গল্প
কু’সন্তান
আফছানা খানম অথৈসামাদ মাস্টার একজন প্রাইমারী স্কুল টিচার ছিলেন।তার স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা আদর্শ হাউজ ওয়াইফ। তাদের তিন ছেলে, কোন মেয়ে নেই। তাদের স্বপ্ন ছিল,তিন ছেলেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করাবে। তাই ছোটবেলা থেকে ছেলেদের লেখা পড়ার প্রতি খুব টেককেয়ার করতেন। ঠিকমত স্কুলের বেতন, পরীক্ষার ফি, সেশন ফি,কাগজ কলম, বই পুস্তুক সব কিছু সময়মতো পেইড করতেন। বর্তমানে প্রাইমারী স্কুলের টিচারদের বেতন বেড়েছে,। কিন্তু বিশ পঁছিশ বছর পূর্বে এমন ছিলনা। তাই সামাদ মাস্টারকে সংসারের খরচা পাতিও ছেলেদের লেখা পড়ার খরচ চালাতে খুব হিমশিম খেতে হতো। তবুও ছেলেদের কখনো অভাব বুঝতে দিতেননা। নিজেদের কষ্ট হলেও ছেলেরা যখন যা চাইত তাই দিতেন। তিন ছেলে “মাসাআল্লাহ” পড়া লেখায় খুব ভালো।
ক্লাশে প্রথম ছাড়া, দ্বিতীয় কোন দিন হননি। সামাদ মাস্টার ও তার স্ত্রী খুশি হয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আল্লাহ পাকের কাছে শোকরিয়া আদায় করতেন ও ছেলেদের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করতেন। আল্লাহপাক তাদের প্রার্থনা কবুল করেন।
ছেলেদের লেখা পড়া ভালো গতিতে চলছে। বড় ছেলে এস.এস.সি তে মেধা তালিকার স্থান অর্জন করেছে ।
ছেলে ভালো রেজাল্ট করেছে, মা বাবা খুব খুশি। ভালো কলেজে ভর্তি করাতে হবে, তানা হলে বড় চাকরী পাবেনা।কিন্তু তার জন্য অনেক টাকা লাগবে।সামান্য স্কুল টিচার সামাদ মাষ্টার’র পক্ষে কি এত টাকা সংগ্রহ করা সম্ভব? এটা দু’জনের মাথায় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দু’জনের ঘুম আসছেনা। এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি করছে। তখনি রাজিয়া সুলতানা বলল,
আপনার কি হয়েছে, এমন করছেন কেন?
না তেমন কিছু হয়নি, ভাবছি জামানকে ভালো কলেজে ভর্তি করতে অনেক টাকা লাগবে। এত টাকা এক সঙ্গে কোথায় পাবো?
আপনি কোন চিন্তা করবেননা। আল্লাহপাক এক ব্যবস্থা করবেন।এদিকে রাজিয়া সুলতামা খুব হিসেব করে খরচা পাতি করতেন। সংসারের প্রয়োজনে টাকা পয়সা তেমন একটা ব্যয় করতেননা। তেমন একটা বিলাসিতা ও করতেননা। শাড়ি চুড়ি জাকজমক ভাবে ব্যবহার করতেননা। একটা ছিড়লে আরেকটা কিনতেন। এমনকি ঈদ আসলে ও নতুন শাড়ি চুড়ি কিনতেননা। মা-বাবা না কিনলে ও ছেলেদের ঠিক কিনে দিতেন। নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে সব সময় ছেলেদের মুখে হাসি ফোটাতে চেষ্টা করতেন।একে বলে ত্যাগহীন ভালোবাসা। যে ভালোবাসায় কোন খাদ নেই। শুধু তাই নয়, রাজিয়া সুলতানা প্রতিদিনের সংসারের খরচ থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে সঞ্চয় শুরু…..।
শুধু ছেলেদের লেখা পড়ার জন্য।
এদিকে ভর্তি পরীক্ষা হলো, জামান উত্তীর্ণ হলো।মায়ের জমানো টাকায় জামান ভালো কলেজে ভর্তি হলো।
সিরিয়াল অনুযায়ী বাকী দু’জন ও লেখা পড়া….।
