ভালোবাসায় পরিপূর্ণতা
আফছানা খানম অথৈ
রাকিব পরিবারের ছোট ছেলে।সরকারী কলেজের অধ্যাপক। পাঁচ বছর ধরে চাকরী করছে।কিন্তু বিয়ে করতে রাজী হচ্ছে না।অবিভাবকের পক্ষ থেকে যতবার বিয়ের চাপ দেয়া হয়,সে না করে দেয়।ভাবীরা মজা করে জিজ্ঞেস করে,
রাকিব পছন্দ-টছন্দ আছে নাকি?কারো জন্য কি অপেক্ষা করছ?থাকলে নি:সংকোচে বলতে পার।আমরা সাদরে তাকে বরণ করব।
রাখিব বিরক্ত হয়ে বলল,
ভাবী কি শুরু করে দিলে।আমার বিয়ের সময় হলে আমি ঠিক তোমাদেরকে বলব।
তার মানে এখনো তোমার বিয়ের বয়স হয়নি?হা হা হো হো….।
ভাবী তোমরা কি শুরু করে দিলে।বললাম না,আমার সময় হলে আমি বলব।অতএব বিরক্ত না করে তোমাদের কাজে যাও।
রাকিব সত্যি একজনকে পছন্দ করে রেখেছে।কিন্তু সমস্যা হলো সে এখনো থাকে খুঁজে পাচ্ছে না।একদিন রেল ষ্টেশনে তার সাথে রাকিবের দেখা।তাও রোমান্টিক সিনারিতে। দুজন দুদিক থেকে টিকেট কাউন্টারের দিকে আসছে।হঠাৎ একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা লাগে।দুজন দুজনের মুখের দিকে কমিনিট তাকিয়ে রইল।আঘাত অবশ্যই দুজনেরি লেগেছে তবুও রাকিব বলল,
সরি।
ইটস ওকে।
তারপর দুজনে টিকেট কাউন্টার থেকে টিকেট নিয়ে ট্রেনে উঠে বসলো।রাকিব কিন্তু ইভার পিছনে পিছেনে গেল।তবুও সে যে কোন কামরায় উঠল টের পেলো না।মাঝে মাঝে ষ্টেশনে ট্রেন থামলে সে গলিতে হেটে হেটে সেই মেয়েটিকে খুঁজে কিন্তু কোথাও তাকে পাইনা। রাকিব ইভা নামের মেয়েটিকে খুঁজে পাইনি ঠিকই,কিন্তু তার প্রেমে পড়ে গেছে অর্থাৎ সে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে।তারপর থেকে সে আপন মনে তাকে খুঁজে চলেছে।তার ধারণা তার ভালোবাসার প্রিয়াকে সে একদিন না একদিন খুঁজে পাবে।কারণ ভালোবাসা আল্লাহপাকের সৃষ্টির নেয়ামত।এই আশা বুকে ধারণ করে সে দিল-কাল যাপন করছে।আর এই জন্য পরিবারের লোকজন বিয়ের জন্য যতই চাপ দিচ্ছে সে কোন কারণ বলতে পারছে না।ভালোবাসার কথা বললে যদি মেয়েটির নাম ধাম জিজ্ঞেস করে।এই ভয়ে সে মুখ খুলছে না।নিরবে নিভৃতে মেয়েটিকে খুঁজে চলেছে।একদিন সাজ সকালে বাবা ডেকে বলে,
রাকিব আমার বয়স তো আর কম হলো না।কখন পরপারের ডাক আসে তা একমাত্র আল্লাহপাক জানেন।বিবাহ যোগ্য কর্মক্ষম ছেলে-মেয়ে রেখে যদি কোন বাবা-মা মারা যান তাহলে আল্লাহপাকের কাছে এর জবাব দিতে হবে, শুধু তাই নয় গুনাগার হতে হবে।তুই কি চাস তোর জন্য আমরা পরকালে সাজা ভোগ করি?
