক্ষুধায় পেট জ্বলছে। সেই কোন সকালে দুটো পান্তা ভাত খেয়ে স্কুলে গেছে। টিফিনের সময় ফাতেমা আর তাপুর সাথে খেলা করেছে। বাড়ি আসতে মন চায়নি। তবে মা কে সেইসব কথা বললো না। আমেনা জিজ্ঞাসা করে, দাদা কোথায়? মা উত্তর দেয়, হে খেতে গেছে। তোর বাপের সাথে কাজ করতে। রহিমের বয়স বারো বছর। ওসমানের দ্বিতীয় সন্তান। বাবা মাঠে কাজ করতে গেলে এতোদিন রহিম খাবার নিয়ে গেছে। রহিম খেতের কাজে লেগে যাবার অর্থ আমেনা আর স্কুলে যেতে পারবে না। মাঠে বাবা আর ভাইয়ের জন্য খাবার নিয়ে যেতে হবে। আমেনার মুখটা মলিন হয়ে যায়। মা রান্না করছিল। তাই সেদিকে লক্ষ্য করলো না। মা বললো, হাত মুখ ধুয়ে বাবুরে কোলে নে। আমেনা বাধ্য মেয়ের মতো কলতলায় চলে গেলো।

বারান্দায় বসে কাথাঁ সেলাই করছে কারিমা। আমেনার বড় বোন। বয়স প্রায় ষোল বছর। বছর দুয়েক ধরে সে অজ্ঞাত রোগে ভুগছে। সারাক্ষণ খুক খুক করে কাসে। আর প্রায় বিছানায় পড়ে থাকে। চিকিৎসা বলতে যা হয়েছে, তা হলো পানি পড়া আর ঝাড়ফুক। ডাক্তার দেখাবার সামর্থ্য ওসমানের নেই। অসুস্থ হলেও কারিমার সেলাইয়ের হাতটা চমৎকার। শরীরটা একটু ভালো লাগলে কাথাঁ সেলাই করে। মাঝে মাঝে খেজুরের পাতা দিয়ে মাদুর বোনে। ওসমান সেগুলো বাজারে বিক্রি করে আসে। কারিমার হাতের কাথাঁটা শেষের পথে। আমেনা কে দেখে বলে, বিকালের মধ্যে কাজটা শেষ হয়ে যাবে। মুকুল আপার বাড়ি দিয়ে আসিস।

দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়। আমেনা মুকুলদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সঙ্গে নিয়েছে কাথাঁ আর চারটে পেয়ারা। গতকাল স্কুল থেকে আসার পথে গাছ থেকে পেড়ে এনেছে। মুকুল আপা পেয়ারা পছন্দ করে। বাড়ি পৌছেঁ দেখতে পায় বারান্দায় ফয়জুল স্যার আর অমল কাকা বসে গল্প করছে। ফয়জুল রহমান মুকুলের বাবা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমেনাদের অঙ্ক স্যার। আমেনা উঠানে প্রবেশ করে শুনতে পায় অমল কাকা বলছে, সাতচল্লিশ সালে দেশভাগের পর গ্রামের অধিকাংশ হিন্দু পরিবার ভারতে চলে গেলো। জমিদার অমরেন্দ্রনাথ চৌধুরীও চলে গেলেন কলকাতা। আমরা কয়েক পরিবার হিন্দু গ্রামে রয়েছি। কিন্তু অভাব অনটনের জন্য টিকে থাকা দুস্কর। অমল কাকা পেশায় কুমোর। তবে মাঝে মাঝে তিনি অন্যের খেতে বর্গাচাষ করেন। ফয়জুল স্যার বললেন, শুধু হিন্দু নয়। মুসলমান কৃষকদের অবস্থাও শোচনীয়। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা রদ করে সরকার। কৃষকরা জমি কিনে সেই জমির মালিক হতে পারে। কিন্তু কতো জন কৃষকের সেই সামর্থ্য আছে? ভূমিহীনের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। আগে খাজনা দিতে হতো জমিদার কে। এখন রাষ্ট্র জমিদারে পরিণত হয়ে খাজনা আদায় করছে। ওদিকে জোতদাররা ধনী এবং শক্তিধর হয়ে উঠেছে।

