গর্ভকালীন সময় শুধু একজন মায়ের জন্য নয় বরং একটি নবাগত শিশুর জন্যেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। গর্ভকালীন সময়ে একজন মায়ের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটে এবং একটি শিশু অতিক্ষুদ্র ভ্রূণ থেকে পূর্ণাঙ্গ মানবশিশুতে রূপ নেয়। নবাগত শিশুর সুস্বাস্থ্য নির্ভর করে মায়ের খাদ্যাভাসের উপর। মায়ের জন্য উপযুক্ত খাদ্য তালিকা শিশুর দৈহিক বিকাশের পাশাপাশি প্রসূতি মায়ের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে। গর্ভবতী মায়েদের খাবার তালিকা পেতে নিজের পুরো লেখাটি পড়ুন।
গর্ভবতী অবস্থায় একজন মায়ের প্রয়োজন পুষ্টিকর খাবার। পুষ্টিকর খাবার নবগত শিশুর দৈহিক বিকাশে সহায়তা করবে। এমন কিছু কিছু খাদ্য উপাদান রয়েছে যেগুলো গ্রহণ না করলে শিশুর মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং গর্ভপাতেও নানারকম সমস্যা দেখা দিতে পারে।
আবার কিছু কিছু খাবার রয়েছে, যা খেলে হঠাৎ গর্ভপাতের মত ঘটনাও ঘটতে পারে। এমনকি শিশু ও মায়ের দুজনেরই জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। তাই গর্ভকালীন সময়ে সঠিক খাদ্য তালিকা নির্বাচন করা অতি জরুরি। পুষ্টিবিজ্ঞানীরা গর্ভকালীন সময়ের বিভিন্ন পর্যায়ে গর্ভবতী মায়েদের জন্য সুষম খাদ্য তালিকা প্রণয়ন করেছেন।
আজকে লেখাটিতে যে সকল বিষয়ে আলোকপাত করা হবে–
গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের খাবার তালিকা
গর্ভধারণের প্রথম তিনটি মাসকে বিশেষজ্ঞরা গর্ভধারণের প্রথম পর্যায়ে হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই সময় মায়ের শারীরিক পরিবর্তনের পাশাপাশি মানসিক আচরণেও এক বড় পরিবর্তন আসে। কেননা এই সময়ে হরমোনের পরিবর্তনজনিত কারণে মুড সুইং, ক্লান্তি, অবসাদ, খিটখিটে ভাবের মত বিষয়গুলো দেখতে পাওয়া যায়।
আবার অনেক সময় অরুচির কারণে গর্ভবতী মা প্রথম তিনমাসে কিছুই খেতে চায় না। তবে এই সময়টিতেই নানারকম রঙিন ফল-মূল, শাক-সবজি খাওয়া বাড়িয়ে দিতে হবে। রঙিন ফলে থাকা ভিটামিন সি গর্ভবতী মায়ের রুচি বাড়াবে এবং সবজিতে থাকা খনিজ লবণ গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক কার্যক্রম নিশ্চিত করবে।
দুধ ও দুধ জাতীয় খাদ্য গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন খাওয়া উচিত। বিশেষ করে টক দই খাওয়া যেতে পারে। দুগ্ধ জাতীয় খাদ্যে রয়েছে ভিটামিন ডি, যা হাড়ের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। গর্ভকালীন সময়ে মায়ের শরীরের ওজন বৃদ্ধি পায় বলে হাড়ের উপর চাপ বাড়ে। আবার গর্ভে থাকা অবস্থায় শিশুর হাড়গুলোও প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে। মা ও শিশুর হাড়ের সুস্বাস্থ্যতার জন্য দুগ্ধ জাতীয় খাদ্যের কোনো বিকল্প নেই।
সত্যি বলতে কি, গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসে অতিরিক্ত কিছু খাওয়া উচিত নয়। এই সময় স্বাভাবিক খাওয়ার পরিমাণ বজায় রাখতে হবে এবং খাবারের তালিকায় যথেষ্ট পরিমাণ শাকসবজি ও ফলমূল রাখতে হবে।