সামাদ মাস্টারকে তিন ছেলের লেখা পড়ার খরচ এক সঙ্গে চালাতে হতো। বড় ছেলে শহরে পড়ে তার খরচ বেড়ে গেছে। তাই পারিবারিক ভাবে একটু কষ্ট করতে হতো। কিন্তু ছেলেদেরকে নিজেদের কষ্টের কথা কখনো বলতেননা। লেখা পড়ার খরচের টাকা সব সময় রেডি করে রাখতেন, এবং চাওয়া মাত্রই দিয়ে দিতেন। খুব ভালোভাবে চলছে ছেলেদের লেখা পড়া।এদিকে সামাদ মাষ্টার একজন আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। স্টুডেনদের খুব ভালোভাবে পাঠদান করতেন। ঠিকমত টেককেয়ার করতেন। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে….।
এবং সাকসেজ ও হয়েছেন। কোন স্টুডেন্ট যদি পর পর দু’দিন স্কুলে না আসতো তা হলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখে আসেতেন । অসুস্থ হলে ডাক্তারের পরামর্শ ক্রমে ঔষধ খাওয়ার নির্দেশ দিতেন। অনুরুপ সামাদ মাস্টারকে ও স্টুডেন্টরা খুব ভালোবাসত।
তার পাঠদানে স্টুডেন্টরা খুব আনন্দ ও উৎসাহবোধ করতো এবং শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠত।পঞ্চম শ্রেণির ফাষ্ট বয় অয়ন দু’দিন ধরে স্কুলে আসছেনা। তিনি তাকে দেখতে গেলেন। ও গড! একি অবস্থা, তার প্রচণ্ড জ্বর। সাদেক মাস্টার গায়ে হাত দিয়ে দেখেন, জ্বরে গা ফুড়ে যাচ্ছে, তখনি তিনি বলে উঠলেন,
অয়নের মা ছেলের জন্য ঔষধ পথ্য কিনেছ?
অয়নের বাবা নেই,অর্থনৈতিক ভাবেও খুব দুর্বল। মা টেনে টুনে কোন রকমে সংসার চালাচ্ছে।ছেলের ঔষধ পথ্য কিনবে কি দিয়ে। তাই নরম স্বরে বলে উঠলেন,
না মানে এখন ও কিনেনি।
সামাদ মাস্টার পূর্বে থেকে জ্ঞাত আছেন, তাদের পরিবার সম্পর্কে, তাই আর কোন কিছু জিজ্ঞেস না করে, একজন পল্লী চিকিৎসক নিয়ে আসলেন।ডাক্তার থার্মোমিটার দ্বারা দেখলেন জ্বরের মাত্রা কত।
ও গড! ১০৪ ডিগ্রী, তিনি কিছু ঔষধ দিয়ে বললেন,
এই ঔষধে জ্বর ভালো না হলে, আমার সাথে যোগাযোগ করবেন।
সামাদ মাস্টার পকেট থেকে টাকা দিয়ে ঔষধের দাম পেইড করলেন।তখনি অয়নের মা চোখের জল মুছতে মুছতে বলে,
স্যার আপনি আমাদের জন্য যা করলেন, আপন ভাই ও তাই করবে না।স্যার আপনার ঋন কোনদিন শোধ করতে পারবনা।
সামাদ মাস্টার তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
অয়নের মা এখন এই সব বলার সময় না। নামাজ পড়ে আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা কর, অয়ন যেন শীঘ্রই আরোগ্য লাভ করে।
সামাদ মাস্টার অয়নের মাকে কিছু উপদেশ দিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা করলো।কিছু পথ আসার পর তার মাথা ঘুরে উঠে। চোখে-মুখে ঝাপসা কিছুই অনুধাবন করতে পারছেননা।অসুস্থ হলে যা হবার তাই হয়েছে, তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। ভাগ্যিস কাছাকাছি লোকজন ছিল, তাই হসপিটালে নিতে দেরী হলোনা।ইমারজেন্সি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তার জরুরী ভিত্তিতে চেকাপ শুরু….।
কিন্তু একি হল!আদর্শ সামাদ মাস্টার আর নেই। ক্ষনিক মুহূর্তে পরপারে চলে গেলেন।স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা সংসারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, তখনি লোকজনের উচ্চ আওয়াজ শুনতে পেলেন।তিনি হাতের কাজ ফেলে, ঘরের সদর দরজা ওভার করে এগিয়ে গেলেন। এম্বুলেন্স থেকে লাশ নামাতে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
তোমরা আমার উঠানে কার লাশ নামাচ্ছ?
