কবর
আফছানা খানম অথৈ
লিয়ন’র বড় ভাই আতিক’র বিয়ে।লিয়ন সেজে-গুজে ভাই’র সঙ্গে গেল।কনে পক্ষের লোকজন বরকে বরন করে নিলো।তারপর বর স্টেজের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো, দুজন তরুণী স্টেজের সামনে দাঁড়ানো।একজন কনের আপন বোন অন্যজন চাচাতো বোন।ইয়ং ছেলেরা কিছু সময় ওদের সঙ্গে তর্ক করলো।লিয়ন কিন্তু কোনকিছু না বলে তাকিয়ে তাকিয়ে দৃশ্যটা দেখল।প্রথম দেখাতে কনের ছোট বোনকে লিয়নের ভালো লেগে গেল।তাই কোন কথা না বলে সম্নানী ভাতা দিয়ে সবকিছু মিট করে দিলো।যথা সময়ে বিয়ের কাজ শেষ হলো।নতুন বউকে নিয়ে সবাই প্রস্থান করলো।সঙ্গে গেল কনের ছোট বোন ও চাচাতো বোন ঐ স্টেজে দাঁড়ানো দুজন।লিয়ন কিন্তু খুব খুশি ওদের আগমনে।
যাক যথা সময়ে বউকে নিয়ে যাওয়া হলো।সবাই নতুন বউকে বরন করে নিলো।সবাই বউ নিয়ে ব্যস্ত আর লিয়ন তার বেয়াইন মানে তার তালতো বোনকে নিয়ে ব্যস্ত।
দুজনের কুশল বিনিময় পরিচয় পর্ব শেষ।শুধু তাই নয় একে অপরের মাঝে খুব খাতির জমে উঠল।যেমন তালতো বোন তেমন তালতো ভাই।পরদিন বৌভাত শেষ করে আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ সবাই স্ব স্ব বাড়িতে প্রস্থান করলো।সুখী ও তার চাচাতো বোন ও নিজ বাড়িতে ফিরে আসল।আসার সময় তালতো ভাই লিয়নকে দাওয়াত করে আসল।পরদিন ছেলের বাড়ি থেকে কিছু আত্নীয়-স্বজন দাওয়াত খেতে আসল।সেই সঙ্গে লিয়ন ও আসল।
সুখী তাকে খুব আপ্যায়ন করলো।তারপর দুজন নির্জন স্থানে গিয়ে মজার গল্পে মেতে উঠল।লিয়ন সুখীকে প্রেমের প্রস্তাব দিলো।সুখী প্রথমে অস্বীকৃতি জানালে ও পরে ঠিক রাজী হয়ে গেল।দুজনের মাঝে ভালোবাসা বাসি হয়ে গেল।একে অপরের হাতে হাত রেখে বাঁচা মরার শফথ করলো।লিয়ন বি কম ফাইনাল ইয়ার আর সুখী আই এস সি প্রথম বর্ষে সবেমাত্র ভর্তি হলো।দুজন এখনো স্টুডেন্ট।সবাই দাওয়াত খেয়ে বউ নিয়ে চলে গেল।লিয়নের কেন জানি যেতে মন চাইছে না। কিন্তু তবুও যেতে হলো।মাঝে দুচার দিন কেটে গেল।একে অপরের মাঝে অস্থির অস্থির ভাব শুরু হলো।
সুখীর ও ভালো লাগছে না।লিয়নকে দেখার জন্য মন প্রাণ উতলা।মেয়ের এমন হাভ ভাব দেখে মা বলল,
সুখী কি হয়েছে, তোর মুখটা এমন শুকনো শুকনো লাগছে কেন?
