সৎ ভাই
আফছানা খানম অথৈ
কাব্যর বয়স যখন সাত বছর তখন তার বাবা-মা দুজনে মারা যায়।এখন আপন বলতে তার আর কেউ নেই।একমাত্র বড় বোন আরিফা এখন তার অবিভাবক।আরিফার মা মারা যাওয়ার পর কাব্যর মাকে বিয়ে করে তার বাবা।কাব্যকে দেখভাল করার দায়িত্ব দেয়া হয় বড় বোন আরিফাকে।কিন্তু সে নিতে নারাজ। তবুও গ্রামবাসী অনেক বুঝিয়ে কাব্যকে তার হাতে তুলে দেয়।অনিচ্ছা সত্বেও সে কাব্যকে তার বাড়িতে নিয়ে যায়।তাকে দেখে তার জামাই বরকত বলল,
কী সর্বনাশ কী সর্বনাশ!এই আপদটা এখানে কেনো?
কেনো কী হয়েছে?
কী হয়নি বলো,ওহ্ বাবা-মা দুজনকে খেয়েছে,এখন এসেছে আমাকে…।
উহু!আমি আর ভাবতে পারছি না।ওকে তাড়াতাড়ি বিদায় কর।ওহ্ এ সংসারে থাকলে অমঙ্গল হবে।তাছাড়া ওকে খাওয়াবে কে?
কে খাওয়াবে মানে,ওহ্ কাজ করে খাবে।
কোথায় কাজ করবে?
কোথায় আবার,আমাদের বাসায়।এমনিতে অন্য লোক কাজ করে।আজ থেকে ওহ্ করবে।
তাই যেন হয়।বসে খাওয়া এ বাড়িতে চলবে না।
বলতে না বলতে কাব্যকে একগাদা কাপড় কাঁচাতে দিলো বোন আরিফা।
এতটুকুন একটা বাচ্চা এতগুলো কাপড় কাঁচাতে গিয়ে খুব হাফিয়ে উঠেছে।তাই পুকুর পাড়ে একটু জিরাতে বসেছে।ক্ষুধায় পেট ছোঁ ছোঁ করছে।বোনের বাড়ি এসেছে,একটু ভালো খেতে দেবে তা না।একগাদা কাপড় কাঁচাতে দিয়েছে।কথাটা ভাবতেই তার চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়লো।কেঁদে কেঁদে বলে,
বাবা-মা আমাকে একা পেলে তোমরা চলে গেলে।আমায় দেখার কেউ রইল না।দুবেলা দুমুটো ভাতের জন্য বোনের বাড়িতে কামলা খাটতে হচ্ছে।
চোখের জলের আর বাঁধ মানল না।অঝর ধারায় ঝরছে।দূর থেকে তা দেখল আরিফার বড় জ্যা আমেনা। আমেনা খুব ভালো দয়াবতী,কারো বিপদ দেখলে এগিয়ে আসে,সাহায্য করে,দান খয়রাত করে।আজও কাব্যর বিপদে এগিয়ে এসে তারপাশে বসল।তারপর মায়ার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল
ভাই তুমি কাঁদছ কেনো?
না কিছু না,এমনি।
এমনি কেউ কাঁদে সত্যি করে বলো,আরিফা তোমাকে বকেছে?
জ্বি না আপু।
তাহলে কাঁদছ কেনো?কাপড় কাঁচাতে কষ্ট হচ্ছে?
জ্বি আপু।
দুপুরে খেয়েছ?
জ্বি না আপু এখনো খাইনি।
আমেনার খুব আফসোস হলো।এতটুকু বাচ্চাকে এমন কামলা খাটাচ্ছে।আরিফার যে টাকা পয়সা কাব্য কেনো আর ও দুচারটা ভাইকে সে দেখভাল করলেও শেষ হবে না।অথচ কাব্যর মতো একটা মাছুম বাচ্চাকে সে খাটাচ্ছে।বিষয়টা তার কাছে খুব খারাপ লাগল।সে তাকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে গেল।তারপর পাশে বসিয়ে ভালোমতো খাইয়ে দিলো।কাব্য খুব খুশি হলো।প্রাণভরে আমেনার জন্য দোয়া করলো।
পরদিন সকাল বেলা কাব্য নাস্তা খেতে বসল।এমন সময় তার ভগ্নিপতির আগমন।সে এসে দেখে কাব্য নাস্তা খাচ্ছে।সে তখনি তার হাত থেকে নাস্তা কেড়ে নিয়ে বলল,
এই হতচ্ছাড়া নাস্তা খাচ্ছিস কেনো?
