সবগুলো পর্ব পড়ুন-
❝আলো আমার, আলো ওগো, আলো ভুবন-ভরা।
আলো নয়ন-ধোওয়া আমার, আলো হৃদয়-হরা॥
নাচে আলো নাচে, ও ভাই, আমার প্রাণের কাছে–
বাজে আলো বাজে, ও ভাই হৃদয়বীণার মাঝে–।
জাগে আকাশ, ছোটে বাতাস, হাসে সকল ধরা॥
আলোর স্রোতে পাল তুলেছে হাজার প্রজাপতি।
আলোর ঢেউয়ে উঠল নেচে মল্লিকা মালতী।
মেঘে মেঘে সোনা, ও ভাই, যায় না মানিক গোনা–
পাতায় পাতায় হাসি, ও ভাই, পুলক রাশি রাশি–
সুরনদীর কূল ডুবেছে সুধা-নিঝর-ঝরা॥❞
প্রতিদিনকার অভ্যাসের মতো আলো আজও বাগানে ছোট বাচ্চাদের সাথে খেলছিলো। হঠাৎ করে কারো সুরেলা সুরে আলোর খেল থেমে যায়। আলো হারিয়ে যায় এই গানের সুরে। আলোর মনে হচ্ছে এ গানের প্রতিটি লাইন আলোকে নিয়ে গাওয়া, একদম মনের গহিন থেকে। তাই তো এই গানের শব্দ অনুসরণ করে আলো ধীরগতিতে এগিয়ে যেতে লাগলো। হঠাৎ দেখলো একটু দূরেই একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে কেউ একজন বসে আছে। উল্টো দিক হয়ে বসে আছে বিধায় আলো ছেলেটির মুখ দেখতে পেলো না। তবে যতো কাছে যাচ্ছে ততোই ছেলেটাকে পরিচিত বলে মনে হচ্ছে আলোর কাছে। একসময় ছেলেটার ঠিক পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো আলো।
পিছনে কারো অস্তিত্ব অনুভব করে ছেলেটি গান থামিয়ে দিলো। পিছনে কে আছে সেটা দেখার জন্য ঘাড় ঘুড়িয়ে পিছনে তাকালো। দেখলো এক অষ্টাদশী দাঁড়িয়ে আছে। যার কথা ভেবে এতোক্ষণ আনমনে গান গেয়েছে ছেলেটা সেই যে তার পিছনে দাঁড়িয়ে। এবার ছেলেটা ঘুরে বসলো অষ্টাদশীর সামনে। মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটা ছেলেটাকে দেখে চমকে গিয়েছে। মুখের ভাব সেটাই বলে দিচ্ছে। সেটা বুঝতে পেরে ছেলেটা নিজের দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বলতে লাগলো-
“কিরে আলো? আমারে কি বেশি সুন্দর লাগতাছে? এমনে হা কইরা তাকাইয়া আছোছ কেন? ওইদিকে তাকা, নইলে পরে আবার নজর লাগলে আমার কপালে পরীর মতো বউ জুটবো না।”
এতোক্ষন আলো অবাক হয়ে মুগ্ধ নয়নে তাফীফকেই দেখছিলো। কিন্তু যখন তাফীফ উক্ত কথাগুলো বললো তখন আলোর হুশ ফিরলো। আর তাফীফের কথা শুনে একদফা ভড়কে গেলো। কেননা এতোক্ষণ যে আলো তাফীফের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে ছিলো। এ যে মারাত্মক লজ্জাজনক ব্যাপার। কিন্তু আলো ব্যাপারটা তাফীফকে বুঝতে দিতে চাইলো না। তাই কোনো রকম অমতা অমতা করে বলতে শুরু করলো-
“আ, আমি কেন তোর দিকে তাকাইতে যামু? পৃথিবীতে কি ছেলের অভাব পড়ছে যে তোর দিকে তাকামু?”
“না তা পড়ে নাই, তবে আমার মতো সুন্দর পোলা মনে হয় নাই।”
তারপর একটু থেমে কিছুটা শাসানোর স্বরে বলে উঠলো-
“দেখ আলো, আমারে নিয়া উলটা-পালটা কিছু ভাববি না বইলা দিলাম আমি। নইলে কিন্তু ভালো হইবো না।”
আলোর কেনো জানি কথাটা তেমন একটা ভালো লাগলো না। তাই কিঞ্চিৎ রেগে বললো-
“নিজেরে দেখছোছ একবারও আয়নায়? কি না চেহারা আবার আয়ছে নিজেরে সুন্দর কইতে।”
“তো তুই এমনে তাকাইয়া আছিলি কেন আগে আমারে ওইডা বুঝা। দেইখাই মনে হইতাছিলো আমারে চোখ দিয়া গিল্লা খাইতাছোছ।”
এবার আলো কিছুটা দিশেহারা হয়ে গেলো। কি বলবে কিছু খোঁজে পেলো না। বাঁ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা মুছে নিলো। তারপরও কি বলবে তা ভেবে পেলো না। তাই কোনো রকম বলে দিলো,”এ্যহ! ঠেকা আমার?” বলেই উল্টো দিক ফিরে এক দৌড় লাগালো। মূলত তাফীফের থেকে পালানোর উদ্দেশ্যে আলো এমনটা করলো। লজ্জায় আলোর গাল খানিকটা রক্তিম বর্ন ধারন করেছে। আলো তো তাফীফকে দেখার জন্য লজ্জা পায় নি। আলো লজ্জা পেয়েছে এটা বুঝতে পেরে যে তাফীফ ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে যে আলো তাফীফ এর দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিলো। আর ভাবতে পারছে না আলো। লজ্জায় কেমন আসাড় হয়ে পড়ছে শরীর।
আলোর লজ্জা পাওয়াটা তাফীফের চোখ এড়ায় নি। তাই তো আর একটু লজ্জা দিতেই তাফীফ জিজ্ঞেস করেছিলো আলো কেন ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো। আর সফলও হলো বটে। আলোকে দৌড় দিতে দেখে কিছুক্ষণ নিরব থেকে হটাৎ করেই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো তাফীফ। এখন যদি অষ্টাদশী এখানে উপস্থিত থাকতো তাহলে নির্ঘাত এই হাসি তার মনের গহিনে দাগ কাটতে সক্ষম হতো।
“চাচী, চাচী। কই চাচী?”
