গল্পঃ অনুপমার চোখে ২

0

গল্পঃ অনুপমার চোখে
লেখকঃ বকুল রায় 

#Part_02

অনুপমাকে ভালোবেসে ফেলেছি, এটা নিজেকে স্বীকার করলেও তাকে বলার সাহস তখনও হয়নি। কারণ জানি, ভালোবাসার কথা বলা আর তা বোঝা দুটো আলাদা বিষয়। অনুপমার চোখে যে শূন্যতা, সেটা হয়তো কোনো এক ব্যথার স্মৃতি, যেখানে আমি প্রবেশ করার অধিকার পাইনি।

প্রজেক্টের কাজ প্রায় শেষ। আমরা দুজনেই ক্লান্ত, কিন্তু তৃপ্ত। এক সন্ধ্যায়, কাজ শেষে আমি অনুপমাকে বললাম, “চলো, একটু হাঁটি। অফিসের কাজের চাপে হাঁপিয়ে উঠেছি।”
সে একটু ভেবে বলল, “ঠিক আছে। তবে বেশি সময় থাকব না।”

আমরা অফিসের কাছের একটা পার্কে গেলাম। ঢাকার ব্যস্ততার মধ্যে এই জায়গাটা যেন আলাদা এক পৃথিবী। পাখিদের ডাক, গাছের ফাঁক দিয়ে আসা হালকা বাতাস, আর নিঃশব্দতা—সব মিলিয়ে অদ্ভুত প্রশান্তি।

“তোমার কী মনে হয়, আমরা কি গল্পটা ঠিকভাবে বলতে পেরেছি?” আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম।
“গল্প ঠিক বলেছি কিনা জানি না, তবে আমরা আমাদের অনুভূতিগুলো ফুটিয়ে তুলতে পেরেছি,” সে বলল।

তার কথা শুনে মনে হলো, সে আসলে আমাদের প্রজেক্টের গল্প বলছে না, বরং নিজের গল্প বলছে। আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। ধীরে ধীরে বললাম, “অনুপমা, তোমার চোখে আমি একটা ব্যথা দেখতে পাই। তুমি যদি কখনো বলতে চাও, আমি শুনব।”

সে থমকে দাঁড়াল। একটু সময় নিয়ে বলল, “সব ব্যথা বলা যায় না, বকুল। কিছু ব্যথা কেবল নিজের ভেতরেই জমে থাকে। তবে তোমার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে মনে হয়েছে, তুমি একজন ভালো মানুষ। আর হয়তো ভালো বন্ধু।”

তার কথাগুলো শুনে মনে হলো, সে আমাকে তার কাছে টেনে নিলেও, একটা অদৃশ্য দেয়াল রেখে দিচ্ছে। তবে আমি হাল ছাড়িনি। অনুপমার এই দেয়াল পেরিয়ে তার মন ছুঁতে হবে।

পরদিন, আমি অফিসে তার জন্য একটা ছোট্ট স্কেচ নিয়ে গেলাম। সেটা ছিল তার মুখের হাসির একটা ছবি। অনুপমা যখন স্কেচটা দেখল, তার চোখে জল চলে এল।
“এটা… এটা আমাকে কেন দিলে?” সে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“কারণ আমি চাই, তোমার চোখে সেই আলো ফিরে আসুক, যেটা হয়তো কোথাও হারিয়ে গেছে,” আমি বললাম।

সে কিছু বলল না। শুধু মৃদু হেসে স্কেচটা তুলে রাখল।

এই ছোট্ট মুহূর্তগুলো আমাদের আরও কাছে আনল। তার হাসির আড়ালে লুকানো রহস্য আমাকে আরও টানতে লাগল। আর আমার মনে হলো, একদিন এই রহস্যের জট খুলবই।

সেদিনের পর থেকে আমার আর অনুপমার সম্পর্ক একটা নতুন মোড় নিল। যদিও আমরা এখনও “বন্ধু” নামের পরিচয়ের আড়ালেই ছিলাম, তবু প্রতিদিন তার কাছে যাওয়ার, তাকে বোঝার চেষ্টা আমাকে এক অদ্ভুত স্বস্তি দিত।

ক্লায়েন্টের ডেডলাইন চলে আসায় অফিসে কাজের চাপ বেড়ে গেল। রাতেও প্রজেক্টের কাজ করতে হচ্ছিল। অফিস থেকে বের হতে হতে রাত দশটা বেজে গেল। অনুপমা বাস ধরতে ব্যস্ত, আর আমি কিছুটা দূর থেকে তাকিয়ে দেখছিলাম।

