অফুরন্ত ভালোবাসা
আফছানা খানম অথৈ
সোহম ও সুমি দুজন ছোট বেলার বন্ধু।সোহম পরিবারের বড় ছেলে।সুমি পরিবারের ছোট মেয়ে। দুজনের বাবা সরকারী কর্মকর্তা।পাশা-পাশি ফ্ল্যাটে তারা থাকে।ছোট বেলার পুতুল খেলার মধ্য থেকে দুজনের বন্ধুত্ব হলো।একে অপরের মাঝে খুব বন্ধুত্ব।স্কুল থেকে ফেরার পর দুজনে এক সঙ্গে খেলাধুলা ছুটাছুটি মাতিয়ে তুলে পুরো বাড়ি।পাশের বাসার ভাড়াটিয়ারা তাদের দুষ্টমির জন্য খুব আরজি দিতেন।দুজনের অবিভাবক বিরক্ত হয়ে খুব বকতেন ও শাসন করতেন।কিন্তু কে শুনে কার কথা,এসব শাসন বারণ কিছুতেই তাদেরকে দমিয়ে রাখতে পারতো না।তারা ঠিক হাসি আনন্দে বাড়িঘর মুখরিত করে তুলতো।কোন এক ফাঁকে তাদের পুতুল খেলার বয়স পেরিয়ে গেল,কলেজে পা রাখল।তারপর কলেজ শেষ করে ভার্সিটিতে গেল।
দুজন ভালো বন্ধু, কিন্তু তাদের এ বন্ধুত্ব কখন যে গভীর ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে তা কেউ টের পেলো না।সোহম মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে, ভালো চাকরী পেয়েছে।তাকে নিজ সিটি ছেড়ে চলে যেতে হবে অন্য সিটিতে।কিন্তু সুমিকে ছেড়ে থাকতে হবে কথাটা ভাবতে মনটা আনচান করে উঠল।সুমির মনটা ও খুব খারাপ।সে মুড অফ করে বসে আছে।সোহম তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখে সে মন খারাপ করে বসে আছে।তখনি সোহম চুপি চুপি তার পিছনে গিয়ে চোখ দুটো চেপে ধরল।সুমি তার হাত দুটো চেপে ধরে বলল,
উহু! লাগছে তো ছেড়ে দাও।
আগে বলো কে?
ঢং করো না তো সোহম, আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে ছেড়ে দাও।
সোহম তার চোখ ছেড়ে দিয়ে তার কাঁধে হাত দিয়ে পাশে বসে পড়লো।তারপর তার চোখে চোখ রেখে বলল,
সুমি কিছু বলছ না যে,কি হয়েছে?
বলার মতো কিছু থাকলে তো?
কী বলছ, আমার চাকরী হয়েছে,তোমার খুশি হওয়ার কথা,কিন্তু তুমি মন খারাপ করে বসে আছ।কারণ কী?
সুমি মিষ্টি হেসে উত্তর দিলো,
কারণ তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারবো না।
কী বলছ,আমি জব করতে যাব না?
অবশ্যই যাবে,তবে যে বললে থাকতে পারবে না।
তুমি চলে গেলে অন্য কোথাও যদি আমার বিয়ে হয়ে যায়?
সুমি তোমার বিয়ে আমার সঙ্গে হবে,অন্য কারো সঙ্গে না।
সোহম এতটা সিউর হলে কি করে?
সুমি আমাদের ভালোবাসার কথা অবিভাবকের নলেজে দেয়া হয়েছে।
উনারা কি বললেন?
উনারা দুফ্যামিলি রাজী।
সোহম সত্যি বলছ তো?
হ্যাঁ সুমি সত্যি।
উনারা আমাদের ভালোবাসা মেনে নিয়েছেন।
তুমি কবে যাচ্ছ?
কাল সকালের গাড়িতে।
ফিরবে কখন?
বিয়ের ডেট ফিক্সড হওয়ার পর।
কবে বিয়ের ডেট হবে।
যেটা সিউর বলতে পারবো না।তবে বেশী দেরী হবে বলে মনে হয় না। বাবা-মা শীঘ্রই বিয়ের কথা পাকা মানে তোমাকে আংটি পরাতে যাবেন।ডার্লিং আর মন খারাপ না করে একটু হাস।
এই বলে সোহম সুমিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে তুলতুলে গালে কিস….।
সুমি তাকে সরিয়ে দিয়ে বলে,
সোহম বিয়ে না হতে এসব কী?
