নীলচোখা জলপরী

0

শঙ্খনদী গ্রামের সকাল সবসময় সমুদ্রের শব্দ দিয়ে শুরু হয়। মাটির ঘরগুলোর চালের ফাঁক দিয়ে বাতাস ঢোকে, আর বাতাসের সাথে ভেসে আসে লবণাক্ত গন্ধ। এই গন্ধে কখনো শান্তি, কখনো অদ্ভুত শূন্যতা থাকে। গ্রামের মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম সমুদ্রের সাথে জীবন কাটিয়েছে—মাছ ধরা, ঝড়ের সাথে লড়াই, হারানো প্রিয়জনের জন্য অপেক্ষা।

 

শৈশব থেকেই গ্রামের বাচ্চারা এক কিংবদন্তি শুনে এসেছে—সমুদ্রের গভীরে নাকি এক জলপরী থাকে। তার চোখ সমুদ্রের জলের চেয়েও নীল, চুলে সাদা মুক্তোর ঝিলিক, গায়ে রূপালি আলো। রাতে সে গান গায়, আর যার কানে সেই গান পৌঁছে যায়, সে নাকি চিরতরে সমুদ্রে ডুবে যায়।

কেউ বলে, সে অভিশপ্ত; কেউ বলে, সে হারানো প্রিয়জনকে খুঁজছে। কিন্তু একথা সবাই জানে—যারা তার ডাকে সাড়া দেয়, তারা আর কখনো ফিরে আসে না।

 

আরিব এই গ্রামেই বড় হয়েছে। তার শৈশব হাসি, খেলা, সমুদ্রের ঢেউ তাড়া করার মধ্যে কেটেছে। কিন্তু এক ঝড়ের রাতে তার মা মারা যায়। সেদিন ঢেউ এত উঁচু ছিল যে পুরো গ্রাম কেঁপে উঠেছিল। মা মৃত্যুশয্যায় ফিসফিস করে বলেছিলেন, “সমুদ্রের গান শুনে নাও, ছেলে… সব উত্তর ওখানেই আছে।”

সেই রাতের পর থেকে আরিব প্রায়ই একা একা সমুদ্রের ধারে বসে থাকত। ঢেউয়ের শব্দ তার কাছে শুধু শব্দ ছিল না—ওগুলো যেন কথাও বলত।

 

ঋতু তখন বর্ষার শেষ। বিকেলের আকাশে ধূসর মেঘ, মাঝে মাঝে সূর্যের আলো ফুঁড়ে বেরোচ্ছে। সেই সন্ধ্যায় সমুদ্র ছিল অস্বাভাবিক শান্ত। আরিব নীরবে বালিতে বসে আঙুল দিয়ে কিছু অদ্ভুত রেখা আঁকছিল। হঠাৎ বাতাস থেমে গেল, ঢেউয়ের ফিসফিসানি বদলে গেল এক অচেনা সুরে—মোলায়েম, গভীর, আর হৃদয়বিদারক।

 

আরিব চোখ তুলে দেখল—দূরে চাঁদের আলো ভেঙে গিয়ে জলের উপর গড়ে উঠছে এক অবয়ব। লম্বা চুলের মেয়েটি যেন ঢেউয়ের উপর ভেসে আছে। তার চোখের রঙ অদ্ভুত গভীর নীল, যেন সমুদ্রের সব রহস্য সেখানে জমে আছে। চুলে মুক্তোর মত সাদা বিন্দু ঝিলিক দিচ্ছে, যেন তারার আলোও সেখানে এসে থেমে গেছে।

 

সে কিছু বলছিল না, শুধু তাকিয়ে ছিল। সেই দৃষ্টি আরিবের বুকের ভেতর এক অদ্ভুত অনুভূতি ছড়িয়ে দিল—ভয় আর টান, দুটো একসাথে।

 

—”তুমি কে?” আরিবের গলা শুকিয়ে গিয়েছিল।

মেয়েটি হালকা হাসল, কিন্তু সেই হাসিতে ছিল অদ্ভুত দুঃখ।

—”আমাকে ভুলে গেছ?”

—”আমি… আমি তো তোমাকে কখনো দেখিনি।”

—”তুমি দেখেছিলে, জন্মের আগে।”

 

আরিব অবাক হয়ে গেল।

—”আমার জন্মের আগে?”

—”হ্যাঁ। আমি তোমার মায়ের বন্ধু ছিলাম।”

 

সমুদ্রের ঢেউ এক মুহূর্তে থেমে গেল যেন, বাতাসও স্তব্ধ।

—”মা তো কখনো তোমার কথা বলেনি।”

—”বলতে পারেনি। আমি আর মানুষ নই। আমি অভিশপ্ত জলপরী।”

 

তার কণ্ঠে ছিল এক শীতল বিষাদ, যা কানে নয়, হৃদয়ে গিয়ে বাজে।

সে ধীরে ধীরে আরিবের কাছে এগিয়ে এলো। ঢেউ যেন তাকে পথ করে দিচ্ছে। আরিব দেখল—তার পা নেই, কোমর থেকে নিচে রূপালি আঁশে ঢাকা লেজ, আর লেজের ডগায় মৃদু আলো ঝলমল করছে।

 