“তুমি একা যাবে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“হ্যাঁ, আমি ঠিকই চলে যাব। তুমি চিন্তা করো না,” সে হালকা হেসে বলল।
“তবু, আমি তোমাকে পৌঁছে দিতে পারি। রাত অনেক হয়েছে।”

সে একটু দ্বিধা করল। তারপর বলল, “ঠিক আছে, যদি তুমিই জোর করো।”

আমরা রিকশায় উঠলাম। ঢাকার রাতে অদ্ভুত এক মায়া থাকে। রাস্তার আলো, ঠান্ডা হাওয়া, আর মানুষের ব্যস্ততা সবকিছু যেন নীরব হয়ে আসে। সেই রাতে, রিকশায় বসে আমরা কথা বলছিলাম।

“তুমি কি কখনো ভেবেছ, জীবনটা একরকম অ্যানিমেশনের মতো?” আমি বললাম।
সে অবাক হয়ে বলল, “মানে?”
“অ্যানিমেশন তৈরিতে যেমন একটা ফ্রেমের পর আরেকটা ফ্রেম জুড়ে পুরো গল্প তৈরি হয়, তেমনই জীবনও তো মুহূর্ত দিয়ে তৈরি। আমরা বুঝতেই পারি না কখন একটা মুহূর্ত আরেকটাকে বদলে দেয়।”

সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর মৃদু স্বরে বলল, “তুমি ঠিক বলেছ। তবে অনেক সময় আমরা যে মুহূর্তগুলো হারিয়ে ফেলি, সেগুলো ফিরে আসে না।”

তার কথায় আমার বুকটা হালকা ভারী হয়ে গেল। আমি জানি, সে তার অতীতের কষ্টগুলো এখনো বহন করছে।

সেদিন রাতে যখন তাকে তার বাসার সামনে নামিয়ে দিলাম, সে হঠাৎ বলল, “ধন্যবাদ, বকুল। আমার জীবনে এমন মানুষ খুব কম পেয়েছি, যারা এভাবে পাশে দাঁড়িয়েছে।”

আমি হেসে বললাম, “তাহলে এবার থেকে আমাকে সেই মানুষদের তালিকায় রাখো। কারণ আমি তোমার পাশে থাকব, যেকোনো সময়।”

সে কিছু বলল না। শুধু মৃদু হাসল। কিন্তু সেই হাসির ভেতর এক ধরনের প্রশংসা ছিল, যা আমাকে বুঝিয়ে দিল, আমি হয়তো ধীরে ধীরে তার জীবনে আমার জায়গা করে নিচ্ছি।

পরের দিন অফিসে যখন গেলাম, সে আমাকে ডাকল।
“বকুল, আমি তোমার জন্য একটা কিছু এনেছি,” সে বলল।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আমার জন্য?”
সে একটা খাম দিল। ভিতরে ছিল একটা ছোট্ট স্কেচ। সেটা ছিল আমার হাসি ফুটিয়ে তোলা একটা ছবি।

“তুমি সবসময় হাসো। এই হাসি যেন না হারায়,” সে বলল।

আমি সেই মুহূর্তে কিছু বলার জন্য শব্দ খুঁজে পেলাম না। এই ছোট্ট উপহার যেন আমার জন্য অমূল্য হয়ে উঠল।

আমাদের সম্পর্কের রঙ একটু একটু করে বদলাচ্ছে। আমি জানি, আমার ভালোবাসা তাকে জানানো এখন সময়ের ব্যাপার। কিন্তু অনুপমার মনে আমার জন্য জায়গা আছে কি না, সেটা জানার ভয়টা এখনও কাটাতে পারিনি।

অনুপমার প্রতি আমার ভালোবাসা এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে আর চুপ করে থাকা সম্ভব ছিল না। তার প্রতিটি হাসি, প্রতিটি দৃষ্টির আড়ালে যে শূন্যতা, তা পূরণ করার ইচ্ছা আমার হৃদয়ে গভীর দাগ কেটেছে।

এক সন্ধ্যায় কাজ শেষে, যখন অফিসের সবাই বের হয়ে গেল, আমি তাকে ডাকলাম।
“অনুপমা, একটু কথা বলতে পারি?”

