সময়ের দরজা

0

মেঘে ঢাকা এক বিকেল। পুরান ঢাকার সরু গলির ভেতরে, ধুলো ধরা এক প্রাচীন বইয়ের দোকানে ঢুকল আরসোহা। ইতিহাসের ছাত্রী সে, কিন্তু ইতিহাসের তারিখ আর ঘটনায় নয়—তার আগ্রহ সেইসব মুহূর্তে, যেগুলো হয়তো ইতিহাসের বইতে লেখা হয়নি, কিন্তু পরিবর্তন করে দিয়েছে পুরো পৃথিবী।

 

দোকানের এক কোণে, ম্লান আলোয়, তাকের ওপর রাখা ছিল চামড়ার মলাটের একটি ডায়েরি। মলাটে খোদাই করা শব্দ—“TEMPUS PORTA”। নিচে ছোট হরফে, লাতিন থেকে বাংলায় অনুবাদ—”সময়ের দরজা”।

 

ডায়েরির প্রথম পাতায় একটি অদ্ভুত সতর্কবার্তা—

“যে এই ডায়েরি পড়বে, সে সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাবে।”

 

আরসোহা ভ্রু কুঁচকে হাসল, “পুরনো দিনের নাটকীয় ধাঁচ।”

 

পাতা উল্টাতেই পেল একটি তারিখ—১৪ আগস্ট, ১৯৪৭। সেই তারিখটি উচ্চস্বরে পড়তেই বইয়ের দোকানের দেয়াল যেন কেঁপে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে ধোঁয়া, ঝড়ো শব্দ, আরসোহা চোখ বন্ধ করল…

 

চোখ খুলতেই দেখল—সে দাঁড়িয়ে আছে এক ভিড়ভাট্টার রাস্তার মাঝখানে। মানুষের গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, হাতে সবুজ পতাকা, মুখে উল্লাসের ধ্বনি—পূর্ব পাকিস্তান জন্ম নিয়েছে।

 

কেউ একজন ধাক্কা দিয়ে গেল। ঠিক তখনই এক বৃদ্ধ তার হাতে একটি চিঠি দিয়ে বলল—

—“এটি পৌঁছে দাও সায়রার কাছে। না হলে ইতিহাস বদলে যাবে।”

 

আরসোহা বিভ্রান্ত। সে জানে, ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশ ছিল না, এই দিনটির মূল্য অসীম। কিন্তু সায়রা কে? কেন চিঠি তার কাছে পৌঁছাতে হবে?

 

সে রওনা হলো, কিন্তু ভিড়ের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলল। হঠাৎ এক বিকট বিস্ফোরণ! ধুলোয় আকাশ ঢেকে গেল। চিঠি তার হাত থেকে পড়ে মাটিতে। এক কালো চাদর পরা লোক সেটি তুলে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল জনতার মধ্যে।

 

অসীম ব্যথা, মাথা ঘুরে আসা… আরসোহা আবার ধোঁয়ার মধ্যে হারিয়ে গেল।

 

 

 

দ্বিতীয় যাত্রা — ভাষার জন্য রক্ত

 

চোখ খুলতেই সে আবার সেই বইয়ের দোকানে। কিন্তু এবার ডায়েরির মলাটে নতুন একটি লাইন—

“তুমি ইতিহাস বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছ।”

 

হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠল। শেষ পাতায় আরেকটি তারিখ—২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২।

 

সে বুঝল, ডায়েরি তাকে আরেকটি সুযোগ দিচ্ছে। এবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে তারিখটি উচ্চারণ করল। আবার ধোঁয়া, আবার সময়ের স্রোত…

 

এবার সে ঢাকা মেডিকেল এলাকার সামনে। উত্তেজনা, প্রতিবাদ, পুলিশের লাঠি, মানুষের স্লোগান—“রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”। ভিড়ের মধ্যে সে দেখতে পেল সেই একই কালো চাদর পরা মানুষটি—হাতে একটি রক্তমাখা খাম।

 

আরসোহা তার পিছু নিল। সরু গলিতে ঢুকে লোকটি পিছনে তাকাল, ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসি—

—“তুমি আবার ফিরে এসেছ?”

