গল্প পরী আফছানা খানম অথৈ

0

পরী

আফছানা খানম অথৈ

পনেরো ষোলো বছরের টগবগে যুবক করিম টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত।বাবা রিক্সা চালক মা গৃহিণী।দুজন অন্ধকার জগতের বাসিন্দা মানে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারে আছন্ন।তাই ছেলেকে ডাক্তারের কাছে না নিয়ে গ্রাম্য ভাষায় যাকে খনকার ও গুনিন বলে ডাকে তার কাছে নিয়ে গেল।গুনিন ও খনকার বলতে বুঝানো হয়েছে যারা ঝাড় ফুঁক তাবিজ কবজ তেলপড়া পানিপড়া ইত্যাদি দেয় এদেরকে।করিমের বাবা তাকে এমন একজন গুনিনের কাছে নিয়ে গেলেন,রোগী দেখে গুনিন বলল,
রবিয়ল ভাই আপনার পোলার গায়ে পেতনির আছর লাগছে।বড় খারাপ্যা পেতনি তাই ছেলেরে কাবু কইরা পালাইছে।
কথাটা শুনামাত্রই রবিয়ল হোসেনের হৃদকম্প শুরু হয়ে গেল।তিনি খুব কাতর হয়ে বলেন,
গুনিন ভাই যেমন করে হোক আমার পোলারে বালা কইরা দেন।
গুনিন মাথা নেড়ে সাঁই দিলো,
হুম করমু, তই কিছু জিনিসপত্র লাগব।
গুনিন ভাই কন কি জিনিস আনতে অইব?
একটা তেতুলের ডাল,এক শিশি সরিষার তেল,এক গ্লাস পানি।
বলতে না বলতে রবিয়ল হোসেন এসব এনে গুনিনের সামনে দিলো।
এবার গুনিন করিমের কনিষ্ঠা আঙুল চেপে ধরে তেতুলের ডাল হাতে নিয়ে বলে,
বল তুই কোত্থেকে আইছস,এক্ষণি চইলা যা তানা অইলে মেরে কাবু করে এই বোতলে ঢুকামু।
লাঠি দেখে করিম ভয় পেয়ে গেল। তাই কেঁদে কেঁদে বলে,
আমারে মাইরেন না,আমি কিছু করি নাই।
এবার গুনিন তেতুলের ডাল দিয়ে মাটির মধ্যে কষে এক বাড়ি দিয়ে বলল,
তুই মিছা কইতাছস, সত্য কইরা কও কোন হানতেন আইছস।তানা অইলে এই বেত দিয়া কইষ্যা বাড়ি দুমু।
করিম আবার বলল,
আমারে মাইরেন না,আমারে ছাইরা দেন।আমি চইলা যামু।
এবার গুনিন বলল,
রবিয়ল ভাই আর কোন চিন্তা নাই।চইল্যা যাইব কইছে।
গুনিন ভাই তাই যেন অয়।
এবার গুনিন ঠোঁট দুটো নেড়ে ছেড়ে বিড়বিড় করে কি সব পড়ে করিমের গায়ে কয়েকবার ফুঁ দিলো।তারপর তেলপড়া পানিপড়া তাবিজ কবজ এসব করিমের বাবার হাতে দিয়ে বলল,
রবিয়ল ভাই এসব ভালো মতন ব্যবহার কইরেন।তানা অইলে পেত্নী আবার লগ্নি অইয়্যা যাইব।
করিমের বাবা গুনিনকে জিজ্ঞাসা করলো,
গুনিন ভাই আপনাকে কত ট্যাকা দেওন লাগবো।
রবিয়ল ভাই আপনার কাছেরতন বেশি কেমনে চাই কন।আপনে আমার খাতিল্যা মানুষ।তই বেশি দেওন লাগবো না,এক হাজার ট্যাকা দিলে চলবো।
করিমের বাবা আর কোন কথা না বলে টাকা দিয়ে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন।
গুনিনের দেয়া ঔষধ ঠিকমতো ব্যবহারের পরও রোগের কোন পরিবর্তন হলো না।বরং করিমের জ্বর আর ও বেড়ে গেল।সে আলা বোলা হয়ে আবল তাবল কথাবার্তা বলছে।মা-বাবা কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর না দিয়ে চোখ দুটো লালে লাল করে আপন মনে কথাবার্তা বলে চলেছে আবার মাঝে মাঝে খিলখিল করে হাসছে।পাড়া প্রতিবেশিরা এক গতিতে তাকে দেখতে আসছে।সবাই জড়ো হয়ে তার কথা শুনছে।কেউ কেউ বলছে, ওর কাছে যাইওনা,পেত্নী আবার তোমাগোরে আছর করবো,এভাবে একে অপরকে হুশিয়ারী সংকেত দিচ্ছে।
করিমের বাবা ছেলের অবস্থা খারাপ দেখে আবার ছুটে গেল গুনিনের কাছে।গুনিন আবার ও একটা তাবিজ তেলপড়া,পানিপড়া দিয়ে বললেন,
রবিয়ল ভাই বড় খারাপ্যা পেত্নী তাই আবার লগ্নি অইছ।যাইতে সময় লাগবো।এ গুলান ঠিক মতন ব্যবহার কইরেন।ঠিক অইয়া যাইব।
করিমের বাবা এগুলো এনে গুনিনের নিয়ম অনুযায়ী ব্যবহার করার জন্য বউকে বললেন।
করিমের মা ছেলের হাতে তাবিজ বেঁধে দিলেন।তারপর তেলপড়া পানিপড়া নিয়ম অনুযায়ী ব্যবহার করতে শুরু করলেন।
কিন্তু কিছুতে কিছু হচ্ছে না।করিমের অবস্থা আর ও খারাপের দিকে গেল।ট্রাইফয়েড জ্বরের কারণে তার মেন্টাল সমস্যা দেখা দিলো।সে পাগলের মতো প্রলাপ বকতে বকতে ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড়াতে শুরু করলো।তার বাবা সহ কয়েক জন মিলে তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল। করিমের মা-বাবা দুজনে খুব চিন্তায় পড়লেন।ভালো গুনিন কোথায় পাবেন এই নিয়ে সবাই জল্পনা কল্পনা…।
এমন সময় করিমের মামা বলল,
দুলাভাই হুনলাম শ্যাম নগর গেরামে নাকি এক্কান বালা গুনিন আছে।বেবাক লোক বালা অইছে। খুব বালা গুনিন সবাই তারে পরী বইলা ডাকে।তিনি নাকি পরীর সাধক।আপনে করিমরে ওর কাছে লইয়া যান।
করিমের বাবা আর দেরী করলো না ছেলেকে নিয়ে গুনিন পরীর বাড়িতে অবস্থান করলো।