সে হাসি মুখে বলল, “অবশ্যই। কী নিয়ে কথা বলবে?”
আমার হাতের তালু ঘামছিল। বুক ধুকপুক করছিল। কিন্তু আমি নিজেকে সামলে বললাম, “অনেক দিন ধরে ভাবছি একটা কথা বলব, কিন্তু সাহস পাচ্ছিলাম না। আজ আর দেরি করতে চাই না।”

সে একটু থমকে গেল। তার চোখে এক ধরনের জিজ্ঞাসা ভেসে উঠল।
“তুমি আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছ, অনুপমা। তোমার সঙ্গে সময় কাটানো, তোমার হাসি দেখা, তোমার গল্প শোনা… এগুলোই আমার দিনগুলোকে রঙিন করে তুলেছে। আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

অনুপমা হতবাক হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড কিছু বলল না। তারপর মৃদু স্বরে বলল, “বকুল… আমি জানি না কী বলব।”
“তোমার কিছু বলার দরকার নেই। আমি শুধু জানাতে চেয়েছিলাম,” আমি বললাম। “তোমার জবাব যাই হোক, আমি তোমার পাশে থাকব।”

কিন্তু সে মাথা নিচু করে বলল, “বকুল, তুমি অসাধারণ একজন মানুষ। আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ তোমার ভালোবাসার জন্য। কিন্তু আমি… আমি তোমাকে সেইভাবে দেখতে পারি না।”

তার কথাগুলো আমার বুকের ভেতর একটা ধাক্কা দিল। কিন্তু আমি চুপ করে রইলাম।
“আমার জীবনে অনেক ভাঙা মুহূর্ত আছে, যা আমাকে এখনও তাড়া করে। আমি কাউকে ভালোবাসার সাহস পাই না, আর তোমার সঙ্গে সেটা করা অন্যায় হবে।”

আমি কিছু বলতে পারলাম না। শুধু তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে। তার চোখে জল টলমল করছিল।

“তুমি আমার খুব ভালো বন্ধু, বকুল। আর আমি চাই, এটা যেন কোনো দিন বদল না হয়।”

আমি মুচকি হেসে বললাম, “তুমি যেমন চাও, অনুপমা। আমি কিছু বদলাব না। শুধু চাই, তুমি খুশি থাকো।”

সে মাথা নিচু করে চলে গেল। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার মনের মধ্যে কষ্ট ছিল, কিন্তু কোথাও একটা প্রশান্তি। কারণ আমি অন্তত আমার ভালোবাসার কথা তাকে জানাতে পেরেছি।

সেই রাতটা আমার জন্য এক অদ্ভুত রাত ছিল। মনটা ভেঙে গিয়েছিল, তবু মনে হলো, আমি হেরে যাইনি। আমি জানি, ভালোবাসা মানে শুধু পাওয়া নয়, বরং প্রিয় মানুষের পাশে থাকা।

(চলবে)….


56
বিজ্ঞাপনঃ মিসির আলি সমগ্র ১: ১০০০ টাকা(১৪% ছাড়ে ৮৬০)

0

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

গল্প সিয়ামের স্বপ্ন আফছানা খানম অথৈ

গল্প সিয়ামের স্বপ্ন আফছানা খানম অথৈ দশ বছরের সিয়াম কমলাপুর রেল ষ্টেশন এ থাকে।তার ঘরে খুব অশান্তি। এক মুহুর্তের জন্য

গল্পঃ অনুপমার চোখে ১

গল্পঃ অনুপমার চোখে লেখকঃ বকুল রায় Part 01 ঢাকার ব্যস্ত সড়কগুলো আমার কাছে সবসময় যেন এক রঙিন ক্যানভাস। ছোটবেলা থেকে

গল্প সুদ আফছানা খানম অথৈ

গল্প সুদ আফছানা খানম অথৈ এক ব্যবসায়ী বিপদে পড়ে এক ইহুদীর কাছ থেকে সুদের উপর কিছু টাকা কর্জ নিলেন।কথা ছিল

গল্প বখাটে আফছানা খানম অথৈ

বখাটে আফছানা খানম অথৈ ফরিদা সবেমাত্র ইন্টারমিডিয়েট এ ভর্তি হয়েছে।রীতিমতো ক্লাস করছে।ইতোমধ্যে অনেকের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠেছে।কলেজ লেভেলে পা দিলে

Leave a Reply