কথাবার্তার এই পর্যায়ে ফয়জুল স্যার দেখলেন আমেনা দাড়িঁয়ে আছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কিরে আমেনা? কখন এসেছিস? আমেনা বলে, মুকুল আপার সাথে দেখা করবো। ফয়জুল স্যার বললেন, বাড়ির ভিতরে যা। আমেনা, তুই কিন্তু কয়েকদিন ধরে ক্লাসে অনুপস্থিত থাকিস। সামনে বার্ষিক পরীক্ষা। এইবারও তোর ফার্স্ট হওয়া চাই। আমেনা মাথা নিচু করে থাকে। কোনো উত্তর দেয় না। মুকুলের ঘরটা একদম সাদাসিধে তবে গোছানো। একটা খাট, টেবিল চেয়ার আর ছোট একটা বুক সেলফ। বুক সেলফ ভরা বই। আমেনা কে দেখে কাছে এনে বসায়। বলে, কাথাঁ এনেছিস? কারিমার শরীরটা ভালো আছে? আমেনা বললো, বড়বুর এখন হাটাঁচলা করতেও অসুবিধা হয়। মুকুল বললো, ওকে শহরে নিয়ে গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখানো দরকার। আমেনা নীরব হয়ে রইলো। মুকুল নীরবতার অর্থ বুঝতে পারে। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলে, গতকাল কামালদা আমার জন্য বেগম রোকেয়ার লেখা একটা বই এনেছে। মহিয়সি নারী। বাঙ্গালি মুসলমান মেয়েদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের অগ্রদূত। কৌতুহলি হয়ে আমেনা প্রশ্ন করে, উনি নিজে এই বই লিখেছেন? মুকুল উত্তর দেয়, হ্যাঁ। বেগম রোকেয়া নিজের চেষ্টায় লেখাপড়া শিখেছেন। প্রথমে তারঁ বড় ভাই এবং বিয়ের পর স্বামী তাকে লেখাপড়া শিখতে সাহায্য করেন। বেগম রোকেয়ার মতে, শিক্ষা মেয়েদের জন্য অত্যাবশক। লেখাপড়া শিখে মেয়েরা কাজ করবে। তাদের চিত্তের প্রসার ঘটবে। এই ব্রত পালনের জন্য তিনি জীবনোৎসর্গ করেছিলেন। বিস্মিত আমেনা মুকুল আপা কে দেখছিল। জ্ঞানের জন্য বা মানব কল্যাণার্থে কেউ জীবন দান করতে পারে, এমন কথা সে প্রথম শুনলো।

সন্ধ্যার আগে আমেনা ঘরে ফিরে যায়। যাওয়ার আগে মুকুল একটু ইতস্তত করে বলেছে কাল সকালে কিছু বকুল ফুল দিয়ে যাস। আমেনা তাকিয়ে দেখে, মুকুলের চোখ দুটো যেনো হাসছে। আমেনা জানেনা আগামী কাল আলমের গ্রামে আসার কথা। আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। হলে থাকে। আলমের বাবার নাম ইসমত আলী। তিনি পাট ব্যবসার সাথে যুক্ত। ১৯৫০ সালে কোরীয়া যুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ফলে পূর্ব বাংলার পাট চাষীদের হাতে বেশ অর্থ জমা হয়। বৈষয়িক অবস্থার উন্নতির ফলে তারা সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। কামাল এবং আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রী অর্জন করেছে। আলম এখন মাস্টার্স করছে। কামাল গ্রামে ফিরে এসেছে।

পরদিন বিকালে দুই বন্ধুর দেখা হয়। আলম বলে, তোমাকে বেশ সতেজ দেখাচ্ছে। গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর আপনজনের সান্নিধ্য নিশ্চয় উপভোগ করছো। কামাল মৃদু হেসে বলে, শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায় লিখেছিলেন, যারা দূর থেকে রেলগাড়ির জানালা দিয়ে গ্রাম দেখে, তাদের ধারনা এইরকম হয়কথাটা শুনে আলম গম্ভীর হয়ে যায়। সে বলে, শুধু গ্রাম নয়, ঢাকা শহরেও পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে উঠেছে। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে আন্দোলন হলো। মানুষ ক্রমে জেগে উঠছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র শুধু ভৌগোলিকভাবে অসামঞ্জস্যপূর্ণ তাই নয়, পূর্ব পাকিস্তানের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের রয়েছে সাংস্কৃতিক ব্যবধান। পূর্বে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষনা দিয়েছিলেন উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এইসব ঘটনা পূর্ব বাংলায় জনরোষের জন্ম দিয়েছে। কামাল বললো, কোনো দেশের উৎপাদন পদ্ধতির যদি পরিবর্তন না হয় তবে সেই সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুক্তি আসতে পারে না। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্বের কথা বলেছেন। সেই সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ভাষণের সময় বলেছেন, ছাত্রদের উচিত নিজের ভাগ্য উন্নয়নে সচেষ্ট হওয়া। এই রাষ্ট্র পুজিঁবাদী। আর পুজিঁ মুনাফা ছাড়া কিছু চেনে না। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ বা ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ সামাজিক বৈষম্য নিরসন করতে পারবে না। আলম বললো, কিন্তু তুমি এই বিষয়টা তো স্বীকার করবে, পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান কে শোষণ করছে। কামাল বললো, ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ। সমাজ বিকাশের একটা পর্যায়ে জাতীয়তাবাদের জন্ম। শিল্পবিপ্লবের পর জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটেছে। যতোদিন ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা থাকবে ততোদিন জনগণের মনে জাতীয়তাবোধের অস্থিত্ব থাকবে। আর জাতি কোনো অবিভাজ্য সত্ত্বা নয়। জাতির মধ্যে বুর্জোয়া শ্রেণী, মধ্যবিত্ত , প্রলেতারিয়েত প্রভৃতি শ্রেণী থাকে। জাতীয়তাবাদ যতোক্ষণ ঔপনেবেশিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে ততোক্ষণ এর ভূমিকা প্রগতিশীল। আলম মাথা নেড়ে বলে, তোমার কথা শুনলাম। কিন্তু আমি মনে করি পুর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা উচিত। কামাল বললো, সংগ্রাম আমাদের অবশ্যই করা উচিত। কিন্তু সংগ্রামের লক্ষ্য হবে আর্থিক মুক্তি। তা না হলে বর্তমানে বাইশটি পরিবার পাকিস্তানের অধিকাংশ সম্পদ কুক্ষিগত করে আমাদের শোষণ করছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ছত্রিশ পরিবারের উদ্ভব হবে। তারা আমাদের শোষণ করবে। সেদিনের মতো তাদের আলোচনা অমীমাংসিতভাবে শেষ হয়।