পরীর আসল নাম অলি উল্লাহ।পরী নামে সে সবার কাছে পরিচিত।এই পরী নামের একটা আষাঢ়ে গল্প সে সে সবার কাছে প্রকাশ করলো।আর লোক জন তা বিশ্বাস করে তাকে খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করতে শুরু করলো।এই আষাঢে গল্পটা হলো,
একদিন ভর দুপুরে অলি উল্যাহ বিলের ধারে কাজ করতে গিয়েছিল।হঠাৎ শোঁ শোঁ শব্দ করে একদল পরী এসে তার সামনে দাঁড়ালো।তাকে ভদ্রভাবে সালাম দিলো।তারপর তাদের পাখায় করে তাকে তাদের দেশে নিয়ে গেল।খুব খাতির যত্ন করলো।সোনার পালংকে শোয়াল,রুপার থালাতে খেতে দিলো।কত রকমের ফল ফলাদি যা আমাদের এখানে নেই,সে সব ফল ফলাদি তাকে খাওয়াল।অলি উল্যার যত্নের কোন ত্রুটি হলো না।সে খাচ্ছে দাচ্ছে আর সোনার পালংকে আরামে ঘুমাচ্ছে।কোন এক ফাঁকে মাস খানেক কেটে গেল।পরীর দল তাকে মুনিব বলে মেনে নিলো।তারপর অনেক তন্ত্র-মন্ত্র শিখিয়ে দিলো।শুধু তাই নয় কিছু ঔষধ ও দিলো।একদিন অলি উল্যাহ বলল,
আমি আপনাদের দেশে আর থাকুম না।আমার পোলা মাইয়ার লাইগ্যা মন কাঁনতাছে,আমারে আমার দেশে দিয়া আহেন।
পরীর সর্দার বলল,
ঠিক আছে যান।তো আমাদের দেয়া তন্ত্রমন্ত্র ঔষধ ঠিকমতো মানুষকে দিবে।তানা হলে তোমার ক্ষতি হবে।যখনি কোন সমস্যায় পড়বে আমাদেরকে ডাকবে আমরা ঔষধ নিয়ে হাজির হবো।
ঠিক আছে আমি রাজী।এহন আমারে আমার দেশে দিয়া আহেন।
পরীর সর্দার পাখায় করে তাকে তার দেশে ফিরিয়ে দিয়ে গেল।
এরপর থেকে সে মেয়েদের মতো লম্বা চুল রাখল।দাঁড়ি গোঁফ যেভাবে আছে সেভাবে বড় হচ্ছে, কখনো কাটাকুটা করছে না।মাথায় জটলা উকুন ভরা,দাঁড়ি গোঁফে মুখ ভর্তি,সাদা পাঞ্চাবি সাদা লুঙি পরে পরীর বেশে থাকে সব সময়।লোক সমাজে তার তেমন একটা মেলামেশা নেই।দোকান পাটে ও তেমন একটা বসেন না।বাড়িতে বসে বসে পরীর বেশে গুনিন ঘিরি করেন।রোগীর ও তার অভাব নেই। প্রায় দিন বাড়িভর্তি থাকে লোকজন।
আজ রবিয়ল হোসেন তার ছেলেকে নিয়ে এলো সে গুনিন পরীর বাড়িতে।এসে দেখে রোগীর লম্বা একটা লাইন।কোন রকমে সিরিয়াল কেটে করিমের বাবা ভিতরে গেল।গুনিন পরী তেমন একটা কথা বলে না।প্রয়োজন হলে দু’চারটা বলে,এর ব্যতিরেকে না।করিমকে দেখলেন,তারপর করিমের বাবা বলল,
পরী ভাই আমার পোলার কি অইছে?
আপনার পোলার কঠিন বেরাম অইছে।খুব খারাপ্যা পরী রক্তের লগে মিশ্যা গেছে।ছাড়াইতে কষ্ট অইব।তাও যাই কিনা ঠিক কইবার পারছি না।
এমন কঠিন কথা শুনে করিমের বাবা ঘাবড়ে গেল।তিনি কাতর স্বরে বলেন,
পরী ভাই যেমন করে হোক আমার পোলারে বালা কইরা দেন।
ঠিক আছে চেষ্টা কইরা দেখবার পারি।তই খরচ একটুু বেশি লাগবো।
পরী ভাই কত ট্যাকা লাগবো?
তুমি গরিব মানুষ বেশি টাকা কেমনে চাই।হাজার দশেক দিলে অইব।
পরী ভাই দশ হাজার ক্যান আমার পোলা বালা অইলে আমি আরও বেশি ট্যাকা দুমু।
আপনি আমার পোলারে বালা কইরা দেন।
করিমের বাবার অনুমতি পাওয়া মাত্রই পরী করিমের কনিষ্ঠা আঙুল চেপে ধরে একটা তেতুলের ডাল দিয়ে করিমকে দিলো মাইর।মারে আর বলে,
তুই কোন হান থেইক্যা আইছস কও।যাইবি কিনা কও, তানা অইলে মাইরা শেষ কইরা পালামু।
মারে আর বলে,করিমের গায়েতো কোন পরী নেই জবাব দিবে কে?করিম মারের আঘাত সইতে না পেরে গুনিনকে কষে দিলো ঘুষি।পরী গুনিন ক্ষেপে গেল।তিনি চোখ রাঙিয়ে বললেন,
আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন ক্যান।ওরে কইষ্যা বাইন্দা পালান।দেখতাছেন না কেমন লাপালাপি করতাছে।এমন করলে নষ্ট পরী তাড়ান যাইব না।
সবাই মিলে তাকে বেঁধে ফেলল।এবার পরী মারে আর বলে,
এই নষ্ট পরী আমি তোগো সাধক, যা কইতাছি তাড়াতাড়ি যা,তানা অইলে তোগো বংশ শেষ কইরা পালামু।
মার খেতে খেতে করিম মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।তবুও পরী মারা বন্ধ করলো না।মার খেতে খেতে এক সময় করিম মারা গেল।করিমের বাবা কেঁদে উঠল।পরী বলল,
ভাই কাইন্দ না। নষ্ট পরীতো তাই রোগীরে মাইরা পালাইছে।আমার ট্যাকা দিয়া রোগী লইয়া যাও।এমন সময় পুলিশ এসে ঘটনা স্থলে উপস্থিত হলো এবং সকল সত্য জানতে পারল।আসলে অলি উল্যাহ,ভন্ড ছিট,বাটপার,পরীর দেশে সে কখনো যাইনি।তাছাড়া পরী-টরি কিছুই তার সাথে নেই,আর থাকলে বা কি পরী কি কখনো মানুষের চিকিৎসা করতে পারে,আদৌ না।এসব হলো অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কার।চিকিৎসার নামে মানুষকে ধোকা দেয়া এবং ভুয়া “পরী” সেজে করিমকে মারার অপরাধে অলি উল্যাহকে জেল হাজতে নিয়ে যাওয়া হলো।
ঃসমাপ্তঃ