জ্বি বাবা মানে ইয়ে,বলছিলাম আর কিছুদিন যাক তারপর বলব।
আর কটা দিন কেনরে? তোর কি কাউকে পছন্দ?থাকলে বল,আমরা তার সঙ্গে তোর বিয়ে দেব।
রাকিব কোন কথার জবাব না দিয়ে বাবা-মায়ের সামনে থেকে কেটে পড়লো।সে প্রতি ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা করে তার ভালোবাসার প্রিয়ার সঙ্গে যেন তার মিলন হয়।এদিকে প্রতি বছরের মতো এ বছর ও হ্যাপি নিউ ইয়ার(2018) থেকে শুরু হলো বাণিজ্য মেলা।মাননীয়া প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণিজ্য মেলার উদ্ভোধন করেন।ক্রেতা-বিক্রেতা সবার মাঝে যেন সুসম্পর্ক বজায় থাকে।কোন ক্রমে বাণিজ্য মেলার সৌন্দর্য নষ্ট না হয়,নিয়ম শৃংখ্যলা যাতে ভঙ্গ না হয় সে জন্য আইন শৃংখ্যলা বাহিনীকে হুশিয়ারী সংকেত দিয়ে দেন। আজ শুক্রবার ছুটির দিন,তাই রাকিব ঘুম থেকে একটু লেট করে উঠল।হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে নাস্তা করলো।তারপর ড্র্য়িংরুমে বসতে দেখল টেবিলের উপরের খবরের কাগজ পড়ে আছে,দৈনিক ইত্তেফাক।রাকিব হাতে নিয়ে পড়তে দেখতে পেল হেড লাইনে বড় বড় লাইনে বিজ্ঞাপন সহ বাণিজ্য মেলার ব্রেকিং নিউজ। বড় বড় বিদেশী শপিং কমপ্লেক্সে’র বাহারী বুলেটিং, এক আইটেম কিনলে দশ আইটেম ফ্রি,আর ও হরেক রকম বিজ্ঞাপন, আর দেরী নয় ক্রেতা ভাই-বোনের চলে আসুন সরাসরি আমাদের বাণিজ্য মেলায়।এখানে আছে দেশী বিদেশী বাহারী ডিজাইনের জিনিসপত্র, যা চাইবেন, তা পাইবেন।মনেরমতো সব আইটেম, পছন্দ সই, মানান সই।
রাকিব আর দেরী করলো না। বেরিয়ে পড়লো।ষ্টেশনে দাঁড়াতে একটা রিক্সা দেখে ডাক দেয়,
এই খালী।
ড্রাইভার এগিয়ে এসে বলে,
সাব কই যাইবেন।
বাণিজ্য মেলায়।
উইঠা বহেন।
রাকিব রিক্সায় উঠে বসলো।ড্রাইভার হ্যান্ডেলে চাপ দিলো।রিক্সা এগিয়ে চলল।পনেরো বিশ মিনিটের মধ্যে রিক্সা বাণিজ্য মেলার গেটের সামনে এসে ব্রেক করলো।রাকিব রিক্সা থেকে নেমে হাটা শুরু করলো।তারপর বাণিজ্য মেলার টিকিট কাউন্টার থেকে টিকেট সংগ্রহ করে ভিতরে ঢুকার জন্য সামনে পা বাড়িয়ে দিলো।ঠিক তখনি যেন তার ভালোবাসার প্রেয়সী এসে সেদিনকার মতো তার সঙ্গে ধাক্কা খেল।দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে অবাক।সেদিনকার মতো একে অপরকে সরি বলে মিট করলো।আজ আর একে অপরকে ছেড়ে গেল না।দুজন পাশা-পাশি হেটে ভিতরে চলে গেল।তারপর রাকিব বলল,
প্লিজ আপনার নামটা কিন্তু এখনো জানা হলো না।
আমার নাম ইভা রহমান।
কি করেন?
তেমন কিছু না, একটা বে সরকারী কলেজে চাকরী করি।বছর খানেক হবে।
রাকিব বিয়ের কথাটা সরাসরি কিভাবে বলবে।তাই একটু ঘুরিয়ে বলল,
ম্যাডাম আপনার স্বামী ও কি চাকরী করেন?
তিনি হেসে উঠে বলেন,
না আমি এখনো বিয়ে করিনি।
থ্যাংকস।
থ্যাংকস কেন?