মুকুলের দুটো দিন আলমের জন্য প্রতীক্ষায় কেটেছে। কামালের সাথে আলোচনার পর আলম আর তাদের বাড়ি আসে নাই। মুকুলের কাছে প্রতীক্ষার প্রহরগুলো দীর্ঘ মনে হয়। ঢাকায় ফিরে যাবার দিন আলম দেখা করতে আসে। রাতের ট্রেনে সে ঢাকায় ফিরে যাবে। মুকুলের অভিমান উদ্বেগ নিমেষে উধাও হয়ে যায়। খুশি ভরা কণ্ঠে বলে, আমাদের কথা মনে পড়লো? দাদার সাথে বুঝি মতবিরোধ হয়েছে? আলম কিছুটা নিস্পৃহ এবং ক্লান্ত। ম্লান কন্ঠে বলে, আমার মনে হয় আমাদের মত এবং পথ উভয় পৃথক হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ দুইজন চুপ করে থাকে। তারপর আলম ধীরে ধীরে বলে, তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। মুকুল আলমের দিকে চোখ তুলে তাকায়। অপেক্ষা করে কথা শোনার জন্য। আলম বলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার দিনার সাথে পরিচয় হয়। প্রথমে আমরা সহপাঠি ছিলাম। এখন মনে হয় আমাদের সম্পর্কটা ভিন্ন রূপ নিয়েছে। বাড়িতে বাবা মা কে বলেছি। আমাদের বিয়ের ব্যাপারে তাদের কোনো আপত্তি নেই। কথা বলার সময় আলম লক্ষ্য করেনি যে মুকুলের মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। আলমের কথা বলা শেষ হলে মুকুল বলে, প্রতিটা মানুষের জীবনসঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতা আছে। তোমার যদি দিনা কে ভালো লাগে তবে তাকে বিয়ে করতে পারো। মুকুলের কন্ঠ সংযত। কোনো ক্ষোভ বা আক্রোশ নেই। আলম ইতস্তত করে বলে, আমি তোমাকে প্রত্যাখান করতে চাইনি। বাধাঁ দিয়ে মুকুল বলে, তুমি তোমার জীবনের সিধান্ত নিয়েছো। এটা দোষের কিছু নয়। সন্ধ্যার আগে আলম চলে গেছে। মুকুল পড়ার টেবিলে বসে আছে। কিছুতে ইতিহাস বইয়ে মনযোগ দিতে পারছে না। একসময় চোখে পড়ে টেবিলের কোণে রাখা বেলী ফুলের মালার দিকে। ভোরের ফুল সন্ধ্যায় বিবর্ণ হয়ে গেছে। মুকুল হাত বাড়িয়ে মালাটি স্পর্শ করে। এতোক্ষণে তার সংযম ভেঙ্গে যায়। বালিশে মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে কাদঁতে থাকে।

খেতের কাজ সেরে ওসমান বাড়ি ফিরেছে। রহিম তার সাথে সাথে হাটঁছে। রহিমের মুখটা গম্ভীর । সারাদিন কাজের পর সে জীবনের আরেকটা দিক দেখেছে। সেটা হলো হাড়ভাঙ্গা খাটুনির জীবন। রাতে বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে সবাই খেতে বসেছে। মা খাবার পরিবেশন করছে। সবার খাওয়া শেষ হলে মা আর কারিমা খেতে বসবে। রহিম বেশ ক্ষুধার্ত। সে গোগ্রাসে খাচ্ছে। ওসমান কিছুটা অন্যমনস্কভাবে ভাত মাখে। একসময় সে আমেনা কে উদ্দেশ্য করে বলে, আম্মা, কাল থেকে আর স্কুলে যাবার দরকার নাই। বাড়িতে মায়ের সাথে সংসারের কাজকর্ম করবা। আমেনা শুনে নীরব হয়ে থাকে। তাদের মতো অভাবের সংসারে লেখাপড়া করা একটা বিলাসিতা ছাড়া কিছু না। রাতে সবার খাওয়া শেষ হলে মা আর কারিমা খেতে বসেছে। খাওয়ার সময় মা নীরব থাকে। কারিমা সারাদিন ঘরের কোণে পড়ে থাকে। মানুষের সান্নিধ্য থেকে সে বঞ্চিত। রাতে এই সময়টায় তার খুব ইচ্ছা করে দুটো কথা বলতে। কারিমা মা কে জিজ্ঞাসা করে, আমেনা আর স্কুলে যাবে না? মা নিশ্চুপ। কারিমা আবার বলে, ওর মাথাডা ভালো। লেখাপড়া করবার পারতো। মা উত্তর দেয় না। কারিমা আবার বলে, জানো মা, মুকুল আপা আমার সেলাইয়ের প্রসংশা করছে। মা খাওয়া শেষ করে উঠে যায়। যাবার আগে বলে, তুই তো তাড়াতাড়ি খাইতেও পারস না। অহন বাসন মাজার জন্যি আমার বসে থাকতি হবে।

