বখাটে
আফছানা খানম অথৈ
ফরিদা সবেমাত্র ইন্টারমিডিয়েট এ ভর্তি হয়েছে।রীতিমতো ক্লাস করছে।ইতোমধ্যে অনেকের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠেছে।কলেজ লেভেলে পা দিলে ছেলে মেয়েদের ভিতরে প্রেমের ভাব সাব চলে আসে।ফরিদার ক্ষেত্রে ও তাই হয়েছে।প্রেমের প্রস্তাব আসতে শুরু করেছে।ফরিদা কিন্তু এসবে মন দিচ্ছে না।মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করছে।
স্কুল জীবন থেকে ফরিদাকে ফলো করে চলেছে তার এলাকার এক বখাটে মাস্তান সাদিক।সে বহুবার প্রেমের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল।ফরিদা তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে।কিন্তু সাদেক থেমে নেই।সে তার পিছু লেগে আছে।কিভাবে তাকে তার আয়ত্বে আনা যায় সেই প্ল্যান তৈরী করছে।
তার কলেজ লেভেলের বন্ধুদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছে।তাদের পিছনে প্রচুর টাকা ব্যয় করছে।এরই মধ্যে ফরিদার অনেক বন্ধু বান্ধবী সাদিকের আয়ত্বে চলে এসেছে।তাদের সহযোগীতায় একদিন গাড়ি ভাড়া করে সাদিক।তারপর তাদেরকে দিয়ে বেড়ানোর নাম করে ফরিদাকে গাড়িতে তোলে।কিছুদূর যাবার পর গাড়ি ব্রেক করে।তার বন্ধু বান্ধবীরা নেমে পড়ল।তারপর সাদিক গাড়িতে উঠে বসল।সাদিককে দেখে ফরিদা ভয় পেয়ে যায়।জিজ্ঞেস করল,
তুমি এই গাড়িতে কেনো?
আমার গাড়িতে আমি থাকব নাতো কে থাকবে?
তার মানে তুমি এই গাড়ি ভাড়া করেছে?
হুম তাই।এখন তুমি আমার সাথে ঢাকা যাবে।
ফরিদার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছেনা।তার হৃদকম্প শুরু হয়ে গেছে।থত্থর করে করে শরীর কাঁপছে।এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে,তার বন্ধু বান্ধবীরা তার কাছে বিক্রি হয়ে গেছে।তাই কায়দা করে তাকে তার হাতে তুলে দিয়েছে।শত ডাকলেও তারা তার ডাকে সাড়া দিবে না।
ফরিদা অনেক কান্না করছে।তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করছে।কিন্তু সাদিক শুনলেতো?
সে তাকে নিয়ে উল্কার গতিতি ছুটে চলেছে।অনেক রাত হয়েছে সে ফরিদাকে নিয়ে ঢাকা তার এক খালার বাসায় উঠেছে।তাকে একঘরে বন্দি করে রেখে সেই বাইরে চলে গেছে।
এরই মধ্যে তার গ্রামের বন্ধুদের দ্বারা মিথ্যে খবর প্রকাশ করেছে,
ফরিদা সাদিকের সাথে পালিয়ে গিয়েছে।শুধু তাই নয় তাদের বিয়ে ও হয়ে গেছে।
ফরিদার মা বাবা খবরটা শুনে অবাক হয়ে গেছে।তারা বিশ্বাস করতে পারছে না।ফরিদা কেনো সাদিকের সাথে পালালো।সেতো সাদেককে দেখতে পারেনা।পছন্দ করে না।তাহলে পালালো কেনো?
বিভিন্ন প্রশ্ন তাদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।কিন্তু গ্রামের লোকজন কি আর থেমে থাকে তাদের বাড়ি বয়ে এসে ধিক্কার দিচ্ছে,ছিঃ ছিঃ করছে।লজ্জায় তাদের মাথা হেট হয়ে যাচ্ছে।
শুধু যে ধিক্কার দিচ্ছে তা না বিচার শালিস বসিয়ে রায় দিয়েছে।এই মেয়ে গ্রামে যেন আর কখনো না আসে।তাকে গ্রামে যেন জায়গা দেয়া না হয়।কড়া হুশিয়ারী দিলো গ্রামের গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
এদিকে ফরিদা খুব বিপদে আছে।কারো কাছে যে সাহায্য নিবে সে উপায় ও নেই।সে অজর ধারায় কাঁদছে।কিন্তু সাদিক প্রস্তাব করেছে,
তোকে ছেড়ে দিতে পারি এক শর্তে?
বলো কী শর্ত?
যদি আমাকে বিয়ে কর।স্বামী হিসাবে মেনে নাও।তবে তোমাকে ছেড়ে দেব।এর ব্যতিরেকে নয়।
আমি মরে গেলেও তোকে বিয়ে বিয়ে করব না।
কেনো করবে না?
তুই আমার যোগ্য না।তোর সাথে আমার যায় না।আমি কখনো তোকে বিয়ে করব না।
ঠিক আছে,যতদিন রাজী না হবি,ততদিন বন্দি থাকবি।
এবার ভেবে দেখ কী করবি?
