উপন্যাস পর্ব “বারো”
মেয়েদের জীবনে বিয়ে একবার হয়
আফছানা খানম অথৈ
বিয়ের পর একাকীত্ব জীবন কাটানো খুব যন্ত্রণাদায়ক ও কষ্টের।সে বিয়ে গোপনে হোক আর প্রকাশ্যে হোক।নয়নের বেলায় ও তাই হয়েছে।শান্তাকে ছেড়ে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে।বিরহ জ্বালা বড় জ্বালা কাউকে যায় না বলা।নয়ন ভেবেছিল বিয়ে হয়ে গেল টেনশন মুক্ত হবে।কিন্তু না এখন আরও টেনশন বেড়ে গেল।বিধাতার একি লীলা খেলা শান্তাকে কিছুতে ভুলতে পারছে না নয়ন।মধুময় স্মৃতিগুলো বারবার রোমান্থন হয়ে উঁকি দিচ্ছে তার হৃদয়াকাশে।এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারছে না প্রাণ প্রিয়াসীকে।তখনি স্বপ্ন যোগে দেখা দিল শান্তা তার মনের জানালায়।মধুময় স্বপ্নে দুজন বিভোর একে অপরকে জড়িয়ে ধরে মজার ভুবনে….।
সুখ সুখ লাগছে,ইচ্ছে করছে আর ও কিছুক্ষণ থাকতে।কিন্তু পারলো না।শান্তা সরে গিয়ে বলল,
নয়ন একি করছ?
কি করছি মানে।বউকে আদর করছি।
বাবা এখনো আমাদের বিয়ে মেনে নেয়নি।
তাতে কি হয়েছে, তুমি আমার বিয়ে করা বউ।
তবুও আমার ভয় করছে।আগে বাবাকে ম্যানেজ করি তারপর আদর সোহাগ।
শান্তা আমি এতকিছু বুঝি না।আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না।তুমি শুধু আমার অন্য কারো না।যদি শুনি তুমি অন্য কারো হয়ে গেছ।তাহলে…।
তাহলে কি থামলে কেন বল?
তোমার বাড়িতে গিয়ে সুইসাইড করব।সাবধান আমার বিয়ে করা বউ যেন অন্য কারো না হয়।
ওকে সুইট হার্ট। আমি শুধু তোমার অন্য কারো না।নয়নের তর সইল না, শান্তার মুখে মুখ লাগিয়ে কিস কিস….।
শান্তা আবার ও দূরে সরে গেল। ।কি যন্ত্রণা বিয়ে করাও বউকে কাছে পাচ্ছে না।কথাটা ভাবতেই তার হৃৎপিন্ডটা কেঁপে উঠল।মুহূর্তে সে চিৎকার করে বলে উঠল,
শান্তা যেওনা শুন, আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না।যেওনা যেওনা…।
বার বার কয়েক বার ডাকল।নয়নের কথা যেন শান্তার কানে গেল না।সে অদৃশ্য হয়ে গেল।
নয়ন আর কিছুই বলতে পারলো না। টেনশনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।তার চিৎকারে সুমন জেগে উঠল।নয়ন নয়ন বলে কয়েকবার ডাকল।তার কোন সাড়া শব্দ নেই।মনে হয় দুঃস্বপ্ন দেখে মুর্ছিত হয়ে পড়েছে।এই ভেবে নয়ন নাকে মুখে পানি ছিটা দিলো।কিছুক্ষণ পর সে স্বাভাবিক হলো।সুমন বলল,
নয়ন ঘুমের ঘোরে এমন চিৎকার করে উঠলি ক্যান,
দু:স্বপ্ন দেখেছিলে বুঝি?
নয়ন কোন কথা বলছে না।বন্ধুর মুখ পানে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।এবার সুমন বলল,
নয়ন কথা বল,স্বপ্নে কি দেখেছিলে?
না তেমন কিছু না।
নয়ন তবে কি তুই অসুস্থ?
না সুমন আমি ভালো আছি।
তাহলে ঘুমের ঘুরে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলি কেন?
মনে হয় স্বপ্ন-টপ্ন কিছু দেখেছি, মনে নেই।এখনো রাত শেষ হয়নি শুয়ে পড়তো?
