পকেটমার আফছানা খানম অথৈ

0

পকেটমার

আফছানা খানম অথৈ

নাজিম মোল্লা দিন মজুর, খেতে খামারে কাজ করে।সকল প্রকার কাজে সে অভ্যস্ত,সিজন অনুযায়ী যে কোন প্রকার কাজ করে থাকে।নিজ গ্রামে ফলন লাগানো শেষ,এখন আপাতত ফ্রি।গরীব মানুষ বসে থাকলে সংসার চলবে না।তাই মাটি কাটার কন্ট্রাকটারের সঙ্গে অন্য জেলাতে কাজ করতে গেল।নাজিম মোল্লা মধ্য বয়সী,ছেলে মেয়ে বিয়ে দেয়া শেষ।ছেলেরা বউ নিয়ে আলাদা থাকেন,মা-বাবার তেমন একটা কেয়ার করেন না।তাই নাজিম মোল্লাকে এ বয়সে সংসার চালানোর জন্য কাজ করতে হচ্ছে।কিছু দিন পার হলো,নাজিম মোল্লা কন্ট্রাকটারকে বলল,
কন্ট্রাকটার সাব টাকা কিছু দেয়ন লাগব।
কন্টাকটার রেগে উঠে বলল,
কাম শেষ না অইতে আমি টাকা দিবার পারুম না।
কিন কন কন্ট্রাকটার সাব বাড়িতে বউ’র লাইগ্যা টাকা পাঠান লাগব না।
কি মুশকিলের কথা আমি বিল না পাইতে টাকা দুমু কেমনে।
তাই বইলা আমার বউ না খাইয়া থাকব।
আমি ওসব হুনবার চাইনা।এখন মন দিয়া কাম কর।
নাজিম মোল্লা আর কিছু বলল না,কাজে লেগে গেল।এমন সময় বউ কল করলো।নাজিম মোল্লা রিসিভ করে বলে,
হ্যালো বউ কেন আছ?
আমি বালা আছি।আপনে বালা আছেন তো?
হু বউ বালা আছি।
তই হুনেন।
হু কও।
আমাগো কিস্তির টাকার সময় অইছে।টাকা পাঠান না ক্যান?
বউ হুন।
জে কন।
কন্ট্রাকটার এহনো টাকা দেয় নাই।
তই আমি এহন কি করমু?
বউ হুন কারো কাছ থেইক্যা কর্জ লইয়া কিস্তির টাকা দেও।কয় দিন পর আমি টাকা পাঠামু,তারপর শোধ কইরা দিও।
ঠিক আছে এহন রাখেন।
কল কেটে দিয়ে নাজিম মোল্লার স্ত্রী আয়েশা বেগম ছুটে গেল সুদের ব্যবসায়ী কামরুজ্জামানের কাছে।তিনি সরাসরি সুদের ব্যবসা করেন,শতকরা বিশ পার্সেন্ট।তাকে দেখা মাত্রই কামরুজ্জামান বলল,
আফা কি মনে কইরা আইছেন?
ভাই বিপদে পইড়া আইছি।
কন কি বিপদ।
আমাগো কিস্তির টাকা দেয়ন লাগব।কাউসারের বাবা এহনো টাকা পাঠাই নাই।আমারে এক হাজার টাকা দেয়ন লাগব।
কামরুজ্জামান আর অমত করলো না।আর করবে বা কেন সেতো এ সমস্ত লোকদের সঙ্গে সুদের কারবার করে।তাই এক হাজার টাকা আয়েশা বেগমের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে বলল,
আফা সময় মতন সুদের টাকা দিয়া যাইবেন।
ঠিক আছে ভাই দিয়া যামুনে।
কামরুজ্জামানের কাছ থেকে টাকা এনে আয়েশা বেগম কিস্তির টাকা শোধ করলেন।এদিকে নাজিম মোল্লার একমাত্র মেয়ে সাফিয়াকে জামাই যৌতুকের জন্য পিটিয়ে বাবার বাড়ি পাটিয়ে দিয়েছে।মা আয়েশা বেগম মেয়েকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে বলে,
মা তোর এই অবস্থা অইছে ক্যান,তোর গায়ে রক্ত ক্যান?
মেয়ে সাফিয়া কেঁদে কেঁদে বলে,
মা আপনের জামাই আমারে মারছে।
কেনরে মা?
ট্যাকার লাইগ্যা।
কেনরে বিয়ার সময় যেই টেকা দেয়নের কথা সবতো দিয়া দিছি।এহন আবার কিসের টেকা…।
