অপূর্ব সত্য ভালোবাসা
আফছানা খানম অথৈ
একদা কবি শেখ ফরিদ সফরে গিয়েছিলেন।পথে তিনি খুব ক্ষুধার্ত হয়ে পড়লেন।তিনি আর হাটতে পারছিলেন না। ক্লান্ত হয়ে নদীর ধারে বসে পড়লেন।হঠাৎ নদীর জলে ভেসে আসল একটা ছেবফল।তিনি ক্ষুধা নিবারনের জন্য ঐ ছেবফলটি খেয়ে পেলেন।কিছুক্ষণ পর তিনি মনে মনে ভাবেন,
ফলের মালীকের অনুমতি ছাড়া যে ফলটি খেয়ে ফেললাম তার জন্যতো আমাকে পরকালে সাজা ভোগ করতে হবে।কিন্তু এখন উপায়….।
পরক্ষণে তার ভাবনার অবসান হলো তিনি বললেন,
ঠিক আছে আমি ফল গাছের মালীকের কাছে থেকে মাফ চেয়ে নেব।তবে আমার সাজা মওকুফ হবে, এর ব্যতিরেকে নয়।
তিনি নদীর ধার দিয়ে হাটা শুরু করলেন।অনেক দূর হাটার পর তিনি দেখলেন নদীর ধারে ফল ফলাদিতে ভরা একটা বাড়ি।তিনি আর দেরী না করে বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়লেন।সদর দরজায় দেখা হলো এক মধ্য বয়সী ভদ্র লোকের সঙ্গে।তিনি তাকে সম্মানের সহিত সালাম দিলেন।ভদ্র লোক সালামের জবাব দিয়ে বললেন,
আপনাকেতো চিনতে পারলাম না,আপনার পরিচয়?
আমি একজন মুসাফির, সফরে এসেছিলাম।কিন্তু আমি একটা অন্যায় করে ফেলেছি।
কি অন্যায়,তাছাড়া আমি কি করতে পারি?
জ্বি না মানে আমি খুব ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিলাম।হঠাৎ দেখলাম নদীর জলে একটা ছেবফল ভেসে যাচ্ছে।আমি ক্ষুধা নিবারনের জন্য ওটা খেয়ে ফেলি।এখন আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন,পরকালে আমাকে কঠিন সাজা ভোগ করতে হবে।বলুন আমাকে ক্ষমা করেছেন?
ভদ্রলোক আশ্চার্য হয়ে ভাবেন নদীর জলে ভেসে যাওয়া ছেবফলের জন্য যে লোক মাফ চাইতে আসতে পারে সে সাধারণ নয়,অসাধারণ দ্বীনদার। আল্লাহপাক ফলের উছিলাতে ওকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন।ও হবে আমার মেয়ের যোগ্য পাত্র।একে কিছুতে হাতছাড়া করা যাবে না।পরক্ষণে তিনি বললেন,
আসলে বাগানের মালীক তো আমি না,আমার মেয়ে,তাকে জিজ্ঞাসা করে আসি?
জ্বি আচ্ছা।
ভদ্র লোক বাড়িতে গিয়ে মেয়েকে ডাকেন,
তাহমিনা আম্মাজান এদিকে এসো।
মেয়ে এগিয়ে এসে বলল,
আব্বাজান আমাকে ডেকেছেন?
হ্যাঁ আম্মাজান।
কিছু বলবেন আব্বাজান?
হ্যাঁ আম্মাজান।পরম করুনাময়ের কাছে লাখ লাখ শোকরিয়া।
কেনো আব্বাজান?
আল্লাহপাক আমার দরবারে আমার দ্বীনদার মেয়ের জন্য একজন দ্বীনদার পাত্র পাঠিয়েছেন।
কী! বলছেন আব্বাজান?
হ্যাঁ আম্মাজান ঠিক বলেছি।যে লোক নদীর জলে ভেসে যাওয়া একটা ফলের জন্য মাফ চাইতে আসতে পারে সে সাধারণ কেউ না।
বলেন কী আব্বাজান?
হ্যাঁ আম্মাজান ঠিক তাই।এখন তুমি যদি রাজী থাক ওর সঙ্গে আমি তোমার বিয়ে দিতে পারি?
আব্বাজান উনি যদি রাজী না হন?
