কালরাত
আফছানা খানম অথৈ
আমাদের সমাজে কিছুকিছু ছেলে-মেয়ে আছে মাতৃভক্ত। মায়ের কথা ছাড়া কোনকিছু করে না।নিজের পছন্দ অপছন্দ সবকিছু নির্ভর কতে মায়ের পছন্দের উপর।এমনকি বিয়ে ও মায়ের পছন্দে করে।শুধু তাই নয়, শ্বশুর বাড়ি যাতায়াত ও মায়ের অর্ডারে করে।এমনি এক কাহিনী উপস্থাপন করছি আজ আপনাদের সামনে।বিবি কুলসুমের পাঁচ ছেলে।চার ছেলের বিয়ে শেষ,এখন ছোট ছেলে তাসরিফের বিয়ের পালা।তাসরিফ ডিগীধারী একজন চাকরীজীবি ছেলে। তবুও নিজের পছন্দের কোন মুল্য নেই। মায়ের পছন্দে বিয়ে করতে হবে।মায়ের আদেশ শিরেধার্য। বরখেলাফ করার সাহস নেই।চারদিকে লোক লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।পাত্রী দেখা শুরু…।
আজ একজন, কাল একজন এভাবে শখানেক মেয়ে দেখা শেষ।তবুও পাত্রী পছন্দ হচ্ছে না।কারো বংশ ভালো না,কারো মেয়ে সুন্দরী না।আবার কোথাও কোথাও দেনা পাওনার হিসেব মিলেনা।ঘটক বিরক্ত হয়ে এবার আর একটা মেয়ে দেখালো।শর্ত একটা এই মেয়ে পছন্দ না হলে সে আর কোন মেয়ে দেখাতে পারবে না। তাসরিফের মা রাজী হলো।তারপর মেয়ে দেখতে গেল।
যাক এবার পাত্রী পছন্দ হলো।এংগেজমেন্ট আংটি পরিয়ে দেয়া হলো কনের ডান হাতের মধ্যমা আঙুলে।পাত্রীর নাম আনিকা বি এ প্রথম বর্ষে পড়ে।যাক দুপক্ষের মতানুযায়ী বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা হলো।সাতদিন পর বিয়ে।এরই মধ্যে দুবাড়িতে মিষ্টি দেয়া নেয়া হলো।কিন্তু একটা শর্ত বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত জামাই বউ কথা বলতে পারবে না।দেখা সাক্ষাত করতে পারবে না।কিন্তু ছেলে মেয়ে মানলে তো।তাসরিফের আর তর সইছে না।সে আনিকার সঙ্গে কথা বলবেই।যাক অনেক কষ্টে মায়ের অজান্তে বউয়ের সঙ্গে ফোনালাপ করলো।
এদিকে গায়ে হলুদের পর্ব এসে গেলো।হলুদ নিয়ে প্রথমে বরের বাড়ি থেকে কনের বাড়িতে,তারপর কনের বাড়ি থেকে বরের বাড়িতে লোকজন যাতায়াত করলো।খাওয়া দাওয়া হলো মোটামুটিভাবে।
ভুলবশত কারো প্লেটে একটু কম পড়েছে ক্ষেপেছে এই নিয়ে হৈচৈ…।কনে পক্ষ খুব ধুমধাম করে খাওয়ালো।তবুও মন ভরছে না বর পক্ষের।ছেলে পক্ষ বলে কথা,তাই তাদের আবদার একটু বেশি।এই নিয়ে শালিস, নালিশ অবশেষে মিটমাট।
যাক গায়ে হলুদের পর্ব শেষ হলো এবার বিয়ের পালা।যথা সময়ে বর পক্ষ বর যাত্রী নিয়ে কনের বাড়িতে উপস্থিত হলো।বরের পথ রোধ করে দাঁড়ালো একদল তরুণী। তাদের আবদার দশ হাজার টাকা সালামী দিতে হবে।তানা হলে বরকে ভিতরে যেতে দেয়া হবে না।এই নিয়ে দুপক্ষ কথা কাটাকাটি…।