আমেনা বেগম নিজ কক্ষে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। চোখে তন্দ্রাভাব চলে এসেছিলো কিন্তু কারো ডাকে তা কেটে যায়। তারপর যখন বুঝতে পারেন পাশের বাড়ির সবুজ এসেছে তখন কক্ষ থেকে বেড়িয়ে আসেন। এসে দেখেন সবুজের সাথে আরো তিন থেকে চার জন এসেছে। আর সবার হাতেই বাজারের ব্যাগ। একজনের হাতে আবার অনেক বড় রুই মাছ আর ইলিশ মাছ দেখা যাচ্ছে। আর সবুজের হাতে হরেক রকেমের মিস্টির প্যাকেট। এসব দেখে আমেনা বেগম খানিকটা আঁচ করতে পেরেছেন কে পাঠিয়েছে এসব। তাও নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলেন,”আরে সবুজ যে! আইজকাল তো তোর দেহাই পাওয়া যায় না। তা কি মনে হইরা আইজকা আমাগো বাড়িতে আয়লি?”
“আরে চাচী অনেক কাম থাহে। এহন এইগুলা রাহেন। আর দেহেন আরো কিছু লাগবো নাকি। লাগলে পাঠাইয়া দিমু।”
“এইগুলা রাখমু কেন? তোর চাচা তো নিজেই বাজার কইরা আনে, কাউরে দিয়া আনায় না। তাইলে এগুলা কেন আনলি?”
“আরে আমি আনি নাই। জুবায়ের ভাই পাঠাইছে। বাজারের সব থেইকা বড় মাছ আর সবথেইকা ভালা সবজি এগুলা। ভাই নিজের হাতে বাজার করছে। আর তোরা দাঁড়াইয়া আছোছ কেন? বারান্দায় নিয়া রাখ এগুলা।”
শেষের কথাগুলো সাথের ছেলেদের উদ্দেশ্যে বলতেই ছেলে গুলো একে একে সবাই নিজের হাতের ব্যাগগুলো বারান্দায় রেখে এলো। সবুজ নিজেও মিস্টির প্যাকেট গুলো রেখে আসলো বারান্দায়। তারপর ফিরে এসে না থেমেই বাড়ির বাহিরের দিকে যেতে যেতে বললো,”যাই চাচী, অনেক কাম আছে।”
“এই দাঁড়া দাঁড়া!”
আমেনা বেগমের কথায় দাঁড়িয়ে গেলো সবুজ। তারপর তাড়া দেখিয়ে বললো,”কি কইবেন জলদি কন।”
“এগুলা কেন পাঠাইছে জুবায়ের?”
“কেন আম্মায় আপনেরে কিছু কয় নাই?”
“কইছে, তোয় আমরা তো সম্মতি দেই নাই এহনো! তাও কেন পাঠাইছে?”
“চাচী এগুলা কি ধরনের কথা কন আপনে? ভাই এর মতো একটা পোলারে না করার সাহস এই গেরামে কারো আছে? আর আপনেরা সম্মতি না দিলেই কি ভাই মাইনা যাইবো? ঝামেলা না করতে চাইলে চুপচাপ সম্মতি দিয়া দিয়েন। আর এতো বড় ঘরের সম্বন্ধ আয়ছে এটা তো আপনাদের কপাল। যাই হোক আসি চাচী, একটু তাড়ায় আছি। কিছু লাগলে কইয়েন। ভাই কইয়া দিছে আপনেদের খোঁজ-খবর রাখতে। ”
আমেনা বেগম আর কিছু বললেন না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। উনি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছেন সমনে বড় ধরনে এক ঝামেলা হবে। জহির রায়হানকেও জানানো হয়নি ব্যপারটা। আমেনা বেগম ভেবে রাখলেন, আজ জহির রায়হান আসলে সর্বপ্রথম উনি এটা জহির রায়হানকে জানাবেন। এসব ভাবনার মাঝেই বারান্দার দিকে একবার তাকিয়ে নিজ কক্ষে চলে গেলেন। এগুলো ধরার আর সাহস পেলেন না উনি। সাথে এটাও বুঝতে পারলেন চেয়ারম্যানের ছেলে জুবায়েরের সাথে সবুজের ভালোই উঠা-বসা রয়েছে। যদিও এটা উনি আগেই অনেকের কাছে শুনেছিলেন। কিন্তু আজকে সেটা নিজেও ভালোভাবে বুঝতে পারলেন।
চলবে….
ভালো লিখেছেন কবি
ধন্যবাদ