উপন্যাস পর্ব “তেরো”
মেয়েদের জীবনে বিয়ে একবার হয়
আফছানা খানম অথৈ
ঝুমা তার বাবার সঙ্গে শান্তার বিয়ের ব্যাপারে মোবাইল ফোনে আলাপ করেছে।শান্তা আঁড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনেছে।এরপর থেকে তার মন খুব খারাপ।কখন জানি ছোটনের সঙ্গে বাবা তাকে বিয়ে দিয়ে দেন।এই ভয় ও আস্থিরতা তার ভিতরে কাজ করে প্রতি মুহূর্ত প্রতিক্ষণ।দৃশ্যটা মায়ের চোখে পড়তেই তিনি জানতে চাইলেন,
শান্তা তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন,চেহারায় মলিন চাপ,রুগ্ন রুগ্ন ভাব, শরীর খারাপ?
জ্বী না মা।
শান্তা মায়ের চোখকে ফাঁকি দেয়া সহজ না।সত্যি করে বলতো কি হয়েছে?
মন চাইল বিয়ের কথাটা বলতে কিন্তু পারলো না।যদি কেলেংকারি হয়ে যায়।উনারা বিয়ে মেনে না নেই।তাই আর বিয়ের কথাটা বলা হলো না।কোন মতে উত্তর দিলো,
মা সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। রাত জেগে পড়তে হয়তো তাই,চেহারায় মলিন চাপ পড়েছে।ও কিছু না, পরীক্ষা শেষ হলে সবঠিক হয়ে যাবে।
মেয়ের সন্তোষজনক জবাব শুনে মায়ের দেহে স্বস্থি ফিরে আসল।তিনি ঘরের কাজে মনোযোগ দিলেন।শান্তা চিন্তিত মন নিয়ে কলেজে চলে গেল।সময়মতো ক্লাস শুরু হলো।টিচার টিচিং শুরু করলেন।শান্তা চুপচাপ পেছনের বেঞ্চে বসে আছে।শান্তার মনের গতি ভালো না।তাই সে টিচিং এ মনোযোগ দিতে পারলো না।আজকের টিচিং’র মূল বিষয় ছিল,বিশ্বকবি রবি ঠাকুরের হৈমন্তী প্রবন্ধের হৈমন্তীর জীবনী সম্পর্কে আলোচনা।কিভাবে তার বিয়ে হলো,সংসার জীবনে এসে নির্যাতিত হলো,মৃত্যু হলো এবং তার মৃত্যুর জন্য গোটা হিন্দু সমাজকে দায়ী করা হলো।এসব ট্রাজেড়ীপূর্ণ বিষয়টি টিচার টিচিং’র মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের বুঝিয়ে দিলেন।সবার মনোযোগ পাঠদানের দিকে থাকলে ও শান্তার মনোযোগ কিন্তু সে দিকে ছিলো না।দৃশ্যটি টিচারের চোখে পড়তেই তিনি বললেন,
শান্তা দাঁড়াও?
শান্তা দাঁড়িয়ে গেল।টিচার প্রশ্ন করলেন,
শান্তা বলতো হৈমন্ত্রীর মৃত্যুর জন্য কে দায়ী ছিল?
শান্তার মনোযোগ ছিল না বিধায় সে বলতে পারলো না।মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।এবার টিচার বলল,
রুমা তুমি বলতে পারবে হৈমন্তীর মৃত্যুর জন্য কাকে দায়ী করা হয়েছিলো?
জ্বী স্যার।
বল দেখি।
স্যার হৈমন্তীর মৃত্যুর জন্য রবি ঠাকুর গোটা হিন্দু সমাজকে দায়ী করেছেন।
রুমা ধন্যবাদ বস।
রুমা বসে পড়লো।শান্তা এখনো দাঁড়িয়ে আছে।এবার টিচার তাকে ও বসার অনুমতি দিলেন।তারপর বললেন,
আমি তোমাদের উদ্দেশ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা ও নিয়মনীতি বলছি শুন,
সবাই একবাক্যে বলল,
ইয়েস স্যার বলুন?