 

এরপর হঠাৎ ছুরি বের করল। আরসোহা দৌড় দিল। মানুষের ভিড় পেরিয়ে, গলির শেষ প্রান্তে পৌঁছে সে হাত বাড়িয়ে চিঠি কেড়ে নিল।

 

চিঠি খুলে দেখল—সেখানে কয়েকটি নাম লেখা, যারা ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। যদি এই নামগুলো ভুল হাতে পড়ে, সবাইকে গ্রেফতার করা হবে।

 

সে দ্রুত চিঠিটি সেই ছাত্রনেতার হাতে পৌঁছে দিল। মুহূর্তের মধ্যে চারপাশে গুলির শব্দ। কিন্তু এবার ধোঁয়া তাকে টেনে নিল না—বরং দৃশ্য বদলে গেল ধীরে ধীরে…

 

 

 

তৃতীয় যাত্রা — স্বাধীনতার প্রভাত

 

সে এখন দাঁড়িয়ে আছে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে। চারপাশে উত্তেজনা, অস্থিরতা, পাকিস্তানি সেনাদের নিষ্ঠুরতা। ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠায় লেখা—

“এটাই তোমার শেষ সুযোগ।”

 

এক মুক্তিযোদ্ধা তার হাতে একটি মানচিত্র দিল—যেখানে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান চিহ্নিত।

—“এটি সেক্টর কমান্ডারের কাছে পৌঁছে দাও। অন্যথায় হাজারো প্রাণ যাবে।”

 

রাতের অন্ধকারে নদী পেরিয়ে, গ্রাম পেরিয়ে, সেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আরসোহা মানচিত্রটি পৌঁছে দিল। সকালে সূর্যের আলো ফোটার সাথে সাথে সে দেখল—বাংলার আকাশে উড়ছে লাল-সবুজ পতাকা।

 

হঠাৎ তার চোখ ঝাপসা হয়ে গেল।

 

 

 

ফিরে আসা

 

আরসোহা আবার সেই বইয়ের দোকানে। কিন্তু এবার ডায়েরি নেই। দোকানদার অবাক হয়ে বলল—

—“মেয়ে, তুমি তো অনেকক্ষণ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছো। কিছু খুঁজছো?”

 

সে হাসল, কিছু বলল না। কিন্তু বুকের ভেতর এক উষ্ণ তৃপ্তি—সে জানে, ইতিহাসের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত সে রক্ষা করেছে।

 

দোকান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দরজার ওপরে ঝুলন্ত আয়নায় তার প্রতিচ্ছবি দেখল। আয়নায় এক মুহূর্তের জন্য দেখা গেল সেই কালো চাদর পরা মানুষটি—মুখে রহস্যময় হাসি…

 


56
বিজ্ঞাপনঃ মিসির আলি সমগ্র ১: ১০০০ টাকা(১৪% ছাড়ে ৮৬০)

0

Nazia Sultana

Author: Nazia Sultana

"সাহিত্যে ডুবে থাকা একজন নিবেদিত লেখক আমি।"

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

প্রতি দান

রাতে থেকে বৃষ্টি হচ্ছিলো, কিছুক্ষণ,বৃষ্টি থেমেছে সবে। সকাল কখন হয়েছে চম্পা জানে না। চম্পা শুনেছে, ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। জ্যোতিষশাস্ত্র

অ্যাথেনার অলৌকিক হার্প

অনেক অনেক বছর আগে, প্রাচীন গ্রিসের এক ছোট্ট গ্রামে বাস করত এক কিশোরী মেয়ে—নাইরা। সে দরিদ্র ছিল, কিন্তু তার গলায়

নীলচোখা জলপরী

শঙ্খনদী গ্রামের সকাল সবসময় সমুদ্রের শব্দ দিয়ে শুরু হয়। মাটির ঘরগুলোর চালের ফাঁক দিয়ে বাতাস ঢোকে, আর বাতাসের সাথে ভেসে

অবাধ্য ছেলের পরিণতি

এক গ্রামে মাহিন নামে এক দুষ্টু ছেলে ছিল । সে অনেক দুষ্টু ছেলে ছিল । স্কুলে বাংলা ক্লাস । সে

Leave a Reply