56
বিজ্ঞাপনঃ মিসির আলি সমগ্র ১: ১০০০ টাকা(১৪% ছাড়ে ৮৬০)

0

Afsana Khanam

Author: Afsana Khanam

লেখক

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

গল্প: অপেক্ষা লেখক:

গল্প: অপেক্ষা লেখক: মো: আবিদ রানা রিমি প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরেই বারান্দায় বসে। তার চোখ সব সময় খোঁজে একটা চেনা

গল্প সিয়ামের স্বপ্ন আফছানা খানম অথৈ

গল্প সিয়ামের স্বপ্ন আফছানা খানম অথৈ দশ বছরের সিয়াম কমলাপুর রেল ষ্টেশন এ থাকে।তার ঘরে খুব অশান্তি। এক মুহুর্তের জন্য

গল্পঃ অনুপমার চোখে ২

গল্পঃ অনুপমার চোখে লেখকঃ বকুল রায়  #Part_02 অনুপমাকে ভালোবেসে ফেলেছি, এটা নিজেকে স্বীকার করলেও তাকে বলার সাহস তখনও হয়নি। কারণ

গল্পঃ অনুপমার চোখে ১

গল্পঃ অনুপমার চোখে লেখকঃ বকুল রায় Part 01 ঢাকার ব্যস্ত সড়কগুলো আমার কাছে সবসময় যেন এক রঙিন ক্যানভাস। ছোটবেলা থেকে

Leave a Reply