চারিদিকে গভীর নীরবতা, শুধু বাতাসের হালকা গুঞ্জন। জঙ্গলের মাঝখানে একা একাকী দাঁড়িয়ে আছে একটি পুরোনো কাঠের বাড়ি। বাড়িটি যেন অনেক বছর ধরে মানবসভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। তবু এটিতে একসময় মানুষের বাস ছিল। বাড়িটির চারপাশে এক অদ্ভুত শীতলতা বিরাজ করছে, যেন সেই শীতলতা বাড়ির ইট কাঠের সাথে মিশে গেছে। দিনের বেলাতেও বাড়িটিতে প্রবেশ করতে ভয় করে।রাত তখন গভীর। পূর্ণিমার আলো জঙ্গলের মেঠো পথ ধরে আসা একজন পথিকের চেহারায় পড়েছে। সে পথিকের নাম নন্দন। সে বহুদিন ধরে সুখ খুঁজছে। জীবনে অনেক কিছু পেয়েও কোথাও যেন এক শূন্যতা বিরাজ করছে তার হৃদয়ে। নন্দন শুনেছিল, এই বাড়িটি অনেকের জীবনে শান্তি ও সুখ এনে দিয়েছে। সেই আশা নিয়ে সে রাতের বেলায় বাড়িটির দিকে এগোতে শুরু করে।বাড়ির দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়ায় নন্দন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো সে ভুল করেছে। বাড়িটি এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যেন। কিন্তু নন্দনের মনে অনেকদিনের জমে থাকা হতাশা তাকে ভর করছিল। সে আর পিছু হটতে পারল না। ধীরে ধীরে দরজায় হাত রাখল। দরজাটি চমৎকারভাবে খুলে গেল, যেন তাকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত ছিল।বাড়ির ভেতর পা রেখেই নন্দন অনুভব করল এক অদ্ভুত অনুভূতি। ঘরের ভেতর বাতাস ছিল না, কিন্তু একটা ভারী অনুভূতি তার ওপর ভর করল। দেয়ালগুলো যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে, নিঃশব্দে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। নন্দন ধীরে ধীরে ঘরের ভেতর ঢুকল। পুরোনো কাঠের মেঝে তার পায়ের নিচে কড়মড় শব্দ করে উঠল। ঘরের প্রতিটি কোণ থেকেই যেন শীতলতার ঢেউ আসছে।নন্দন হঠাৎ শুনতে পেল একটা মৃদু গুঞ্জন। সেটা দূর থেকে আসছে বলে মনে হলো। কিন্তু কীসের শব্দ তা সে বুঝতে পারল না। ঘরের এক কোণে একটা পুরোনো চেয়ারের ওপর একটি ডায়েরি পড়ে ছিল। ডায়েরির পাতাগুলো জীর্ণ, কিন্তু নন্দন ডায়েরিটা হাতে তুলে নিল। ভেতরে লেখা ছিল: “এই বাড়ি সুখ এনে দেয়, কিন্তু সেই সুখের মূল্য দিতে হবে।”নন্দনের শরীরের প্রতিটি রোমকূপ খাড়া হয়ে গেল। ডায়েরির সেই কথাগুলো যেন তাকে কিছু ভয়ঙ্কর কিছু বলার চেষ্টা করছিল। তবুও, নন্দন নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তা অবজ্ঞা করল। সে আসলে এই বাড়ি থেকে সুখ চায়, যেভাবে সে শুনেছে যে অনেকে পেয়েছে।ঘরের ভেতরে একটি পুরোনো আয়না ছিল। আয়নাটি প্রায় পুরো ঘরজুড়ে। নন্দন আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের ছায়া দেখতে পেল, কিন্তু হঠাৎ তার ছায়াটি অস্বাভাবিকভাবে হাসতে শুরু করল। সে আতঙ্কিত হয়ে পিছিয়ে গেল। “এটা সম্ভব নয়,” সে নিজেকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল। কিন্তু তার ছায়াটি আয়নার ভেতর থেকে এগিয়ে আসছে, যেন তাকে টেনে নিয়ে যেতে চায়।নন্দন ভয় পেয়ে যায়, কিন্তু সে পালাতে পারল না। ঘরটির প্রতিটি কোণা যেন তাকে আটকে রেখেছে। ঘরের শীতল বাতাস তার শরীরের ভেতর ঢুকে গেছে। তার মনে হলো, সুখ যদি এমন হয় তবে সে তা পেতে প্রস্তুত নয়।তবে ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। ঘরের ভেতরকার এক অদ্ভুত শক্তি তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। আয়নার ছায়াটি ধীরে ধীরে বাস্তবে রূপান্তরিত হলো, এবং নন্দন দেখতে পেল একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। তার চোখে শূন্যতা, মুখে এক অদ্ভুত হাসি। সেই ছায়াটি বলে উঠল, “তুমি সুখ চেয়েছ, আর সুখ পেয়েছ। কিন্তু সুখ মানেই সবসময় যা তুমি ভাবছ, তা নয়।”নন্দন বুঝল, এই বাড়ি তাকে ফাঁদে ফেলেছে। সে অনেক বড় ভুল করেছে এখানে এসে। কিন্তু পালানোর কোনো পথ ছিল না। তার চারপাশের ঘর ক্রমেই ছোট হয়ে আসতে লাগল, যেন ঘরের দেয়ালগুলো তাকে গিলে খাচ্ছে।শেষমেশ, নন্দন কোথাও হারিয়ে গেল। তার শরীর নিথর হয়ে পড়ল, কিন্তু তার মন আটকে রইল সেই শূন্যতায়। সে এখন সেই বাড়ির অংশ, সেইসব আত্মাদের মতো যারা সুখের সন্ধানে এসে চিরতরে হারিয়ে গেছে।এখনো সেই বাড়ির দরজায় মাঝেমধ্যে নতুন পথিক এসে দাঁড়ায়। আর নন্দন, সে দাঁড়িয়ে থাকে সেই আয়নার ওপাশে, অপেক্ষা করে আরেকটি আত্মার, যারা সুখের সন্ধানে আসবে, কিন্তু ভুল পথে।