বারে বিয়ে তো হবে সিউর।
তবুও তোমাদেরকে বিশ্বাস নেই।কারণ প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় চোখ বুলাতে তোমাদের মতো পুরুষদের প্রেমের নামে নোংরামি করার দুচারটা কাহিনী চোখে পড়ে।
তার মানে তুমি আমাকে ঐসব নষ্ট পুরুষদের সঙ্গে তুলনা করছ?
ঠিক তাই না।তবে ভাবছি কারণ পুরুষ তো,বলা তো যায় না,কখন কি ঘটে?
ঠিক আছে তাহলে মাকে বলব তাড়াতাড়ি আৎ করতে।
ওকে মাই সুইট হার্ট সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা কর।
তাহলে এ কথা রইল।চলি খোদা হাফেজ।
সোহম সুমির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরল।পরদিন সকালে সুমিকে ফেসবুকে গুড মর্নিং জানিয়ে গন্তব্য স্থলে ফিরে গেল।
এদিকে সোহমের মা তার বাবার সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে আলাপ করলে তিনি বললেন,
এত তাড়াহুড়ার কি আছে,সোহম সবেমাত্র চাকরীতে জইন করেছে,কটা মাস যাক,তারপর না হয় বিয়ের কথা ভাবা যাবে।
সোহমের মা সরাসরি কথাটা না বলে একটু ঘুরিয়ে বলল,
না মানে আমি বলছিলাম কি,ছেলেটা চলে গেছে,বাসাটা খালী খালী লাগছে।আমার একা একা ভালো লাগছে না।বউটা থাকলে ভালো হত।
তাছাড়া তারা দুজন দুজনকে ভালোবাসে। তাই বলছিলাম আর দেরী করা ঠিক হবে না।
ঠিক আছে তুমি যা ভালো মনে কর,তাতে আমি রাজী।
সোহমের মা-বাবা আর দেরী করলো না।সুমির মা-বাবার সঙ্গে কথা বলে এংগেজমেন্ট’র দিন ধার্য করলো।
সমমমতো এনগেজমেন্ট’র পর্ব শেষ করলো।তারপর ভালো একটা দিন দেখে বিয়ের দিন ধার্য করলো।এক মাস পর বিয়ে।
সোহম পরিবারের বড় ছেলে।সুমি পরিবারের ছোট মেয়ে।বুঝতে পারছেন আদর আহলাদ কতখানি?
দুজনের বিয়ের আসর খুব জমবে।
এদিকে সোহম আর সুমি মুঠোফোনে ঘন্টার পর ঘন্টা মজার মজার আলাপ নিয়ে ব্যস্ত…।
ভালোবাসা যেন উপছে পড়ছে।কোন কারণে কানেকশনে সমস্যা হলে মনে হয় দুজন হার্টফেল করবে।এমন ভালোবাসা দুজনের মধ্যে।যাক আস্তে আস্তে বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসছে।যথা সময়ে বিয়ে অনুষ্ঠিত হলো। খুব জাকজমকভাবে সোহম ও সুমির বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলো।আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবীরা খুব আনন্দ করলো।ব্যান্ড পার্টি মিউজিক বিনোদন ও ছিল তাদের বিয়েতে।যাক খুব আনন্দ উল্লাসের মধ্য দিয়ে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলো।সুমি সোহমের বউ হয়ে তাদের বাড়িতে গেল।নতুন বউকে নিয়ে সবাই অনেক মজা করলো।তারপর সবাই চলে গেল।সুমি একা তার ঘরে বসে রইল।এমন সময় সোহম আসল।সোহমকে দেখে সে লম্বা একটা ঘোমটা দিয়ে বসে রইল।তারপর সোহম তার ঘোমটা তুলে তাকে স্পর্শ করতেই সে বলল,
“ডোন্ট টাচ মি”
সোহম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
সুমি এখন তো বিয়ে হয়েছে, টাচ্ করতে সমস্যা কোথায়?
সমস্যা অনেক আছে, কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি না।
তার মানে তুমি অন্য কাউকে….।
হ্যাঁ আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি।
তাহলে আমাকে বিয়ে করলে কেন?