মা বড় আপু নেই তো তাই ভালো লাগছে না।তাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
আচ্ছা ঠিক আছে কালকে যা তাকে দেখে আয়।
জ্বি আচ্ছা মা।
পরদিন সুখী তার বোনকে দেখার নাম করে লিয়নকে দেখতে গেল।লিয়ন তাকে দেখে খুশিতে লাফাতে লাফাতে বাজার সদাই করতে গেল।মাছ, মাংস, ফল ফলাদি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসল।সুখীর বোন রান্না-বান্না নিয়ে ব্যস্ত, আর এই সুযোগে লিয়ন সুখী প্রেমের গল্পে ব্যস্ত….।
সুখীর বোন রান্না শেষ করে ডাইনিং টেবিল সাজিয়ে তাদেরকে ডাক দেয়,
সুখী লিয়ন তোরা কোথায়, খেতে আয়।
এই তো আপু আসছি।
দুজন খেতে বসলো।লিয়ন মাছ মাংস রোস্ট পোলাও দিয়ে সুখীর প্লেট একেবারে ভরিয়ে দিয়েছে।সুখী আর খেতে পারছে না, তবুও লিয়ন দিচ্ছে, এবার সুখী বলল,
প্লিজ লিয়ন ভাই আমি আর খেতে পারবো না।এবার তদারকি করা বন্ধ করুন।
যাক খাওয়া শেষ,দুজন শুতে গেল।সুখী লিয়ন কারো চোখে যেন ঘুম আসছে না।একে অপরকে নিয়ে ভাবছে।ইচ্ছে করছে চাঁদনী রাতে গল্প করে সারারাত কাটিয়ে দিতে।কিন্তু মন চাইলে তো সবকিছু করা যায় না।এই ভেবে দুজন নিজেকে সামলে নিলো।পরদিন ঘুম থেকে উঠে দুজন একসঙ্গে নাস্তা করলো।তারপর দুজন সবার অগোচরে প্রেমের আলাপ-সালাপ সেরে নিলো। সপ্তাহ পার হয়ে যাচ্ছে এখনো সুখী বাড়ি যাওয়ার কথা বলছে না।এদিকে মা কল করে বলে,
রীমা সুখীর কলেজ খোলা, তাকে পাঠিয়ে দিচ্ছিস না কেন?
মা আর কদিন বেড়াক তারপর যাবে।
রীমা আর বেড়ানোর দরকার নেই, তাড়াতাড়ি সুখীকে পাঠিয়ে দেহ।
ঠিক আছে মা পাঠাব।
এরই মধ্যে সুখী লিয়নের প্রেম একেবারে পাকা হয়ে গেল।সুখী বোনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।লিয়ন সুখীকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসল।মাঝে পরামর্শ করে নিলো দেখা করার দিনক্ষণ।লিয়ন সুখী রোজ রোজ গোপন অভিসারে দেখা করে।কিন্তু দুফ্যামিলির কেউ জানে না।এভাবে কেটে গেল কয়েক মাস। একদিন ভর দুপুরে সুখীদের পুকুর পাড়ে গাছ তলাতে দুজন বসে বসে রোমান্স…।
সুখীর ছোট চাচ্চু দৃশ্যটা দেখে তার মাকে বলল।সুখী ঘরে ফেরার পর তার মা জিজ্ঞেস করলো,
সুখী লজ্জা শরমের মাথা খেয়েছিস নাকি?
সুখী না জানার ভান করে বলল,
কি হয়েছে মা, আমি কি করেছি?
কি করসনি বল, লিয়নের সঙ্গে ভর দুপুরে….।
ছি: ছি: মান সম্নান সবশেষ।
সুখী মায়ের রক্ত চক্ষুর ভয়ে বলল,
মা এসব কে বলেছে তোমাকে?
কে আর বলবে, তোর ছোট চাচ্চু, ভাগ্যিস তোর বাবা দেখেনি।দেখলে নিশ্চিত একটা অঘটন ঘটত।
প্লিজ মা শুন এসব মিথ্যে কথা।
মানলাম মিথ্যে কথা, কিন্তু তুই ওর সাথে পুকুর পাড়ে গিয়েছিলি কি জন্য?
মা নিয়ন ভাই’র কাছে আমার একটা নোট খাতা ছিল।তার কথা বলতে গিয়েছি।
সুখী শুন যা হবার হয়েছে, ফের যদি তোকে আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে দেখি, তবে সত্য মিথ্যা যাচাই হবে।
ঠিক আছে মা তাই হবে।
সুখী কোনমতে মাকে বুঝিয়ে হাফ ছাড়লো।কিন্তু পরবরতীতে যদি ফাঁস হয়ে যায় কি হবে।একথা ভাবতে সুখীর ভিতরে তোলপাড় শুরু হলো।
এদিকে লিয়নের বাড়িতে ঠিক খবরটা পৌছে গেল।লিয়নের মা রীমার শ্বাশুড়ি কটাক্ষ করে বলল,
ছি: ছি: কি বেয়াদব মেয়েরে বাবা, আমার ছেলেটাকে নষ্ট করেছে।বউ তোমার বোনকে সাবধান করে দিও, যাতে আমার ছেলের সঙ্গে আর না মেশে।ফের যদি তোমার বোনকে আমার ছেলের সঙ্গে মিশতে দেখি তোমাকে কিন্তু ঘর ছাড়া করবো।
বোনের জন্য আজ তাকে এতবড় অপমান সহ্য করতে হলো।এত জঘন্য অপমান কি সহ্য করা যায়।রীমা আর থেমে থাকতে পারলো না।কল করে মাকে কড়া ভাষায় বলল,
মা সুখীকে কিছু বলবে?
