সূরাহ : নিশু, নিশু! এই তারছিরা নিশু।
নিশু নিজ গৃহ থেকে বেরোতে বেরোতে বললো-
নিশু : তুই আবার আমারে তারছিরা কইতাছোছ?
সূরাহ : তোরে তারছিরা না কইলে আমার ভাল্লাগে না।
নিশু : হইছে, তোয় সক্কাল-সক্কাল বাড়ি আয়লি যে?
সূরাহ : আইজ আমি ইস্কুলে যামু না। মামা বাড়ি বেড়াইতে যামু, এইডাই কইতে আয়ছি।
নিশু : আবি কবে? তাইলে তো আমার একলা ইস্কুলে যাওয়া লাগবো।
সূরাহ : আইজ বিকালেই আইয়া পরমু।
নিশু : তাইলে আমিও যামু না আইজকা।
সূরাহ : আইচ্ছা। আর শুন, আর একটা কথা কইবার আইছিলাম।
নিশু : কি কথা?
সূরাহ : কাছে আয়, এই কথা আমাগো দুইজনের মইধ্যে গোপন থাকবো।
অতঃপর নিশু সূরাহ’র কাছাকাছি যেতেই সূরাহ নিশুর কানে ফিসফিস করে বলতে শুরু করলো-
সূরাহ : রহিম চাচার গাছে এইবার হেব্বি বড়ই ধরছে। কালকে ভোরে আযান দেওয়ার আগে আগে লিলিগো বাড়ির সামনে দাড়াবি। ওনতে আমি আর তুই মিল্লা বড়ই আনবার যামু।
নিশু : রহিম চাচা যেই মানুষ, আমগোরে বড়ই আনতে দিবো তোর মনে হয়?
সূরাহ : আরে গাধী! হুদাই কি তোরে তারছিরা ডাকি আমি? এত্তো সক্কাল-সক্কাল কে তোর লাইজ্ঞা গাছ পাহাড়া দিবো? এই বুইড়া বেডায় তো তহন ঘুমে থাকবো।
নিশু : সুরাহ’রে আম্মায় জানলে আমারে মাইরাই ফালাইবো। আম্মায় কয় সক্কালের এই কুয়াশা নাকি ভালা না। গেরামে নাকি এই কুয়াশায় কি ঘুইরা বেড়ায়।
সূরাহ : তোর মাথা। চাচী তো কয় তোরে ভয় দেখানির লাইজ্ঞা। এইগুলো সব ফাও কথা। অনেক দেরি হইয়া গেছে, এলা আমি যাই। আর যদি কালকে আযানের আগে তোরে লিলিগো বাড়ির সামনে না দেখিরে নিশু! তুই শেষ, তোরে একেবারে ভ্যানিশ কইরা দিমু আমি।
পরের দিন-
সূরাহ লিলিদের বাড়ির সামনে নিশুর জন্য অপেক্ষা করছে ১৫ মিনিট যাবত। তবে নিশুর আসার কোনো নামগন্ধও নেই। সুরাহ সেখানেই একটা গাছের গোড়ায় বসে অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পরে। একসময় কারো ডাকে সূরাহ’র ঘুম ভাঙে।
নিশু : সূরাহ! এই সূরাহ! উঠ তারাতাড়ি।
সূরাহ চোখ খুলে সামনে তাকাতেই সব ঘুম সাথে সাথে উধাও হয়ে গেলো এবং ক্ষিপ্ত স্বরে প্রশ্ন করলো-
সূরাহ : এতো আগে আইলি কেন? আরেকটু পরে আইতি!
নিশু কিছুটা বোকা স্বভাবের মেয়ে। তাই সূরাহ’র কথার মানে নিশু বুঝতে পারে নি। নিশু ভেবেছে সত্যি নিশু আগে আগে চলে এসেছে। তাই নিশুও জিজ্ঞেস করলো-
নিশু : বেশি আগে আইয়া পরছি? তোয় তুইও তো অনেক আগে আইয়া পরছোছ!