সেটা উপরওয়ালার মর্জি।উপরওয়ালা রাজী থাকলে সব হবে,এর ব্যতিরেকে নয়।
ঠিক বলেছেন আব্বাজান।
আম্মাজান আমি গেলাম।তুমি ওর জন্য চা নাস্তা পাঠিয়ে দাও
জ্বি আচ্ছা আব্বাজান।
তাহমিনার বাবা কবি শেখ ফরিদের কাছে গিয়ে বসলেন।অত:পর তিনি জানতে চাইলেন,
বেয়াদবি মাফ করবেন,আপনার মেয়ে কি বলেছেন?
সে একটা শর্ত দিয়েছে?
বলুন কী শর্ত?
যদি আপনি তাকে বিয়ে করেন,তবে সে ক্ষমা করবে।এর ব্যতিরেকে নয়…।
আমাকে কিছু দিন সময় দিন।তাছাড়া আপনাদের ওতো জানা শুনার দরকার আছে নাকি?
আমাদের যতটুকু জানার জেনেছি।এখন আপনি রাজী থাকলে বিয়েটা সম্পন্ন করতে পারি।
অনেক ভেবে চিন্তে শেখ ফরিদ বলল,
ঠিক আছে আপনি ব্যবস্থা করুণ।
পরক্ষণে তাহমিনার বাবা বলল,
বাবাজি আমার মেয়ের কিছু খুঁত আছে তা বিয়ের আগে আপনাকে জানানো দরকার।তানা হলে পরে আপনি আমাকে দোষী করবেন।শুধু তাই নয় আল্লাহপাকের কাছে আমাকে গুনাগার হতে হবে।
জ্বি বলুন।
বাবাজি আমার মেয়ে অন্ধ,ল্যাংড়া,বোবা,বয়রা বদসুরুত,এবার বলেন আপনি আমার এই খুঁতো মেয়েকে বিয়ে করতে রাজী কিনা?
কবি শেখ ফরিদ ভাবলেন পরকালের সুখ হলো আসল সুখ।এই দুনিয়ার সুখ হলো দুদিনের জন্য।আমার দরকার সাজা মওকুফের। খুঁতো মেয়ে হলেও আমি রাজী।পরক্ষণে তিনি বললেন,
জ্বি আমি রাজী।আপনি বিয়ের ব্যবস্থা করুণ।
তাহমিনার বাবা ইসলামের রীতিনীতি অনুযায়ী শেখ ফরিদের সঙ্গে মেয়েকে বিয়ে দিলেন।শেখ ফরিদ এশার নামাজ পড়ে তসবি হাতে সালাম দিয়ে বাসর ঘরে প্রবেশ করলেন।বউয়ের দিকে দৃষ্টি পড়তে একি দেখলেন,অপরুপ রুপবতি এক রুপসী কন্যা বসে আছে তার সামনে।ভয়ে তার শরীর কেঁপে উঠল।তিনি বলেন শ্বশুর সাহেব বললেন,তার মেয়ে খুঁতো, বদসুরুত, কিন্তু এখন একি দেখছি অপরুপ রুপবতী…।
একি মানবি নাকি পরী।যাই শ্বশুর সাহেবকে জিজ্ঞাসা করে আসি।
কবি শেখ ফরিদ ছুটে গেল শ্বশুরের কাছে।তাকে দেখে শ্বশুর সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন,
বাবাজি বাসর ঘরে যাননি?
জ্বি গিয়েছিলাম।
তো ফিরে আসলেন যে,আমার মেয়ে খারাপ কিছু বলেছে?
জ্বি না।
তো কি হয়েছে?
জ্বি না মানে বাসর ঘরে ওটা কার মেয়ে?
কেনো আমার মেয়ে।
আপনিতো বলেছেন আপনার মেয়ে বদসুরুত খুঁতো।কিন্তু এখন দেখছি সে নিখুঁত রুপবতী।এমন মিথ্যে বলার মানে কী?
বাবাজি শান্ত হও। আমি মিথ্যে বলিনি সত্য বলেছি।আর কেনো এসব বলেছি শুন তার ব্যাখ্যা দিচ্ছি।আমার মেয়েকে অন্ধ বলার মানে হলো,সে আমি ছাড়া কোন পর পুরুষের দিকে কখনো তাকাইনি তাই।
ল্যাংড়া বলেছি,সে কখনো বাড়ির বাইরে যাইনি।আর বোবা বলেছি,সে আমি ছাড়া কোন পর পুরুষের সাথে কথা বলেনি।আর বয়রা বলেছি তার কণ্ঠ আমি ছাড়া কোন পর পুরুষ শুনেনি।আর বদসুরুত বলেছি, আমি ছাড়া আর কোন পর পুরুষ আমার মেয়ের রুপ দেখেনি।
কবি শেখ ফরিদ সবকিছু বুঝতে পারলেন।তারপর ছুটে গেলেন বাসর ঘরে।দুরাকাত নফল নামাজ পড়ে বউয়ের সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন।স্বামীর পরিচয় শুনে স্ত্রী বলল,
আপনি কী কবি শেখ ফরিদ?