এই ধরণের কথাবার্তা শুনে কারিমা অভ্যস্ত। সে কখনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে না। আজ কি হলো কে জানে। তার বুকের ভেতরটা অভিমানে ভরে গেলো। সে তো একটা মানুষ। পাড়া প্রতিবেশীরা মা কে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে আইবুড়ো মেয়ে। বসায় পড়ে খাইতে দিতে হয়। অথচ কারিমা তো পরনির্ভরশীল হতে চায়নি। এই অসুখের মধ্যেও সে কাজ করার চেষ্টা করেছে। খাওয়া শেষ করে কারিমা আজ আর মা কে ডাক দেয় না। এটোঁ বাসনপত্র গুছিয়ে সেগুলো তুলে নিয়ে ধোয়ার জন্য পুকুর ঘাটের দিকে রওনা দেয়। কিন্তু একটু হেটেঁ যেতেই তার পা টলমল করতে শুরু করে। দাতেঁ দাতঁ চেপে কারিমা আরেকটু অগ্রসর হয়। এইবার তার সারা শরীর কাপতেঁ থাকে। প্রাণপণ চেষ্টা করেও নিজের ভারসাম্য রাখতে পারে না। বাসনপত্র নিয়ে আঙ্গিনায় আছাড় খেয়ে পড়ে। শব্দ শুনে মা ছুটে আসে। আঙ্গিনার দিকে তাকিয়ে বিষয়টা বুঝতে তার বাকি থাকে না। এতোক্ষণে মায়ের সব সংযম ভেঙ্গে যায়। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চীৎকার করে বলে, করেছিস কি তুই লেংড়ী? বসে পড়ে খায়ে তোর সাধ মেটে না। এখন আমার বাসন মাজতে হবে। তোকেও ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে। শব্দ শুনে বাড়ির সবাই জেগে উঠেছে। ঘরের বাইরে বের হয়ে এসে তারা তাকিয়ে রইলো। কেউ কোনো কথা বললো না।

এই দৃশ্যপট শেষ হলো মধ্যরাতে। সারাদিনের কঠোর পরিশ্রমের পর বাড়ির প্রতিটা সদস্য গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কারিমা ঘুমায়নি। সন্ধ্যার ঘটনার পর তার চোখ দিয়ে এক ফোটা জল পড়ে নাই। সে জীবনের সহজ হিসাবটা বুঝে গেছে। সংসারে তাকে প্রয়োজন যার মাধ্যমে স্বার্থদ্ধোর হয়। মানুষ শুধু তাকে ভালোবাসে। পৃথিবীতে তার বেচে থাকা বা না থাকা সমান কথা। কারিমা নিস্পৃহভাবে মায়ের ঘুমিয়ে পড়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে নিশব্দে বাড়ির বাইরে বের হয়ে যায়।

রাতের শেষে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। বাইরে এখন পরিষ্কার সব দেখা যায়। মায়ের ঘুম ভাঙ্গলো ওসমানের আর্তচীৎকারে। বাবা কাদঁতে কাদঁতে বলছে, আম্মা গো, তুমি এইটা কি করলা? ধরমর করে মা উঠে বসে। তারপর শব্দ লক্ষ্য করে বাড়ির অদূরে আমগাছের দিকে এগিয়ে যায়। মাটি থেকে বেশ কিছু উপরে একটা মোটা ডাল থেকে দড়িঁ ঝুলছে। কারিমা সেই দড়িঁতে গলায় ফাসঁ দিয়েছে। নিজের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে আত্নহত্যা করে তার পরিবারকে অন্তত একজন মানুষের খাওয়াবার হাত থেকে মুক্তি দিয়ে গেছে। থর থর করে কেপেঁ ওঠে মা। এ সেই জননী যে সন্তানকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়ে কাদেঁ।

পাকিস্তান রাষ্ট্র বিকশিত হয়েছিল পুজিঁবাদী ধারায়। ওপরতলার কিছু আমলা এবং ব্যবসায়ী যাদের অধিকাংশ ছিল অবাঙ্গালি তারা সব সুবিধা ভোগ করতো। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুক্তি আসেনি। ১৯৪৬ সালে সাধারণ মানুষের ভোটের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই পূর্ববঙ্গের মানুষ ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ভোট দেয়। কারণ ছিল অর্থনৈতি শোষণ। শুরুতে মানুষ স্বায়ত্বশাসনের জন্য আন্দোলন করে। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফার ঘোষণা দেন। এর পূর্বে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের কথা তুলে ধরে। পরিস্থিতি অগ্রসর হচ্ছিলো স্বাধীনতার দিকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়। পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্র পুজিঁবাদী শিবির এবং সমাজতান্ত্রিক শিবিরে ভাগ হয়ে যায়। ইতোমধ্যে স্তালিনের মৃত্যু হয়েছে। ১৯৫৬ সালে ক্রশ্চেভের উত্থান ঘটে। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি সংশোধনবাদ গ্রহণ করে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের এইসব ঘটনার প্রভাব পড়ে ভারত এবং পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির উপর। কমিউনিস্ট পার্টি মস্কো পন্থী এবং পিকিং পন্থী এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়।