বলছি সবাই মনোযোগ দিয়ে শুন,
শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করা মাত্রই আজে-বাজে কথা বলা বন্ধ করবে এবং রুল অনুযায়ী সম্মান প্রদর্শন করবে।
পাঠদানের প্রারম্ভে মনোযোগ আকর্ষন করবে।
পাঠদানের সময় হৈ হুল্লুড় করে শিক্ষককে অসম্মান ও অবমাননা করবে না।
শ্রেণিকক্ষে কোন গোলযোগ দেখা দিলে তাৎক্ষণিক ভাবে তা অধ্যক্ষের কাছে পেশ করবে।
সর্বদা সত্য কথা বলবেও সৎ পথে চলবে।
এর ব্যতিক্রম হলে কিন্তু ভালো ফলাফল অর্জন করতে পারবে না।যার প্রমাণ তোমরা এই মাত্র দেখলে।
সবাই সাপোর্ট করে একবাক্যে বলল,
ঠিক বলেছেন স্যার।
টিচার বিদায় নিলেন।সময়মতো কলেজ ছুটি হলো।শান্তা বেরিয়ে পড়লো।কলেজ গেট পেরিয়ে এক পা দুপা করে এগুতে লাগল।এমন সময় নয়ন শান্তা শান্তা বলে ডাক দিলো।শান্তা থমকে দাঁড়ালো।নয়ন যোগ হলো।তারপর বলল,
শান্তা চলো।
কোথায়?
আমি যেখানে নিয়ে যাব সেখানে।
শান্তা নয়নের বিবাহিত স্ত্রী।তাই না করতে পারলো না।দুজন একটা রিক্সাই উঠে বসলো।কয়েক মিনিটের মধ্যে রিক্সা হোটেল আয়নার সামনে এসে ব্রেক করলো।দুজন নেমে পড়লো।নয়ন ভাড়া দিয়ে ড্রাইভারকে বিদায় করলো।তারপর শান্তাকে নিয়ে হোটেলের ভিতর প্রবেশ করলো। চাবি দিয়ে তালা খুলে একটা ভি আই ভি রুমের ভিতর ঢুকল।তারপর দরজা বন্ধ করে দিলো।শান্তার স্বামী নয়ন, তবুও কেমন জানি ভয়,বুকের ভিতর ধুকধুক করছে।তখনি শান্তা প্রশ্ন করলো,
নয়ন তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এলে কেন?
কেন বুঝনা?
না বুঝি না।
বলছি শুন,শান্তার কানের কাছে ফিসফিস করে নয়ন বলল,
বউকে নিয়ে মজা..।
বলতে না বলতে নয়ন শান্তাকে একটা প্যাকেট বের করে দিয়ে বলল,
এই প্যাকেটের ভিতর শাড়ী আর কিছু কসমেটিকস আছে,তুমি পরে নাও,আমি বাইরে থেকে আসি।
নয়ন বাইরে গেল। শান্তা রুমটাকে ভালো করে দেখে নিলো।খুব সুন্দর ভি আই ভি রুম।দুটো খাট, পরিপাটি বিছানা,সোফা,ডাইনিং টেবিল,ড্রেসিং টেবিল,এটাস্ট বাতরুম।সব মিলিয়ে নবদম্পত্তির জন্য রুমটা দারুণ মানিয়েছে।শান্তা খুব করে সাজু-গুজু করে নিলো।গোল্ডেন কালারের বেনারসি কাতান,ম্যাচিং করা ব্লাউজ,সিটি গোল্ডের নেকলেস ছুড়ি, টিকলি,পায়েল,স্বর্ণের টিপ, এসব সাজে সে সেজেছে।ড্রেসিং টেবিলের ফ্রেমে বাঁধানো বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে দেখে দেখে বলে,
মাসআল্লাহ দারুণ মানিয়েছেতো।নয়নের পছন্দ আছে বলতে হবে।
ঠিক তখনি নয়ন কলিংবেল দিপ দিলো।শান্তা দরজা খুলতে নয়ন একি দেখল,
অপরুপ সাজে দাঁড়িয়ে আছে রুপবতী এক নারী।মানে ফিল্মের নায়িকার চেয়ে ও সুন্দরী তার প্রিয়তমা।তার তাকিয়ে থাকার ভঙ্গিমা দেখে শান্তা বলল,
এমনভাবে তাকিয়ে থাকার মানে কি?
মানে হলো আমার রুপসী বউকে ভালো করে দেখা।
স্বামীর প্রসংশা না শুনলে স্ত্রী লোকের মন কখনো খুশি হয়না।তাই শান্তা জানতে চাইল,
নয়ন শাড়িটা আমাকে কেমন মানিয়েছে?
হুম!দারুণ মানিয়েছে।যার বর্ণনা দিয়ে আমি শেষ করতে পারবো না।অপু বিশ্বাস, পরিমনি এদেরকে ও হার মানিয়েছে?এক কথায় বলা চলা অসম্ভব রকম সুন্দরী আমার বউ।
নয়ন আর চাপা মারতে হবে না।এসো ঘুমাব।
কি বললে তুমি ঘুমাবে?
তো কি করব?