সুমন আর বাড়াবাড়ি করলো না।শুয়ে পড়লো।পুজোর ছুটিতে নয়ন বাড়ি আসল।ষ্টেশন থেকে তাদের বাড়ি এক কি:মি হেটে যাওয়া সম্ভব না।একটা রিক্সাই উঠল।গ্রামে প্রবেশ করতে একি শুনল।এক মহিলার করুণ কান্নার আর্তনাদ।নয়ন রিক্সা ব্রেক করে দাঁড়ালো।মহিলাটি কেঁদে কেঁদে বলছে,
হায় আল্লাহগো আমারে মাইরা পালাইলোগো। তোমরা কে কোথায় আছ আমারে বাঁচাও গো বাঁচাও।
পাষণ্ড বোকা স্বামী মারে আর বলে,
এখন কাইন্দ্যা বুক ভাসাইতাছস ক্যান।মাইয়্যা জন্ম দিলি ক্যান।পর পর চার চারডা মাইয়া।পোলা না অইলে বংশের বাতি দিবো কেড়া?যা কইতাছি আমার ঘর থেইক্যা।আজ থেইক্যা তোর খাওন দাওন সব বন্ধ।এই আমি ঘরে খিল দিলাম।
স্বামী ঘরে খিল দিলো।স্ত্রী বাইরে কেঁদে কেঁদে বলে,
ওগো আমি কি করমু। সবইতো আল্লাহর ইচ্ছা।
আমি এসব হুনবার চায়না।আমি আবার বিয়া করুম।
ওগো এমন কঠিন কথা কইয়্যেন না।আমারে ক্ষমা কইরা দেন।
তোর কোন ক্ষমা নাই।আমি বিয়া করমু।আমার পোলা চাই,পোলা।তুই আর আমার ঘরে ঢুকবি না।
এত কথার পরেও তার রাগ পরলো না।সে বউকে দিলো কড়া মাইর।নয়ন থেমে থাকতে পারলো না।বাড়ির ভিতরে ঢুকে পাষণ্ড স্বামীর হাত চেপে ধরে বলল,
মিয়া ভাই কি শুরু করে দিলে থাম।
না নয়ন আমি থামুম না।আমারে ছাইরা দেও।
নয়ন কোন কথা শুনল না।তাকে ঝাপটা মেরে সরিয়ে দিয়ে বলল,
মিয়া ভাই,ফের যদি ভাবীর গাঁয়ে হাত তোল আমি তোমাকে পুলিশে দেব।
নয়ন অপরাধ করলো জরি,আর পুলিশে দিবা আমারে এইডা কেমন কথা।বুঝবার পারলাম নাতো?
মিয়া ভাই বুঝিয়ে বলছি শুন,কন্যা সন্তানের জন্য ভাবী দায়ী নয়, তুমি দায়ী।
কি কও নয়ন আমি দায়ী অমু ক্যান?