রেললাইনের পাশে অবস্থিত বস্তির একটা ছোট খুপরি ঘরে জানালার সামনে দাড়িঁয়ে আছে কামাল। তার চোখের দৃষ্টি অন্যমনস্ক। সে বর্তমান কালের রাজনীতির কথা ভাবছে। পুজিঁবাদী ব্যবস্থা বিকাশের ইতিহাস তার জানা। ত্রয়োদশ শতকে ইতালিতে সংঘটিত রেনেসাঁস আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব পর্যন্ত যুদ্ধ, উপনিবেশ স্থাপন, বিপ্লব , সংস্কার প্রভৃতি বহু ঘটনার মধ্য দিয়ে পুজিঁবাদী ব্যবস্থা বিকশিত হয়েছে। তেমনি সমাজতন্ত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে , এই ধারণায় কামাল বিশ্বাস করে না। কিন্তু বিপ্লব সংঘটনের জন্য তার আশু কর্তব্য তো নির্ধারন করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে সে কি ভুমিকা পালন করবে? কামাল নারায়ণগঞ্জে এসেছে কয়েক মাস আগে। পাটকলে শ্রমিক হিসেবে কাজ নিয়েছে। এখানে সে এসেছে পার্টির নির্দেশে। কয়েক জন ব্যক্তি ছাড়া কামালের পরিচয় বা উদ্দেশ্য কেউ জানে না। দরজায় মৃদু শব্দ হলো। কামাল দরজা খুলে দেখে শামসু দাড়িঁয়ে আছে। শামসু কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী। সেও পাটকলে কাজ করে। শামসু বলে, তোমাকে একটা খবর জানাতে এলাম। কাল ধর্মঘট। মিলের শ্রমিকরা হরতাল ডেকেছে। শুনে কামাল কিছুক্ষণ নীরব হয়ে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে বলে, শামসু ভাই , আপনি কি মনে করেন আওয়ামী লীগের সাথে মিলিতভাবে সংগ্রাম করে শ্রমিক শ্রেণী তাদের লক্ষ্যে পৌছঁতে পারবে? আওয়ামী লীগের রাজনীতি কিন্তু জাতীয়তাবাদী ধারার অর্ন্তভুক্ত। শামসু বললো, তোমার সাথে আমি একমত। কিন্তু আমাদের পরিস্থিতি অনুযায়ী সিধান্ত নিতে হবে। ১৯৬৬ সাল থেকে আওয়ামী লীগ ছয় দফা বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করছে। সেই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিক এবং কৃষকরা সচেতন হয়ে উঠেছে। কামাল কে নীরব দেখে শামসু আবার প্রশ্ন করে, কাল মিছিলে তুমি যোগ দেবে? কামাল শান্তভাবে জবাব দেয় আমার সিধান্ত কাল সকালে পেয়ে যাবেন।

পরের দিন হরতালের সময় পুলিশ মিছিলে গুলি বর্ষণ করে। গুলিতে কয়েক জন শ্রমিক নিহত হন। শ্রমিক নেতা শামসু কে পুলিশ আহত অবস্থায় গ্রেফতার করে। পুলিশের গাড়িতে ওঠার সময় শামসু দেখতে পায়, অদূরে তিনটি লাশ পড়ে আছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শামসু। তার হাটুঁ জোড়া একবার কেপেঁ ওঠে। না তার কোনো ভুল হয়নি। তিনটি লাশের মধ্যে একটি মরদেহ কামালের।

এখন মধ্যরাত। মুকুল টেবিলে বসে হারিকানের আলোয় পরীক্ষার খাতা দেখছে। সে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পেয়েছে। চার মাস আগে কামালের মৃত্যু সংবাদ তারা পায়। এই শোক বাবার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হয় নাই। তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন। মুকুল বাবার দেখাশোনা করে। খাতা দেখা শেষ করে মুকুল জানালার কাছে এসে দাড়াঁয়। আজ জোৎস্না রাত। বাইরে চাদেঁর আলোর বন্যা বইছে। মুকুলের মনে হয়, মানুষের জীবনের মালিন্য প্রকৃতি কে স্পর্শ করে না। আলম আর দিনার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ওরা অনাগত জীবনের সুখচিন্তায় বিভোর। দেশের অবস্থা ক্রমে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। বাঙ্গালি ভাষা আন্দোলনের পরে স্বায়ত্ব শাসনের কথা বলেছিল। এখন বলছে স্বাধীনতার কথা। পূর্ব বাংলা যদি স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু করে তবে পশ্চিম পাকিস্তান নিশ্চিত ভাবে শক্তি প্রয়োগ করবে। মুকুলের সাথে শেষ দেখার সময় আলম বলেছিল, দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য সে সংগ্রামে অংশ নিতে প্রস্তুত। এই সংগ্রাম কি ওসমান বা অমলদের অন্ন বস্ত্রের নিশ্চয়তা দেবে? আর্থিক মুক্তি আসবে? প্রশ্নগুলো মুকুলের মনে বার বার ফিরে আসে। সে সিধান্ত নেয় এড়িয়ে না গিয়ে সমগ্র জীবনব্যপী প্রশ্নগুলোর উত্তর খোজাঁর চেষ্টা করবে।

বাংলাদেশের গ্রামের জলাশয়, গাছপালা, প্রকৃতি, উপন্যাসঃ ত্রিকালদর্শী- লেখক ডট মি
ছবিঃ  বাংলাদেশের গ্রামের জলাশয়ের দৃশ্য