হ্যাঁ প্রিয়তমা।কেনো আমাকে পছন্দ হয়নি?
হয়নি মানে আপনাকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার জন্য খোদা পাকের দরবারে লাখ লাখ শোকরিয়া।আমি আপনার লেখা অনেক উর্দূ কবিতা ও গজল পড়ে মুগ্ধ হয়েছি।কিন্তু আপনাকে বাস্তবে পাব তা কখনো আশা করিনি।
সত্যি?
জ্বি সত্যি।
তাহলেতো খোদাপাকের কাছে শোকরিয়া আদায় করতে হয়?
ঠিক বলেছেন।
খুব আনন্দ ও ভালোবাসার মধ্য দিয়ে দুজনে বাসর রাত পার করলো।এর মাঝে পার হলো সপ্তাহ খানেক।শেখ ফরিদ বলল,
আব্বাজান অনেক দিন তো হলো।এবার তাহমিনাকে নিয়ে আমি দেশে ফিরে যেতে চাই।এতে আপনার কোন আপত্তি আছে?
বাবাজি আপত্তি থাকবে কেনো,বরং আমি খুশি।
তাহলে আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন।
বাবাজি তুমি কোন চিন্তা করো না।আমি তোমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করছি।
হাজী আবদুল মালেক মেয়ে জামাইর যাওয়ার সুবন্দোবস্ত করে দিলেন।হাজী সাহেবের একমাত্র মেয়ে শ্বশুর বাড়িতে খালী হাতে তো আর যেতে পারেন না।তিনি সংসারে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে নৌকা সাজিয়ে দিলেন।তাহমিনা বাবার-মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিতে কেঁদে উঠলেন।বাবা মেয়েকে শান্তনা দিয়ে বললেন,
কাঁদে না আম্মাজান,শ্বশুর বাড়ি হলো নারীর আপন ঠিকানা।প্রত্যেক মেয়ের উচিত বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ির লোকদের আপন করে নেয়া।আমি চাই তুমিও তাই কর।
দোয়া করবেন আব্বাজান আমি যেন সবাইকে আপন করে নিতে পারি।
হাজী সাহেব মেয়ে জামাইকে নৌকা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসলেন।স্রোতের তালে তালে নৌকা এগিয়ে চলল।মাঝ পথে আসার পর ডাকাত দল তাদের আক্রমন করলো।নৌকা ভর্তি মাল চিনিয়ে নিলো ডাকাত দল।তারপর ডাকাতের সর্দার বলল,
এই শালাকে নদীতে ফেলে দিয়ে সুন্দরীকে নিয়ে আয়।
অর্ডার পাওয়া মাত্রই ডাকাত দল তাহমিনাকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যেতে উদ্যত হলো।তখনি শেখ ফরিদ বউকে জড়িয়ে ধরে আক্রমনের মুখে বাঁধা প্রদান করলো।কে শুনে কার কথা, তার উপরে এরা হলো ডাকাত অমানুষের দল,তারা ঠিক শেখ ফরিদকে নদীতে ফেলে দিয়ে তাহমিনাকে চিনিয়ে নিয়ে গেল।
শেখ ফরিদ আল্লাহপাকের মেহেরবানীতে কোনমতে সাতরিয়ে নদীর কূলে ভিড়ল।তাহমিনাকে অনেক খুঁজল কিন্তু কোথাও পেল না।
এদিকে তাহমিনাকে ডাকাত দল আলাদা একটা ঘরে রাখার ব্যবস্থা করলো।ডাকাতের সর্দার তাহমিনাকে দেখতে আসলো।এসে দেখে তাহমিনা নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে কাঁদছেন।দুহাত তুলে প্রার্থনা করছেন,হে পরম করুণাময় আল্লাহ আমি সতী নারীর প্রার্থনা আপনি কবুল করুন,আমার মান সম্মান সতীত্ব রক্ষার দায়িত্ব আপনার,আমাকে এই ডাকাত দস্যুর হাত থেকে রক্ষা করে আমার স্বামীর কাছে পৌছানোর তাওফিক দিন।ডাকাতের সর্দার তা দেখে ফিরে আসলেন।শুধু তাই নয় সবাইকে বলে দিলেন তার যেন ক্ষতি কেউ না করে।
