সবগুলো পর্ব পড়ুন-
সাল ১৯৯৩…
তাফীফ : কিরে আলো! কই যাস?
আলো : আহা মরন! চোখে দেখছ না ইস্কুলে যাইতাছি?
তাফীফ : হো দেখতাছি তো।
আলো : তাইলে আবার জিগাস কেন?
তাফীফ : মন চাইছে তাই জিগাইছি। যা তো এনতে, এতো প্যান প্যান না কইরা।
আলো : আমি কইছিলাম আমারে ডাক দিয়া কিছু জিগাইতে। নিজেই প্যান প্যান করে আবার আমারে কয়।
অতঃপর তাফীফ আর কিছু বলার পূর্বেই আলো সেখান থেকে প্রস্হান নেয়। মহল্লার কিছু ছেলের সাথে আড্ডায় মত্ত ছিলো তাফীফ। হঠাৎ করে আলোকে স্কুলে যেতে দেখে উপরোক্ত কথাগুলো জিজ্ঞেস করে এবং আলো সেখান থেকে প্রস্হান নেওয়ার পর আবারো তাফীফ মত্ত হয়ে যায় ছেলেদের আড্ডায়।
বিকেলে-
আলো : আম্মা, আমি বাগানে গেলাম খেলতে।
আমেনা বেগম : ওই মাইয়া দাঁড়া। কিয়ের এতো খেলা তোর? খেলছ তো যাইয়া পিচ্চি পিচ্চি পোলাপানডির লগে। তোর মতো এমন দামড়া মাইয়ারে খেলতে দেখছ এই গেরামে?
আলো : যাই না আম্মা! একটু গেলে কি হয়?
আমেনা বেগম : বাড়ির পিছে যে পাতা জইমা রইছে দেখছোস? যা গিয়া ঝারু দে।
আলো : খেলা শেষ করে সব ঝাড়ু দিয়া একদম ঝকঝকা বানাইয়া দিমু, পাক্কা।
আমেনা বেগম : আলো! তোর আব্বারে বলতে হইবো তুই যে প্রতিদিন বাইরে খেলতে যাস?
আলো : হিহিহি। আমি তো মজা করতাছিলাম আম্মা। আমি তো এখনই ঝাড়ু দিতে যাইতাছি। দেখবা আজকে একেবারে ঝকঝকা বানাইয়া দিমু সব।
আলো আর কিছু বললো না। মন খারাপ করে বাড়ির পিছনে চলে গেলো ঝারু দেওয়ার উদ্দেশ্যে। এদিকে মেয়ের কথা শুনে আমেনা বেগম লুকিয়ে একগাল হেসে নিলেন। উনি ভালো করেই জানতেন আলোর বাবা জহির রায়হানের নাম শুনলেই আলো সুরসুর করে রাজি হয়ে যাবে।
আলো আনমনে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে ঝাড়ু দিতে লাগলো। তার কিছুক্ষন পরই সেখানে তাফীফের আগমন-
“কিরে আলো! আইজকা বাগানে যাস নাই কেন?”
“তুই এনে কেন?”
“তুই যাস নাই দেইখাই দেখতে আয়লাম। ভাবছিলাম তোর মনে হয় বিয়া, এই লাইজ্ঞাই যাস নাই।”
“যাবি তুই এনতে? আমারে জ্বালানি ছাড়া আর কোনো কাম খুঁইজা পাস না?”
“আয়ছেরে! আমার তো পৃথিবীতে কামের অভাব পরছে যে তোরে জ্বালামু।”
“হ, তাইলে যা এনতে এলা।”
“তয় ঝাড়ু হাতে এনে কি করছ?”
“ঝাড়ু হাতে মানুষ কি করে বুঝছ নাহ? তুই এহন যাবি এনতে নাকি ঝাড়ুর বারি খাবি? আমার মেলা কাম পইড়া আছে। তোর লগে প্যাচাল পারার সময় কই আমার!”
“তুই সবসময় আমার লগে রাগ দেখাই কথা কছ কে? মুখে কি একটুও রস কস আল্লাহ তোরে দেয় নাই!”
“না দেয় নাই। তোর সমস্যা আছে কোনো?”
“না আমার সমস্যা থাকবো কেন? আমি তো তোর ভবিষ্যতের বুইড়া, টাকলা, ভুড়িওয়ালা জামাইয়ের কথা ভাইবা কইলাম। বেচারার কপালডাই খারাপ। বুড়া বয়সে শেষমেশ এমন এক তারছিড়া করল্লার মতো তিতা বউ কিনা কপালে জুটবো। ভাবা যায় এগুলা?”
