পতিতা
আফছানা খানম অথৈ
সাজেদা ম্যাট্টিক পাশ করেছে।ইন্টারে ভর্তি হবে,ঠিক সেই মূহূর্তে তার বাবা গাড়ি এক্সিডেন্ট করে।ডান পা ভেঙ্গে যায়।টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে না পারায় তিনি পঙ্গু হয়ে বিছানায় পড়ে থাকেন।সাজেদার বাবা অটো চালাতেন।তার ইনকামে সংসার চলত।এখন তিনি পঙ্গু হয়ে পড়ে আছেন। সংসার চলবে কিভাবে?
চিন্তায় পড়ল সাজেদা।কোন উপায় না পেয়ে সে অটো চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়।অটো চালিয়ে যা আয় হয় কোনমতে সংসার চলে।কিন্তু লোকে তা ভালো চোখে দেখছে না।পথেঘাটে চলাফেরা করার সময় নানাজন নানান কথা বলে।মেয়ে মানুষ কেনো অটো চালায়?আজে বাজে কথা বলে, বাজে ইঙ্গিত করে।শুধু তাই নয় অনেকে কুপ্রস্তাব দেয়,ইভটিজিং করে।সাজেদা এসব উপেক্ষা করে অটো চালিয়ে পরিবারের জন্য ভরনপোষণ, ও বাবার ঔষধ পথ্য কিনছে।
পরিবারেকে বাঁচাতে সাজেদা যুদ্ধ করে চলেছে।আর লোকজন তাকে নিয়ে হাসি তামাসা করছে।তাকে ফলো করছে সমাজের কিছু নষ্ট শ্রেনির পুরুষেরা।একদিন যাত্রী হয়ে উঠে তার অটোতে এক নষ্ট পুরুষ কাদের মোল্লা।সে তার সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে।নামধাম পরিচয় জানতে চাই।সাহেজা নিঃসংকোচে তার পরিচয় বলে।তারপর সে জানতে চাই,সে মেয়ে হয়ে কেনো অটো চালাচ্ছে?
সাজেদা নির্দ্বিধায় উত্তর দেয়।তার দু:খের কথা তার কাছে প্রকাশ করে।এই সেরেছে কাদের মোল্লা পেয়েছে একটা সুযোগ,সে মনে মনে প্ল্যান করে, একে হাতছাড়া করা যাবে না।যেমন করে হোক পটাতে হবে।
সে অনেক ভেবেচিন্তে মিষ্টি সুরে বলে,
বোন তোমার কথা শুনে খুব দুখ পাইলাম।তোমার মতো একটা শিক্ষিত মেয়ে অটো চালাচ্ছ?আফসোস।তুমি চাকরী করলে তো পার?
ভাইজান আমাকে চাকরী দেবে কে?
কে দেবে মানে,আমি দেব,তুমি চাকরী করবে?
জ্বি ভাইজান করব।
আমি কাদের মোল্লা পারি না এমন কোন কাজ নেই।তুমি গার্মেন্টসে চাকরী করবে?ভালো বেতন পাবে।
জ্বি ভাইজান করব।আপনার কী গার্মেন্টস আছে?
আমার নেই,তো আমার এক বন্ধুর আছে।আমি সেই গার্মেন্টসের ডাইরেক্টর।তোমাকে চাকরী দেয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।আমি তোমার মতো অনেককে চাকরী দিয়েছি।
সত্যি বলছেন ভাইজান?
বোন তোমার সাথে আমি মিথ্যে বলব কেনো? আমার আবার দয়ার শরীর।আমি কারো দু:খ কষ্ট সহ্য করতে পারি না।কী চাকরী করবে?
আমি একটু ভেবে দেখি।
এতে ভাবাভাবির কী আছে।তুমি চাইলে কালই জয়েন করতে পার।
ভাবছি আমি চলে গেলে সংসার চলবে কিভাবে?
সেই চিন্তা তোমাকে করতে হবে না।এই নাও দশ হাজার টাকা অগ্রিম।
কাদের মোল্লা আর দেরী করলো না।তার হাতে দশ হাজার টাকার একটা বান্ডিল গুজে দিয়ে বলল,
বোন তুমি এখন বাসায় চলে যাও।টাকাগুলো বাসায় পৌছে দিয়ে এসো।এটা আমার বাসার ঠিকানা।বাসার সামনে এসে ফোন দিও।
সাজেদার আশাহত হৃদয়ে আশার আলো ফুটে উঠল।সে কাদের মোল্লার আষাঢ়ে গল্প সত্যি মনে করল।খুশিমনে বাসায় ফিরে গেল। মায়ের হাতে টাকাগুলো বুঝিয়ে দিলো।তারপর বাবার পাশে বসে হাসিমাখা কণ্ঠে বলল,
বাবা তুমি আর কোন চিন্তা করো না।আমার গার্মেন্টসে চাকরী হয়ে গেছে।মাসে বেতন পনেরো হাজার টাকা।
সত্যি বলছিস মা?
