৪০০ হিজরীর পূর্বে কি মাযহাব ছিলো না?
মিডিয়া জগতে একটি মিথ্যা প্রপাগান্ডা প্রচার হতে দেখা যায় যে, মাযহাবের আবিষ্কার নাকি ৪০০ হিজরির পরে; এর পূর্বে নাকি মাযহাব ছিলো না!
আজ আমরা এর সত্যতা নিয়ে আলোচনা করবো।
📗 ৪০০ হিজরীর পূর্বে মাযহাব
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন-
والاوزاعي امام اهل الشام وقد كانوا على مذهبه الى المئة الرابعه
ইমাম আউযায়ী রাহিমাহুল্লাহ (১৫৭. হিজরি) সিরিয়াবাসীর ইমাম ছিলেন। ৪০০ হিজরী পর্যন্ত সিরিয়াবাসী তাঁর মাযহাবের অনুসরণ করেছিলো। [মাজমূউল ফাতাওয়া —ইবনে তাইমিয়া: ২০/৫৮৩]
📗 শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভীর বক্তব্য ও সংশয় নিরসন
লা-মাযহাব বন্ধুরা শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী রাহ. এর নিচের উক্তিটি দারা নিজেদের পক্ষে দলিল পেশ করে থাকে এবং সাধারণের মাঝে খুবই জলঘোলা করে থাকে। তারা এখান থেকে প্রমাণ করতে চায় যে, ৪০০ হিজরির পূর্বে কোনো মাযহাব ছিলো না।
📗 আপত্তি নিরসন
এখন আমরা দেখবো, মাযহাব সম্পর্কে মুহাদ্দিসে দেহলবী রাহ. মূলত কী বলেছেন।
তিনি বলেন-
اعلم ان الناس كانوا في المائة الاولى والثانية غير مجتمعين على التقليد لمذهب واحد بعينه وبعد المائتين ظهر فيهم التمذهب للمجتهدين باعيانهم… ينبغي ان القياس وجوب التقليد لامام بعينه
فاذا كان إنسان جاهل في بلاد الهند أو في بلاد ما وراء النهر وليس هناك عالم شافعي ولا مالكي ولا حنبلي ولا كتاب من كتب هذه المذاهب وجب عليه أن يقلد لمذهب أبي حنيفة ويحرم عليه أن يخرج من مذهبه لأنه حينئذ يخلع ربقة الشريعة ويبقى سدى مهملا
জেনে রাখো, লোকেরা প্রথম ও দ্বিতীয় হিজরী শতকে নির্দিষ্ট কোনো ইমামের মাযহাবের তাকলীদ করার ব্যাপারে জমে ছিলো না। নির্দিষ্ট ইমামের মাযহাবের তাকলীদ করার বিষয়টি দ্বিতীয় শতকের পর প্রকাশ পায়। …আর নির্দিষ্ট ইমামের তাকলীদ ওয়াজিব হওয়াটা বুদ্ধি-বিবেচনারই দাবী।
কারণ যখন ভারতবর্ষ কিংবা আশেপাশের অন্যান্য দেশসমূহের মানুষজন অজ্ঞ ও মূর্খ ছিল, সেখানে ছিলো না কোনো শাফেঈ আলেম না কোনো মালেকী আলেম কিংবা হাম্বলী আলেম। না ছিলো সেসব মাযহাবের কোনো কিতাব। (কেবল হানাফী আলেমগণ ছিলো) কাজেই তাদের উপর ইমাম আবু হানীফার মাযহাবের তাকলীদ করাটা ওয়াজিব হয়ে পড়লো এবং তাদের জন্য তাঁর মাযহাব থেকে বের হওয়া যাওয়া হারাম হয়ে গেলো। কারণ যদি তারা তাঁর মাযহাব না মানে তবে তারা শরীয়তের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যাবে আর তাদের আমলগুলো পণ্ডশ্রমে পরিণত হবে। (আল ইনসাফ পৃ: ৬৮-৭৯)
তিনি আরো বলেন-
ان المذاهب الاربعة المدونة المحررة قد اجتمعت الامة او من يعتد به منها على جواز تقليدها الى يومنا هذا.