৩ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
গর্ভবতী হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই গর্ভবতী মায়ের শারীরিক পরিবর্তন ভালোভাবেই লক্ষ্য করা যায়। এসময় মায়ের ওজন ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং ক্ষুধার পরিমাণ কিছুটা বেড়ে যায়। আর এই সময়েই খাদ্য গ্রহনের পরিমাণ বাড়ানোর উপযুক্ত সময়।
৩ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা নিম্নে দেওয়া হল:
- দুধ
- টক দই
- সবুজ শাক
- রঙিন ফলমূল
- বিভিন্ন প্রকার ডাল
- চালের তৈরি খাবার
- মটরশুঁটি
- আয়োডিনযুক্ত লবন
- বাদাম বা বাদাম জাতীয় খাদ্য
- ডিম
- দেশি মুরগির মাংস
- পুকুর ও নদীর মাছ
- কড লিভার তেল
- ঘি বা সরিষার তেল
৪ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
চতুর্থ মাস থেকে মূলত মাকে খাবারের পরিমাণ বাড়াতে হবে। একজন সুস্থ নারীর জন্য যতটুকু ক্যালোরি প্রয়োজন, তার থেকে ৩৫০ ক্যালোরি বেশি খাদ্য একজন গর্ভবতী মাকে খেতে হবে। এই অতিরিক্ত ক্যালোরি বিভিন্ন প্রকার পুষ্টিকর খাদ্য থেকে নেওয়া যেতে পারে।
আমিষ, শর্করা ও স্নেহ; এই তিনটি হচ্ছে খাদ্যের প্রধান উপাদান। যার মধ্যে স্নেহ থেকে আমরা বেশি পরিমাণ ক্যালরি পেয়ে থাকি। তাই খাদ্য তালিকায় স্নেহ জাতীয় খাদ্যের পরিমাণ বাড়ানো উচিত। স্নেহ জাতীয় খাদ্যগুলো হচ্ছে বিভিন্ন প্রকার তেল, ঘি ইত্যাদি।
চার মাসের গর্ভবতী মায়ের খাদ্য তালিকায় আমিষ জাতীয় খাদ্য বেশি বেশি রাখতে হবে। আমিষ জাতীয় খাদ্যকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: প্রাণিজ আমিষ ও উদ্ভিদজ আমিষ। প্রাণিজ আমিষের মধ্যে রয়েছে মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি। আর উদ্ভিদ আমিষের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার ডাল, বাদাম অথবা বীজ জাতীয় খাদ্য, মটরশুঁটি ইত্যাদি।
আমাদের শরীরে শক্তি যোগায় শর্করা জাতীয় খাদ্যগুলো। আলু মিষ্টি, আলু, ভাত, গমের রুটি ইত্যাদি শর্করা জাতীয় খাদ্য। এসকল খাদ্য গর্ভবতী মায়ের নানা রকম শারীরিক ঘাটতি পূরণ করতে এবং মানসিকভাবে শক্ত রাখতে সহায়তা করবে।
৮ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
গর্ভধারণের অষ্টম মাসেই মায়ের ওজন সর্বোচ্চ হয়ে থাকে। এই সময় শিশুটি পূর্ণাঙ্গ মানব শিশুদের রূপ নেয় এবং গর্ভপাতের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। এই সময় গর্ভবতী মাকে শুধু শারীরিকভাবে সুস্থ হলে চলবে না, একই সাথে মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে হবে। কেননা যেকোনো মুহূর্তে গর্ভপাত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
আর এই সময় গর্ভবতী মায়ের খাদ্য চাহিদা সর্বোচ্চ হয়ে থাকে। একজন সাধারন নারীর দৈনিক যতটুকু ক্যালোরি খাদ্য গ্রহণ করা উচিত তার থেকে একজন ৮ মাসের গর্ভবতী মায়ের জন্য ৪৫০ ক্যালোরি অতিরিক্ত খাদ্যের প্রয়োজন পড়ে।