মন চাইল তাই।
আচ্ছা তোমার ভালোবাসার মানুষটির নাম কি?
আমার ভালোবাসার মানুষটির নাম সোহম রহমান।বাবার নাম সাইফুর রহমান।মায়ের নাম সায়লা রহমান।
সোহম বুঝতে পারলো সুমির ভালোবাসার ফান।তাই আর দেরী না করে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
মাই সুইট হার্ট আমাকে এত ক্ষ্যাপানোর মানে কি,দেখাচ্ছি মজা…।
প্লিজ সোহম শুন,জাস্ট এক মিনিট।
সুমি যা বলার তাড়াতাড়ি বল,আমার ধৈর্য আর মানছে না।
ওকে সুইট হার্ট বলছি।
সোহম ভাবী বলেছে বিয়ের প্রথম রাতে নব দম্পত্তির নতুন জীবন শুরু করার পূর্বে স্বামীকে দুরাকাত নফল নামাজ পড়তে হয়।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই।
সোহম আর দেরী করলো না।দুরাকাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহপাকের কাছে শোকরিয়া আদায় করলো,এবং তাদের ভালোবাসা যেন গভীর থেকে গভীরতম হয় তার জন্য প্রার্থনা করলো।সাথে সাথে সুমি ও প্রার্থনায় শরীক হলো।তারপর সোহম সুমিকে নিয়ে মজার ভুবনে….।
সকালে ফজরের আযানের কিছু সময় পর সুমি ঘুম থেকে উঠল।তারপর ফজরের নামাজ পড়ে সবার জন্য বেড ট্রি রেডি করে শ্বাশুড়ির ঘরের দরজায় নক করে।তিনি দরজা খুলে বউকে বেড ট্রি হাতে দেখে বললেন,
বউ মা তুমি এ সাজ সকালে,বুয়া কোথায়া?
মা বুয়া রান্না ঘরে।
তো তোমার হাতে চা কেন?
মা এসব বুয়ার কাজ না।
তো কার কাজ ?
মা এসব হলো বাড়ির বউয়ের কাজ।আজ থেকে এসব কাজ আমি করবো।
সায়লা রহমান কোন কিছু না বলে বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।তারপর আপন মনে বলেন,
আমার বউটা খুব লক্ষি।হে পরওয়ার দেগার সারাজীবন আমাদের বউ শ্বাশুড়ির ভালোবাসা যেন অটুট থাকে সেই তৌফিক দান করুন।
সোহম ও সুমির দাম্পত্য জীবন খুব সুখে কাটতে লাগল।সোহম অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে হ্যানিমনে যাওয়ার জন্য।সুমির অনেক দিনের প্ল্যান কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত আর সিলেটের চা বাগানের প্রাকৃতিক নৈসর্গিক দৃশ্য দেখার।সোহমকে হ্যানিমনে কোথায় যাবে জিজ্ঞেস করলে সে ও বলে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত ও সিলেটের চা বাগানের কথা।যাক দুজনের মতামত এক হয়ে গেল।
সময়মতো তারা হ্যানিমনে গেল।একটা হোটেল বুকিং নিলো।বিকেলের পড়ন্ত রোদে দুজন ছুটে গেল কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত দেখতে।প্রকৃতি তার আপন নিয়মে চলে, সে কি মজার দৃশ্য সমুদ্রের পানি গুলো ফুলে উঠে খুব উপরে উঠছে,আবার নামছে।সুমি ও সোহম একে অপরের হাত ধরে হেটে হেটে উত্তাল তরঙ্গের ঢেউ’র খেলা দেখছে।তারা আরও দেখল ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা সমুদ্রের নিকট থেকে ঝিনুক কুড়িয়ে এনে খুব সুন্দর করে ঝিনুকের মালা তৈরী করছে।সুমি তাদের সঙ্গে কথা বলল,তারপর পছন্দ সই কয়েকটা মালা কিনল।