0
ভারতের ওয়াকফ বিল নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। তবে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট যখন বিজেপির মন্ত্রী কিরণ রিজিজু ভারতের লোকসভায় ‘ওয়াকফ সংশোধনী বিল’ পেশ করে, তখন এই বিতর্ক নতুন মাত্রা পায়। হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার এটিকে ‘সংস্কার’, ‘স্বচ্ছতা’ ও ‘আধুনিকতা’র পথ হিসেবে দাবি করলেও, এর মূলে রয়েছে মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অধিকারের উপর আঘাত এবং ভারতীয় সংবিধানের লঙ্ঘন। এই বিলের মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের চরম মুসলিম বিদ্বেষ প্রকাশ পেয়েছে। প্রথমে সংক্ষেপে ওয়াকফ এর ভাবার্থ জেনে নেব।
ওয়াকফ সম্পত্তি শুধু জমি বা ভবন নয়, এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও অর্থনৈতিক ভিত্তি। এই আয়ে মাদ্রাসা, মসজিদ ও এতিমখানা চলে। এই বিলের মাধ্যমে সরকার এই সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণ করলে মুসলিমদের শিক্ষা, কল্যাণ ও ধর্মীয় জীবন বিপর্যস্ত হবে। ভারতীয় সংবিধানের ২৫-২৬ অনুচ্ছেদে ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলা আছে। কিন্তু এই বিল সেই অধিকার কেড়ে নিয়েছে। এটি মুসলিমদের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করার এবং তাদের প্রান্তিক পর্যায়ে নামিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা।
ঐতিহাসিক পটভূমি:
ওয়াকফের ইতিহাস দীর্ঘ। এটি ইসলামের স্বর্ণযুগে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় থেকে শুরু। ভারতে এর আইনি কাঠামো গড়ে ওঠে ব্রিটিশ শাসনামলে। ১৯১৩ সালে ‘মুসলিম ওয়াকফ বৈধকরণ আইন’ পাস হয়, যা মুসলিমদের ধর্মীয় ও জনহিতকর সম্পত্তির জন্য প্রথম আইনি ভিত্তি তৈরি করে। এই আইন নিশ্চিত করেছিল যে, মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান বা দরিদ্রদের জন্য দানকৃত সম্পত্তি তার উদ্দিষ্ট উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হবে। ১৯৫৪ সালে ‘ওয়াকফ আইন’ এসে ওয়াকফ বোর্ড গঠন করে এর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেয়। ১৯৯৫ সালে এই আইন পরিমার্জিত হয়ে ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এই ঐতিহাসিক আইন মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের প্রতীক ছিল। কিন্তু বর্তমান হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার এই ঐতিহ্যকে সংস্কারের নামে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে।
২০২৪-এর সংশোধনী বিল:
নতুন বিলে সরকার ডিজিটাল নিবন্ধন, ওয়াকফ বোর্ডে নারী ও অ-মুসলিম প্রতিনিধিত্ব, জেলাশাসকদের হাতে সম্পত্তি নির্ধারণের ক্ষমতা এবং সরকারি নিরীক্ষণের কথা বলেছে। এগুলো স্বচ্ছতা ও আধুনিকতার জন্য প্রয়োজনীয় বলে দাবি করা হয়। কিন্তু এর পিছনে রয়েছে মুসলিম সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা। জেলাশাসকদের ক্ষমতা ও সরকারি হস্তক্ষেপ মানে ওয়াকফ বোর্ডের স্বায়ত্তশাসনের অবসান। এটি মুসলিমদের ধর্মীয় সম্পত্তির উপর রাষ্ট্রের দখলদারি। সাংবিধানিকভাবে ওয়াকফ মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অধিকার। তাই ওয়াকফ বোর্ডে অ-মুসলিম সদস্যের প্রস্তাব অযৌক্তিক ডিজিটালাইজেশনের নামে নজরদারি করে সরকার মুসলিম সম্পদের উপর নজর রাখতে চায়, যা গোপনীয়তা ও স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ।
স্প্যানিশ ইনকুইজিশনের সাদৃশ্য:
ইতিহাসে স্প্যানিশ ইনকুইজিশনের সময় মুসলিম ও ইহুদিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। ভারতের ওয়াকফ বিল কি সেই কৌশলেরই প্রতিফলন? বিজেপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর অভিযোগ—ওয়াকফ বোর্ডে দুর্নীতি। কিন্তু সমাধান হিসেবে তারা যে পথ বেছে নিয়েছে, তা সংস্কার নয়, বরং একটি সম্প্রদায়ের অধিকারে অবৈধ দখলদারি।
বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া:
ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায় ও বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশ এই বিলের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তারা এটিকে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের উপর আক্রমণ হিসেবে দেখছে। সরকার ‘মুসলিম নারীদের কল্যাণ’ ও ‘সংস্কার’র কথা বললেও, এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের শিরদাঁড়া ভাঙার চেষ্টা। এই বিল শুধু মুসলিমদের পরাজিত করেনি, ভারতের বহুত্ববাদী চরিত্রকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
আমাদের তাওহিদী জনতা! এই অবৈধ আইনের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলতে হবে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও শান্তিপ্রিয় জনগণের উচিত এই জুলুমের প্রতিবাদ করা।
লেখক:
মাহফুজ বিন আব্দুল মালিক মোবারকপুরী
প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, সমালোচক।

0