পরাজিত প্রেমিক
আফছানা খানম অথৈ
কাফি সবেমাত্র ডিগ্রী শেষ করেছে।এখনো চাকরী হয়নি।সে পায়েল নামের এক মেয়ের সঙ্গে ভালোবসার সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।পায়েলেরও ইন্টার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে।বাবা এবার মেয়ের বিয়ে দেয়ার জন্য তোরজোড় শুরু..।
পায়েল বিষয়টা কাফিকে জানায়।কাফি ঘটক মারফত পায়েলের বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়।পায়েলের বাবার এক কথা বেকার ছেলের সঙ্গে কখনো মেয়ে বিয়ে দেবে না।কাফি পায়েলের বাবাকে প্রতিশ্রুতি দেয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে তার মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে। তিনি যেন সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করেন।পায়েলের বাবা রাজী হোন।এরপর থেকে শুরু হয় তার ক্যারিয়ার গড়ার সংগ্রাম।চাকরীর জন্য চেষ্টা করে শেষে ব্যর্থ হয়ে সে চলে যাই দক্ষিণ আফ্রিকায়।
এদিকে ঘটে যায় আরেক দুর্ঘটনা। পায়েলের বাবা হঠাৎ অফিসে স্ট্রোক করে।তাকে দ্রুত গতিতে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।ডাক্তারি চিকিৎসায় তিনি মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠলেও উনার এক হাত এক পা অবশ হয়ে যাই।তিনি আর হাঠতে পারেন না।অতএব উনাদের পরিবারে এখন দু:খের বন্যা বয়ে চলেছে।পায়েলের বাবা আমজাদ রহমান এখন আর অফিস করতে পারছেন না।তাদের পরিবারে এখন আর কোন আয় রোজগার নেই।খুব কষ্টে তারা দিন গুরজান করছেন।তাদের এই বিপদের দিনে পাশে দাঁড়ানোর কেউ যখন ছিলোনা,তখন একমাত্র কাফি তাদের পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলো।প্রতি মাসে টাকা পাঠাত আর সেই টাকায় চলতো পায়েলের বাবার ঔষধ পথ্য আর পরিবারের ভরন পোষণ।এমনি ভাবে কেটে গেল বছর দুয়েক।দূ’পরিবারের মাঝে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠল।পায়েল ও কাফির বাবা-মা বিয়ের কথা পাকা করে পেলেন।কাফি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরলে বিয়ে হবে।দু’পরিবারে বিয়ের আনন্দে বয়ে চলেছে।
এদিকে কাফি বিয়ের কেনাকাটা করতে মার্কেটে যাই।যাওয়ার পথে তাকে এট্যাক করে কিছু হাইজাকার।
তার সঙ্গে থাকা সব টাকা ছিনতাই করে নিয়ে যাই হাইজাকার।কাফি কি করবে না করবে ভেবে পাচ্ছে না।এদিকে বিয়ের দিন তারিখ ও ঠিক হয়ে গেছে।টাকা ছাড়া বিয়ের কেনাকাটা করবে কিভাবে।তবে কি পায়েলকে হারাতে হবে।কথাটা ভাবতে তার মাথায় সপ্ত আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।সে চিৎকার করে বলে,
না না আমি পায়েলকে ছাড়া বাঁচব না।যেমন করে হোক বিয়ের কেনাকাটা করতে হবেই।সে সাহস করে হাইজাকারের পিছু নিলো।হঠাৎ ঝোপ বুঝে কোপ মারলো।ওদের হাতের পিস্তল কেড়ে নিয়ে তাক করলো,তারপর টাকা নিয়ে কেটে পড়লো।হাইজাকার শত চেষ্টা করেও তাকে ধরতে পারলো না।
সে কোনমতে বাসায় পৌছল।তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়ের কেনাকাটা করলো।এবার দেশে ফেরার পালা,কিভাবে ফিরবে সেটা হলো চিন্তার বিষয়।কোনমতে যদি হাইজাকারের সামনে পড়ে তাহলে রক্ষা নেই,নির্ঘাত মৃত্যু।কিন্তু উপায়।
তার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো।সে বলল,
দোস্ত কী খবর?
আর বলিস না। খুব বিপদে আছি।
বলিস কী!
হ্যাঁ দোস্ত।
বলতো কী হয়েছে?
কাফি আর দেরী করলো না।ঘটে যাওয়া ঘটনা তার কাছে প্রকাশ করলো।তারপর বন্ধু বলল,
দোস্ত চিন্তা করিস না।আমি তোকে বিমান বন্ধরে পৌছে দেব।
বলতে না বলতে কাফির ফোনে রিং বেজে উঠল।তখনি বন্ধু বলল,
দোস্ত কার ফোন?
আমার প্রাণ প্রিয়া পায়েল।
ঠিক আছে,আমি এখন চলি।পরে কথা হবে।
বন্ধু বিদায় নিলো।কাফি ফোন রিসিভ করে বলে,
হ্যালো জান কি করছ?
