প্রতারণা
আফছানা খানম অথৈ
মিথিলা ইঞ্জিনিয়ার পাস করে সবেমাত্র চাকরীতে যোগ দিয়েছে।ফ্যামিলির বড় মেয়ে। বাবা ছিলেন কলেজ টিচার মা হাই স্কুল টিচার।উনারা চাকরী থেকে অবসর নিয়েছেন।তাই শিক্ষা জীবন শেষ করার পর পর মিথিলার চাকরীর প্রয়োজন পড়েছে।সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকেন মিথিলা।যখন ফ্রি হই তখন ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত থাকে।একদিন রাতের বেলা মেসেঞ্জার অপশানে কল আসে মিথিলার। মিথিলা রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলে,
হ্যালো কে আপনি?
অপর প্রান্ত চুপচাপ কোন কথা নেই।মিথিলা কিন্তু থেমে নেই হ্যালো হ্যালো বলে চলেছে।কোন সাড়া না পাওয়াতে সে ফোন কেটে দেই।কিছুক্ষণ পর আবার রিং বেজে উঠে।মিথিলা কিন্তু এবার থেমে নেই।রাগের স্বরে বলে,
হ্যালো কে আপনি?কল করে কথা বলছেন না।যত্তসব ফালতুয়ামি।
তখনি অপর প্রান্ত থেকে আওয়াজ আসে,
হ্যালো আমি শুভ।
তো কথা বলছেন না কেনো,আপনার পরিচয়?
বললাম না আমি শুভ।
নামে কী পরিচিতি শেষ।পুরো এড্রেস বলেন।তানা হলে আমি ফোন কেটে দেব।
প্লিজ ফোন কাটবেন না।এইতো বলছি,আমি ইঞ্জিনিয়ার শুভ আহমেদ।
মিথিলা খুশি হয়ে বলে,
থ্যাংকস।
ওয়েলকাম।এবার আপনার পরিচয় বলেন?
আমি ইঞ্জিনিয়ার মিথিলা রহমান।
থ্যাংকস।ফ্যামিলিতে কে কে আছে?
বাবা-মা ভাই-বোন।আমি পরিবারের বড় মেয়ে।
থ্যাংকস।
আপনার ফ্যামিলিতে কে কে আছে?
বাবা-মা আর একমাত্র বোন।
থ্যাংকস।
প্রথম দফায় দুজনের মাঝে আলাপ পরিচয় হয়।তারপর পরিচয় থেকে আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব,বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাস।শুভ কিন্তু পাক্কা অভিনেতা ফোনে এমনভাবে প্রেমের ডায়ালগ বলছে যা শুনে মিথিলা একেবারে বেসামাল হয়ে উঠে।আর তর সইছে না শুভ’র সঙ্গে দেখা করার জন্য মন প্রাণ ব্যাকুল হয়ে উঠে।অফিস থেকে বের হওয়ার পর মিথিলা কল দেয়।শুভ রিসিভ করে বলে,
হ্যালো মিথিলা তুমি কোথায়?
আমি এইমাত্র অফিস থেকে বের হলাম।শুভ তুমি কোথায়?
আমি অফিসের কাজে বাইরে ব্যস্ত আছি।
মিথিলা রাগ হয়ে বলে,
যত্তসব তুমি কী গো?যখনি ফোন করি তখনি তুমি ব্যস্ত থাক।
জান কী হয়েছে কোন সমস্যা?
সমস্যা নয়তো কী,আমাদের রিলেশনের মেয়াদ পাঁচ মাস হয়ে গেল।এখনো আমরা কেউ কাউকে দেখিনি।দেখা করতে হবে না?
মিথিলা তাতো আবশ্যই।
তাহলে বলো কবে আমরা দেখা করছি?