মা না জানার ভান করে বলল,
রীমা রাগছিস কেন, সুখী কি করেছে?
মা তুমি কিচ্ছু জানো না।অথচ লিয়ন ও সুখীকে নিয়ে গ্রামের লোকজন আজে বাজে কথা বলাবলি করছে।আজ আমার শ্বাশুড়ি ও অনেক বাজে কথা বলল।
রীমা শুন মা, লোকের কথা কান দিস না।সব মিথ্যে কথা।
তাহলে আমার শ্বাশুড়ি ও যে বলল।
উনার কোন দোষ নেই।লোকের মিথ্যে রটনা বিশ্বাস করে এসব বলেছে আর কি।
তবুও মা সুখী যেন লিয়নের সাথে আর কথা না বলে।
ঠিক আছে রীমা তাই হবে।
এদিকে লিয়নের কানে ও কথাগুলো ঠিক পৌছে গেল।লিয়ন সুখীকে ছাড়া থাকতে পারবে না।কথাটা ভাবতেই তার মাথায় সপ্ত আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।গোপনে দুজন নির্জন স্থানে মিলিত হলো।সুখী লিয়ন দুজনের মুখ ভারী।কারো মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না।কমিনিট পর লিয়ন বলল,
সুখী তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না।
সুখীর চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।তবুও কেঁদে কেঁদে লিয়নকে জড়িয়ে ধরে বলে,
লিয়ন আমিও তোমাকে ছাড়া বাঁচব না।তুমি কিছু একটা কর।
সুখী কি করব বুঝতে পারছি না।দুফ্যামিলির কেউ এ ভালোবাসা মেনে নেবে বলে মনে হয় না।
তাহলে কি করবে?
সেটাই তো ভাবছি।
আর একবার চেষ্টা করে দেখ।
সুখী আমি অনেক চেষ্টা করেছি দুফ্যামিলির কাউকে ম্যানেজ করতে পারছি না।সুখী বরং এক কাজ কর,তুমি আমাকে ভুলে যাও।
ভুলে যাওয়ার কথা শুনে সুখী আর ও কাঁদে।লিয়ন তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
সুখী কাঁদছ কেন?
আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না।তার চেয়ে বরং তুমি বিয়ে কর।
আমিও তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না।
তাহলে আমাকে বললে কেন?
এমনি বললাম আর কি।
লিয়ন চলো আমরা গোপনে বিয়ে করে পেলি।
সুখী হুট করে বিয়ে করলে কেলেংকারী আর ও বাড়বে বৈ কমবে না।যা করার বুঝে শুনে করতে হবে।
লিয়ন যা করার তাড়াতাড়ি কর।এরই মধ্যে আমার জন্য পাত্র দেখা শুরু হয়ে গেছে।
স্টপ সুখী এমন কথা আর বলবে না।তুমি আমার ছাড়া অন্য কারো হতে পারবে না।
তো দেরী না করে তোমার ঘরনী করে নাও।
সুখী একটু অপেক্ষা কর।আমি আরেক বার চেষ্টা করে দেখি।
ঠিক আছে লিয়ন যা করার তাড়াতাড়ি কর।
ওকে তাই হবে।মন খারাপ করো না লক্ষিটি।চলো ফেরা যাক।
দুজন বিদায় নিয়ে স্ব স্ব বাড়িতে ফিরে গেল।
সুখী লিয়ন গোপনে দেখা করলে কি হবে।কথায় বলে না দেয়ালের ও কান আছে।আজ লিয়নের বড় ভগ্নিপতি যাওয়ার পথে তাদের রোমান্স দেখে শ্বাশুড়ির কাছে কথাগুলো প্রকাশ করলো।শুরু হলো বউ শ্বাশুড়ির মাঝে ঝগড়া।যে যা পেরেছে কটাক্ষ করে তাই বলেছে।এক পর্যায়ে শ্বাশুড়ি রীমাকে ঘর থেকে বের করে দেয়ার হুমকি ও দিয়েছে।তাছাড়া এক ফ্যামিলিতে দুসমন্ধী তার উপরে নষ্টা মেয়েকে কিছুতে তিনি ছেলের বউ করবেন না বলে জানিয়ে দিলেন।রীমা মাকে ফোন করে কেঁদে কেঁদে বলে,
মা তোমরা চাও আমার সংসার ভেঙ্গে যাক?