“এইডা আমার আর আমার জামাইয়ের ব্যাপার। তোর ভাইবা কাম নাই। তুই যা তো এনতে।”
“যাইতাছি তো। সারাক্ষণ এতো প্যান প্যান করছ কেন? মাইয়া মানুষ হইছস চুপচাপ থাকবি। তা না কইরা সবসময় খালি প্যান প্যান আর প্যান প্যান। পাশের বাড়ির জমিলারে দেখছোছ? কত ভালা মাইয়াডা! দেখলেই পরান জুড়াইয়া যায়।”
“তো যা না জমিলার কাছেই যা। যাইয়া তোর পরান জুড়া। এনে কি করছ?”
“এর আগে কো তুই আমারে তুই কইরা কছ কেন? আমি তোর বড় না! সম্মান দিয়া কথা কবি। নয়লে নদিতে নিয়া চুবামু তোরে।”
“আয় তোরে দিতাছি সম্মান!”
হাতে থাকা ঝাড়ুটি তাফীফের দিকে উঁচু করে ধরে কথাটি বলে আলো। এতেই তাফীফ বুঝে যায় এখন এখান থেকে না পালালে তাকে নিশ্চিত মার খেতে হবে। তাই তাফীফও আর দেরি করলো না। আলোকে ভেংচি কেটে এক দৌড়ে স্হান পরিত্যাগ করলো। অতঃপর আলো তাফীফের উদ্দেশ্যে বকাবকি করতে করতে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো।
আমেনা বেগম রাতের রান্না করছিলেন। সে সময় সেখানে পাশের বাড়ির জমিলার মা রহিমা খাতুনের আগম ঘটে। আমেনা বেগম রহিমা খাতুনের দিকে একটা হাসি উপহার দিয়ে বসতে দিলেন। রহিমা খাতুনও বিনা বাক্যে বসে পান চিবাতে লাগলেন। তারপর আমেনা বেগমই প্রথমে কথা বলা শুরু করলেন-
“আপা, এহন দেহি আর আগের মতো আহেন না! ব্যাস্ত নাকি অনেক?”
“কয়দিন ধইরা রোগে ধরছে আপা। তাই আর বাড়ির বাইরে যাই না।”
“কি হইছে আফা?”
“এই বয়সে যে কত রোগে ধরে হিসাব নাই। এগুলা রাহেন আপা। আসল কথায় আহি।”
“কি কথা আপা?”
“বাহাদুর মিয়ার পোলা তাফীফ রে তো চিনেনই?”
“হ আপা চিনমু না কেন?”
“তোয় আইজকাল তো তাফীফের লগে আলোর অনেক ভাব দেহা যায়। মাঝে মইধ্যেই দেহি দুইজন একলগে দাঁড়াইয়া কি ফুসুরফাসুর করে।”
“আপা, ওগো সম্পর্ক তো সাপ-বেজির মতো। ফুসুরফাসুর না, দুইজন এক লগে হইলেই ঝগড়া লাগে। ওরা তো বাচ্চা কালের তেই এমন আপা।”
“আপা এইডা না হয় আপনে আর আমি বুঝি। কিন্তু মাইনষে তো আর বুঝে না। আর আমগো আলোও তো দেখতে মাশাল্লাহ। এহন তো আর ওরা ছোটও না। বিয়ার বয়স হইয়া গেছে। এহন এমন দুইডা বিয়ার বয়সি পোলা-মাইয়ারে একলগে দেহা গেলে মাইনষে তো খারাপ কিছু ভাববোই।”
“কেন আপা, কেউ কিছু কইছে?”
“সোজাসুজি কিছু কয় নাই। তোয় কথার ধরনে বুঝছি আর কি।”
“মাইয়াডারে কেমনে বুঝাই কন তো আপা। শুধু হাতে-পায়েই বড় হইছে, বুদ্ধিজ্ঞান আর হয় নাই।”
“আরে আপা এমন যুবতি মাইয়ারে ঘরে বহাইয়া রাখলে তো এমন হইবোই। বিয়ে দিয়ে দিলে দেখবেন সব ঠিক হইয়া যাইবো।”
“দেহি আপা।”
“শুনেন আপা, ভালো একটা সম্বন্ধ আয়ছে আমাগো আলোর লাইজ্ঞা।”
এবার আমেনা বেগম রহিমা খাতুনের দিকে ঘুরে বসলেন। উনার চেহারায় কিছুটা সিরিয়াসনেস ফুটে উঠেছে। এই দেখে রহিমা খাতুন তৃপ্তির হাসি হাসলেন। আর বলতে লাগলেন-
“পোলা অনেক ভালা আপা। লাখে একটা। বিশাল বড়লোক। আমগো আলোরে পুরা রাজরানী বানাইয়া রাখবো। আলোরে নাকি নদীর পাড়ে দেখছে পোলায়। দেইখাই নাকি আলোরে মনে ধইরা গেছে। পরে আমাগো সবুজ রে কইছে আপনাদের জানাইতে। আপনেরা রাজি থাকলে বাপ-মা নিয়া আয়বো।”
“পোলাডা কে আপা?”