সূরাহ : হুদাই কি তোরে আমি তারছিরা ডাকি?
নিশু : এহনি তো কইলি আগে আয়ছি। তাইলে আবার তারছিরা ডাকছ কেন?
সূরাহ : ওরে তারছিরা, এতো আগেই আয়ছোছ যে তোর লাইজ্ঞা অপেক্ষা করতে করতে আমি ঘুমাইয়াই পরছিলাম।
অতঃপর নিশু বুঝতে পারলো সূরাহ আসলে কি বুঝাতে চেয়েছে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে বললো-
নিশু : এহনো বিশ মিনিট বাকি আছে আযান দেওনের। তারাতারি চল।
সবাই জেগে উঠার ভয়ে নিশু আর সূরাহ তারাতারি করে চলতে শুরু করলো বড়ই পারার উদ্দেশ্যে। কুয়াশার কারনে চারদিকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তারপরও এই কনকনে শীত এবং কুয়াশাকে উপেক্ষা করে পনেরো বছরের দুটো মেয়ে ছুটে চলেছে। দুজনেই দুজনের হাত ধরে আছে। কেননা এই কুয়াশায় একবার হাত ছুটে গেলে খুজে পাওয়া অনেকটা কষ্টসাধ্য। দুজনেই প্রাণপণে দৌড়ে চলেছে। একসময় তারা তাদের গন্তব্যে পৌছে যায়। সাথে করে দুজনেই নিজেদের মন মতো বড়ই পেরে পুনরায় বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। কুয়াশা কিছুটা কমে যাওয়ায় এখন তারা হাত না ধরেই হেটে চলেছে। সেই মুহূর্তে নিশু বললো-
নিশু : সূরাহ! একটা কথা কই?
সূরাহ : যতোডি ইচ্ছা কো। বড়ই দেইখা এহন আমার মন ফুরফুরা আছে।
নিশু : আম্মায় সত্যিই কইতো রে। আসলেই কুয়াশায় আমাগো গেরামে কিছু ঘুইরা বেড়ায়। যেমন আমিও এহন ঘুরতাছি, সাথে আমি আরো অনেক কিছুরে ঘুরতে দেখতাছি।
সূরাহ : হায়রে তারছিরা! তুই তো দিনে দিনে আরো তারছিরা হইতাছোছ। আমার মনডা এহন ভালা দেইখা কিছু কইলাম না তোরে।
সূরার কথা শেষ করার সাথে সাথেই গ্রামের এক পরিচিত হুজুর সূরাহকে ডাক দিলো-
হুজুর : সূরাহ! এই ভোর বেলা একলা একলা কই যাও?
সূরাহ : আসসালামু আলাইকুম, একলা কই হুজুর? আমার লগে তো নিশু আছে।
হুজুর : নিশু?
সূরাহ : হ নিশু। কিরে নিশু তুই চুপ কইরা আছোছ কেন?
সূরাহ উপরোক্ত কথাটি বলে পাশে ফিরতেই দেখলো নিশু নেই। আশেপাশে ভালো করে খুজার পরও যখন নিশুকে পেলো না তখন বললো-
সূরাহ : এহনি তো আমার লগে আছিলো!
হুজুর কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরে কিছু সুরা পরে সূরাহ’র গায়ে ফু দিয়ে দিলেন। সাথে করে বললেন, “চলো আজকে আমি তোমারে দিয়া আসি। আমিও ওইদিকেই যামু।” অতঃপর সূরাহ হুজুরের সাথে চলতে শুরু করলো। আর মনে মনে ভেবে চলেছে এখন যেমন নিশু সূরাহ’কে ফেলেই চলে গেছে, ঠিক তেমনভাবে সূরাহ’ও আজ নিশুকে রেখেই স্কুলে চলে যাবে। একসময় হুজুর সূরাহ’কে জিজ্ঞেস করলো-
হুজুর : সূরাহ মা! সত্যিই কি নিশু তোমার লগে ছিলো?
