রাতে থেকে বৃষ্টি হচ্ছিলো, কিছুক্ষণ,বৃষ্টি থেমেছে সবে। সকাল কখন হয়েছে চম্পা জানে না। চম্পা শুনেছে, ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। জ্যোতিষশাস্ত্র এবং ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী ভোরের স্বপ্ন বা শেষ রাতের স্বপ্নকে সত্য বলে মনে করা হয়, কারণ এ সময় মানুষ গভীর ঘুমে থাকে এবং মন থেকে আসা স্বপ্নগুলো সত্য হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।দিনশেষে ঘুমোনোর পর সেগুলো সম্পর্কিত জিনিসই আমাদের স্বপ্নে আসে। সারা দিন আমরা যা কিছু চিন্তাভাবনা করে থাকি, তা ঘুমের সময় আমাদের স্বপ্নে ফুটে ওঠে। স্বপ্ন দেখার কোনও নির্দিষ্ট সময় হয় না। যে কোনও সময় ঘুমোলেই মানুষ স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু ওর স্বপ্নের সাথে তো ওর রোজকার জীবনের মিল নেই। ও অত ভাবতে পারছে না।গাতরটা এখনও ব্যাথা করছে। হঠাৎ দরজায় টোকা।
বেশে মৃদু স্বরে কেউ বললো :- কেউ আছেন?
কাপড় টা কোন ক্রমে জরিয়ে
চম্পা:- কে ? আমি ঘরে আছি। আসছি
হালকা ধাক্কা দিতেই দরজাটার ফাঁক দিয়ে দুম করে কিছু আলো ঘরের চলে এলো। বাহিরে দাড়িয়ে থাকা মানুষটা অচেনা চম্পা র। ঘরে ভিতরের মদ, উগ্র সুগন্ধি আর গুমোট ভাবের মিশ্রিত একটা গন্ধ নাকে ধাক্কা দেওয়া লোকটার মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেলো, মুখে চোখে বিরক্তি আর কৌতুহলী ভাব। বোঝাই লোকটা এখানে প্রথম এসেছে ।
লোকটা না বলে ছেলে বলাই ভালো।
ছেলেটা বললো:- আমি। আসলে…
চম্পা বললো:- দেখুন পরে আসুন, সারা রাতে ধকল গেছে। আধঘণ্টা পরে আসুন।
ছেলেটা আবার আমাতা আমতা করে বললো :-
না আসলে।
চম্পা :- বুঝতে পেরে ছি বাবু এখানে প্রথম। তাড়া আছে,আমি খালি আছি। একটু মুখটা ধুয়ে নিতে দাও। চা না খেলে আমার মুড আসে না।তোমাকে সেরা মজা দেবে চম্পা । পুরো পয়সা উসুল মজা দেবো বাবু। তবে রেট ফিক্সড ঘন্টায় দেড় হাজার টাকা তবে তোমার জন্য ইস্পেশাল ছাড় হাজারে ফাইনাল। মদ আনতে বলবো নাকি ? দেশী বিদেশী সব পাবে। তার জন্য আলাদা রোখড়া।
ছেলেটা :- আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।
চম্পা:- রেন্ডি কে আবার আপনি?? কে গো তুমি?
তুমি তো ভদ্রঘরের ছেলে। সকাল সকাল এয়েচো আমায় পছন্দ হলো না বুঝি। কচি মাল চাই? বলো তোমার বাজেট কতো?
ছেলেটা বললো:- চম্পা দেবী মাফ করবেন,আমি ওই জন্য আসিনি।
চম্পা হো হো করে হেসে :- এ পাগলা না সিপি এম। ব্যেশাকে এতো সম্মান,কি চাই পরিস্কার করে বলো দেখি।
ছেলেটা বললো :- আমি প্রতিমা তৈরির জন্য আপনার দালানের মাটি নিতে এসেছি।
চম্পা :- অঅঅ…এই নাটকে .পুজো আসছে। এই সময় তো আমাদের দুয়ারে অনেক ভদ্রলোকের পা পড়ে। আমাদের মতো অপবিত্র দের কথা মনে পরে। আমাদের হাত থেকে মাটি নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। বসুন দিচ্ছি।
ছেলেটা বললো:- আপনাদের দালানের মাটি দিয়েই তো মায়ের প্রতিমা গড়া হয়। নিজেকে অপবিত্র মনে করছেন কেন??