অতিরিক্ত ক্যালরিযুক্ত পুষ্টিকর খাদ্যের তালিকা:
- বিশুদ্ধ ঘি
- সোয়াবিন
- চর্বিহীন মাংস
- শিমের বিচি ও মটরশুঁটি
- বাদাম ও বাদামজাতীয় খাদ্য
- শুকনো ফল
- মিষ্টি আলু অথবা আলু
- স্যামন মাছ
- চাল বা গমের আটার রুটি
গর্ভবতী মায়ের খাদ্য তালিকা pdf
গর্ভবতী মায়ের জন্য উপযুক্ত খাদ্যের কোনো অভাব নেই। বিশেষজ্ঞরা প্রতিনিয়তই গর্ভবতী মায়েদের জন্য পুষ্টিকর খাদ্যের তালিকা প্রকাশ করে থাকেন। আপনি এই তালিকা পিডিএফ ফাইল আকারেও পেতে পারেন। একটি পিডিএফে খাদ্যের নামের পাশাপাশি প্রতিদিন কতটুকু গ্রহণ করা উচিত, দিনে কয় বেলা গ্রহণ করা উচিত এবং কোন সময়টি খাদ্য গ্রহণের জন্য উপযুক্ত তাও জানতে পারবেন।
এ সকল পিডিএফ তালিকা মূলত পুষ্টিবিজ্ঞানীদের দল প্রকাশ করে থাকে। কোন খাদ্যটি থেকে বেশি পরিমাণ ক্যালরি গ্রহণ করতে পারবেন এবং কোন খাদ্য ঠিক খাওয়া মোটে উচিত নয় সেটিও এখানে উল্লেখ করা থাকে।
ডাউনলোড করে নিন- গর্ভবতী মায়ের খাদ্য তালিকা pdf
গর্ভবতী মায়ের ফল খাবার তালিকা
ভিটামিন ও খনিজ লবণের জন্য সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে বিভিন্ন প্রকার ফল। গর্ভবতী মায়েদের জন্য ফল একটি উৎকৃষ্ট খাবার। প্রতিদিন নাস্তার সময় ও খাবারের পর ফল খাওয়া যেতে পারে। পুষ্টিবিজ্ঞানীরা গর্ভবতী মায়েদের জন্য যে সকল ফল খেতে পরামর্শ দিয়ে থাকেন, সেগুলো হচ্ছে–
- কলা
- পেয়ারা
- আতা
- কমলা
- মালটা
- ডালিম
- আপেল
- নাশপাতি
- আম
- তরমুজ
তবে কিছু কিছু ফল রয়েছে যা খাওয়া গর্ভবতী মায়েদের জন্য সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। এসব ফল হচ্ছে: পেঁপে, আঙুর, আনারস ইত্যাদি। গর্ভবতী মায়েদের ভুলেও এসব ফল খেতে দেওয়া যাবে না। এসব ফল খেলে গর্ভপাতের মত ঘটনাও ঘটে যেতে পারে।
গর্ভবতী মায়েদের খাবার তালিকা
এবার আমরা আলোচনা করব গর্ভবতী মায়েদের একটি পূর্ণাঙ্গ খাদ্য তালিকা নিয়ে। আমরা জানি, খাদ্য উপাদানকে সাধারণত ছয়টি ভাগে ভাগ করা যায়। যার মধ্যে প্রধান তিনটি উপাদান হচ্ছে– আমিষ, শর্করা ও স্নেহ জাতীয় খাদ্য।
আমিষ জাতীয় খাদ্য আমাদের দেহের ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করে, শর্করা ও স্নেহ জাতীয় খাদ্য আমাদের দেহের শক্তি উৎপাদন করে। এছাড়া ভিটামিন ও খনিজ লবণ দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও বিপাকীয় কাজে সহায়তা করে। আর পানির অপর নামই তো জীবন, পানির উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না।
আমিষ জাতীয় খাদ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে মুরগির মাংস, গরুর মাংস, ছাগলের মাংস, বিভিন্ন প্রকার মাছ (বিশেষ করে নদী ও পুকুরে পাওয়া মাছ) ডাল জাতীয় খাদ্য ইত্যাদি। গর্ভবতী মায়েদের খাদ্য তালিকায় আমিষ জাতীয় খাদ্যের পরিমাণ বরাবরের মতো বেশি রাখতে হবে।