না মানে আমার ক্ষুধা লেগেছে,তাই…।
তাই খেতে বসেছিস,এইতো।
জ্বি হ্যাঁ।
বলেছি না,এই বাড়িতে যখন তখন খাওয়া যাবে না।যা কাজ কর গিয়ে।
কাব্যকে একগাদা কাজ দিয়ে চলে গেল তার ভগ্নিপতি।ঘরমোছা, তালাবাসন ধোয়া,টয়লেট পরিস্কার ইতাদি।আরিফা এসব দেখেও কিছু বলছে না।কারণ সেও চাই কাব্য তার বাড়িতে কাজের ছেলে হয়ে থাকুক।কাজের বিনিময়ে সে খাবে,তাকে ফ্রি খাওয়াবে কেনো?তাছাড়া সে তার আপন কেউ না,সৎ ভাই।
অনাদর অবহেলায় কেটে চলেছে তার দিনগুলি।প্রতিদিন একগাদা কাজ করছে।তবুও বোন ভগ্নিপতির মন পাচ্ছে না।তারা উঠতে বসতে ভাতের খোটা দিচ্ছে।শুধু তাই নয় এক আধটু ভুল হলে গায়ে হাত তোলে মারধর করে।
একদিন তার হাত থেকে একটা গ্লাস পড়ে ভেঙ্গে যায়।আরিফা ছুটে এসে তার গালে কষে চড় বসিয়ে দিয়ে বলে,
কী সাবধানে ধরতে পারিস না।গ্লাসটা ভেঙে ফেললি।আজ তোকে মেরে…।
আরিফার মেজাজ হাইতে উঠে গেল।সে তাকে খুব মারছে।তার মার সইতে না পেরে সে কেঁদে কেঁদে তার পা ছেপে ধরে বলছে,
আপু ভুল হয়ে গেছে।মাফ করে দাও।আর এমন হবে না।
কথাগুলো বলছে আর মাফ চাচ্ছে।কিন্তু আরিফা থামছে না।তাকে আর ও মারছে।আরিফার বড় জ্যা আমেনা সহ্য করতে পারলো না।সে ছুটে এসে তার হাত চেপে ধরে বলল,
বোন আরিফা অনেক হয়েছে আর নয়।এতটুকুন বাচ্চাকে একটা গ্লাসের জন্য এমন মারধর করছ?
ভাবী তুমি বুঝবে না।ওহ্ একটা কাজ ও ঠিকমতো করতে পারে না।
তা না হয় বুঝলাম।তাই বলে এতটুকুন বাচ্চাকে এমন মারধর করবে?