এদিকে কবি শেখ ফরিদ প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারিয়ে খুব ভেঙে পড়লেন।মসজিদে মসজিদে বিভিন্ন দেশে ঘুরে মুসাফির বেশে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকেন সর্বদা।মসজিদের ঈমাম সাহেব তাকে নামাজ অবস্থায় কাঁদতে দেখে তার দু:খের কারণ জিজ্ঞেস করলেন।তিনি তার দু:খের কথা ঈমাম সাহেবের কাছে প্রকাশ করলেন।সবকথা শুনার পর তিনি তাকে শান্তনা দিলেন এবং ধৈর্য ধারণ করতে বললেন।
এদিকে ডাকাতের সর্দার জরুরী এলাম ঘোষণা করে দিলো।সুন্দরী নিলাম দেয়া হবে। এক রাতের জন্য দুলক্ষ টাকা।আগ্রহী প্রার্থীদের যোগাযোগ করতে বললেন।মসজিদের ঈমাম সাহেব প্রথম রাতের জন্য সুন্দরী নিলাম নিলেন।এশার নামাজের পর তিনি শেখ ফরিদকে বললেন,
যাও তুমি আজ সুন্দরীর সাথে রাত কাটাবে।
শেখ ফরিদ বলল,
কী বললেন ঈমাম সাহেব,আমি যদি ঐ সুন্দরীর সাথে রাত কাটায় আমার ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে।আল্লাহপাকের কাছে গুনাগার হতে হবে।লোকে আমাকে ভন্ড, দুচরিত্রা বলবে।ঈমাম সাহেব আমাকে ক্ষমা করবেন।আমি এসব পারব না।
শুন বৎস শান্ত হও।শুনেছি মেয়েটি নাকি খুব পরহেজগার। তুমি ছাড়া অন্য কেউ যদি তার সাথে রাত কাটায়, তাহলে তার সতীত্ব নষ্ট হবে।আর কোন কথা না বলে তুমি তার কামরায় চলে যাও।
শেখ ফরিদ আর কোন কথা না বলে তসবিহ হাতে নামাজের বিছানা নিয়ে তার ঘরে প্রবেশ করলেন।শেখ ফরিদ আপন নিয়মে নামাজ পড়ছে।তাহমিনা কিন্তু কেঁদে চলেছে।তখনি শেখ ফরিদ বলল,
ওহে সুন্দরী আমি তো তোমার কোন ক্ষতি করিনি।তবুও কাঁদছ কেনো?
আপনি ভালো মানুষ বিধায় আমাকে রক্ষা করেছেন।কিন্তু কাল যখন অন্য জন আসবে সে তো আর আমাকে ভালো থাকতে দিবে না।তখন আমি কী করবো?তাই কাঁদছি।
আচ্ছা তুমি এখানে এলে কী করে?
শুনে কি করবেন,আপনি কি আমাকে আমার স্বামীর কাছে পৌছে দিতে পারবেন?
চেষ্টা করবো বলো তোমার স্বামীর নাম কী?
কবি শেখ ফরিদ।
সত্যি?
জ্বি সত্যি।
তখনি শেখ ফরিদ বলল,
তাহমিনা ভালো করে তাকিয়ে দেখ আমি তোমার স্বামী কবি শেখ ফরিদ।তাহমিনা আর দেরী করলো না।স্বামীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল।দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কিছু সময় কাটাল।এরপর শেখ ফরিদ বলল,
প্রাণের প্রিয়তমা আজ আল্লাহপাক কঠিন পরীক্ষার পর আমাদের “অপূর্ব সত্য ভালোবাসার” মিলন ঘটালেন।এভাবে আল্লাহপাক তার প্রিয় বান্দাদের বিপদ দিয়ে ইমান পরীক্ষা করেন।লাখ লাখ শোকরিয়া খোদা পাকের কাছে।
ঠিক বলেছেন প্রাণের স্বামী।এবার চলুন আমরা দেশে ফিরে যাই।
শেখ ফরিদ আর দেরী করলো না।প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে নিজ দেশে ফিরে গেল।
ঃসমাপ্তঃ