শর্করা জাতীয় খাদ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে আলু মিষ্টি, আলু, ধান ও গমের তৈরি রুটি কিংবা ভাত। আর স্নেহ জাতীয় খাদ্যগুলোর মধ্যে ঘি এবং বিভিন্ন প্রকার তেল উল্লেখযোগ্য। স্নেহ জাতীয় খাদ্যে ক্যালোরির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।
ভিটামিন ও খনিজ লবনের প্রধান উৎস হচ্ছে বিভিন্ন প্রকার ফল ও শাকসবজি। বিভিন্ন শাকসবজি, যেমন পালংশাক, মিষ্টি কুমড়া, গাজর, পুঁইশাক, লাউ, করলা, টমেটো ইত্যাদি। আর ফলের মধ্যে রয়েছে কমলা, মালটা, পেয়ারা, তরমুজ, জাম্বুরা, আতা, ডালিম ইত্যাদি।
পানির কথা না বললে কিন্তু লেখাটি অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। পানির অপর নাম জীবন। বেঁচে থাকতে হলে পানি অপরিহার্য। গর্ভকালীন সময়ে মানব শরীরের পানির চাহিদা বেড়ে যায়। তাই গর্ভবতী মাকে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ গ্লাস পানি নিয়মিত পান করা উচিত।
গর্ভবতী মায়ের কি কি খাবার খাওয়া উচিত না
তবুও এমন কিছু কিছু খাদ্য রয়েছে যা পুষ্টিসমৃদ্ধ হলেও গর্ভকালীন সময়ে মায়েদের খাওয়া একেবারে উচিত নয়। এগুলো খেলে অনেক সময় হঠাৎ করে গর্ভপাতের মত ঘটনা ঘটতে পারে। এমনকি মা ও শিশু উভয়ের জীবন ঝুকিতেও ফেলতে পারে। এমন সব খাদ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে কফি, চা, পনির, কাঁচা ডিম, অপাস্তুরিত দুধ, পেপে, কলিজা, সামুদ্রিক মাছ ইত্যাদি।
চা বাঙালির কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি পানীয়। আবার বর্তমানে কফিও বাংলাদেশ তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। চা ও কফিতে থাকে ক্যাফেইন নামের একটি উপাদান, যা শিশুর ওজন কম হওয়ার পেছনে দায়ী।
কাঁচা খাবার আমাদের রান্না করেই খাওয়া উচিত। কাঁচা ডিম, কাঁচা মাংস কিংবা কাঁচা দুধ (অপাস্তুরিত দুধ) গর্ভকালীন সময়ে খাওয়া পরিহার করা উচিত। কেননা এসব কাঁচা খাদ্যে বিভিন্ন রকম ব্যাকটেরিয়া থাকে, যা পেটের নানা রকম গোলযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
কলিজা ও সামুদ্রিক মাছ আপাতত দৃষ্টিতে পুষ্টিকর খাদ্য মনে হলেও গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্যে এটি উপকারের চেয়ে অপকার করে বেশি। কলিজায় এক ধরনের প্রাণিজ ভিটামিন এ থাকে, যা গর্ভের শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। আবার সামুদ্রিক মাছ খেলে গর্ভবতী মায়ের শরীরে বিষাক্ত পারদের উপস্থিতি বেড়ে যেতে পারে। তাই এই সময়টায় সামুদ্রিক মাছ খাওয়া বর্জন করা উচিত।
গর্ভকালীন সময়ে মায়েদের খাবার নিয়ে মোটেও হেলা করা উচিত নয়। এই সময়ে মায়ের গ্রহণ করা খাদ্যগুলোই কিন্তু শিশুর ভবিষ্যতে মানসিক ও শারীরিক বিকাশে প্রভাব ফেলবে। আশা করছি, গর্ভকালীন মায়েদের খাবার তালিকা নিয়ে লেখাটি আপনাদের উপকারে আসবে।
আরো পড়ুন
- সর্দিকাশিতে মধু
- বিভিন্ন খাবারের উপকারিতা
- রসুনের উপকারিতা ও অপকারিতা
- আদার উপকারিতা ও অপকারিতা
- লেবুর উপকারিতা ও অপকারিতা