কিছুতেই বর পক্ষের লোকেরা দশ হাজার টাকা দিতে রাজী হচ্ছে না।কনে পক্ষের ও এককথা দশ হাজার টাকা না দিলে বরকে যেতে দেয়া হবে না।এই নিয়ে আরও কিছু সময় কথা কাটাকাটি হয়।তারপর পাঁচ হাজার টাকাতে মিটমাট হয়।বর পক্ষের লোকজন টাকা দিয়ে ফিতা কেটে ভিতর মহলে চলে গেল।বর স্টেজে আসন পেতে বসলো।তার চারপাশে বন্ধুরা বসল।যাক সময়মতো বিয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ হলো।তারপর বর কনের দর্শনের পর্ব শেষ করে,বউকে গাড়িতে তুলে দেয়া হলো।বউকে নিয়ে গাড়ি রওয়ানা করলো।
এদিকে ছেলের বাড়িতে বউকে বরন করার জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো।গ্রামাঞ্চলের বিয়ে এখনো আগের দিনের কিছু নিয়মনীতি মেনে চলা হয় সর্বত্র।তাসরিফের মা বউকে বরন করার জন্য ঘড়ি ভর্তি পানি আর আমা গাছের একটা ডাল ঘড়ির পানির ভিতরে চুবিয়ে রেখেছেন।আর এক কলসি পানি মুখে একটা কুমড়া দিয়ে চেপে রেখেছেন।আর ঘরের বারান্দায় কিছু চাল ছিটিয়ে রেখেছেন।বউ আসার সাথে সাথে ঘড়ির পানি ছিটা দিয়ে বউকে বরন করা হবে।তারপর কলসি দেয়া হবে বউকে, কাঁথে নিয়ে ঘরে ঢুকার জন্য।কিন্তু ছিটানো চাল কি করবে? বউ যদি লক্ষি হয় ছিটানো চাল কুড়িয়ে বাটিতে তুলবে।আর যদি অলক্ষি হয় পা দিয়ে পিষে পার হয়ে যাবে।এসব প্রস্তুতি নিয়ে তারা বউ আসার জন্য অপেক্ষা করছে।বলতে না বলতে বউয়ের গাড়ি এসে গেল।ছোট ছেলে মেয়েরা বউ এসেছে, বউ এসেছে বলে চিৎকার শুরু করলো।
প্ল্যান অনুযায়ী কাজ চলছে।বউ আসার সাথে সাথে ঘড়ির পানি ছিটিয়ে বউকে বরন করা হলো।তারপর কলসি কাঁথে দেয়া হলো।বউ তা নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো।কিন্তু চালের উপর ফাঁড়া দিয়ে বউ চলে গেল।কারণ এই ব্যাপারে সে কিছুই জানে না।কিন্তু এখানে তা শেষ নয়।বউয়ের সঙ্গে আসা মেহমানদের কিছু কড়া কথা শুনতে হলো।বউয়ের আত্মীয়-স্বজন সবাই চুপ।কারণ এটা বিরাট অন্যায়।তাই নিরবে তারা সবকিছু হজম করে নিলো।
যাক রাতের খাওয়া শেষ হলো।যে যার মতো করে শুতে গেল।ঘরভর্তি মেহমান,কে কোথায় শুবে,এই নিয়ে টানা হেঁছড়ে…।
তবে এই পরিবারের একটা রেওয়াজ, বিয়ের পরে প্রথম রাতে বউ জামাই এক সাথে থাকতে পারবে না।এই রাতের নাম হলো “কালরাত” এই রাতে বউ জামাই এক সাথে থাকলে নাকি ভয়ানক বিপদ হতে পারে।সাবধান এই রাতে কিছুতেই দুজন এক হতে পারবে না।তাহলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার।সামনের দিনগুলো অমঙ্গল হবে।তাই দুজনকে দুজাগায় রাখা হলো।কিন্তু জামাই মানলে তো?
সে বউয়ের কাছে আসার জন্য আকুলি বিকুলি…।ভাবীকে ডেকে বলে,
ভাবী তোমরা এখনো সেকেলে রয়ে গেলে?