জ্বি বাবা সত্যি।
এবার আমি তোমার চিকিৎসা করাব।
মা তাই যেন হয়।
মা বাবার দিকে খেয়াল রেখো।মনি, ফাহাদ তোরা ভালোভাবে লেখাপড়া করিস।আমি মাসে মাসে টাকা পাঠাব।ভালো থাকিস।আমি এখন আসি।
মা-বাবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে সাজেদা এগিয়ে চলল।কাদের মোল্লার বাসার সামনে গিয়ে সে ফোন করলো।ফোন পাওয়া মাত্রই কাদের মোল্লা এগিয়ে আসল।অত:পর সাজেদাকে নিয়ে রওয়ানা করলো।কিছুসময়ের মধ্যে তাঁরা গন্তব্যস্থানে উপস্থিত হলো।ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে,সাজেদাকে তাঁর হাতে বুঝিয়ে দিলো।ম্যানেজার তাকে আবাসিক হোস্টেলের একটা কামরায় নিয়ে গেল।সাজেদা কোনকিছু বুঝে উঠার আগে তাঁকে ভিতরে রেখে দরজা বন্ধ করে তিনি চলে গেলেন।কিছুক্ষণ পরে হোস্টেল বয় তাকে কিছু ফ্যাশন কাপড় দিয়ে বলল,
এগুলো পরে নেন।
কেনো?
পরে নেন তারপর বুঝবেন কেনো?
কাদের ভাই কোথায়?
উনি চলে গেছে।
তাহলে আমার চাকরী..?
আজ থেকে আপনার চাকরী এখানে।
এখানে আমি চাকরী করব না।
এসব কথা বলে আর কোন লাভ নেই।চাকরী আপনাকে করতেই হবে।
বললেই হলো।আমি এক্ষণই চলে যাব।
এখানে আসা যায়।তবে যাওয়া যায় না।
কেনো?
কিছুদিন থাকেন তারপর সব বুঝতে পারবেন।তাছাড়া উনি আপনাকে বিক্রি করে গেছে।
সত্যি বলছেন?
জ্বি সত্যি। আর কথা না বাড়িয়ে কাপড়গুলো পরে সাজু-গুজু করে নেন।কিছুক্ষণ পর গেস্ট আসবে।
কথাগুলো শোনার পর সাজেদার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।এতক্ষণে সে বুঝতে পারলো এটা চাকরী না,দেহব্যবসা। কেঁদেকেঁদে বুক ভাসাল।হায়রে নিয়তি এই বুঝি কপালে লেখা ছিলো।আমার মতো অসহায় নারীকে নিয়ে ছলচাতুরী করলো ভাই সেজে কাদের মোল্লা।চাকরী দেয়ার নাম করে বানালো পতিতা।এরা মানুষ নাকী পশু?এদের ঘরে কী মা বোন নেই? আল্লাহ তুমি এদের বিচার করো।ইহজগত ও পরজগতে এদের সাজা দিও।
আমাদের সমাজে কাদের মোল্লার মতো কিছু অমানুষ আছে যারা নারীদেরকে দিয়ে দেহ ব্যবসা করায়।আজকাল আবাসিক হোস্টেলগুলোতে চলে রমরমা দেহব্যবসা।মাঝেমাঝে মিডিয়ার লোকেরা এই নিয়ে নিউজ করে,ভিডিও আপলোড করে।তা দেখে লোকজন হাসিতামাসা করে।পতিতাদের নিয়ে বিভিন্ন নোংরা কথাবার্তা বলে,ছি: ছি: করে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো,হোস্টেল মালীক ও ম্যানেজারের কেনো নিউজ ও ভিডিও আপলোড করা হয় না?