“আপনেও চিনেন। আমাদের এলাকার চেয়ারম্যানের পোলা জুবায়ের।”
“আপা পোলার তো অনেক বেশি বয়স। আর আগেও নাকি একটা বিয়ে করছিলো!”
“বয়স দিয়া কি করবেন আপা? মাইয়া সুখে থাকলেই তো হইলো। আলো অনেক সুখে থাকবো ওই পোলার কাছে। আর আপনে তো জানেন না আপা, আগের বউডারে কত ভালোবাসতো। কিন্তু বউডার হায়াত আছিলো না।”
” আচ্ছা আপা, ওর বাপের লগে কথা কইয়া দেহি।”
রহিমা খাতুনও আর কিছু বললেন না। বসে বসে পান চিবুতে লাগলেন।
রাতের প্রখর নিরবতা ভেদ করে জানালার বাহির থেকে পাতার মরমর শব্দ ভেসে আসছে। শব্দটা এই সময় ভয়ানক শুনা গেলেও আলো ভয় পেলো না। কারন আলো হয়তো জানে এই সময় এখানে কে চলাচল করছে। তাই তো ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো। তবে এই হাসির কারন যে আলোর কাছেও অজানা, আবার হয়তো জানা যা আলো আপাতত স্বিকার করতে চাইছে না। এসবের মাঝেই হুট করে জানালায় একটু শব্দ হলো। আলো একটু সময় নিয়ে তিনবারের মাথায় শব্দ হতেই জানালাটা খুলে দিলো। দেখলো যা ভেবেছিলো তাই। তাফীফ দাঁড়িয়ে আছে বাহিরে। আলোকে জানালা খুলতে দেখে তাফীফ এক ধমক দিয়ে উঠলো, “হোপ, অসভ্য মাইয়া মানুষ। এতো রাইতে জানালা খুলছোস কোন দুঃখে?”
“দুঃখে খুলতে যামু কেন? খুলছিলাম তো সুখেই। কিন্তু কে জানতো তুই আয়ছোছ! তাইলে তো আর খুলতাম না।”
“আমি ছাড়া এই সময় তোর জানালায় কে আহে?”
“ওইডা আমি তোরে কইতে যামু কেন?”
“ছেহ, তোর তে কত বড় আমি। একটু সম্মান দিলেও তো পারছ!”
“তুই সম্মানের কোনো কাম করছোছ যে তোরে আমি স তে সম্মান দিমু?”
“তোর ওই স তে সম্মান আমার লাগবোও না।”
“এইসব রাইখা আগে এইডা ক যে কোন কামে আয়ছোছ? ”
“আমি কি খালি তোর কাছে কামেই আহি আলো?”
“না তুই তো একটা আকাইম্মা মানুষ। তুই আবার কি কামে আয়বি?”
“না আইজকা কামেই আয়ছি। আর আমি সবসময় যা করি এগুলাই আমার কাম। তোর মতো বলদ মাইয়া এগুলা বুঝবো না।”
“আহারে, তা কি কাম শুনি।”
তাফীফ আরো কিছু বলবে তার আগেই আলোর দরজায় টোকা পরলো। তাই তাফীফকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আলো জানালাটা তাফীফের মুখের উপর বন্ধ করে দিলো। অতঃপর ধীর সুস্থে গিয়ে দরজা খুলে দিলো।
“এতো দেরি লাগে কেন দরজা খুলেতে?” আমেনা বেগম সন্দিহান চোখে আলোর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন। আলো এর প্রতিউত্তরে অমতা অমতা করে বলতে লাগলো,”আসলে আম্মা চোখটা লাইগা আয়ছিলো, তাই।”
“আয়চ্ছা খাইতে আয়।” বলেই আমেনা বেগম চলে গেলেন। আর আলোও যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
চলবে….

ভালো লিখেছেন কবি
ধন্যবাদ আপনাকে