কি আর করবো,তোমার কথা ভাবছি।তুমি কবে আসছ?
এই তো আগামী সপ্তাহে।
সত্যি বলছ তো?
হুম সত্যি?
বেশি দেরী করো না।তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।
আমার ওতো তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
তাহতে আসি আসি করেও আসছ না কেনো?
কি করব জান,বিদেশ বলে কথা। আসি বললেতো আর আসা যায়না।
তাই বলে এত বছর থাকবে।
লক্ষিটি টেনশন করো না বিয়ের পর দেরী করব না।ঘন ঘন আসব।
এমন কথা সবাই বলে।কিন্তু বিয়ের পর খবর থাকে না।পরনারী নিয়ে রঙ্গলীলা করে।
আমি সবার মতো না।কারণ আমি তোমাকে বড্ড বেশি ভালোবাসি।তুমি ছাড়া অন্য কোন নারীর দিকে আমি কখনো তাকাইনি।বিয়ের পর ও তাকাব না।
কথাটা মনে থাকলে তো?
থাকবে।একশ বার থাকবে।হাজার বার থাকবে।
সত্যি?
সত্যি সত্যি তিন সত্যি।
ঠিক আছে।এখন রাখি।গুড নাইট।ভালো থেকো।
সপ্তাহ পার হতে কাফি বন্ধুকে নিয়ে রওয়ানা করলো।গাড়ি কিছু দূর রানিং’র পর আবার হাইজাকার এট্যাক করলো।একে একে সকল যাত্রীকে চিনতাই করা হলো।এবার কাফির পালা, কাফির মাথায় ক্যাফ থাকাতে তারা প্রথমে চিনতে পারলো না।পরে ক্যাফ সরাতে ঠিক চিনে ফেলল।তখনি হাইজাকার বলল,
শালা সেদিন আমাদেরকে বোকা বানিয়ে পালিয়ে গেলি।আজ তোর রক্ষা নেই।মেরে ফেলব।বের হও।
জামার কলার ধরে কাফিকে নিয়ে যেতে প্রস্তুত হলো।তখনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলো পুলিশ।হাইজাকার পালিয়ে গেল।কাফি প্রাণ রক্ষা পেলে।সে সময় মতো বাংলাদেশে ফিরল।বিমান বন্ধরে নামতেই ফেসবুক দেখল এক লোক হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে।তার জন্য রক্তের প্রয়োজন। এই মহুর্তে রক্ত না দিলে তাকে বাঁচানো যাবে না।কিন্তু তার গ্রুপের রক্ত কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।কাফির সঙ্গে তার রক্তের গ্রুপ মিলে গেল।সে ছুটে গেল তাকে রক্ত দিতে।তার দেয়া রক্তে প্রাণ ফিরে পেল সেই ছেলেটি।ছেলেটির বাবার সঙ্গে তার অনেক কথা হলো।আফ্রিকায় ঘটে যাওয়া ঘটনা তিনি তার কাছে প্রকাশ করলেন।সব কথা শোনার পর,ছেলেটির বাবা বলল,
তুমি আর আফ্রিকা যাবে না?
জ্বি না।
কেনো কেনো?
আফ্রিকায় বাঙালির নিরাপত্তা নেই।সব সময় হাইজাকার পেছনে লেগে থাকে।তাছাড়া ওদের সাথে আমার মনোমালিন্য হয়েছে।এখন ওরা আমাকে ফেলে ঠিক মেরে ফেলবে।
সত্যি বলছতো?
জ্বি চাচা সত্যি।চলি চাচা। ভালো থাকবেন।
হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে সে বাসায় পৌছল।তারপর ছুটে গেল পায়েলের কাছে।
পায়েল সদর দরজায় কাফিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
I love you জান।কেমন আছে?
কাফি পায়েলকে জড়িয়ে ধরে বলল,
আহামদুলিল্লাহ জান ভালো আছি।আজ আমি অনেক সুখী।
এত সুখী হওয়ার মানে।
আমার ভালোবাসার পাখি আজ আমাকে জড়িয়ে ধরে “আই লাভ ইয়ু” বলেছে।আমার আর কোন টেনশন নেই।আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।
আমিও তোমাকে পেয়ে অনেক সুখী।চলো ভিতরে চলো।
কাফিকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো।পায়েল খুব যত্ন করে তাকে খাওয়াল।তারপর সে বাসায় ফিরে গেল।
এর ফাঁকে পায়েলের বাবা মেয়ের বিয়ে অন্য জাগায় ঠিক করে ফেলল।পায়েল প্রথমে রাজী না হলেও পরে ঠিক রাজী হয়ে গেল।
এদিক কাফি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল,তার ডায়রিয়া খুব সিরিয়াস।তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো।দ্রুত গতিতে চিকিৎসা শুরু…।
প্রায় সাত দিন হয়ে গেল।পায়েল তাকে দেখতে আসল না,ফোন ও করলো না।কাফি প্রায় সুস্থ এমন সময় পায়েলের বাবা হাসপাতালে অবস্থান করলো।আস্তে করে কাফির পাশে গিয়ে বসল।তারপর বলল,
কাফি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।
জ্বি বলুন।
ইয়ে মানে…।
মানে মানে করছেন কেনো সরাসরি বলুন।
না মানে তোমার সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে হবে না।
কি বলছেন এই সব,আমার মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন,বন্ধু-বান্ধব সবাই জানে আপনার মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে।এখন বলছেন বিয়ে হবে না।এর মানে কী.?