আগে মিষ্টি খাও।তারপর যা করার করব।
নয়ন শান্তার মুখের দিকে মিষ্টি এগিয়ে দিলো।অনুরুপ শান্তা ও তার মুখের দিকে মিষ্টি এগিয়ে দিয়ে বলল,
আগে তুমি খাও।
নয়ন বলল,
না আগে তুমি খাও।এমনি দুষ্টমির চলে কমিনিট পার হলো।তারপর ঠিক একে অপরকে মিষ্টি খাওয়ালো।নয়নের আর তর সইল না।বউয়ের তুলতুলে গালে কিস করতে করতে মজার ভুবনে…।
বিয়ে এমন একটা বাঁধন যা কোন শাসন বারন মানে না।গোপন হোক আর প্রকাশ্যে হোক।তাই আজ শত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে শান্তা নয়ন মিলিত হলো গোপন অভিসারে।একবার ও ভাবল না বাস্তবতার কথা,পিতা মাতার কড়া শাসনের কথা।প্রেম পাগল মন কিছুই মানতে চায় না।চাই শুধু ভালোবাসা আর ভালোবাসা।অনেক রাত করে তারা ঘুমিয়েছে।সকাল দশটা বেজে গেল।এখনো তাদের ঘুম ভাঙছে না।হোটেলে এক প্রকার হৈ হুল্লুড শুরু হলো।
৭ নাম্বার ভি আই ভি রুমের গেস্ট এখনো উঠছে না কেন?হোটেল বয় এসে বারবার কলিংবেল টিপছে। কিন্তু ভিতর থেকে কোন সাড়া আসছে না।সবাই বলাবলি করছে ৭ নাম্বার রুমের গেস্ট মারা গেল নাকি?
শেষ পর্যন্ত ম্যানেজারের নলেজে কথাটা দেয়া হলো।ম্যানেজার ছুটে এসে কলিংবেল টিপ দিলো।শান্তা ওয়াসরুমে,নয়ন ফ্রেস হয়ে সবেমাত্র বের হয়েছে।তখনি কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজা খোলে দিলো।তাৎক্ষণিকভাবে ম্যানেজার বলল,
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখুনতো কয়টা বাজে?
কেন সকাল দশটা। কোন সমস্যা?
সমস্যা মানে সকাল থেকে হোটেল বয় একশ বার কলিংবেল টিপ দিলো।আপনাদের কোন সাড়া শব্দ নেই।আর একটু হলেতো পুলিশ কল করতাম।
সরি ম্যানেজার সাহেব, ভুল হয়ে গেছে।অনেক রাত পর্যন্ত জেগেছিলামতো তাই উঠতে দেরী হলো।
ততক্ষণে শান্তা ওয়াস রুম থেকে বের হলো।তাকে দেখা মাত্রই ম্যানেজার জানতে চাইল,
তুমি মইন সাহেবের ছোট মেয়ে শান্তা না?
জ্বী হ্যাঁ।
তোমার দুজন সম্পর্কে কী?
নয়ন উত্তর দিলো,
আমরা স্বামী স্ত্রী।
ম্যানেজারের গেস্ট এসেছে,তাই তিনি আর কোন প্রশ্ন না করে কাজে মন দিলেন।শান্তা বলল,
নয়ন এই সেরেজে ম্যানেজার বাবাকে সব বলে দেবে।
এখন উপায়?
চলো তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যায়।
নয়ন আর অমত করলো না।ম্যানেজারকে রুম ভাড়া দিয়ে বিদায় হলো।
এদিকে শান্তার মা মেয়ের চিন্তায় অস্থির।মেয়ে গত রাতে বাড়ি ফিরেনি,কোথায় গেল,কার সাথে গেল,নাকি নয়নের সাথে পালিয়েছে এসব ভাবনা তাকে খুব অস্থির করে তুলল।তখনি শান্তা মায়ের পাশে এসে দাঁড়ালো।মেয়েকে দেখা মাত্রই মা জিজ্ঞেস করলো,
শান্তা গতরাতে কোথায় ছিলে?
মা গতরাতে আমার এক সই’র বার্থ ডে ছিল।
তাই বলে রাতে থেকে যাবি?
প্লিজ মা রাগ করো না।অনুষ্ঠান শেষ হতে অনেক রাত হয়েছেতো,তাই আসেনি।
তা বুঝলাম,কিন্তু ফোনে জানিয়ে দিলেতো পারতি।
মা বাবা যদি রেগে যান তাই ভয়ে বলিনি।
যাক মাকে কোন রকম বানিয়ে বলে হাফ ছাড়লো।কিন্তু সত্য একদিন প্রকাশ হবে।তখন কি হবে? এসব ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়লো।একদিকে টেনশন অন্যদিকে রাত জাগা।তাই ঘুম আসতে তার আর দেরী হলো না।