গল্প
একাত্তরের দিনগুলি
আফছানা খানম অথৈ
লেখক রফিকুল ইসলাম রাফি অনার্স মাস্টার্স শেষ করে বেকার ঘুরছেন।চাকরীর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন।অবশেষে লেখালেখিতে মন দিলেন।কিন্তু তাতেও ফেরে উঠতে পারলেননা।নতুন লেখক তাই প্রকাশকরা তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেনা।পাণ্ডুলিপি কেউ পড়ে, কেউ পড়েনা।অনেকে বস্তা পঁচা লেখা বলে ফিরিয়ে দেন।তবুও হাল ছাড়েননি রাফি, প্রকাশকদের ধর্না ধরে চলেছে।
একদিন এক প্রকাশক ঝাড়ি দিয়ে বলল,
বলেছিনা এসব নীচু মানের লেখা আমরা প্রকাশ করিনা।তবুও বিরক্ত করছেন কেনো?
প্রকাশক সাহেব বলছিলাম কী,একটু পড়ে দেখলে ভালো হতো না।
আরে ভাই বিরক্ত করবেন নাতো?শুরুতে পড়ে বুঝতে পেরেছি।লেখার মান ভালো না,বস্তা পঁচা।এসব লেখা আমরা প্রকাশ করিনা।
রাফির চোখের জল টলমল করছে,,লজ্জায় ফেলতে পারছেনা।এক বুক দু:খ নিয়ে ফিরে আসল।মনটা খুব খারাপ তাই ম্যাচে ফিরলনা।ফুটপাতে এক পাশে শুয়ে রইল।ট্রাফিক পুলিশের চোখ পড়তেই তারা এগিয়ে এসে বলল,
এইযে এত রাতে এখানে শুয়ে আছেন কেনো?বাড়িঘর নেই নাকি?
রাফির মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছেনা।সে তাদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।পুলিশ ভাবে অন্য কিছু।চোর ডাকাত হবে হয়তো।
তারা আর দেরী করল না।তাকে থানায় নিয়ে গেল।পরদিন খবর পাই তার বন্ধু সাদেক।ছুটে যাই ,উর্ধবতন কর্মকর্তাকে বুঝিয়ে বলে,তাকে নির্দোষ প্রমাণ করে জামিন নিয়ে আসে।বাসায় আসলে বলে,
তোর আক্কেল হবে কবে বলতো?বাসায় না এসে ফুটপাতে শুতে গেলি কেনো?
দোস্ত আর বলিসনা।প্রকাশকের কথায় মাথায় আগুন ধরে গেল।ওরা বলে আমার লেখা নাকি বস্তা পঁচা।এসব কথা শুনলে কার মাথা ঠিক থাকে বল।
তাই বলে এমন কাণ্ড করবি।তুই সিরিয়াস হও।ভালো কিছু লিখ।দেখবি তোর সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে।প্রকাশকদের লাইন,লোকজন অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য ভিড়..।
দোস্ত তুই ঠিক বলেছিস।তাই করতে হবে।তোর দয়াতে বেঁচে আছি।তোর ঋন কোনদিন শোধ করতে পারবোনা।
হয়েছে আর এসব না বলে, লেখায় মন দেহ।
এরপর রাফি লেখায় মন দিলো।পাঠকের মনোযোগ আকর্ষনেরর জন্য দিন রাত খেটে চলেছে।লিখে ফেলেছে এক কঠিন গল্প।
১৯৭১ সালের কথা।মশিউর রহমান মিশু ছিল একুশ বাইশ বছরের টগবগে যুবক।মাত্র মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে।বাংলাদেশ ছিল তখন পরাধীন।পাকিস্তানিরা এদেশ শাসন করতেন।বাংলাদেশের সরকারী গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিয়োগ দেয়া হতো পাকিস্তানি লোকদের।আমাদের দেশে যা উৎপাদন হতো তা নিয়ে যাওয়া হতো পাকিস্তানে।বঙ্গবন্ধু এসব অন্যায় বরদাস্ত করলেন না।প্রতিবাদ করলেন।ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকে বসলেন।কিন্তু তাতেও কোন লাভ হলোনা।তারা বাঙালি জাতির উপর অন্যায় অত্যাচার করে চলেছে।
এদিকে মিশু ও থেমে নেই।বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য মিটিং মিছিল করে চলেছে।একদিন বাসায় ফেরার পথে দেখল।বোরকা পরা একটা মেয়ে রিক্সায় উঠল।চারদিক কাপড় দিয়ে ঘেরা। কিছুই দেখা যাচ্ছেনা।সে সাইকেল চালিয়ে তার পিছু পিছু গেল।মেয়েটি একটা দ্বোতলা বাসার সামনে এসে নেমে পড়লো। বাসায় ঢুকতেই বাবা বলল,
মা আসতে কোন অসুবিধা হয়নিতো?