সরাসরি কিভাবে কথাটা বলবে সবাই ভাবনায়…।
কিন্তু না বলেও উপায় নেই। তাই লোকজন বলে উঠল,
ভাবী সাহেবা ধৈর্যধারণ করুণ। জন্ম মৃত্যু সব কিছু আল্লাহ পাকের হুকুমে হয়। এতে মানুষের কোন হাত নেই। এটা অন্য কারো লাশ না, সামাদ স্যারের লাশ।
কথাটা শুনা মাত্রই তিনি মুর্ছিত হয়ে পড়লেন । তার কোন সাড়া শব্দ নেই। আশ পাশের মহিলার পাঁজাকোলা করে তাকে বিছানায় নিয়ে শোয়ালেন। কখন, কিভাবে স্বামীর দাফন-কাফন হলো তিনি এসবের কিছুই জানলেননা।স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুতে তিনি খুব ভেঙ্গে পড়লেন। আগের মতো খাওয়া দাওয়া কাজকর্ম ঠিক মতো করতে পারছেননা। স্বামীর শোকে কাতর,সারাক্ষণ মনমরা হয়ে তার কথা ভাবেন। ছেলেরা ভাবল এমনিভাবে চলতে থাকলে, মা অসুস্থ হয়ে পড়বেন।শেষে বাবার মতো পরপারে চলে যাবেন।তিন ছেলে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলে,
মা তুমি যদি এমনি ভাবে ভেঙ্গে পড়, তাহলে আমরা কি করব। বাবা ছিল আমাদের মাথার চাদ, উনি আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন। এখন তুমি ও যদি উনার মতো….।
আমরা কাকে নিয়ে বাঁঁচব, কে আমাদের দেখবে। মা আজ থেকে আর কোন কান্না নয়, আর কোন টেনশন নয়,আমরা তিন ভাই আছিনা, আমরা মানুষের মতো মানুষ হয়ে তোমার সকল দুঃখ দূর করে দেব। তোমাকে তিন ভাই মিলে মাথায় করে রাখব।মোটামুটি ভাবে ছেলেদের শান্তনাতে মায়ের মনে কিছুটা স্বস্থি ফিরে আসল। তিনি পূর্বের নিয়মে সংসার মুখী হলেন। আগে পেতেন ফুল মাইনে, এখন ওয়ারিশ হিসেবে স্ত্রী পাবেন হাফ মাইনে। এখন রাজিয়া সুলতানার মাথায় একটা চিন্তা এই টাকায়, সংসার ও ছেলেদের লেখা পড়ার খরচ চালাতে হবে।
তবুও তিনি হাল ছাড়েননি, শক্ত হাতে বৈঠা ধরেছেন। তিন ছেলেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করাবেন।কিন্তু তার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন।এই গভীর সমুদ্র পাড়ি দেয়া তার জন্য খুব দুঃসাধ্য ব্যাপার।
তবুও আল্লাহ পাকের অশেষ মেহের বানীতে তিনি এগিয়ে চলেছেন।ছেলেদের লেখা পড়া ভালোভাবে চলছে। মেঝো ছেলে আমান ও এস.এস.সি তে মেধা তালিকার স্থান অর্জন করেছে।তাকে জামান নিয়ে গেল। একই ম্যাচে দুই ভাই থাকেন এবং একই কলেজে পড়েন।বাকী একজন হাই স্কুলে পড়ে সে মায়ের সঙ্গে গ্রামে থাকে।