মিয়া ভাই আমি ডাক্তার ও নয়,বৈজ্ঞানিক ও নয়,অতি সাধারণ একজন মানুষ।গুটি কতক গুরুত্বপূর্ণ কথা বুঝিয়ে বলছি শুন,
সন্তান ছেলে হবে কি মেয়ে হবে তা নির্ভর করবে পুরুষের উপর,
মানব দেহের প্রতিটি দেহকোষে ২৩ জোড়া ক্রোমোসোম থাকে।তার মধ্যে ২২ জোড়া দেহের গঠন প্রনালী জৈবিক কাজ নিয়ন্ত্রণ করে।এক জোড়া সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করে।
স্ত্রী লোকদের ডিপ্লয়েড কোষে দুটি লিঙ্গ নির্ধারক ক্রোমোসোমই x ক্রোমোসোম (xx)।কিন্তু পুরুষের বেলায় একটি x অপরটি y ক্রোমোসোম (xy)।স্ত্রী লোকদের ডিম্বানু গঠনের সময় প্রতিটি ডিম্বানু অন্যান্য ক্রোমোসোমের সাথে একটি করে x ক্রোমোসোম লাভ করে।কিন্তু পুরুষদের শুক্রানু সৃষ্টির সময় অর্ধেক শুক্রানু x ক্রোমোসোম এবং অপর অর্ধেক y ক্রোমোসোম লাভ করে।গর্ভধারণ কালে x ক্রোমোসোমবাহী শুক্রানু যদি ডিম্বানুকে নিষিক্ত করে,তবে নিষিক্ত ডিমের ক্রোমোসোম হবে xx এবং সন্তান হবে কন্যা।অপর পক্ষে y ক্রোমোসোম বহনকারী শুক্রানুকে দিয়ে যদি ডিম্বানু নিষিক্ত হয়,তবে নিষিক্ত ডিমে ক্রোমোসোম হবে xy। ফলে ভুমিষ্ট হবে পুত্র সন্তান।
আমাদের দেশে কন্যা সন্তান প্রসব করলে অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের কারণে মাকে অপবাদ দেয়া হয়।অথচ কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ার ব্যাপারে মায়ের কোন ভুমিকা নেই।এটা আমার কথা নয়, বিজ্ঞানের কথা।বিজ্ঞান পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এ তথ্য বের করেছেন।তাই আমি বলতে বাধ্য হলাম, কন্যা সন্তানের জন্য জরি ভাবী দায়ী নয়,তুমি দায়ী।অপরাধী তুমি,সাজা তোমার হওয়া দরকার।
জরির স্বামী তার ভুল বুঝতে পেরে বলল,
নয়ন ভাই তোমার মতো কইরা কেউ আমাগোরে কোনদিন বুঝাইয়া কয় নাই।তাই আমরা বেবাক ভুল কইরা গেছি।ভাই তুমি আমারে ক্ষমা কইরা দাও।
মিয়া ভাই ক্ষমা আমার কাছে নয়,ভাবীর কাছে চাও।
নয়ন ভাই তুমি ঠিক কইছ।জরি আমি না জাইনা তোমারে অনেক মারধর করছি।আমারে ক্ষমা কইরা দাও।আমি অপরাধী।তোমার কোন দোষ নাই।
স্বামীর চোখের জল দেখে স্ত্রী বলল,
ওগো এমন কথা মুখা আইনেন না।গুনা অইব।
স্ত্রীর কাছে মাফ চাওয়াটা আমাদের এই পুরুষ শাসিত সমাজে গুনা বলে ধরা হয়।তাই জরি বিবি এমন কথা বলল।কিন্তু স্বামী এসব অন্যায় আর মানতে রাজী না।তাই বলল,
জরি এসব আমি আর মানবার পারুম না।স্ত্রী হোক আর স্বামী হোক যে অন্যায় কইরবে তাকে মাফ চাইতে অইব।তানা অইলে গুনা অইব।জরি তুমি আমারে ক্ষমা না কইরলে আল্লাহ ও আমারে ক্ষমা কইরব না।
এবার জরি বলল,
ওগো আপনি সত্য কইতাছেন?
হু জরি সত্য কইতাছি।আমি সবাইরে বুঝাইয়া কমু,কন্যা সন্তানের জন্য মা দায়ী না।
জ্বে ছমিরনের বাপ আপনি সবাইরে বুঝাইয়া কইয়েন।
নয়ন, জরি ও তার স্বামী দুজনকে মিট করে দিয়ে বাড়িতে ফিরে গেল।মা ছেলের খোস গল্প শেষ হলো।মা ছেলে এক সঙ্গে খেতে বসলো।খেতে খেতে মা বলল,
নয়ন তোকে একটা কথা বলতে চাই।
জ্বী মা বল?
নয়ন একা একা আমার ঘরে ভালো লাগে না।তাছাড়া আমি আর বাঁচব বা কদিন।তাই ভাবছি এবার আমি তোকে বিয়ে করাব।
বিয়ের কথা শুনে নয়নের বুকের ভিতর ধুকধুক শুরু হয়ে গেল।মুহূর্তে তার ভিতরে অস্থিরতা শুরু হলো।কোন মতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
ঠিক আছে মা এসব কথা এখন থাক।আগে আমার পরীক্ষা শেষ হোক তারপর বিয়ের কথা ভাবা যাবে।