বাংলাদেশ যুগঃ একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকঃ

রকিবের মতো অন্য যে সব তরুণের জন্ম একুশ শতকের সূচনাকালে তারা কখনো প্রত্যক্ষ করতে পারে নাই যে, সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আত্নত্যাগ করেছে। বিশ শতকের নব্বই দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায়। স্নায়ুযুদ্ধের দ্বন্ধে জয়ী হয় যুক্তরাষ্ট্র। একুশ শতকের পৃথিবী একমেরু কেন্দ্রীক। যুক্তরাষ্ট্র এখানে একা মোড়ল। সময়টা বিশ্বায়নের। বিলম্বিত এই পুজিঁবাদ কে অনেকে বলছেন, লোভের যুগ। মানুষ এখন শুধু নিজের কথা ভাবে। ন্যায়নীতি , মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে শুধু বড় হতে চায়। রাতে পড়ার টেবিলে বসে রকিব এইসব কথা ভাবছিল। তার সামনে মিশেল ফুকোর অপরাধ এবং শাস্তি বইটি রয়েছেফুকো বলেছিলেন, মানুষকে চিরকাল পরাজিত করা যায় না। নিপীড়নের স্বীকার হয়ে মানুষ কোনো না কোনো সময় বিদ্রোহ করে।

বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জন করে। দুইজন রাষ্ট্রপ্রধান কে হত্যা, দুইবার সামরিক শাসন, নব্বই দশকের অভ্যুত্থানের পর গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। ঘুরে ফিরে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্টিত হয়। এই দুইটি দলের মধ্যে পার্থক্য যাই থাকুক, উভয় দলই মুক্তবাজার অর্থনৈতিক দর্শনে বিশ্বাস করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। কিন্তু সমগ্র দেশের জনগণ কি এই উন্নয়ণের সুফলভোগী?

রকিব গ্রামে আসার পর চারদিন পার হয়ে গেছে। প্রথম তিন দিন ছিল একই রকম অনারম্বর। তবে আজকের দিনটিকে বলা যায় নিস্তরঙ্গ গ্রামের জীবনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এদোঁ ডোবায় ঢিল ছুড়লে যেমন কিছু ঢেউ খেলে যায়। ঘটনাটা হলো তাদের পাড়ার মেয়ে তিথি আত্নহত্যা করেছে। পুলিশ এসে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ নিয়ে গেছে। তিথির জীবনের গল্প সংক্ষিপ্ত। লোকমান মিঞার পাচঁ সন্তানের মধ্যে তিথি সবার বড়। লোকমান মিঞা স্থানীয় পৌরসভার অফিস সহকারীর পদে চাকরি করতেন। দুই বছর আগে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তখন সংসারের ব্যয়ভার এসে পড়ে তিথির উপর। তিথি নিজের চেষ্টায় বিকম পাস করে। গ্রামের এনজিওতে হিসাব রক্ষকের চাকরি পায়। বাবা যতোদিন কর্মরত ছিলেন, ততোদিন টানাপোড়নের মধ্যেও তাদের জীবন স্বাভাবিক ছিল। মা তিথির বিয়ের জন্য বিভিন্ন জায়গায় পাত্রের খোজঁ করতেন। কিন্তু তিথির গায়েরঁ রঙ কালো এবং সে বেশ স্থুলকায় হওয়ায় যৌতুকের অঙ্ক ছিল উচ্চ। তারপর পরিস্থিতি পরিবর্তন হলে, তিথির পরিবার তার বিয়ে দিতে অনীহ হয়ে পড়ে। মা ভেবেছিলেন, তার আরও চারটে সন্তান আছে। তাদের পড়ার খরচ, ভবিষ্যৎ, মা বাবার চিকিৎসার ব্যয় প্রভৃতির জন্য যদি তিনি একটি সন্তানকে কোরবানী দেন তবে আল্লাহ নিশ্চয় তার অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন । আসছে বসন্তে তিথির বয়স তেত্রিশ হবে। ঘটনাটা কিভাবে ঘটেছিল কেউ জানে না। তবে তিথি ঠিকই বুঝেছিল যে সে সন্তানসম্ভাবা। অবিবাহিতা মেয়ের কলঙ্কের দায় থেকে মুক্তির জন্য সে গলায় ফাসঁ দিয়ে আত্নহত্যা করে।

বলাবাহুল্য গ্রামবাসীর মধ্যে এই ঘটনা নিয়ে মুখরোচক আলোচনা চলছে। রকিব ঘর থেকে বের হয়ে দেখতে পায়, ওসমান মৃধা কোরআন পাঠ শেষ করে দোআ পড়ছেন। তার চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত। রকিব তাকে না ডেকে কিছুক্ষণ চুপ করে দাড়িঁয়ে থাকে। এক সময় নানা হাত তুলে মোনাজাতের ভঙ্গীতে বলেন, হে খোদা মেয়েটাকে শান্তি দিও। রকিবের মনে পড়ে , মা একদিন বলেছিলেন, তার বড় বোন কারিমা আত্নহত্যা করেছিল। বিকাল বেলা নদীর তীরে বসে সুমিত্রার সাথে রকিব কথা বলছে। রকিব বলে, কোনো দেশ কতোখানি অসভ্য সেই বিষয়টি নারী নির্যাতনের ধরণ দেখে বোঝা যায়। যুগ যুগ ধরে ঘটনাগুলোর রূপ বদলায়। কিন্তু নিপীড়ন অব্যাহত থাকে। সুমিত্রা নির্বিকার ভাবে উত্তর দেয়, এগুলো নিত্য নৈমন্তিক ঘটনা। নুসরাত, তনু বা ইয়াসমিনের মতো মারাত্নক ঘটনা না হলে লোকে পত্রিকায় সেই খবর পড়ে না। রকিব বলে, ভয়াবহতার মাত্রার কথা জানি না। কিন্তু মানুষ কে তো প্রতিবাদ করতে হবে। আজ তিথির প্রতি নিপীড়ন হয়েছে। কাল আমি নিজে খুন হতে পারি। সুমিত্রা কৌতুক ভরে প্রশ্ন করে, তুমি কোন রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র? রকিব উত্তর দেয়, আমি কোনো দলের সদস্য নই। সুমিত্রা বলে, কলেজে পড়ার সময় কবীর সুমনের একটা গান শুনতাম। গানের একটা কলি ছিল,