শত জোরাজুরির পর ও ফরিদা রাজী হচ্ছেনা,তাকে বিয়ে করার জন্য।সাদিকেরে মেজাজ গরম হয়ে উঠে সে তাকে মারধর করে।হাতের নখ পায়ের নখে গরম ছ্যাঁকা দেয়,তুলে ফেলার হুমকি দেয়।
এভাবে সে রোজ রোজ ফরিদাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করত।বিয়ের জন্য চাপ দিতো।তবুও ফরিদা বিয়েতে রাজী হয় না।
কিন্তু এভাবে আর কতোদিন।তাকে বের হতে তো হবে।কিন্তু উপায়?সে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইছে।সাতদিন পার হয়ে গেলো। কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না।কি করবে না করবে ভেবে পাচ্ছে না। রুম থেকে বের হতেও পারছে না।উভয় সংকটে আছে সে।আজ সাদিক দরজায় তালা দিতে ভুলে গেছে।এই সুযোগে সে বের হয়ে গেছে।তারপর গাড়ি করে গ্রামে চলে আসল।
কিন্তু গ্রামের লোকজন তাকে মেনে নিলো তো?।সবাই তাকে দেখে ধিক্কার দিলো,ছি: ছি:..।
সে বলল,
চাচা আমার কোনো দোষ নেই।সব দোষ সাদিকের।
ন্যাকা সাজ না?আমরা সব জানি,তুমি সাদিকের সাথে পালিয়েছ।এই গ্রামে তোমার কোনো জায়গা নেই।দূর হয়ে যাও।
চাচা ভুল বুঝবেন না।আমার কোনো দোষ নেই।
আমরা তোমার কথা বিশ্বাস করিনা।
আমার কথাটাতো একবার শুনবেন?
তোমার কোনো কথা শুনতে চাইনা।তুমি যাও গ্রাম থেকে।
কথা না বাড়িয়ে ফরিদা চলে গেল নিজ বাড়িতে।কিন্তু
সে কী:
মা বাবাও চুপচাপ,তাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে কথা বলছে না।
মা বাবা তোমরাও আমাকে ভুল বুঝছ?সাদিক আমাকে ব্ল্যাকমেইল করেছে।আমি তার সাথে যায়নি।তার সাথে আমার বিয়ে ও হয়নি।বিশ্বাস কর?
আমরা তোর কোনো কথা বিশ্বাস করিনা।তুই কলঙ্কীনি।তুই কি করে পারলি সাদেকের মতো বখাটের সাথে পালাতে।তুই ফিরে এলি কেনো?তুই মরতে পারিস না।তুই আমাদের মেয়ে না।তোর জন্য সমাজে মুখ দেখাতে পারি না।তুই মরলে আমরা বাঁচি।
দু:খে শোকে জর্জরিত ফরিদা।কোথাও মা বাবা বুকে টেনে নেবে তা না।সবাই দূরদূর করছে।মরতে বলছে।ফরিদা ভাবছে সত্যিতো আমি কলঙ্কীনি।বেঁচে থেকে বা আমার কী লাভ?কেউতো আমাকে মেনে নেবেনা।সারাজীবন কলঙ্কের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে।তার চেয়ে মরে যায়?সবাই মুক্তি পাক কলঙ্কের বোঝা থেকে।ঘরে জায়গা হলো না ফরিদার। এতরাতে তাকে বের করে দেওয়া হলো।সে যাবে কোথায়?তাই বাগান বাড়িতে গিয়ে একটা গাছের সঙ্গে ওড়না পেঁছিয়ে সে আত্মহত্যা করলো।
মরার আগে একটা চিঠি লিখল মা বাবার কাছে
শ্রদ্ধেয়া বাবা মা
আমার সালাম ও ভালোবাসা নিও।আশা করি ভালো আছ।
যাক: বাবা মা তোমাদেরকে আজ একটা নিছক সত্য কথা বলার জন্য কাগজ কলম হাতে নিলাম।তোমরা সবাই আমাকে দোষী সাব্যস্ত করলে।কিন্তু একবার ও আসল সত্যটা জানার চেষ্টা করলে না।আমার কোনো দোষ ছিলো না।আমার কিছু বন্ধু বান্ধবী সাদেকের টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গেছে।তারা আমাকে বেড়ানোর নাম করে গাড়িতে করে নিয়ে যায়।কিছুদূর যাবার পর সাদেকের হাতে তুলে দিয়ে তারা নেমে পড়ল।আমি শত চিৎকার করার পর ও তারা আমার কথা শুনেনি,এবং আমাকে নেয়নি।এরপর সাদেক আমাকে ঢাকায় তার এক খালার বাসায় বন্দি করে রাখে।আমাকে শারীরিক ও মানসিক টর্চার করে।বিয়ে করার জন্য জোর করে। কিন্তু আমি রাজী হয়নি।একটু সুযোগ পেয়ে পালিয়ে এসেছি তোমাদের কাছে।কিন্তু তোমরা কলঙ্কীনি বলে আমাকে তাড়িয়ে দিলে! লোকের কথা বিশ্বাস করলে?একবার ও আমার কথা শুনলে না।সত্য মিথ্যা যাছাই করলে না?আমাকে বের করে দিলে,মরতে বললে?
কিন্তু আমি যাব কোথায়?আমার যে যাবার জায়গা নেই।তাই মরে সব সমস্যার সমাধান করে গেলাম।
ভালো থেকো সুখে থেকো এই দোয়া করি খোদা পাকের কাছে।
ইতি
তোমাদের অপরাধী কন্যা
ফরিদা ইয়াছমিন।
সকাল হলে সবাই তার লাশ দেখতে পেল।তার পাশে লেখা চিঠিটা পড়ে মা বাবা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।বুঝতে পারলো তার মেয়ে নির্দোষ।এক “বখাটের” জন্য কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে ফরিদা আত্মহত্যা করলো।তার এই আত্মহত্যার জন্য মা বাবা এবং সমাজ দায়ী।আমাদের প্রত্যেকের উচিৎ কাউকে অপবাদ দেয়ার আগে সত্য মিথ্যা যাছাই করা।কিন্তু আমরা তা না করে এক তরফাভাবে রায় দিয়ে পেলি।