না তা চাই না।
তাহলে সুখীকে বারন করছ না কেন?সে আজ আবার লিয়নের সঙ্গে দেখা করেছে।
সত্যি বলছিস তো?
হ্যাঁ মা সত্যি।
ঠিক আছ এখন রাখ।আমি ওকে জিজ্ঞাসা করে দেখি।
সুখী ঘরে আসা মাত্রই মা কড়া ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
সুখী তুই নাকি আজ আবার লিয়নের সঙ্গে দেখা করেছিস।রীমাকে এর জন্য কত গালমন্দ শুনতে হচ্ছে।তুই কি চাস ওর সংসার ভেঙ্গে যাক?
না মা আমি তা চাই না।
তাহলে ওয়াদা কর, আর কখনো ওর সাথে দেখা করবি না।
ঠিক আছে মা আমি আর লিয়ন ভাই’র সঙ্গে দেখা করব না।
এদিকে লিয়ন বাড়ি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মা কড়া ভাষায় বলল,
লিয়ন তুই নাকি আজ আবার নষ্টা সুখীর সঙ্গে দেখা করেছিস।ছি: ছি: যে মেয়ে বিয়ের আগে পর পুরুষের সঙ্গে দেখা করে সে কখনো ভালো হতে পারে না।এই মেয়েকে কখনো আমার পরিবারের বউ করবো না।সাবধান ভুলেও ঐ নষ্টা মেয়ের সাথে আর মিশবি না।
লিয়ন আর কিছু না বলে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো।তারপর ডায়েরীতে একটা চিরকুট লিখে রেখে গেল।
মা,
আমার সালাম নিবেন।আপনারা ভালো থাকেন শান্তিতে থাকেন।এই কামনা করি।
মা আমি সুখীকে খুব ভালোবাসি।সেও আমাকে ভালোবাসে।কিন্তু তোমাদের এক ঘেয়েমী ভরা অহংকারের কারণে আমাদের ভালোবাসার মিলন হলো না।এ জগতে আমাদের মিলন হয়নি তাতে কি হয়েছে, লায়লী-মজনুর মতো না হয় পর জনমে হবে। তাই আমরা সুইসাইডের পথ বেছে নিয়েছি।কারণ বেঁচে থাকলে তোমরা আমাদেরর ভালোবাসা কখনো মেনে নেবে না।তাই মরে সব সমস্যার সমাধান করে গেলাম।মা সবশেষে আমার একটা অনুরোধ মৃত্যুর পর আমাদের দুজনকে পাশা-পাশি “কবর” দেবে।ভালো থেকো মা।খোদা হাফেজ।
ইতি
তোমারই সন্তান
লিয়ন।
লিয়ন সুখী গভীর রাতে পুকুর পাড়ে একটা গাছের সঙ্গে এক রশিতে ফাঁসি দিলো।ভোর হতে লোকজন পুকুরের পাশ দিয়ে যেতে দুটো লাশ একসঙ্গে ঝুলতে দেখে চিৎকার করে উঠে।চারদিক থেকে লোকজন ছুটে আসে।লিয়ন ও সুখীর মা-বাবা ছেলে- মেয়ের লাশ দেখে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পড়লো।দুজনের পাশে পেল সেই চিরকুট।সুখী লিয়নের মৃত্যুতে দু’পরিবারে শোকের ছায় নেমে এলো।কোথায় গেল তাদের অহংকার কোথায় গেল তাদের দেমাগ।দুপরিবার মিট হয়ে সুখী লিয়নকে পাশা-পাশি “কবর” দিলো।