এদল ওদল বাজায় মাদল রাজদন্ডের তালে,

বেশি বাড়াবাড়ি করলে লাশ ভাসবে নালায় খালে।

তিথি আপু যদি বেচে থাকতো তাহলে তার ভবিষ্যৎ কি হতো? গৃহবধু অথবা পতিতাবৃত্তি। রকিব কথাটা মানতে পারে না। সে বলে, কেন? মেয়েরা তো লেখাপড়া শিখে চাকরি করতে পারে। সুমিত্রা আগের মতো নিস্পৃহ কন্ঠে বলে, তিথি আপু তো লেখাপড়া শিখে চাকরি করতো। তবু সে বাচতে পারে নাই। রকিব এই কথার উত্তর দিতে না পেরে চুপ করে থাকে। তার মনে পড়ে কয়েক মাস আগে কোটা সংস্কার আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। রকিব এই আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। কিন্তু তার মনে হয়েছে দেশে বিদ্যমান বেকার সমস্যা এই আন্দোলনের কারণ। যারা এই আন্দোলনে যুক্ত ছিল তাদের লক্ষ্য হলো শাসক শ্রেণীর সদস্য হওয়া। সোজা ভাষায়, সরকারি চাকরি পাওয়া। জনগণের মধ্য থেকে ক্ষুদ্র একটা অংশ হয়তো শাসক শ্রেণীর সদস্য হতে পারবে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হবে না। তাদের সাথে যুক্ত হবে তিথির মতো হতভাগ্য কিছু মানুষ।

রকিবকে নীরব দেখে সুমিত্রা আস্তে আস্তে বলে, আমি দুই বছর আগে আর্ট কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। বাবার আয় নেই। শিল্পচর্চা আমার জন্য বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু না। সদাব্রতের সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার আগে সুশীলের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। সুশীল সাফ জানিয়ে দিয়েছে, সে আমাকে তার রক্ষিতা হিসাবে রাখতে রাজী আছে। সেইজন্য কিছু টাকা পয়সা দেবে। রকিব তুমি বলতে পারো, কোন অবস্থানটা বেশি সন্মানজনক? সুশীলের রক্ষিতা হওয়া ? নাকি পৌঢ় সদাব্রতের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে সতীনের সঙ্গে ভাগ করে সংসার করা? এই প্রশ্নের উত্তর রকিবের কাছে নেই।

রহমত বাড়ি ফিরেছে সন্ধ্যাবেলা। রকিব কে দেখে তার চোখ দুটো জুড়িয়ে যায়। কারখানায় কাজ করে তার একটি সন্তানকে অন্তত সে লেখাপড়া শেখাতে পারছে। ছেলের হাতটা ধরে বলে , আয় বাবা, আমার কাছে বসে থাক। রকিব বাবার ক্লান্ত মমতাময় মুখের দিকে তাকায়। তার মনে হয় বাবার মুখে কিসের যেনো উদ্বেগের ছায়া। রাতে সবাই একসাথে খেতে বসেছে। রকিব মা কে প্রশ্ন করে, রফিক ভাই কোথায়, মা? মা যেনো বা এড়িয়ে গিয়ে উত্তর দেয়, ও পরে খাবে। রকিব মায়ের দিকে তাকায়। চারদিন আগে সে গ্রামে এসেছে। এর মধ্যে একবারও বড় ভাইয়ের সাথে তার দেখা হয়নি। নাজু রফিকের বড় ছেলে। ওসমান মৃধার পাশে বসে খাচ্ছিল। নাজু বলে, বাবার তো কাজ নেই। তাই সে সারাদিন ঘরের মধ্যে চুপ করে বসে থাকে। কথাটা রকিবকে ধাক্কা দেয়। সে খাওয়া বন্ধ করে জিজ্ঞাসা করে, কাজ নেই মানে? ভাইয়ের কি হয়েছে? উত্তর দেয় ওসমান মৃধা। আস্তে আস্তে বলে, রফিক সরকারি পাটকলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতো। পাটকলে লোকসান হতে শুরু করায় সরকার পাটকল বন্ধ করে দিয়েছে। এই মিলগুলো ব্যক্তি মালিকানায় দিয়ে বিক্রি করে দেয়া হবে। ফলে শ্রমিক ছাটাই শুরু হয়ে গেছে। রফিকের কাজটা চলে গেছে। শুধু তাই নয়। পাটকলের পাশে শ্রমিকের সন্তানদের জন্য স্কুল ছিল। ফ্যাক্টোরির টাকায় এই স্কুল পরিচালিত হতো। সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। নাজুর লেখাপড়া বন্ধ। মনিরও হয়তো আর পড়তে পারবে না।