এই কথা কে কইব মা,তার এক কথা আমারে টেকা আর ও দেয়ন লাগব।নইলে সে আমারে তালাক দিব কইয়া দিছে।
কস কি মা তোর শ্বাশুড়ি কিছু কই নাই।
কি যে কও মা উনিতো ছেলেরা উসকাইয়া দেন আর ও টেকা চাওনের লাইগ্যা।
মারে মাইয়্যারা জনম দুঃখী,তাগো মনে আয় এই দুঃখ কোন দিন যাইব না।
মা আমি আর এই বেড়ার ঘরে যামু না।
কেনরে মা?
কেন আবার যে বেড়া কাম কইরা বউরে খাওয়াইবার পারে না,ভিখারীর মতন বারবার টেকা দাবী করে তার ঘরে আমি আর যামু না।
মারে মাইয়্যারা কখনো বাবার ঘরে চিরকাল থাকবার পারে না।স্বামীর ঘর অইল গিয়া তাগো আপন ঠিকানা।
মা তাই বইলা আমি এই অমানষের ঘরে যামু।
মারে বেড়াগো স্বভাবটা এই রহম সব সময় মাইয়াগোরে বাঁকা চোহে দেহে,ছোট ভাবে।
মা তবু ও আমি ওর ঘরে যামু না।
মারে আমরা গরীব মানুষ,কত কষ্ট কইরা দার দেনা কইরা একবার তরে বিয়ে দিছি।এই ঘর থেইক্যা চইলা আইলে আমরা কি পারমু তরে আবার বিয়া দিতে।তাছাড়া এত টেকা পামু কই।
মা আমি আর কোন বেড়ার ঘরে যামু না।তবুও তোমরা আমারে এই বেড়ার ঘরে যাইতে কইয়ো না।
মারে মাইয়ারা কখনো একা থাকবার পারে না।তাছাড়া এখনো তুই পোয়াতি হস নাই।এই বয়সে কেউ স্বামী ছাড়া থাকবার পারে না।তোর বাবা আসুক সমাজি লইয়া বিচার ডাইকা তারপর তোকে দুমুনে।
মেয়েকে কোন রকম বুঝিয়ে মা শান্ত করলো।এর ফাঁকে কেটে গেল কয়েক দিন।নাজিম মোল্লা বিকাশে টাকা পাঠিয়ে বলল,
হ্যালো বউ,শামিমের বিকাশে টাকা পাঠাইছি,তুইলা নিও। আয়েশা বেগম কোন কিছু না বলতে নাজিম মোল্লা ফোন কেটে দেয়।আয়েশা বেগম শামিমের বিকাশ থেকে টাকা তুলে এনে কামরুজ্জামানের সুদের টাকা দিলো।আর বাকী টাকা দিয়ে মেয়ের জন্য ঔষধ পথ্য ও চাল ডাল যাবতীয় সদাই করলো।মেয়েকে নিয়ে কোনমতে আছে আয়েশা বেগম।এদিকে সাফিয়ার স্বামী নাছোড় বান্দা বউকে মেরে ও শান্তি নেই,তার টাকা চাই…।সে লোক মারফত খবর পাঠালো টাকা না দিলে সে সাফিয়াকে তালাক দিয়ে অন্যত্র বিয়ে করবে।কথাটা শুনা মাত্রই আয়েশা বেগমের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।সে অনুনয় বিনয় করে বলে,
বাবা জাকির এমন কড়া কথা কইয়ো না। গুনা অইব, আমাগোরে আর কটা দিন সময় দাও।যেমন কইরা হোক টেকার ব্যবস্থা করমু।
জামাইকে কোন রকম বুঝিয়ে আপাতত শান্ত করলেন,এবং নাজিম মোল্লাকে সব কিছু বুঝিয়ে বললেন।সব কথা শুনার পর নাজিম মোল্লা বলল,
বউ চিন্তা কইরো না,জামাইরে বুঝাইয়া কইও আমি কাম শেষে টেকা নিয়া আহি,তারপর জামাইরে দুমুনে।
ঠিক আছে কমুনে আপনে এহন রাখেন।