চম্পা ছেলেটির দিকে তাকিয়েই থাকে। এই গুমোট পরিবেশে ওর অস্বস্তি হলেও ছেলেটার চোখে চম্পা জন্য সম্মান রয়েছে, যা চম্পা অন্য কারো চোখে দেখেনি।
চম্পা পোশা টিয়া হঠাৎ ই “মা মা , খেতে দে, “বলে ডেকে ওঠে।
ছেলেটা হঠাৎ চম্পা ঘরে ঢুকে পড়ে টিয়া পাখিটার কাছে চলে যায় তারপর বলে ” এটা আপনার টিয়া কি সুন্দর। কি সুন্দর মা বলে ডেকে উঠলো। আপনার ছেলে না মেয়ে এটা..”
চম্পা একটু হেসে উঠে যায়। ” এখানে মেয়ে হয়ে জন্মানো অভিশাপ।”
ছেলেটা বললো ” জানেন আপনি নিজের জীবন কে অভিশাপ বলেছেন,কারণ জীবন নিয়ে আপনার হয়তো অনেক অভিযোগ আছে। এই জীবন টা নিয়ে সন্তুষ্ট না। কিন্তু সমাজের কোন মানুষের জীবন টা নিয়ে সন্তুষ্ট।সবার জীবনে অনেক অনেক অভিযোগ। আপনি দেহ বেচে, কেউ বেচে শ্রম, কেউ বেচে মেধা। সবাই আমরা বিক্রি করি নিজেকে। তাই আপনার আমার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ”
চম্পা হাসলো একটু পরেই আঁচল ভরে মাটি নিয়ে আসে।
চম্পা বললো:- ব্যাগ দান বাবু। মাটি ভরে দিই।
ছেলেটা:- আপনাদের ঘরের মাটি দিয়েই কেন মায়ের মূর্তি গড়ানো হয়? জানেন?
চম্পা বললো:- না না। শিক্ষিত হলে কি দেহ বিক্রি করে খেতে হতো বছরের পর বছর ভদ্র বাবুরা এসে নিয়ে যায় তাই দেখেছি।
ছেলেটা বললো:- আপনাদের নিষিদ্ধপল্লীর মাটি দিয়ে তৈরি হয় দুর্গা প্রতিমা! নেপথ্যে লুকিয়ে রয়েছে গুঢ় রহস্য
কুমোরটুলি জুড়ে সোঁদামাটির গন্ধ। শুরু হয়ে গিয়েছে প্রতিমা তৈরির কাজ। কাঠামোয় পড়েছে মাটির প্রলেপ, রঙের পরত। মৃৎশিল্পীদের হাতে ধীরে ধীরে প্রাণ পাচ্ছে মাতৃপ্রতিমা। মা দূর্গা অপূর্ণ আপনাদের মাটি ছাড়া।প্রতিমা তৈরিতে গঙ্গা জল, ধানের শীষ, গোবর, গাভীর মূত্র ছাড়া আরও একটি উপকরণ হল যৌনপল্লির মাটি। হ্যাঁ, দুর্গাপ্রতিমা তৈরিতে সমাজের তথাকথিত অপবিত্র পাড়ার মাটিই অপরিহার্য।মা মহামায়া যেমন অসীম তেমন এই মাটির প্রবিত্রতাও অসীম। তাই এই মাটি দিয়েই মা সেজে ওঠে।এই মাটি জমে আছে অসীম পবিত্রতা।
চম্পা:- সত্যি, এই মাটি এতো মূল্যবান ? তাহলে যে আমাদেরকে সবাই অচ্ছূৎ বলে।
ছেলেটা বললো “কে বললে আপনারা অচ্ছুৎ। ও আপনি আপনার ছেলেকে তো খেতে দিলেন।আপনি বলেলেন চা না খেলে আপনার মুড আসে না, আমাকে একটু চায়ের জন্য বললেন । ”
চম্পা বললো ” আপনি চা খাবেন। ”