এদিকে রাজিয়া সুলতানা স্বামীর পেনশনের টাকা তোলার জন্য খুব ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ফাইল পত্র নিয়ে অফিস আদালতে দৌড়াদোড়ি করতে করতে প্রায় তিন বছর সময় লেগে গেল। অবশেষে যাক আল্লাহ পাক মুখ তুলে চেয়েছেন।রাজিয়া সুলতানা স্বামীর পেনশনের টাকা হাতে পেলেন।সিরিয়াল অনুযায়ী তিন ছেলের উচ্চতর ডিগ্রী শেষ হলো।পেনশনের টাকা ও শেষ হলো।রাজিয়া সুলতানার হাত একেবারে খালী। এখন একমাত্র সম্বল তিন ছেলে।তারা বড় চাকরী পেলে মায়ের টেনশন দূর হবে। আল্লাহ পাকের কাছে এটুকু প্রার্থনা তার। মায়ের পায়ের তলে সন্তানের বেহেস্ত।(আল কোরান)।
তাই সবার আগে মায়ের প্রার্থনা আল্লাহ পাক কবুল করেন।হয়ত তাই হলো মায়ের দোয়াতে সিরিয়াল অনুযায়ী তিন ছেলের বড় চাকরী হয়ে গেল। বড় ছেলে ম্যাজেট্টেট, সেঝো ছেলে টি.এন.ও ছোট ছেলে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। এই তিন ছেলেকে এতদূর নিতে মাকে কত কষ্ট না করতে হলো।ছেঁড়া কাপড় পরা আর উপোষ করা ছিল, মায়ের নিত্য দিনের সঙ্গী।এদিকে বড় ছেলে জামানের ইউনিভার্সিটি লাইফে এক বড় লোকের মেয়ের সাথে রিলেশন হয়। যাকে এক কথায় বলে প্রেম।তাদের দু’জনার কথা ছিল, চাকরী হলে তারপর বিয়ে। ঠিক তাই হলো, জামান মা’কে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলল। যে মা নিজের সুখ শান্তি বিসর্জন দিয়ে ছেলেকে মানুষ করলো, সে আজ মা’কে না জানিয়ে বিয়ে করলো। কি নিষ্ঠুর লীলা খেলা। এদিকে সামনে আসছে ঈদ। ছুটিতে তিন ছেলে বাড়ি আসবে।মায়ের মন খুশিতে ভরে উঠল।ছেলেরা এখন বড় চাকরী করে, সম্নান বলে একটা কথা আছেনা। তাই ছোট্ট টিনের ঘরটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে পরিপাটি করে রাখলেন। আর ছেলেদের পছন্দের খাবার রেডি করে রাখলেন। তিন ছেলে তিন জাগায় চাকরী করে। তাই তিন জন তিন টাইমে আসলেন। প্রথমে ছোট ছেলে আসল।অনেক দিন পর ছেলেকে দেখলেন। মা’কে সালাম করা মাত্রই তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কপালে চুমু খেয়ে খুব আদর করলেন। তারপর আসল, সেঝো ছেলে। সে ও মা’কে সালাম করতে, তিনি তাকে বুকে জড়িয়ে কপালে চুমু এঁকে খুব আদর করলেন।এবার বড় ছেলে ম্যাজেট্টেট জামানের পালা। সে গাড়ি থেকে নামল, কিন্তু একা নয়, সঙ্গে একজন মেয়ে তা ও ছেলের বেশে, পরনে প্যান্ট শার্ট। চুল দেখে মনে হয় ও ছেলে না, মেয়ে। যাক জামান গাড়ি থেকে নামা মাত্রই মায়ের পা ধরে সালাম করল।
তিনি অনুরুপ ভাবে তাকে ও আদর করলেন।তারপর জামান বলল,
মা আমি একটা বড় ভুল করে ফেলেছি। তোমাদেরকে না জানিয়ে হঠাৎ করে বিয়ে করে ফেলেছি।
আমাকে ক্ষমা করে দাও।