ফোন রেখে নাজিম মোল্লা কাজে মন দিলো।দীর্ঘ কয়েক মাস পর মাটি কাটার কাজ শেষ হলো। কন্ট্রাকটার সকল শ্রমিকের পারিশ্রমিক হিসেব নিকেশ করে দিয়ে দিলেন।টাকা নিয়ে নাজিম মোল্লা রওয়ানা দিলো।গাড়ি ষ্টেশনে দাঁড়ালো।টিকেট কাউন্টার থেকে টিকেট সংগ্রহ করে ষ্টেশনের একটা বেঞ্চিতে এসে বসলো।তার উপর নজর পড়লো এক পকেটমার’র। সে আস্তে করে এসে নাজিম মোল্লার পাশে বসলো।আচমকা বলল,
ভাইজান কেমন আছেন?
নাজিম মোল্লা তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
তুমি কে ভাই তোমারে তো চিনবার পারলাম না।
ভাই আমারে চিনবেন না,আমি আপনার আরেক ভাই।
এ কথা বলে পকেটমার কেঁদে উঠল।
নাজিম মোল্লা শান্তনার স্বরে বলল,
ভাই কান্দ ক্যান তোমার কি অইছে?
সে কাঁদে আর ও কাঁদে, কেঁদে কেঁদে বলে,
ভাইজান আমার মা-বাবা ছোট বেলা মারা গেছে।আমি খুব অসহায়।আমরা দুভাই ছিলাম।আমার বড় ভাই দেখতে হুবাহুব আপনার মতো ছিল।মাত্র দুদিনের জ্বরে সে মারা গেল।এখন এ জগতে আমার আর কেউ রইল না উঁঃ উঁঃ উঁঃ…।
ভাইজান আপনাকে দেখতে হুবাহুব আমার ভাইয়ের মতো লাগে,তাই ভাই বলে ডাকলাম।চলুন না আমাদের বাড়িতে।
নাজিম মোল্লা সত্যবাদী,সহজ সরল স্বভাবের মানুষ।তাই অপরিচিত হওয়া সত্বে লোকটার সব কথা সে বিশ্বাস করে বলল,
ভাই কাইন্দ না সবাইকে একদিন মরতে অইব। আমি এহন যাইবার পারুম না দেশে যামুনে।আবার আইলে তোমার বাড়ি থেইক্যা বেড়াইয়া আহুমনে।
ঠিক আছে ভাই আমি এখন যাই।
পকেটমার যাবার বেলায় নাজিম মোল্লাকে জড়িয়ে ধরে বুকে বুক লাগিয়ে কোলাকুলি করলো আর এই সুযোগে তার পকেটের সব টাকা হাতিয়ে নিলো।বাড়ি ফিরে নাজিম মোল্লা বউকে টাকা দিতে পকেটে হাত দিলো।পকেট শূন্য এক টাকা ও নেই।সে ভাবনায় পড়লো তার টাকা কোথায় গেল।অনেক ভাবনার পর তার মনে হলো সেই লোকটার কথা।তখনি বউ বলল,
ওগো এমন কইরা ছাইয়া আছে ক্যান,টেকা কই,আয়েশার জামাইরে টাকা দেয়ন লাগব না।
নাজিম মোল্লা কেঁদে উঠে বলে,
বউ আমার সব শেষ, সব টেকা পকেটমার নিয়া গেছে।আয়েশা বেগম ও থেমে থাকল না কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।এমনি ভাবে দিন মজুর নাজিম মোল্লা “পকেটমার’র” পাল্লায় পড়ে সর্বহারা হলো।
ঃসমাপ্তঃ


56
বিজ্ঞাপনঃ মিসির আলি সমগ্র ১: ১০০০ টাকা(১৪% ছাড়ে ৮৬০)

0

Afsana Khanam

Author: Afsana Khanam

লেখক

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

সুপুরুষ ও কাপুরুষ

ছেলেবেলায় ভালো পড়াশোনায় ছিলো সুমন। তাই এমনিতেই মহিলা মহলের প্রিয় ছিলো সমুন। কিন্তু আজকাল , সুমন পাড়ায় জিমে ঘাম ঝরাচ্ছে।

আমায় দুঃখ দাও আমায় কষ্ট দাও

তুমি আমার সাথে মিথ্যা ভালোবাসার খেলা খেলছ। জানি আমি, এতে তুমি আনন্দে আছ, তবু আমি তোমায় কিছুই বলি না। কারণ

উদঘাটন

উদঘাটন      ❝সেদিনের পর থেকে আজও চিন্তিত থাকে সুকান্ত। সে কোনোদিনও সেই স্মৃতি ভুলতে পারবেনা❞ রহস্য আর রহস্যময় মানুষ

Leave a Reply