না মানে…।
জ্যায়ের কথায় লজ্জা পেলো আরিফা।তাই আর কিছু না বলে মাথা নিচু করে নিলো।আমেনা কাব্যকে ডেকে নিয়ে গেল।তার মাথায় হাত বুলিয়ে খুব আদর করলো।কাব্য খুব ক্ষুধার্ত,বোন তাকে এখনো খেতে দেয়নি।আমেনা তাকে ভালো করে খাইয়ে দিলো।
দিন রাত কাব্য বোনের সংসারে খেটে চলেছে,দুবেলা দুমুটো ভাতের জন্য।কিন্তু তাও তার কপালে জুটছে না।তাকে ঠিকমতো খেতে পরতে দেয়া হচ্ছে না।বাসি উচ্ছিষ্ট খাবার তাকে খেতে দেয়া হয়।তবুও সে কিছু বলে না।মুখ বুঝে সবকিছু সহ্য করে।কারণ তাঁর যাওয়ার জায়গা নেই।
কী অসহ্য,না পারে কইতে না পারে সইতে।ভিতরটা জ্বলে পুড়ে মরছে।শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার কাব্য।মনের দু:খ মনের ভিতর পুষে রেখেছে।কারো কাছে প্রকাশ করতে পারছে না।বোন হয়ে আরিফা তাকে ভালো চোখে দেখছে না।ভাইটাকে পড়ালেখা করাবে তা না,কামলা খাটাচ্ছে।এই দুনিয়ার মানুষগুলো কেমন যেন স্বার্থপর।যার মা-বাবা বেঁচে নেই।তাকে কেউ ভালোবাসে না।দূর দূর করে…।
আজ কাব্যর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।বোন হয়ে ভাইকে সহ্য করতে পারছে না।অনাদর অবহেলায় জর্জরিত তার জীবন।আর কত সইবে।এক সময় সে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে।জ্বরে কাতরাচ্ছে।এখন তার সেবা যত্নের প্রয়োজন।কিন্তু কে করবে তার সেবা?বোনতো নয় যেন রাক্ষসী।ভাইয়ের দিকে ফিরে ও তাকাচ্ছে না।বরং কাজ না করে শুয়ে আছে কেনো এজন্য শাসাচ্ছে।জ্বরটা একটু কমেছে।অমনি সে কাজে লেগে গেছে।কাজ করতে করতে এক সময় সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে।তার শ্বাসকাশ বেড়ে যায়।নি:শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।কেমন জানি শোঁশোঁ শব্দ করে।প্রাণ যায় যায় ভাব।এমন করুণ দৃশ্য দেখে সহ্য করতে পারল না আমেনা।চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো।চোখ মুছতে মুছতে বলল,
বোন আরিফা, কাব্যর অবস্থা ভালো না।এক্ষণি তাকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।
না আমি পারবো না।
বলো কী! ওকে ডাক্তারের কাছে না নিলে মারা যাবে তো?
যাক তাতে আমার কী?
আরিফা এত নিষ্ঠুর হয়ো না।সৎ হলেও সে তোমার ভাই।তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও প্লিজ।
বললাম তো পারব না।
এটাই কি তোমার শেষ কথা?
হ্যাঁ এটাই আমার শেষ কথা।
আমেনার শত অনুরোধ ব্যর্থ হলো।কাব্যকে আরিফা ডাক্তারের কাছে নিতে কিছুতেই রাজী হলো না।শেষে আমেনা তার স্বামীকে নিয়ে কাব্যকে হাসপাতালে নিয়ে গেল।ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেল।কাব্যর কোন সাড়াশব্দ নেই।ডাক্তার স্টেথোস্কোপ যন্ত্র বসিয়ে দেখে শ্বাস প্রশ্বাস প্রবাহিত হচ্ছে না।ডাক্তার তাকে মৃত বলে ঘোষণা করলো।পর হয়ে ও আমেনা ডুকরিয়ে কেঁদে উঠল।কাব্যকে সে আপন ভাইয়ের মতো দেখেছে।কখনো পর ভাবেনি।প্রায় সময় খাইয়েছে,আদর করেছে।আজ কাব্যর মৃত্যুতে তার খুব খারাপ লেগেছে।বারবার তার প্রতিচ্ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠছে।কিছুতেই ভুলতে পারছে না।আর কাব্যর বড় বোন আরিফা ভাইয়ের মৃত্যুতে আনন্দ উল্লাস করছে।কারণ তার মাথা থেকে একটা আপদ বিদায় হয়েছে।কথায় বলে না,অনেক সময় পর ও আপন হয়।আজ কাব্যর ক্ষেত্রে তাই হয়েছে।আপন হয়েছে পর।পর হয়েছে আপন।আরিফার চোখে কাব্য “সৎ ভাই”।তাই এত নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে।যার কারণে তার মৃত্যু হয়েছে।আরিফা ও তার স্বামীর কাছে টাকা বড়।তাই টাকা বাঁচাতে গিয়ে “সৎ ভাইকে” মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।জেনে রাখা ভালো,টাকা হারালে টাকা পাওয়া যায়।কিন্তু মানুষ পুন:জন্ম হয় না।তাই টাকার মুল্যায়ন না করে,জীবনের মুল্যায়ন করা সবার উচিৎ।
ঃসমাপ্তঃ