জ্বি না আব্বু।
মা একটু সাবধানে চলাফেরা করিস।দেশের অবস্থা ভালোনা।যে কোন সময় যুদ্ধ লেগে যেতে পারে।
মিশু মেয়েটির পরিচয় জেনে নিলো।সে উর্ধবতন কর্মকর্তা ইকরাম খানের মেয়ে সাইয়্যেরা।পরদিন সে সাইয়্যেরা পেছনে পেছনে আসল।কিছু সময় তার বাসার সামনে উঁকিঝুঁকি মারল।সাইয়্যেরা ও ভিতর থেকে উঁকিঝুঁকি মারল।এভাবে রোজ সে সাইয়্যেরাকে ফলো করে চলেছে।একদিন সাইয়্যেরা তার বান্ধবীদের নিয়ে কলেজ মাঠের এক কোনায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে।ঠিক তখনি মিশু সেখানে উপস্থিত হলো।তারপর বলল,
সাইয়্যেরা তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল?
জ্বি বলুন।
এখানে নয়।একটু নিরিবিলি।
দুজন নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল।তারপর মিশু বলল,
সাইয়্যেরা আমি তোমাকে ভালোবাসি।বিয়ে করতে চাই।
সাইয়্যেরা কিছু না বলে কেটে পড়লো।
সাইয়্যেরার মন ও তাই চাই।কিন্তু বাবার ভয়ে কিছু বলতে পারছেনা।কারণ সে পাকিস্তানি, মিশু বাঙালি।বাবা কখনো এ ভালোবাসা মেনে নেবেনা।সাইয়্যেরা মুখে কিছু না বললে ও ভাবসাবে প্রমাণ করে সে মিশুকে ভালোবাসে, পছন্দ করে।তাই সে তার পিছে লেগে আছে।সাইয়্যেরা কিন্তু বাবার ভয়ে আতঙ্ক। কথা বলার কোন সুযোগ পাচ্ছেনা।বাবার পাঠানো রিক্সা করে রোজ কলেজে যাতায়াত করে।এভাবে আর কতদিন। মিশুর কিন্তু তর সইছেনা।একদিন সে তাকে বাসায় নিয়ে যায়।তারপর বিয়ের আয়োজন করে।
খবর পেয়ে সাইয়্যেরা বাবা রাগে আগুন।উর্ধবতন কর্মকর্তা বলে কথা,হুকুমে হাকিম নড়ে।সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ নিয়ে হাজির।মেয়েকে জোর করে নিয়ে আসেন।মিশুর করার কিছুই ছিলোনা।অপলক দৃষ্টি তাকিয়ে রইল।
তারপর শত চেষ্টা করেও সাইয়্যেরার সাথে যোগাযোগ করতে পারলোনা।
এদিকে বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেন,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।
রক্ত যখন দিয়েছি আরও দেব,এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।
এরপর শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। মিশুও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলো।
সাইয়্যেরা মা হতে চলেছে।খবরটা বাবার কানে যেতে তিনি অগ্নিরুপ ধারণ করলেন।সাইয়্যেরাকে বাচ্চা নষ্ট করার জন্য কড়া ধমক দিলেন।সাইয়্যেরা কেঁদে কেঁদে বলে,
প্লিজ আব্বু এমন কথা বলোনা।আমি বাচ্চা নষ্ট করতে পারবোনা।এটা আমাদের ভালোবাসার ফসল।
না তোকে পারতেই হবে।আমরা পাকিস্তানি আর ওহ বাঙালি।একদিন বড় হয়ে ওহ আমাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে।ওকে কিছুতেই রাখা যাবেনা।মেরে ফেল।
আব্বু আমাকে মারো,বাচ্চাকে নয়।সব মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি। মানুষ হত্যা মহাপাপ।সে পাকিস্তানি হোক আর বাঙালি হোক।আল্লাহ এ অন্যায় বরদাস্ত করবেননা।
