বাংলাদেশে ডিভোর্স বা বিবাহ বিচ্ছেদ একটি আইনসম্মত এবং স্বীকৃত প্রক্রিয়া। যদিও বিবাহ একটি পবিত্র বন্ধন, অনেক ক্ষেত্রেই দাম্পত্য জীবনে টানাপোড়েন, পারস্পরিক মতবিরোধ, পারিবারিক সমস্যা, আর্থিক সংকট বা ব্যক্তিগত অসামঞ্জস্যতার কারণে ডিভোর্সের (তালাক) প্রয়োজন হয়।
বাংলাদেশে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষের জন্য পৃথক বিবাহ ও তালাক আইন রয়েছে। তবে, মুসলিম বিবাহ ও তালাক আইন অনুযায়ী, বিবাহ নিবন্ধিত হলে আইন অনুযায়ী তালাক সম্পন্ন করতে হয়, এবং এই প্রক্রিয়ায় কাজী অফিস বা বিবাহ নিবন্ধকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করবো বাংলাদেশে ডিভোর্স কীভাবে হয়, এর আইনগত দিক, তালাকের পদ্ধতি এবং কাজী অফিসের ভূমিকা।
বাংলাদেশে ডিভোর্সের আইনগত স্বীকৃতি
বাংলাদেশে ডিভোর্স বা বিবাহ বিচ্ছেদ আইনত স্বীকৃত। এখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আইন অনুসরণ করা হয়।
১. মুসলিম আইনে ডিভোর্স
মুসলিমদের জন্য ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ এবং ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন অনুসারে ডিভোর্স দেওয়া যায়। তালাকের কিছু ধরণ রয়েছে, যেমন:
- তালাক-এ-তাফউইজ: স্ত্রী যদি স্বামীর কাছ থেকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা পান, তাহলে তিনি নিজেই তালাক দিতে পারেন।
- তালাক-এ-আহসান: একবার তালাক উচ্চারণ করে তিন মাস অপেক্ষা করা হয়, যদি পুনর্মিলন না হয়, তাহলে তালাক কার্যকর হয়।
- তালাক-এ-হাসান: তিন মাসে তিনবার তালাক উচ্চারণ করা হয় এবং ইদ্দত শেষে তালাক কার্যকর হয়।
- তালাক-এ-বাইন: তালাকের পর পুনরায় বিবাহ করতে হলে স্ত্রীকে অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয় (হালালা প্রয়োজন)।
তালাকের জন্য প্রক্রিয়া:
- স্বামী বা স্ত্রী লিখিত নোটিশ দিতে হয়।
- এই নোটিশ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বা পৌরসভায় জমা দিতে হয়।
- তালাক কার্যকর হতে ৯০ দিন সময় লাগে।
- কাজী অফিস বা বিবাহ নিবন্ধকের মাধ্যমে তালাক রেজিস্ট্রি করতে হয়।
২. হিন্দু আইনে ডিভোর্স
বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য ঐতিহ্যগতভাবে ডিভোর্স অনুমোদিত ছিল না। তবে, ২০১২ সালে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন পাস হওয়ার পর কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ডিভোর্সের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
৩. খ্রিস্টান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের ডিভোর্স
খ্রিস্টানদের জন্য ১৮৬৯ সালের খ্রিস্টান বিবাহ আইন এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২ অনুসরণ করা হয়।
কাজী অফিস বা বিবাহ নিবন্ধকের ভূমিকা
বাংলাদেশে তালাক রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক। একজন বিবাহ নিবন্ধক বা কাজী সাধারণত নিম্নলিখিত কাজগুলো সম্পন্ন করেন—
- তালাকের নোটিশ গ্রহণ ও নিবন্ধন করা।
- তালাক কার্যকর হওয়ার জন্য ৯০ দিনের অপেক্ষাকালীন সময় নিশ্চিত করা।
- উভয় পক্ষের আপস-মীমাংসার চেষ্টা করা।
- আইনগত নথি সংরক্ষণ করা এবং প্রয়োজন হলে কপি প্রদান করা।
তালাক কার্যকর হলে কাজী অফিস থেকে তালাকের সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হয়, যা ভবিষ্যতে আইনি ও পারিবারিক প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
ডিভোর্সের কারণ ও প্রভাব
বাংলাদেশে ডিভোর্সের হার দিন দিন বাড়ছে। এর পেছনে কিছু প্রধান কারণ হলো—
প্রধান কারণসমূহ:
✔ দাম্পত্য কলহ ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব
✔ অর্থনৈতিক সমস্যা ও চাকরি নিয়ে বিরোধ
✔ পারিবারিক হস্তক্ষেপ (শ্বশুরবাড়ির সমস্যা)
✔ প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা
✔ গার্হস্থ্য সহিংসতা ও নির্যাতন
✔ অসুস্থতা বা বন্ধ্যাত্বের মতো পারিবারিক সমস্যা
ডিভোর্সের সামাজিক ও মানসিক প্রভাব:
✔ সন্তানদের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে
✔ মানসিক চাপ ও হতাশা তৈরি হয়
✔ একা থাকার অনুভূতি তৈরি হয়
✔ নতুন জীবন শুরু করা কঠিন হয়ে পড়ে
তালাকের বিকল্প সমাধান
ইসলাম এবং সমাজ উভয়ই তালাককে নিরুৎসাহিত করে। তালাকের আগে কিছু বিকল্প সমাধান চেষ্টা করা যেতে পারে—
✔ পারিবারিক সালিশ বা মধ্যস্থতা: দুই পরিবারের অভিভাবকদের নিয়ে আলোচনা করা।
✔ পরামর্শ গ্রহণ: বিবাহ পরামর্শদাতা বা ধর্মীয় ব্যক্তির সাহায্য নেওয়া।
✔ অস্থায়ী বিচ্ছেদ (separation): সরাসরি তালাক না দিয়ে কিছুদিন আলাদা থাকা।
✔ আদালতের মাধ্যমে সমাধান: যদি আইনি জটিলতা থাকে, তবে কোর্টের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
উপসংহার
বাংলাদেশে ডিভোর্স আইনগতভাবে অনুমোদিত এবং এটি একটি প্রয়োজনীয় সামাজিক ব্যবস্থা। কাজী অফিস বা বিবাহ নিবন্ধকের মাধ্যমে তালাক নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক। তবে, তালাক নেওয়ার আগে যথাযথ চিন্তাভাবনা করা উচিত, কারণ এটি শুধু দুজন মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক শেষ করে না, বরং পুরো পরিবার ও সন্তানদের ওপরও প্রভাব ফেলে।
যদি কোনো সম্পর্ক সত্যিই টিকিয়ে রাখা সম্ভব না হয়, তবে আইনগত প্রক্রিয়া মেনে, পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে ডিভোর্স সম্পন্ন করাই সবচেয়ে ভালো উপায়।