মানে হলো প্রবাসী পুরুষের সঙ্গে আমি মেয়ে বিয়ে দেব না।
একথাটা আরও আগে বললেতো পারতেন।এখন বলছেন কেনো?
কাফি আমি এতকিছু বুঝিনা।শুধু এটুকু বলব,তোমার সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে হবে না।তাছাড়া পায়েল ও রাজী না।
সত্যি বলছেন তো।
হ্যাঁ সত্যি।বাকীটা ওর মুখ থেকে শুন।
বাবা চলে গেল।মেয়ে তার পাশে এসে বসল।তখনি কাফি বলল,
পায়েল তোমার বাবা যা বলেছে তা কি সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
তার মানে তুমি আমাকে বিয়ে করবে না।
না করব না।
কারণ কী?
কারণ প্রবাসী পুরুষ আমার পছন্দ না।
তাহলে এতদিন ভালোবাসার অভিনয় করলে কেনো?মিথ্যে আশ্বাস দিলে কেনো?
আমি এত কৈফিয়ৎ দিতে পারব না।শুধু এটুকু বলব,তোমার সাথে আমার বিয়ে হবে না।চলি ভালো থেকো।
পায়েল বিদায় নিলো।কাফি তার গতিপথ লক্ষ্য করে তাকিয়ে রইল।শেষ বারের মতো ভালো করে দেখে নিলো।
এদিকে ধুমধাম করে পায়েলের বিয়ে হয়ে গেল।সে শ্বশুর বাড়িতে চলে গেল।
পায়েলকে ছাড়া কাফির জীবন শুন্য। এখানে থাকলে সে পায়েলকে ভুলতে পারবে না।বারবার তাকে মনে পড়বে।তাই সে ফের আফ্রিকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। যাওয়ার পথে বিমানবন্দরে নামতেই তার কাছাকাছি এসে একটা ছেলে বলল,
ভাইয়া কেমন আছেন?
আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।তোমাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।তুমি কে?
আমি সেই ছেলে যাকে আপনি রক্ত দিয়ে বাঁচিয়েছিলেন।
বাঁচানোর মালীক একমাত্র আল্লাহ।আমি উছিলামাত্র।
তবুও আমি আপনার কাছে ঋনি হয়ে গেলাম।
আমাকে চিনলে কি করে?
আব্বু আপনার একটা ছবি তুলে রেখেছিল।
তোমার পাশে উনি কে?
আমার স্ত্রী।পায়েল ভাইয়াকে সালাম দাও।
পায়েল কাফিকে সালাম দিলো।নতুন করে কাফির সাথে পায়েলের পরিচয় হলো।এই পায়েল অন্য কেউ না,কাফির ভালোবাসার মানুষ।যা দেখে সে চমকে উঠল।গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল।লজ্জায় পায়েল মাথা নিচু করে নিলো।
পরক্ষণে সেই ছেলেটি বলল,
ভাইয়া একটা কথা বলব?
হ্যাঁ বল।
আব্বু বলেছে আপনি আর আফ্রিকা যাবেন না।এখন চলে যাচ্ছেন কেনো?
যার জন্য দেশে ফেরা সে আমাকে ভুলে গেছে।তাই চলে।যাচ্ছি।
মানে।
মানে হলো আমি একজনকে ভালোবাসতাম।তার সাথে পাঁচ বছরের সম্পর্ক।এখন সে আমাকে ভুলে অন্যত্র বিয়ে করেছে।তাই চলে যাচ্ছি।
আব্বু বলেছে ওখানে নাকি আপনার খুব বিপদ।ওরা যদি আপনাকে মেরে ফেলে?
সমস্যা নেই,যেখানে আমার ভালোবাসার মানুষ নেই,বেঁচে থাকার ঠিকানা নেই,সেখানে বেঁচে থেকে কি লাভ।তাই মরার জন্য আমি ওখানে যাচ্ছি।কারণ আমি এক “পরাজিত প্রেমিক”।
তাই বলে নিজেকে এভাবে শেষ করে দেবেন?
আর কোন উপায় নেই যে ভালোবাসা ভুলতে পারছি না।চলি খোদা হাফেজ।
ঃসমাপ্তঃ