সন্তান হাজার অপরাধ করলে ও মা তা হাসি মুখে বরন করে নেন।রাজিয়া সুলতানা ও তাই করলেন। ছেলের জঘন্য অন্যায়কে ক্ষমা করে দিয়ে বললেন,
বাবা আমি কি তোদের উপর রাগ করতে পারি। তোরাইতো আমার সব। আস বউ মা, ঘরে আস।
বউ শ্বাশুড়ীকে সালাম করাতো দূরের কথা। ঝাপটা মেরে তার হাত সরিয়ে দিয়ে বলে।
আপনার এই নোংরা হাতে আমাকে টাচ্ করবেননা, ময়লা লাগবে। জামান তুমি আমাকে এ কোথায় নিয়ে এলে। এই নোংরা পরিবেশে মানুষ থাকে কি করে? আমি বাপু এই পরিবেশে থাকতে পারবোনা। চল আমরা ঢাকা ফিরে যাই।
জামান অনেক বুঝিয়ে তাকে ঈদ পর্যন্ত রাখল। পরদিন সাতটার গাড়ি করে তারা ঢাকা চলে গেল। তারপর থেকে জামানের সাথে মায়ের আর কোন যোগাযোগ নেই।
এরপর মেঝো ছেলে আমানের পালা। তার ও ইউনিভার্সিটি লাইফে এক শিল্পপতির মেয়ের সাথে রিলেশন।তারপর মা’কে না জানিয়ে হুট করে বিয়ে।কোন এক গ্রীষ্মের ছুটিতে বউ’কে নিয়ে বাড়ি আসল। আমানের বউয়ের নাম মিষ্টি। চেহারা চুরুত ও সুন্দর, কিন্তু পোশাক আশাকের বেশ ভুষা ভালোনা।পরনে স্কীনের পায়জমা গায়ে ফিটফাট গেঞ্জি।একেবারে বডির সাথে ফিট হয়ে আছে।গ্রামের লোকজনতো, এমন একটা আনকালচার্ড পোশাক পরা মেয়ে, যাকে দেখতে কি না নায়িকার মতো লাগছে, তাকে দেখার জন্য লোকজন জড়ো…।
কেউ কেউ বলে উঠল,
কি কলির যুগ আইল,মেয়েরা পরে ছেলের পোশাক।ছিঃছিঃ কেয়ামত নিকটে আইসা গেছে।
তখনি মিষ্টি ক্ষেপে উঠে বলে,
ছিঃছিঃ আমান তুমি আমাকে এ কোথায় নিয়ে এলে। যত্তসব ব্যাগডেটেড় মহিলা।আমি আর এখানে থাকবোনা।এক্ষণি আমাকে নিয়ে চলো।
এতরাতে কোথায় যাবে,মিষ্টিকে কোন রকমে বুঝিয়ে রাত পার করলো।সকালে ফিরে গেল।তারপর থেকে মায়ের সঙ্গে আমানের সাথে ও যোগাযোগ বন্ধ।
তারপর ছোট ছেলে মিলনের পালা।তারও রিলেশনের বিয়ে। তার শশুর ডিপুটি ম্যাজেট্টেট।সে কোন এক ছুটিতে বউকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসল।মিলন মা’কে সালাম করে বউ’কে বলল,
সুইটি সালাম কর, আমার মা।
সুইটি উত্তর দিলো,
আমি সালাম করব এই নোংরা বুড়ো মহিলাকে, প্রশ্নই উঠেনা। তাছাড়া পায়ে ধরে সালাম করার নিয়ম এখন নেই।
এতদিন পরে রাজিয়া সুলতানা মুখ খুললেন,
বউ মা, আমাকে সালাম না করো। তবু ও একথা বলো না, পায়ে ধরে সালাম করার নিয়ম উঠে গেছে।পবিত্র কোরানে আল্লাহ পাক উল্লেখ করেছেন,বারো জনকে দেখা দেয়া ও সম্মান করা জায়েজ আছে।এরা হচ্ছেন গুরুজন।এই গুরুজনের মধ্যে প্রথম কাতারে আছে,পিতা-মাতা ও শ্বশুর-শ্বাশুড়ি।এদেরকে সম্মানের সহিত সালাম করলে পাপ হয়না বরং পুণ্য হয় । আর তুমি কিনা বলছ পায়ে…।