সংকলিত ও গ্রন্থবদ্ধ এই চার মাযহাবের অনুসরণের বৈধতার উপর আজও পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহ অর্থাৎ উম্মাহর গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। [হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/২৮৬]
আপত্তি: ৪০০ হিজরির আগে নির্দিষ্ট মাযহাব ছিলো না।
📗 জবাব —১
প্রথমত: ৪০০ হিজরীর পূর্বে নির্দিষ্ট মাযহাব ব্যাপকভাবে ছিলো না ঠিক; তবে কোন কোন শহরে নির্দিষ্ট মাযহাবের অনুসরণ তখনো ছিলো। যেমন আমরা ইবনে তাইমিয়ার বক্তব্য থেকে জানতে পেরেছি।
দ্বিতীয়ত: ৪০০ হিজরির আগে নির্দিষ্ট মাযহাব ছিলো না তো কী হয়েছে! তখন নির্দিষ্ট মাযহাবের প্রয়োজনই পড়েনি তাই ছিলো না। কারণ, তখন দিক দিকে গভীর জ্ঞানের অধিকারী আলেম-ওলামাগণ ছিলেন, বড় বড় ফকীহ ও ইমামগণ ছিলেন। চারদিকে ইলমের জয়জয়কার। যখন-তখন যেকোনো মাসআলার সুষ্ঠু সমাধান পাওয়া যেতো তাই নির্দিষ্ট কোনো মাজহাব অনুসরণ করার প্রয়োজনই পড়েনি।
কিন্তু যখন প্রয়োজন হলো, তখন চালু হয়ে গেছে। অর্থাৎ যখন চারদিকে ধীরে ধীরে জাহালাত নেমে আসলো ও মানুষের মাঝে মূর্খতা ছড়িয়ে পড়লো। তাকওয়া কমে গেলো। যে যেভাবে পারছে মাসআলা দিচ্ছে, যে যেমন খুশি যার তার কাছ থেকে মাসআলা গ্রহণ করছে। তখন প্রয়োজন হয়ে পড়লো নির্দিষ্ট একটি মাযহাব অনুসরণ করার, যাতে করে মানুষ নিজ খেয়াল খুশি মত ফতোয়া দিতে না পারে এবং নিজ খেয়াল খুশি মতো যার তার ফতোয়া গ্রহণ করতে না পারে।
এখন প্রশ্ন এসে দাঁড়ালো যে নির্দিষ্ট মাযহাব গ্রহণ করবো ঠিক আছে, কিন্তু কোন কোন মাযহাব গ্রহণ করবো। মাযহাব তো অনেক।
এর সমাধান হলো- যে মাযহাবগুলো সর্বজনসমাদৃত এবং নিরবিচ্ছিন্ন সনদসহ সুসংরক্ষিত ওর সুবিন্যাস্তভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে কেবল সেই সব মাযহাবেরই অনুসরণ করা হবে।
এখান থেকেই হানাফী, মালেকি, শাফেঈ, হাম্বলী মাযহাবের ধারা চালু হয়ে গেছে। কারণ এই চার মাযহাবই সঠিক ও সুশৃঙ্খলভাবে সংকলিত হয়েছিলো। আর বাকি মাযহাব গুলো পুরোপুরিভাবে সংরক্ষিত ছিলো না।
📗 জবাব —২
৪০০ হিজরির আগে তো বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈর মতো হাদিসের গ্রন্থগুলোও ছিলো না, তার মানে কি এসব গ্রন্থগুলো বাতিল?
📗 জবাব —৩
কেউ তার যৌবনের প্রথম চার বছরে বিয়ে করেনি তার মানে কি সে পরবর্তী সময়েও বিয়ে করতে পারবে না? কেউ তার সংসার জীবনের প্রথম চার বছরে বাড়ি তৈরি করেনি এর মানে কি সে পরবর্তীতেও বাড়ি তৈরি করতে পারবে না?
📗 জবাব —৪
মাযহাব এমন কোনো নতুন জিনিস না যে প্রথম যুগে না থাকলে পরবর্তী যুগে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। মাযহাব হচ্ছে কুরআন হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যার সুসংকলিত রূপ। আর কুরআন হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যা যেকোনো সময়ই গ্রহণ করা যায়।
📗 জবাব —৫
শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী রাহ. বলেছেন ৪০০ হিজরীর পূর্বে নির্দিষ্ট মাযহাব ছিলো না। এর থেকে বোঝা যায় ৪০০ হিজরীর পূর্বে নির্দিষ্ট মাযহাব ছিলো না ঠিক, তবে অনির্দিষ্ট মাযহাব তো ছিলই। যদি অনির্দিষ্ট মাযহাব না থাকতো তাহলে নির্দিষ্ট মাযহাবের কথা আসতো না আর যদি অনির্দিষ্ট মাযহাব থাকাটা শির্ক না হয় তাহলে নির্দিষ্ট মাযহাব কেন শির্ক হবে? বরং নির্দিষ্ট মাযহাব তো আরো উত্তম হবে, কারণ নির্দিষ্ট মাযহাবের ক্ষেত্রেই সুশৃংখলতা বেশি বজায় থাকে।
একাধিক মাযহাব গ্রহণ করলে একেক মাযহাবের আলেম একেক ধরনের কথা বলবে এতে করে মানুষের ভিতরে সন্দেহ সৃষ্টি হবে। কারো কারো ক্ষেত্রে ঝামেলাও মনে হতে পারে যে একেক হুজুর একেক কথা বলে কেন?
দুনিয়ার ক্ষেত্রেও দেখা যায় মানুষজন সাধারণত নির্দিষ্ট এক ডাক্তার থেকেই চিকিৎসা গ্রহণ করে থাকে। একেকদিন একেক ডাক্তার থেকে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ কোনো অভিজ্ঞ ডাক্তার দেবে না।
📗 জবাব —৬
পরের পৃষ্ঠায় তিনি নিজেই স্বীকার করে নিয়েছেন যে পরবর্তীওয়ালাদের জন্য নির্দিষ্ট মাযহাবের তাকলীদ করা ওয়াজিব। এবং কেন ওয়াজিব তাও তিনি স্পষ্ট উল্লেখ করে দিয়েছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের লা-মাযহাব বন্ধুরা কেবল ৪০০ হিজরির পূর্বে নির্দিষ্ট মাযহাব ছিলো না তা উল্লেখ করে; বাকিগুলো উল্লেখ করে না।
লুবাব হাসান সাফওয়ান
ছাত্র: আল-ইফতা ওয়াল হাদীস
আরো পড়ুন-
- আহলে হাদিস কারা
- আহমদ ইবনে হাম্বল (রাঃ) এর জীবনী
- সীরাত গ্রন্থ পরিচিতি
- আসমানী কিতাবসমূহ
- ফেরেশতাগণের পরিচয়