কে শুনে কার কথা।পাকিস্তানিদের মনে আল্লাহর ভয় নেই।তাই বাঙালিদের উপর অত্যাচার করছে,নির্বিচারে হত্যা করছে।যেমনটি ইকরাম খান তার মেয়ের উপর করছে।শত অনুরোধ সত্বেও তিনি বারবার চাপ দিচ্ছেন বাচ্চা নষ্ট করার জন্য।কিন্তু সাইয়্যেরা রাজী হচ্ছেনা।বাবা মেয়ের মাঝে অনেক সময় ধরে তর্ক বিতর্ক চলে।কোন সমাধান হয়না।তিনি আবারো জোরালো চাপ দেন বাচ্চা নষ্ট করার জন্য।সাইয়্যেরা বাবার পা চেপে ধরে কেঁদে কেঁদে বলে,
বাবা আমি আমার সন্তানের প্রাণ ভিক্ষা চাই।ওকে মেরোনা।আল্লাহর কসম লাগে।
ইকরাম খান আপাতত থামলেন।সাইয়্যেরা স্বস্থির নি:শ্বাস ফেলল।তবুও আতঙ্কের মাঝে আছে। কখন বাবা তার সন্তান নষ্ট করতে বলে।
এদিকে যুদ্ধের ভয়াবহ অবস্থা।পাকিস্তানিরা নিবির্চারে বাঙালিদের হত্যা করছে।আর তা দেখে আনন্দ উল্লাস করছে ইকরাম খান।শুধু তাই নয় মিশুর মৃত্যু কামনা করছে।
অন্যদিকে সাইয়্যেরা স্বামীর দীর্ঘায়ু সুস্থ সবল জীবন ও বাংলাদেশকে স্বাধীন করে স্বামীকে তার কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করছে।
বাবা চায় পাকিস্তানের জয়,মেয়ে চায় বাংলাদেশের জয়,আজব কাণ্ড।
বাংলার মাটি লাল রক্তে রঞ্জিত।রাস্তাঘাট লাশ আর লাশ।কাফন গোসল ছাড়া এক সঙ্গে গনকবর দেয়া হচ্ছে শত শত মানুষকে।তবুও বাঙালিজাতি থেমে নেই।কখনো প্রকাশ্যে কখনো গোপনে শত্রু সেনাদের পরাজিত করছে।নয় মাস যুদ্ধ হলো।ত্রিশ লক্ষ বাঙালি শহীদ হলো।পাকিস্তানিরা পরাজিত হলো।বাঙালিজাতি ফিরে পেল তাদের স্বাধীনতা।
ততদিনে সাইয়্যেরার কোলজুড়ে আসে একটা ফুটফুটে ছেলে সন্তান।সেই সন্তান তার কাছে বেশিদিন ছিলোনা।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সকল পাকিস্তানির দেশে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ পড়লো।ইকরাম খান যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।সাইয়্যেরা তার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে রাখল।বাবার নির্দেশ তাকে নিতে পারবেনা।কিন্তু সাইয়্যেরা মানলেতো, সে তাকে নিবে।বাবা কড়া ধমক দিয়ে বললেন,
যদি ওকে রেখে না যাস এক্ষণই মেরে ফেলব।তার বুকের উপর পা চেপে দিতে প্রস্তত হলো।সাইয়্যেরা কেঁদে কেঁদে বাবার পা চেপে ধরে বলল,
প্লিজ আব্বু ওকে মেরোনা।এইতো আমি রেখে যাচ্ছি।
সাইয়্যেরা নিরুপায় হয়ে বাচ্চাকে মাতৃ শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে রেখা যায়।
এদিকে সকল মুক্তিযোদ্ধা স্বস্ব অবস্থানে ফিরে আসল।মিশু এসে সাইয়্যেরা খোঁজ করলো।খবর নিয়ে জানতে পারলো তারা দেশে ফিরে গেছে।
গল্পটি পাঠক মহলে ব্যাপক আলোডন সৃষ্টি করে।চারদিকে লেখকের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।দূর দূরান্ত থেকে পাঠকরা ছুটে আসছে অটোগ্রাফ নিতে।সেই সঙ্গে ছুটে আসল দুপ্রান্ত থেকে মিশু ও তার স্ত্রী সাইয়্যেরা।ততদিনে দুজন বুড়ো হয়ে গেছে। চুলে পাক ধরেছে।তবুও একে অপরকে চিনতে ভুল করলোনা।দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল।অতপর মিশু বলল,
সাইয়্যেরা তুমি এখনো বেঁচে আছ?