জলপরী বলতে শুরু করল তার গল্প।

বহু শতাব্দী আগে, সে ছিল এই গ্রামেরই এক মেয়ে। সমুদ্রপাড়ের এক জেলে ছেলের প্রেমে পড়েছিল। তারা চাঁদের আলোয় প্রতিদিন দেখা করত। কিন্তু এক রাতে ঝড়ে সেই ছেলেটি সমুদ্রে হারিয়ে যায়।

সে চাঁদের নীচে দাঁড়িয়ে সমুদ্রকে প্রার্থনা করেছিল—প্রিয়জনকে ফিরিয়ে দাও। সমুদ্র উত্তর দিয়েছিল, কিন্তু শর্তে—তার আত্মা চিরকাল সমুদ্রের সাথে বাঁধা থাকবে, আর সে কখনো মানুষের তীরে ফিরতে পারবে না। সেই থেকে সে জলপরী, চিরন্তন অপেক্ষার অভিশাপে বন্দি।

 

—”তোমার মা একদিন আমার গান শুনে আমাকে দেখতে পেয়েছিল। আমি তাকে মুক্তি দিতে বলেছিলাম। কিন্তু সে পারেনি। এখন তুমি হয়তো পারবে।”

 

—”কিভাবে?”

—”তোমাকে গভীর সমুদ্রে যেতে হবে। যেখানে আলো পৌঁছায় না। সেখানে আছে কালো প্রবালের বেদি। ওই বেদিতে আমার মুক্তোর হার রেখে আসতে হবে।”

 

আরিব অনুভব করল, এটা শুধু বিপজ্জনক নয়, প্রাণঘাতী। তবু তার মনে হল, এই কাজ না করলে যেন জীবনের সব প্রশ্ন অউত্তরিত থেকে যাবে।

 

পরের রাতে, ছোট এক নৌকায় করে সে সমুদ্রে বেরিয়ে গেল। আকাশ কালো মেঘে ঢেকে আছে, বাতাসের মধ্যে ঝড়ের গন্ধ। জলপরী দূর থেকে গান গাইছে, সেই গান যেন পথ দেখাচ্ছে।

 

সমুদ্রের গভীরে নামার সময় শ্বাস নেয়া কঠিন হয়ে পড়ল। ঠান্ডা জল শরীর জমিয়ে দিচ্ছিল। অন্ধকারে হঠাৎ দেখা দিল এক বিশাল কালো মন্দির, যা প্রবাল দিয়ে গড়া। মন্দিরের মাঝে কালো প্রবালের বেদি।

 

আরিব ধীরে ধীরে সেখানে গিয়ে মুক্তোর হার রাখল। সাথে সাথে এক প্রবল আলো সমুদ্রভরিয়ে দিল। সেই আলোতে সে শেষবার দেখল—জলপরী তার দিকে হাসছে, চোখে অশ্রু, ঠোঁটে কৃতজ্ঞতা।

—”ধন্যবাদ, আরিব। তুমি আমাকে মুক্তি দিলে।”

 

পরের দিন সকালে গ্রামবাসী সমুদ্রতটে ভাসমান একটি নৌকা পায়। নৌকার ভিতরে কেউ নেই, শুধু ভিজে থাকা এক কাপড়ের টুকরো—যা ছিল আরিবের।

 

বৃদ্ধ জেলেরা বলে, পূর্ণিমার রাতে চাঁদের আলোয় তারা মাঝে মাঝে দেখে—এক তরুণ আর এক জলপরী, সমুদ্রের গভীরে পাশাপাশি ভেসে বেড়াচ্ছে। তাদের মুখে এক শান্তির হাসি, যেন দুজনেই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে।

 

গ্রামের বাচ্চারা এখনো সমুদ্রের ধারে খেলতে গিয়ে ঢেউয়ের শব্দে শোনে এক মোলায়েম গান। বড়রা বলে, “ওটা নীলচোখা জলপরীর কণ্ঠ… আরিবের সাথে তার গল্প শেষ হলেও, সমুদ্র কখনো গল্প শেষ করে না।”


56
বিজ্ঞাপনঃ মিসির আলি সমগ্র ১: ১০০০ টাকা(১৪% ছাড়ে ৮৬০)

0

Nazia Sultana

Author: Nazia Sultana

"সাহিত্যে ডুবে থাকা একজন নিবেদিত লেখক আমি।"

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

প্রতি দান

রাতে থেকে বৃষ্টি হচ্ছিলো, কিছুক্ষণ,বৃষ্টি থেমেছে সবে। সকাল কখন হয়েছে চম্পা জানে না। চম্পা শুনেছে, ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। জ্যোতিষশাস্ত্র

অ্যাথেনার অলৌকিক হার্প

অনেক অনেক বছর আগে, প্রাচীন গ্রিসের এক ছোট্ট গ্রামে বাস করত এক কিশোরী মেয়ে—নাইরা। সে দরিদ্র ছিল, কিন্তু তার গলায়

সময়ের দরজা

মেঘে ঢাকা এক বিকেল। পুরান ঢাকার সরু গলির ভেতরে, ধুলো ধরা এক প্রাচীন বইয়ের দোকানে ঢুকল আরসোহা। ইতিহাসের ছাত্রী সে,

অবাধ্য ছেলের পরিণতি

এক গ্রামে মাহিন নামে এক দুষ্টু ছেলে ছিল । সে অনেক দুষ্টু ছেলে ছিল । স্কুলে বাংলা ক্লাস । সে

Leave a Reply