কী করব ভাই,মায়ের আদেশ শিরেধার্য। অমান্য করার সাহস নেই।
তবুও মাকে বুঝিয়ে বলো বিয়ের প্রথম রাতের নাম হলো “বাসর রাত”।এই রাত নব দম্পত্তির জন্য মধুররাত।এই রাত জীবনে একবার আসে বারবার আসে না।এই রাতে জামাই বউ একসঙ্গে থাকতে হয়।তানা হলে গুনা হবে।
দেবরজি যাই করেন কোন লাভ হবে না।মা তার মত বদলাবেন না।তাছাড়া আমাদের সময় ওতো তাই করেছে।তোমার ভাইতো তা মেনে নিয়েছে।
প্লিজ ভাবী বুঝতে চেষ্টা কর।ভাইয়া ভুল করেছে।তাই বলে আমিও ভুল করব?প্রশ্নই উঠেনা।মাকে যেমন করে হোক রাজী করাও।আমি একা থাকতে পারবো না।
দেবরের অনুরোধে ভাবী গেলো মায়ের কাছে।তারপর তাসরিফের কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করলো।কিন্তু মা কিছুতেই রাজী হলেন না।তার এক কথা এই কালরাতে বউ জামাই এক সঙ্গে থাকা নিষেধ।এটা তার বংশের রেওয়াজ।এই রেওয়াজ সে কিছুতেই ভাঙতে পারবে না।তাছাড়া তার শ্বাশুড়ি ও এই রেওয়াজ মেনেছে।সেও মানবে এতে দোষের কী আছে?মাত্রতো একটা রাত এ আর এমন কী?
বড় ভাবী ব্যর্থ হলো এবার মেজো ভাবীর পালা।তাকে ডেকে তাসরীফ বলল,
প্লিজ ভাবী আমি আর পারছি না?
কেনো ভাই কী হয়েছে?
বউকে ছাড়া বাসর রাতে কেউ একা থাকে?
কেনো সমস্যা কোথায়?তোমার ভাই তো থেকেছে?
প্লিজ ভাবী বুঝতে চেষ্টা কর।ভাইয়া ভুল করেছে,তাই বলে আমিও ভুল করব?
কী করব ভাই মায়ের কথার উপর কথা বলার সাহস কারো আছে?
তবুও বলতে হবে। মা যে রাতকে “কালরাত” বলছে,এই রাত হচ্ছে বাসর রাত।এই রাতে সম্পর্কে নবী করিম (সা) অনেক ব্যাখা দিয়েছেন,অনেক হাদিসে উল্লেখ করেছেন,এই রাত নব দম্পত্তির জন্য শ্রেষ্ঠরাত,মধুররাত। এই রাত মিস করা ঠিক নয়।এই রাতে যতখুশি আনন্দ কর।এই রাতের ব্যাপারে যদি কেউ ভুল ব্যাখ্যা দেয় তা মানা ঠিক নয়।এই রাতের ব্যাপারে যদি কেউ বাঁধা দেয়,প্রয়োজনে বউকে নিয়ে পালিয়ে যাবে।তবুও এই রাত মিস করবে না।কারণ নব দম্পত্তির জন্য এই রাত সুখময় রাত শান্তির রাত।ভাবী যেমন করে হোক আমাদের দুজনের একসঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করে দাও।মাকে ভালো করে বুঝাও।
দেবরের অনুরোধে মেঝো বউ ও শ্বাশুড়িকে খুব করে বুঝালো।কিন্তু কোন লাভ হলো না।তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন।এবং ছেলেকে একঘরে তালা বন্দি করে রাখলেন।
সকাল হলে সবাই জেগে উঠল।যে যার মতো কাজে লেগে গেলো।আজ বউভাত,কনের বাড়ি থেকে লোকজন আসবে।তাদের খাবার দাবারের আয়োজন চলছে।বড় বউ আসল দেবরের ঘরের তালা খুলতে।কিন্তু সে কী! দেবরের সাড়াশব্দ নেই।সে গভীর ঘুমে মগ্ন।ভাবী নাম ধরে কয়েকবার ডাকল।কোন সাড়াশব্দ নেই।এবার সে তাসরিফ কথা বলছে না বলে চিৎকার দিলো।তার চিৎকারে সবাই এগিয়ে আসল।এসে দেখে তাসরিফ নেই,মারা গেছে।বউয়ের বিরহ সইতে না পেরে সে স্ট্রোক করে মারা গেল।এমন অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারে আছন্ন আছে এখনো সমাজের অনেক লোকজন।এদেরকে বুঝানোর সাধ্য কারো নেই।এরা হাদিস কোরআনের কিছুই মানে না।নিজেরা যা বুঝে তা ভালো মনে করে,সঠিক মনে করে।আর বাসর রাতকে “কালরাত” মনে করে বউ জামাইকে আলাদা ঘরে রাখে।
ঃসমাপ্তঃ