সূরাহ : হ হুজুর। ওয় আমারে রাইখা কেমনে চইলা গেলো! আমিও আজকে ওরে না নিয়াই ইস্কুলে যামু।
হুজুর : তোমার সাথে কখন দেখা হইছে নিশুর?
সূরাহ : ওইডা তো মনে নাই, তোয় ওয় আইয়া কইছিলো আযান দেওনের আর বিশ মিনিট নাকি বাকি ছিলো।
হুজুর : আচ্ছা তোমারে একটা কথা কমু, তোমগো বাড়ি যাইয়া।
সূরাহ : কি কথা হুজুর?
হুজুর : আগে চলো, পরে কইতাছি।
একসময় তারা সূরাহদের বাড়ি চলে আসে। এতোক্ষণে কুয়াশা পুরোপুরি কেটে গেছে। সকলে জেগে উঠে নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। হুজুরকে বসতে দিয়ে সূরাহ জিজ্ঞেস করলো-
সূরাহ : কি জানি কইবেন কইছিলেন হুজুর!
হুজুর : মা, তুমি আমারে বিশ্বাস করো তো?
সূরাহ : হ করি, এই কথা জিগাইলেন কেন?
হুজুর : মা, তোমার সাথে দেখা হওয়ার আগে আমি নিশুদের বাড়ি গেছিলাম।
সূরাহ : কেন হুজুর?
হুজুর : তোমার সাথে দেখা হওয়ার এক ঘন্টা আগে আমার বাসায় খবর গেছে নিশুদের বাড়ি যাওনের। তোয় যাওয়ার পর শুনি লিলিগো বাড়ির লোকজন নাকি কার চিৎকার শুনতে পাইছিলো। পরে সবাই বাইর হইয়া দেখে বাড়ির পিছনে নিশু মইরা পইরা আছে। আর ওর পুরা শরীরে খামচির দাগ ছিলো। সাথে ওর পেট থেকে অর্ধেক ভুরি বের করা ছিলো। পরে সব লোকজন মিল্লা ওরে তহনই নিশুদের বাড়ি নিয়া যায়। আইজ যোহরের পর জানাজা হইবো নিশুর।
সূরাহ’র আর কোনো কথা না বলেই দৌড়াতে লাগলো নিশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে। কারন সূরাহ জানে নিশু ওর সাথেই ছিলো। আর হুজুরকেও সূরাহ অনেক বিশ্বাস করে। সত্যি মিথ্যা জানার জন্যই সূরাহ প্রান পণে ছুটে চলেছে। যখন সূরাহ নিশুদের বাড়ি পৌছালো তখন দেখতে পেলো বাড়ির চারদিকে কান্নার রোল পরে আছে। নিশুর মা বিলাপ করে কেদে চলেছে, আর তার সামনে রয়েছে একটা লাশ। গ্রামের অনেক লোকজন এসে দেখে যাচ্ছে লাশটি, সাথে করে সবার মুখে একই কথা,”আহারে মাইয়াডা এই বয়সেই মইরা গেলো, বড় ভালা মাইয়া আছিলো।” কিন্তু সূরাহ’র বিশ্বাস হচ্ছে না নিশু আর নেই, সাথে করে মৃতদেহের উপর থেকে সাদা কাফনের কাপড়টি সরিয়ে দেখারও সাহস সূরাহ পাচ্ছে না। যদি সত্যি সত্যি এটা নিশু হয় তাহলে? আর হুজুরের সব কথা সত্যি হলে সূরাহ’র সাথে কে ছিলো? আর সূরাহ’ই বা কাকে এখন তারছিরা বলে ডাকবে? এসব কথা ভাবতে ভাবতে সূরাহ’ও একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। যখন সূরা জেগে উঠবে তখন কি বুঝাবে নিজেকে? কি করে বুঝাবে যে তার প্রাণপ্রিয় বান্ধুবি নিশু আর নেই?
সমাপ্ত

ভালো লিখেছেন কবি