এমন কুশিক্ষা তোমাদের ছেলে মেয়েদেরকে কখনো দিওনা।গুরুজনকে সব সময় সম্মান করতে শেখাবে। তানা হলে তারাও তোমাদের মতো আনকালচার্ড হয়ে যাবে।
ডিপুটি ম্যাজেট্টেট এর মেয়েকে আনকালচার্ড বলা কি চারটি খানি কথা।নামাজ রোজা, শিষ্টাচার, ভদ্রতা, নম্রতা, আদব কায়দা, সততা, সুশিক্ষা যাদের ভিতরে নেই, তারা কোরান হাদিসের সত্যবানী শুনলে পিত্তি জ্বলে উঠে।সামাদ মাস্টারের তিন পুত্রবধু উচ্চতর ডিগ্রী নিয়েছে ঠিকই। কিন্তু সুশিক্ষা ও মনুষ্যত্ববোধ কিছুই তাদের ভিতরে নেই।তাই গুরুজনের কদর বুঝেনি। শ্বাশুড়ীকে আজে বাজে কথা বলে চলে গেল।
এদিকে তিন স্টুপিড শিক্ষিত ছেলে কি করেছে দেখেন।বউদের মন রক্ষা করার জন্য তাদের কথা অনুযায়ী মায়ের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফাঁকে কেটে গেল ক’মাস মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন।তার ঘরের দরজা বন্ধ দেখে আশ পাশের লোকজন ছুটে আসল। সবার আগে ছুটে আসল নোমান। যার ছোট বেলায় মা মারা যাবার পর রাজিয়া সুলতানাকে মায়ের ছোখে দেখতেন এবং খুব টেককেয়ার করতেন। বিশেষ করে রাজিয়া সুলতানা ও স্বামীর মতো উদার ও ভালো মনের অধিকারী তাই লোকজনের বিপদে সবার আগে এগিয়ে যেতেন। আর নোমানকে যখন যা তৈরী হতো ছেলেদের মতো যত্ন করে খাওয়াতেন।নোমান প্রতিদিনের মতো আজ মা’কে দেখতে এসে একি দেখলেন! মায়ের গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। সে দ্রুত গতিতে ডাক্তার নিয়ে আসল। ডাক্তার ঔষধ পথ্য দিয়ে গেল।মোটামুটি ভাবে তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। নিজের পেটের সন্তানের খবর নেই।ভাড়া সন্তান এসে মায়ের টেককেয়ার করছে।এদিকে তিন শিক্ষিত স্টুপিড ছেলে সুন্দরী আনকালচার্ড বউ নিয়ে খুব সুখে আছে। মায়ের কথা মনে পড়ছেনা। স্বামীর মাইনের টাকায় বউরা দামী দামী শাড়ি-চুড়ি, গহনা কিনে..।
প্রতি বাসায় দু’চারজন কাজের বুয়া।স্বামীর সঙ্গতা ছাড়া সব কাজ বুয়া করে দেন। তাদের কাজ হলো সোফায় বসে বসে স্টার ঝলসার সিরিয়াল দেখা আর ক্লাবে গিয়ে আড্ডা মারা। এটা নাকি যুগের ফ্যাশন।এই সব আনকালচার্ড শিক্ষিত স্টুপিড পুরুষদের একটু ও লজ্জা করেনা তাদের বউরা যে ক্লাবে গিয়ে পরপুরুষের সঙ্গে…।
তাদের মতে মডেলিং যুগে এমন না হলে কি ভালো লাগে। তাই কিছু কিছু শিক্ষিত স্টুপিড বউদেরকে এসব অসাজিক কাজে বাধা দেননা।তাদের মতে এসব যুক্তি সঙ্গত।
এরা কি বুঝবে! গুরুজনের কদর?