সুইট হার্ট একটু ধৈর্য ধর। সময়মতো আমি জানিয়ে দেব।
শুভ আমি তোমার আর কোন কথা শুনতে চাই না।কালকের মধ্যে যদি দেখা না কর আমি তোমার সাথে ব্রেকআপ করবো।
প্লিজ সুইট হার্ট রাগ করো না।ঠিক আছে কাল আমরা দেখা করবো।
কখন?
কাল বিকেল তিন ঘটিকায় রমনা পার্কে।এবার খুশি তো সুইট হার্ট?
ইটস ওকে।এখন রাখি। বাই বাই বাই।
কথা পাকা করে দুজন বাসায় ফিরে গেল।পরদিন জাস্ট টাইমে মিথিলা রমনা পার্কে উপস্থিত হলো।একটা বেঞ্চ দখল করে সে বসে পড়লো।বরাবর তিনটা এখনো শুভ আসেনি।মিথিলা হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
উফ বিকেল তিনটা বেজে গেল এখনো শুভকে দেখছি না,,তবে কি সে আসবে না?না না তা হতে পারে না।আর একটু অপেক্ষা করে দেখি তারপর…।
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে শুভ পা টিপে টিপে মিথিলার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে তার চোখ দুটো চেপে ধরলো।তখনি মিথিলা বলল,
উফ লাগছে তো ছেড়ে দাও।
তখনি শুভ বলল,
আগে বলো কে,তারপর ছাড়বো।
কে আর হবে ইঞ্জিনিয়ার শুভ আহমেদ।
সিউর।
সিউর এবার ছেড়ে দাও।
শুভ মিথিলার চোখ ছেড়ে দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
হাই কেমন আছ?
তুমি ভালো থাকতে দিলে তো?
আমি আবার কী করলাম।
সবকথা বলতে হয় না,বুঝে নিতে হয়।
ওকে সুইট হার্ট।
তখনি শুভ একটা লাল গোলাপ তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
I love you মিথিলা I love you.
মিথিলা এক্সেপ্ট করে বলল,
I love you too.
তখনি শুভ বলল,
মিথিলা আমি জানতাম না আমার কল্পনায় আঁকা নারীর সঙ্গে তোমার এতটা মিল হবে।
মিথিলা চমকে উঠে বলল,
শুভ তুমি কি অন্য কাউকে ভালোবাস?
নাতো।
তাহলে কিছুক্ষণ আগে কার কথা বললে।
বলেছিলাম তোমার কথা।
মানে!
মানে হলো আমি কল্পনায় এতদিন যার ছবি এঁকেছি সে হচ্ছ তুমি,অন্য কেউ না।
সত্যি বলছ তো?
হুম সত্যি।তুমি আমার স্বপ্নে দেখা নায়িকা। আমি তোমাকে ভালোবাসি।বিয়ে যদি করি তোমাকে করবো।তুমি আমার জান,প্রাণ,আত্ম, দেহ, মন সব।
মিথিলা হা হা হো হো করে হেসে উঠে বলল,
এত্তকিছু?
তো আর বলছি কী।মিথিলা এখন বলো কি খাবে?
তুমি যা খাওয়াবে তাই খাব।
হুম চলো।
দুজন রেস্টুরেন্টে গিয়ে কেবিনে বসলো।তারপর ইচ্ছেমতো নাস্তা করে নিলো।মিথিলা বিল দিতে চাইলে শুভ বলল,
মিথিলা রাখ বিল আমি দেব।
তো আমি দিলে সমস্যা কোথায়?
সমস্যা নেই,তবে আমি দেব।কারণ গার্লফ্রেন্ডের বিল বয়ফ্রেন্ডকে দিতে হয় এটাই নিয়ম।
বিল দিয়ে দুজন স্ব স্ব বাসায় ফিরে গেল।এরপর দুজনের মাঝে নিয়মিত দেখা সাক্ষাত ও কথা হয়।মিথিলা শুভ”র প্রেমে একেবারে দিওয়ানা।শুভ ও সে রকম অভিনয় করে চলেছে।মাঝে ক’মাস পার হলো।একদিন দুজন গোপন অভিসারে মিলিত হলো।মিথিলার কোলে শুভ মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।তখনি মিথিলা বলল,
শুভ একটা কথা বলব?