এখন মধ্যরাত। পড়ার টেবিলে বসে আছে রকিব। তার সামনে নতুন দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত মোশাররফ হোসেন নান্নুর একটি প্রবন্ধ রয়েছে। প্রবন্ধের শিরোনাম, একটি সোনালী স্বপ্নের অপমৃত্যু। প্রবন্ধে এক জায়গায় লেখক লিখেছেন, শুরু থেকেই রাষ্ট্রীয় পাটকলে দুর্নীতি, লুটপাট ও অব্যবস্থাপনা প্রাধান্যে চলে আসে। তারপর থেকে বিগত চার দশকে পাটশিল্প ও পাটনীতি নিয়ে যা হয়েছে তা বিভিন্ন সরকারের আমলে একই রাজনৈতিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা মাত্র। এক্ষেত্রে শাসকশ্রেণীর দলগুলোর মধ্যে নীতিগত কোনো পার্থক্য নেই। কৃষি ভিত্তিক স্থায়ী শিল্প হিসেবে পাটখাতকে বিবেচনা না করে সাম্রাজ্যবাদী দাতা গোষ্ঠী ও বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে কাঠামোগত সমন্বয়ের নামে ১৯৮২ সাল থেকে বিরাষ্ট্রীয়করণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদের আমলে প্রথম দফায় ৩৫টি পাটকল পূর্বের মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। ৮০দশকে বিশ্বব্যাংক পাটখাত উন্নয়নে ১৭০০ কোটি টাকা ঋণ দেয়, যার অন্যতম শর্ত ছিল পাটকল বন্ধ, শ্রমিক ছাটাইঁ এবং বিরাষ্ট্রীয়করণ করা। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালে খালেদা জিয়ার সরকার এশিয়ার বৃহত্তম আদমজী পাটকল বন্ধ করে দেয়। আদমজী পাটকল বন্ধ করায় বিশ্বব্যাংক, মার্কিন দূতাবাস এবং শাসকশ্রেণীর ক্ষমতা বহির্ভুত রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে অভিনন্দন জানায়। অথচ বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পাটখাতের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এক চতুর্থাংশ জনগণ নির্ভরশীল। অতপর ২০২০ সালের ২রা জুলাই আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রায়াত্ত্ব ২৫ টি পাটকল একসঙ্গে বন্ধ ঘোষণা করে।

রকিবের ঘুম ভাঙ্গে বড় ভাইয়ের উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে। রফিক বলছে, আপনারা ভদ্রলোক। স্কুলে চাকরি করেন। আপনাদের জন্য আন্দোলনে যাওয়া সহজ। আমার কাজ নেই। খাবার কেনার পয়সা নেই। আমি মিছিল করে কি করবো? আতিক স্যার বলেন, পাটকল বন্ধ হলে হাজার হাজার লোক বেকার হয়ে যাবে। আর আমরা প্রতিবাদ করবো না? আতিক রহমান স্থানীয় শ্রমিক সংগঠনের নেতা। পাটকল বন্ধের প্রতিবাদে সংগঠনটি ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে।

রকিব কখন এসে তাদের পাশে দাড়িঁয়েছে কেউ লক্ষ্য করে নাই। সে বলে, ভাই , আমাদের আন্দোলনে যাওয়া উচিত। আমরা যদি সংগঠিতভাবে প্রতিবাদ না করি, তাহলে আজ পাটকল বন্ধ হয়েছে। কাল চিনিকল বন্ধ হয়ে যাবে। কিছু মানুষ অনায়সে দেশের সম্পদ লুট করে খাবে। রফিক অবাক হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকায়। বলে, তুই লেখাপড়া শিখে চাকরি করবি। কৃষক , শ্রমিকের আন্দোলনে তোর স্বার্থ কি? রকিব উত্তর দেয়, যে জ্ঞান মানুষকে শুধু নিজের কথা ভাবতে শেখায়, সেই লেখাপড়ার প্রয়োজন আমার নেই। ব্রেখট বলেছিলেন, ক্ষুধার্ত মানুষ বইয়ের দিকে হাত বাড়াও। কেন না ওটা অস্ত্র। চলতি পথে আমরা জ্ঞানার্জন করতে পারবো। ইতোমধ্যে ওসমান মৃধা এবং রহমত এসে উঠোনে দাড়িঁয়েছে। তারা সবাই মিছিলে যাবে। ওসমান মৃধার চোখের কোণে এক ফোটা জল চিক চিক করছে। তিন রাজত্ব পার হয়ে এসে আজ আর সে নীরব দর্শক নয়। রহমত, রফিক, রকিবের সাথে ওসমান মৃধা দৃপ্ত পদক্ষেপে মিছিলে এগিয়ে চলে।


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

0

Lubna Negar

Author: Lubna Negar

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

ইসলামী জীবন

ইসলামী জীবন মোঃ রুহুল আমিন ইসলামের মূল স্তম্ভ গুলো মেনে জীবন গড়ি, ঈমান মজবুত করে মুসলিম সঠিক পথটা ধরি। ঈমান

কবিতা দুফোটা মায়া অশ্রু আফছানা খানম অথৈ

কবিতা দুফোঁটা মায়া অশ্রু আফছানা খানম অথৈ স্বামী চলে গেলে বহু দূরে বিদায়কালে রেখে গেলে দুফোঁটা মায়া অশ্রু। আঁচলে বেঁধে

কবিতা দান আফছানা খানম অথৈ

  কবিতা দান আফছানা খানম অথৈ রোজা এলে দানের দুয়ার খুলে হাজার গুন, কিছু একটু দিলে পরে সেলফি তোলেন খুব।

ঈদ আনন্দ

ঈদ আনন্দ মোঃ রুহুল আমিন ঈদ এসেছে রোজার শেষে খুশি সবার মাঝে, সবাই রইবে নতুন জামায় পরে খুশির সাজে। ঈদের

Leave a Reply