এদিকে মাঝে ক’বছর পার হলো। মায়ের শরীরে আগের মতো শক্তি নেই।টাকা তুলতে ব্যাংকে যেতে পারেননা।চেক সাইন করে দিলে নোমান টাকা তুলে নিয়ে আসে। সদাই করে দিয়ে যায়। জানোয়ার ছেলে গুলো মায়ের খবর না নিলে ও মা ঠিক মতো তাদের খবরা খবর টানেন।তিন ছেলের ঘরে নাতী নাতনী হয়েছে শুনে খুশি হলেন।প্রতি ঈদে ছেলেদের আসার পথ চেয়ে বসে থাকতেন।ভাবতেন ছেলেরা এক সময় তাদের ভুল বুঝবে এবং আমাকে দেখতে আসবে।ছেলেদের কথা মনে পড়লে তিনি খুব করে কাঁদতেন।আর বলতেন বাবা জামান,আমান,মিলন,তোরা কিভাবে মায়ের কথা ভুলে গেলি।আমিতো তোদের কথা ভুলেনি।খোদা তোদের বিচার করবে।এত বছর পরও মায়ের কথা মনে পড়লোনা।তোরা মানুষ নাকি জানোয়ার?রাজিয়া সুলতানা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লো। সকাল হলে নোমান ও আশ পাশের কয়েক জনকে ডেকে বললেন,নোমান তুই আমার পেটের ছেলে না হয়ে ঠিক মতো মায়ের দায়িত্ব পালন করেছিস। আমি আল্লাহ পাকের কাছে প্রার্থনা করি তোর ইহকাল ও পরকাল যেন মঙ্গলের হয়।আর আমার গর্ভজাত তিন সন্তানের বিচার খোদাপাকের কাছে দিলাম।
আর ক’টা কথা আমার মৃত্যুর পর তাদেরকে খবর দিবিনা। যদি তারা এসে যায়, তাহলে আমাকে দেখাবিনা। আর আমার জানাজাতে অংশ গ্রহন করতে দিবিনা। বলবি এটা আপনার মায়ের নিষেধ।এ কথাই আদর্শ হাউজ ওয়াইফ রাজিয়া সুলতানার শেষ কথা। মাঝে সপ্তাহ খানেক পার হলো। রাজিয়া সুলতানার শরীর স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছেনা।শরীর খুব দূর্বল লাগছে।রান্না করতে মন চাইছেনা। তিনি না খেয়ে শুয়ে আছেন। সকাল হলে আশ পাশের সবাই জেগে উঠল।রাজিয়া সুলতানা প্রতিদিন ভোরে উঠে নামাজ পড়েন। কিন্তু আজ এত সকাল হলো, এখন ও তার ঘরের দরজা বন্ধ।নোমান সহ সবাই ছুটে আসল।দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে একি দেখলেন!রাজিয়া সুলতানা আর নেই। পরপারে চলে গেছেন।নোমান খুব কেঁদে উঠল।তারপর রাজিয়া সুলতানা কথা অনুযায়ী তাকে দাফন করার জন্য সবকিছু রেডি করলো। রাজিয়া সুলতানাকে খাটিয়ায় নিয়ে শোয়ানো হলো, এখন ও কাঁধে নেয়া হয়নি।ঠিক সেই মুহূর্তে ঐ জানোয়ার তিন সন্তান দামী গাড়ি করে হাজির হলো। এত দামী গাড়ি, সুট ট্রাই পরা ভদ্র লোকজন , বউ বাচ্চা এরা কারা? লোকজন বলাবলি শুরু করলো। তখনি নোমান কেঁদে কেঁদে বলে উঠল,
এদেরকে চিনবেননা,এরা হলো শিক্ষিত স্টুপিড “কু’সন্তান”। যারা জীবিত অবস্থায় কখনো মা’কে দেখতে আসেননি,টেককেয়ার করেননি। মৃত অবস্থায় এসেছেন মা’কে স্যালুট জানাতে।ছেলেরা অনুরোধ করলো মা’কে দেখতে। নোমান সহ সবাই একবাক্যে বলে উঠল,
না দেখানো যাবেনা।শুধু তাই নয়,জানাজাতে অংশ গ্রহণ করতে পারবেননা। এটা মায়ের আদেশ।হাজার হোক ছেলেতো, জনগনের যা বলার বলেছে। জোর জবর ধস্তি করার অধিকারতো তাদের নেই।লোকজনের ছিঃছিঃ ও ধিক্কার তাদেরকে খুব লজ্জিত করলো।তবু ও নিষেধ অমান্য করে মা’কে এক পলক দেখে দাফনের কাজ শেষ করে গন্তব্য স্থলে ফিরে গেল।
ঃসমাপ্তঃ