হুম বলো।
আমরা দুজনে স্টাবলিস্ট।আমার মনে হয় আর দেরী করা ঠিক হবে না।
শুভ বুঝে ও না বুঝার ভান করে বলল,
সুইট হার্ট কী দেরী করা যাবে না?
শুভ বুঝে ও না বুঝার ভান করছ ?বিয়ে করতে হবে না?নাকি সারা জীবন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করবে?
তা কে বলেছে?
তাহলে আজই আমাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তবা পাঠাও।
ওকে সুইট হার্ট পাঠাব।তবে…।
তবে কী তামলে কেনো বলো।
মিথিলা আমি একটা বিপদে আছি।আগে সেখান থেকে উদ্ধার হই,তারপর যা করার করবো।
বিপদের কথা শুনে মিথিলার হৃদকম্প শুরু হয়ে গেল।সে হাফিয়ে উঠে বলল,
শুভ কী হয়েছে, কিসের বিপদ?
সুইট হার্ট তুমি অস্থির হইও না।মানুষ মাত্রই বিপদ আপদ আসে।তাই বলে এত অস্থির হতে হয় না।
শুভ কী বললে,তোমার বিপদের কথা শুনে আমি অস্থির হবো না তো কে হবে?তোমার কী হয়েছে খুলে বলো?
ওকে সুইট হার্ট বলছি।আমার ছোট বোন সিঙ্গাপুরে স্বামীকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিল।হঠাৎ সিরিয়াসভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লো।ইমারজেন্সি চিকিৎসা শুরু..।
ডাক্তার জরুরী ভিত্তিতে জানাল পাঁচ লাখ টাকা লাগবে।আমার জমানো টাকায় বাড়ি কিনে ফেলেছি।আর বাকী টাকা এক বন্ধুকে ধার দিয়েছি।এইমাত্র ফোন করলাম বলল দিতে পারবে না।ঐ দিকে আমার একমাত্র বোনের চিকিৎসার জন্য জরুরী টাকার দরকার।কি করবো ভেবে পাচ্ছি না।
তখনি মিথিলা বলল,
তোমার বোনের নাম্বারটা দাও। একটু কথা বলে দেখি।
তখনি শুভ তার বোনকে কল দিয়ে বলল,
লাকী আমার গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে কথা বল।
কাতরাতে কাতরাতে লাকী সালাম দিয়ে বলল,
হ্যালো ভাবী কেমন আছেন?
ভালো।তুমি কেমন আছ?
ভালো নেই ভাবি।ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস এসেছি বেড়াতে।এখন হয়ে গেলাম অসুস্থ।জানি না তোমার সাথে আর দেখা হয় কিনা,তোমাদের বিয়ে দেখি কি না?
লাকী এমন অলক্ষণে কথা বলো না।আল্লাহপাক তোমাকে সুস্থ করে তুলবেন।
দোয়া করবেন ভাবি তাই যেন হয়।এখন রাখি।বাই বাই বাই।
ফোন রাখতে শুভ বলল মিথিলা আমাকে লাখ পাঁচেক টাকা ধার দাও।পরে আমি দিয়ে দেব।
আসল নকল যাছাই না করে মিথিলা বলল,
ওকে চলো।
খুশি হয়ে শুভ বলল,
সুইট হার্ট তুমি সত্যি টাকা দিবে?