এরপর আর ও কিছু সময় তারা মজা করলো তারপর হোটেলে ফিরল।এখানে কয়েক দিন থাকার পর তারা ছুটে গেল সিলেটে চা বাগান দেখতে।দুজন মিলে চা বাগান দেখতে গেল।সেখানে দেখা হলো তাদের সঙ্গে চা বাগানের কেয়ার টেকারের সঙ্গে উনি তাদেরকে চা বাগান সম্পর্কে জানা-অজানা সব তথ্য বললেন।তারপর সুমিও সোহমকে চা বাগানের সকল এরিয়া ঘুরে দেখালেন।সুমি খুব আনন্দ ভরে চা বাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করলো।শুধু তাই নয় আসার সময় কয়েক প্যাকেট চা পাতা কিনে নিয়ে আসল।ভ্রমন শেষ তারা বাসায় ফিরে আসল।দুপরিবারের শ্বশুর-শ্বাশুড়ি বউ- জামাইকে নিয়ে খুব হ্যাপি। কারো প্রতি কারো কোন অভিযোগ নেই।ভালোবাসা যেন উপছে পড়ছে।সোহমের ছুটি শেষ সে তার গন্তব্য স্থলে ফিরে যাবে।বউকে জড়িয়ে ধরে বলল,
মাই সুইট হার্ট তোমাকে ছেড়ে থাকতে খুব কষ্ট হবে।কিভাবে যে থাকব।
উহু! কি যে বল না,বিয়ে কি তুমি একা করেছ, চাকরী ছেড়ে বউকে নিয়ে শুধু ..,সংসার চলবে কি করে?,কাজ করতে হবে না?
অবশ্যই হবে।
তাহলে আর দেরী না করে কাজে লেগে যাও।কারণ কিছুদিন পর আসবে নতুন অতিথি।
সোহম বউকে জড়িয়ে ধরে বলল,
সত্যি বলছ সুমি,আমি বাবা আর তুমি মা…?
তো আর বলছি কি।
তাহলে তো আর অলসতা করা যাবে না।
ঠিক বলেছ সোহম,এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে আমাদের নবাগত বাচ্চাটি যাতে সুন্দর ভাবে এই পৃথিবীর আলোর মুখ দেখে।
ওকে সুইট হার্ট তাই হবে।
দুজন আর ও কিছু সময় মজা করলো।সোহম তার গন্তব্য স্থলে ফিরে গেল।সোহমের মা দাদি হবে কথাটা শুনে খুব খুশি হলেন।তারপর থেকে বউয়ের খুব টেককেয়ার করেন।সময়মতো ডাক্তারি চেকাপ,খাওয়া-দাওয়া সবকিছু ভালো ভাবে পালন করে চলেছেন।সময়মতো সুমির কোল জুড়ে আসল এক ফুটফুটে কিউট ছেলে বেবি।দুপরিবারের মাঝে যেন আনন্দের জোয়ার বয়ে বেড়াচ্ছে।সুমির শ্বশুর-শ্বাশুড়ি একমাত্র নাতিকে পেয়ে খুব খুশি।বউ শ্বাশুড়ির মাঝে খুব মিল মহব্বত।
সোহম ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসল।এসে দেখে মা তার বেবিকে দোলনায় দুলিয়ে ঘুম পাড়ানির মাসি পিসির গান শুনাচ্ছে।ছেলে এসে মাকে সালাম করে বেবিকে কোলে নিয়ে খুব আদর করলো।ছেলে বাড়ি এসেছে মা তার পছন্দের রান্না দিয়ে ডাইনিং টেবিল সাজিয়ে ছেলে ও বউকে খেতে ডাক দেয়।দুজন এগিয়ে এসে বলে,
ওয়াও মা তুমি এত রান্না কখন করলে?
কখন আবার এইতো কিছুক্ষণ আগে।
বউ ছেলে দুজনে মাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু এঁকে বলে,
মা তুমি খুব লক্ষি।
বেশ হয়েছে আর আহলাদ করতে হবে না।খেয়ে নাও।,বউ মা তুমিও বস।
সবাই একসঙ্গে খেতে বসলো।মা ছেলেও বউকে খুব যত্ন করে খাওয়ালেন।তিনি একজন আদর্শ মা হিসেবে সব দায়িত্ব পালন করে চলেছেন সর্বদা।সুমি ও সোহমের মাঝে ভালোবাসার কমতি নেই।দুজনের মধ্যে যেন “অফুরন্ত ভালোবাসা” উপছে পড়ছে।