কারণ তারাই তো আসল দোষী।। তাঁদের সহযোগীতায় মেয়েরা এখানে আসে।তাঁদের ইন্ধনে এইসব অপকর্ম হচ্ছে।তারা নারীদেরকে দিয়ে দেহব্যবসা করিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা ইনকাম করছে।পতিতাকে সাজা না দিয়ে প্রথমে সাজা দেয়া উচিৎ হোস্টেল মালীক,ম্যানেজার ও হোস্টেলের দায়িত্বে থাকা লোকজনকে।তবে সমাজ থেকে দেহব্যবসা কিছুটা কমবে,এর ব্যতিরেকে নয়।প্রতিটা পতিতার ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে এক একটা করুণ ইতিহাস।কেউ স্বইচ্ছায় পতিতাবৃত্তি বেচে নেয়নি। তাঁদেরকে বিপদে ফেলে,চাকরী দেয়ার নাম করে,বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে, এসব অপকর্ম করতে বাধ্য করেছে।কিছু লোভী অসৎ চরিত্রের মানুষ।আজ সাজেদাকে চাকরী দেয়ার নাম করে বানিয়েছে পতিতা।
এদিকে সাজেদার বাবা-মা খুব খুশি, মেয়ে চাকরী পেয়েছে।মেয়ের নাম্বারে ফোন করে।কল সার্ভিস হচ্ছে না।অপর প্রান্ত থেকে আওয়াজ আসে এই মূহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।একটু পরে ডায়াল করুণ।বারবার কয়েকবার তাঁরা চেষ্টা করলো,কিন্তু কোন রকমে কল সার্ভিস হলো না।বাবা-মা ভাবল মেয়ের ফোনে হয়তো চার্জ নেই।তাই কল সার্ভিস হচ্ছে না।এইভেবে ফোন রেখে দিলো।কিন্তু না পরদিন ও একই অবস্থা কল সার্ভিস হচ্ছে না।এভাবে কেটে গেলো সপ্তাহ, মাস, বছর।সাজেদার আর কোন খবর তাঁরা পেলো না।
এদিকে সাজেদা পুরুষের মনোরঞ্জন নিয়ে ব্যস্ত।নানান পুরুষের নানান মত,একেকজনকে একেকভাবে খুশি করতে হয়।উপায় নেই করতে হবে।তা না হলে বিপদ।একদিন হাসান নামে এক ছেলে ভালোবাসায় ছ্যাঁকা খেয়ে নেশা করে আবাসিক হোস্টেলে আসে।তাকে সন্তুষ্ট করার দায়িত্ব পড়ে সাজেদার উপর।দুজনে একসঙ্গে রাত কাটায়।একপর্যায়ে দুজন দুজনের দু:খের কথা শেয়ার করে।হাসানের কেনো জানি তার প্রতি মায়া জন্মে যায়।রোজ রাতে হাসান ছুটে আসে সাজেদার কাছে একটুখানি ভালোবাসার জন্য।এভাবে কেটে যায় কিছুদিন।একদিন হাসান তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়।সাজেদা রাজী হয়।দুজন রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যায়।তারপর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়।
এদিকে সাজেদার বাবার চিকিৎসা না করার কারণে পায়ে ক্যান্সার হয়ে যায়,এবং তিনি মারা যান।তারা সরকারী খাসের জাগায় থাকত।এক নেতা ক্ষমতার দাপটে তাদেরকে তাড়িয়ে দিয়ে সেখানে একটা দশতলা ভবন তৈরী করেন।তারপর সাজেদার মায়ের ঠাঁই হয় ফুটপাতের আস্তানায়।দুছেলে-মেয়ে নিয়ে বিপদে পড়েন রহিমা।বিপদে পড়ে ভিক্ষার থালা হাতে নেন।দুচার টাকা যা পান তা দিয়ে কোনমতে পেটের ভাত যোগাড় করেন।এইভাবে কেটে যাচ্ছে রহীমার জীবন।
- এদিকে সাজেদা মা-বাবাকে খুঁজতে এসে দেখে এখানে কুঁড়েঘরের পরিবর্তে দশতলা ভবন তৈরী করা হয়েছে।পরিচিত কেউ এখানে নেই।সবাই অপরিচিতা এরা কী তাঁর মায়ের খবর বলতে পারবে?হয়তো না।তবুও কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলো।কেউ বলতে পারলো না।একবুক দুখ নিয়ে সে বাসায় ফিরে গেল।এরফাঁকে কেটে গেল কিছুদিন। একদিন মার্কেট থেকে ফেরার পথে,একভিক্ষুক তার দিকে হাত পেতে বলল,
মা আমায় কটা ট্যাকা ভিক্ষা দেন।আজ দুদিন ধইরা না খাইয়া আছি।
সাজেদা মুখের দিকে তাকাতে দেখল,এই ভিক্ষুক অন্য কেউ না,তার গর্ভধারিণী মা।সে চমকে উঠে বলল,
মা তুমি!
তুমি কে মা?
আমি তোমার সাজেদা।
সাহেজা তুই এতদিন কইছিলি?
বলব মা সব বলব।আগে বলো বাবা কেমন আছে?
তোর বাবা আর নাই।পায়ে ক্যান্সার লইয়া বিনা চিকিৎসায় মইরা গেছে।
মা-মেয়ে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে ডুঁকরিয়ে কেঁদে উঠে।তারপর সাজেদা তার “পতিতা” হওয়ার গল্প বলে।অনেক সাধনার পর খুঁজে পাই,সাজেদা তার মা,ভাই, বোনকে।পতিতা জীবন থেকে মুক্তি পায় সাজেদা, তারপর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।মা,ভাই,বোন, স্বামী সবাইকে নিয়ে সে সংসার জীবন শুরু করে।
আমি এক পতিতার গল্প লিখেছি।এরকম অনেক পতিতা সমাজের অনাছে কানাছে লুকিয়ে আছে যাদের খবর কেউ রাখে না।ঃসমাপ্তঃ