হুম দেব।
সুইট হার্ট তুমি আমার অনেক উপকার করলে। তোমার উছিলায় আমার একমাত্র বোনটি বেঁচে যাবে।আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি।
শুভ গেল মিথিলার সঙ্গে।মিথিলা একাউন্ট থেকে পাঁচ লাখ টাকা তুলে শুভকে দিলো।তারপর বাসায় ফিরে গেল।শুভ’র কাছে কল দিলো।কল সার্ভিস হচ্ছে না।বলে, দু:খিত একটু পরে ডায়াল করুন।মিথিলা কিন্তু থেমে নেই কলা দিয়ে চলেছে।কোন রকমে সংযোগ হচ্ছে না। বারবার একই উত্তর আসছে।এবার সে তার বোনের নাম্বারে কল দিলো। সেটাও বন্ধ।মিথিলা ভাবল কোন কারণে হয়তো বন্ধ।পরে সার্ভিস হবে।তাই কমিনিট পর পর কল দেয়।এমনিভাবে সাত দিন পার করে দিলো।তারপর ও যখন কল সার্ভিস হলো না।তখন পুলিশের কাছে কমপ্লেইন করলো।সবকথা শুনার পর পুলিশ বলল,
আপনি কোন ধরনের মেয়ে বলুন তো?শিক্ষিত হয়ে বোকার মতো কাজ করলেন।ভালো করে না জেনে না শুনে বয়ফ্রেন্ড বানিয়ে ফেললেন।আবার পাঁচ লাখ টাকাও দিলেন।
আসলে ও এমনভাব করেছে।একটি বারের জন্য মনে হয়নি এটা অভিনয়।
তবুও আপনার ভালো ভাবে জানা দরকার ছিলো।
আমি তার মিষ্টি ডায়ালগ শুনে সবকিছু ভুলে গিয়েছি।আর খুব বিশ্বাস করে ফেলেছি। এটাই ছিল আমার চরম ভুল।আমি এখন তাকে উচিৎ শিক্ষা দিতে চাই।তা না হলে সে আমার মতো আরও অনেকের সাথে প্রতারণা করবে।
তা অবশ্যই ঠিক বলেছেন।
তাহলে আর দেরী না করে জরুরী ভিত্তিতে ওয়ারেন্ট জারী করে তাকে ধরে নিয়ে আসেন।
সেটা আপনাকে বলতে হবে না। আমরা অবশ্যই আমাদের দায়িত্ব পালন করবো। পুলিশ সুপার থেমে থাকল না।প্রতি থানায় শুভ’র ছবি পাঠিয়ে দিলো।সব থানার পুলিশ খুব সতর্কতার সহিত তাকে খুঁজতে শুরু….।
এক মাস পর পুলিশ তাকে ঠিক খুঁজে বের করলো।থানায় এনে পুলিশ রিমান্ডে দেয়ার পর সকল সত্য বেরিয়ে আসল।আসলে শুভ নামের ইঞ্জিনিয়ার লোকটি এক সময় পেশাদার দাগী চোর ছিল।এলাকার মানুষ তার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠে।তারপর সবাই এক হয়ে একদিন তাকে ধরে খুব মারধর করে এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেয়।এরপর সে শহরে এসে ঘাটি স্থাপন করে এবং পাত্র সেজে নারীদের সাথে প্রতারণা করে।খবর পেয়ে ছুটে আসে মিথিলা।আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জোর গলায় বলল,
মহামান্য আদালত শুভ নামের লোকটির বিরুদ্ধে আমার আনীত অভিযোগ,
এই লোকটি ভুয়া ইঞ্জিনিয়ার সেজে বয়ফ্রেন্ডের অভিনয় করে আমার কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।আমি আমার টাকা ফেরত ও ন্যায্য বিচার চাই।আমি আদালতের কাছে ওর এমন সাজা চাই যাতে করে সে আর কোন নারীর সাথে “প্রতারণা” করার সুযোগ না পাই।
আদালত তার অভিযোগ মঞ্জুর করলো এবং তাকে কঠিন সাজা দিলো।
ঃসমাপ্তঃ
সুন্দর লিখেছেন ✨
বেশ আনন্দ দায়ক।পড়ে মুগ্ধ হলাম।