আমার ওতো একই প্রশ্ন,তুমি বেঁচে আছ?
হ্যাঁ আল্লাহ আমাদের দুজনকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।আমাদের সন্তান…।
জানিনা সে কোথায় আছে।
চোখের জল মুছতে মুছতে দুজন ছুটে গেল লেখক রাফির কাছে।তার পরিচয় জানতে চাইলে সে বলল,
আপনারা কারা?
দুজন এক সঙ্গে বলল,
আমরা এ গল্পের নায়ক নায়িকা।এটা আমাদের জীবন কাহিনী।
সত্যি বলছেন?
হ্যাঁ সত্যি।এবার বল তুমি কে?
আমি আপনাদের ফেলে যাওয়া সন্তান রফিকুল ইসলাম রাফি।
সত্যি বলছিস বাবা?
জ্বি হ্যাঁ মা সত্যি।মা, বাবা সন্তান ফেলে দিতে পারে।কিন্তু মা পারেনা।তুমি কিভাবে আমায় ফেলে গেলে?
আর বলিসনা বাবা।সে অনেক করুণ কাহিনী।তোকে বাঁচানোর জন্য এ কাজ করেছি।আব্বার কড়া নির্দেশ বাঙালি বংশধর রাখবেন না, মেরে ফেলবেন।তাই বাধ্য হয়ে তোকে বাঁচানোর জন্য মাতৃ শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে রেখে যাই।
বল কী মা?
হ্যাঁ সত্যি?
তারপর কী হলো?
তারপর দেশে ফিরে যাই।তোর নানা আমাকে বিয়ে দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে।আমি রাজী হলামনা।ভুলতে পারলাম না,তোকে,তোর বাবাকে।বাংলাদেশে ফিরতে চাইলাম।আব্বা দিলোনা।তার এক কথা বিয়ে করতে হবে।আমি করলাম না।তোর বাবার ভালোবাসা বুকে নিয়ে সারা জীবন কাটিয়ে দিলাম।
এখন কিভাবে আসলে?
আব্বা মারা গেলেন।তারপর বাংলাদেশে ফিরে আসলাম।প্রথমে মাতৃ শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে ফিরে গেলাম।ততদিনে কর্মচারী অদল বদল হলো।কেউ মারা গেল।কেউ চাকরী থেকে অবসর নিলো।তোকে যার হাতে তুলে দিলাম রোকেয়া আপা তিনি মারা গেছেন।আমাকে কেউ চিনল না।তোর কথা জিজ্ঞেস করলাম কেউ বলতে পারলোনা,ফিরে এলাম।এরপর অনেক খুঁজলাম কোথাও পেলামনা। নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি,আল্লাহ যেন আমার স্বামী সন্তান ফিরিয়ে দেন।আল্লাহ আমার প্রার্থনা কবুল করেছেন।আমি আমার স্বামী সন্তান ফিরে পেয়েছি।আমি এখনো ভুলতে পারছিনা ‘একাত্তরের দিনগুলি”।আয় বাবা আমার বুকে আয়।
মা বাবা ছেলে মিট হলো।তারা আবার সংসার জীবন শুরু করলো।