ছেলেটা বললো ” এক ঢিলে দুই পাখি মরা হবে,আপনি অচ্ছুৎ নয় প্রমাণ হবে। আর একটু গল্প করা যাবে। ”
চা খেতে খেতে উনি বললো। “গঙ্গা মাটি এবং গণিকালয়ের মাটির ছাড়াও দেবীর মূর্তি তৈরির কাজে যে মাটি ব্যবহৃত হয়, তাতে রাজদরবারের মাটি, চৌমাথার মাটি, গজদন্ত মৃত্তিকা, নদীর দুই তীরের মাটি থাকে। নারীশক্তিকে সম্মান জানিয়ে দুর্গা পুজোয় ব্যবহৃত হয় নবকন্যার ঘরের মাটি।
এই নবকন্যা হলেন (১) নর্তকী/ অভিনেত্রী, (২) কাপালিক, (৩) ধোপানী, (৪) নাপিতানি, (৫) ব্রাহ্মণী, (৬) শূদ্রাণী, (৭) গোয়ালিনী, (৮) মালিনী ও (৯) পতিতা। তাই আপনি নিজেকে অপবিত্র ভাবেন না আজ থেকে। ”
আর তারপর উনি নজরুল ইসলামের ব্যাশা কবিতাটিও আবৃত্তি করলো।
চা আড্ডা শেষ হলো আরো মিনিট দশকের মতো। এ বাড়িতে কোন পুরুষের উপস্থিত চম্পার ভালো লাগে না তেমন সবাই আসে তো শরীরের খিদে মেটানোর তাগিদা নিয়ে। কিন্তু ছেলেটা অদ্ভুত কত কথা বলতে পারে। দশ মিনিটে বিশ্বের দর্শন করিয়ে দিলো। তাই ভালো লাগছিলো ওর উপস্থিতি।
ছেলেটা হাসলো:- কৃতজ্ঞতা জানাবো না। একদিন আসুন আমার স্টুডিও তে। এ বছর আমি প্রথম ঠাকুর গড়ছি মামার সাথে। গনেশ পাল আমার মা। আপনাকে তো মেয়ের মতো দেখে উনি। ”
চম্পা বললো:- নিশ্চিত যাবো। আপনার নাম টা জানা হলো না।
ছেলেটা হেসে বললো। “মানব। ”
মানব চলে যেতে অনেকক্ষন গলিটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। এখনও তেমন বেলা হয়নি। খদ্দের আসার সময় হয় নি। তবুও শ্যামলী, পম্পারা গলিতে ফিল্ডিং দিতে শুরু করে দিয়েছে। চম্পা আজ ওদের সাথে প্রতিযোগিতায় নামবে না। মানব বাবু ওনার কার্ড দিয়ে গেছে। উনি ওর ছবি আঁকাতে চেয়েছে। তবে বলেছেন এখন তেমন পয়সা দিতে পারবে না। বিক্রি হলে দেবে।
কিন্তু ঠিক পয়সার লোভে নয় একটা আজানা টানে ও মানবের স্টুডিও যাবে ঠিক করলো। কিন্তু আজ যাওয়া টা ঠিক হবে কি না। মহালয়া দিন যাবে ও।
দেবী দুর্গার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই আসবে ও। আর মানবের সাথে দেখা হয়ে ও জীবন নিয়ে একটা আলাদা ধারণা তৈরি হয়েছে। জীবন টা নতুন করে বাঁচাতে ইচ্ছা করছে ওর। তাই প্রতি দান একটা প্রণাম করে আসা উচিত মাকে। পূজার সময় তো মা ব্যাস্ত থাকবে। হয়তো চম্পা ও। তাই কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসতে চায় সে তারাতারি।
,,,,,,