না মানে এমনি,ম্যাডাম একটা কথা বলব?
হ্যাঁ বলুন।
আপনার কি দশ মিনিট সময় হবে।
কেন কেন?
ইয়ে মানে আপনার সাথে আমার স্পেশালি কিছু কথা ছিল।তাই..।
ঠিক আছে চলুন।
কোথায় বসবেন?
কোথায় মানে,বাণিজ্য মেলার ভিতরে বিনোদনের জন্য কর্তৃপক্ষ পার্ক তৈরী করেছেন।সেখানে দশ মিনিট কেন ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপ করলেও কেউ না করবে না।
ওকে ম্যাডাম চলুন।
দুজন পাশা-পাশি হেটে পার্কের বেঞ্চিতে গিয়ে বসলো।রাকিব বলবে বলবে ভাব করছে, কিন্তু বলতে পারছে না।কেন জানি নার্ভাস নার্ভাস লাগছে।কমিনিট পর ইভা ম্যাডাম বলল,
রাকিব সাহেব কিছু বলছেন না যে?
ও হ্যাঁ ম্যাডাম কিভাবে যে কথাটা শুরু করি।
টিচার মানুষ কিছু বলার জন্য এতভাব নিতে হয় নাকি?
ঠিক বলেছেন, ম্যাডাম আমার পরিবার থেকে বিয়ের জন্য আমাকে চাপ দেয়া হচ্ছে।কিন্তু আমি মনেরমতো কাউকে খুঁজে পাইনি বিধায় এতদিন বিয়ে করতে রাজী হইনি।যাক এবার ভাগ্য চক্রে পছন্দের মানুষ পেয়ে গেছি।
তো আর দেরী করবো না,তাড়াতাড়ি বিয়ে করবো।যদি আপনার কোন আপত্তি না থাকে।
মানে?
মানে হলো আপনাকে আমার পছন্দ,সেদিন ট্রেন ষ্টেশনে টোকা-টুকি খাওয়ার পর থেকে আপনার প্রতি আমার মনে অসম্ভব রকম ভালোবাসার সৃষ্টি হয়।আমি ট্রেনে আপনাকে অনেক খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি।এরপর থেকে আপনার আশায় আশায় প্রহর গুনছি,কখন আল্লাহপাক আমাদের দেখা করিয়ে দেন।
যাক অবশেষে আল্লাহপাকের সুমতি হয়েছে, এবং আমাদের দেখা করিয়ে দিয়েছেন।
এবার আপনার মতামত বলুন?
রাকিব সাহেব সত্য কথা বলতে কি, আমার ও ঠিক আপনার মতো অবস্থা পরিবার থেকে বিয়ের জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে,কিন্তু আমি কিছু বলতে পারছি না।
কেন আপনি কি কাউকে ভালোবাসেন?
হ্যাঁ বাসি।
সে কি করে, কোথায় থাকে?
সে একজন সরকারী কলেজের অধ্যাপক।অবশ্য এই মুহূর্তে তিনি আমার সামনে বসে আছেন।
উফ!ইভা আর একটু হলে তো আমি হার্টফেল করতাম।
কেন কেন?
যদি তুমি অন্য কারো নাম বলতে।
উহু!ব্যাপারটা তো খুবই ফ্যান্টাসটি।
তো আর বলছি কি।
শুন রাকিব ভালোবাসা আল্লাহপাকের দেয়া নেয়ামত।সত্যিকার ভালোবাসা কখনো এক মনে হয় না।দুটি মন যখন এক হয়ে যায়, তখনি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়।এবং সেই ভালোবাসা হয় পবিত্র এবং মহৎ।আমাদের দুজনের উদ্দেশ্য এক তাই আমরা একে অপরকে খুঁজে পেয়েছি।
এবার রাকিব বলল,
তো আর দেরী কেন,
“আই লাভ ইয়ু”
এবার ইভা একসেপ্ট করলো,
“আই লাভ ইয়ু টু”
ইভা আর একটা কথা, আমার পছন্দের উপর আমার পরিবারের পক্ষ থেকে কোন অভিযোগ নেই। এবার তোমার কথা বলো।
রাকিব আমার পরিবারের ও কোন অভিযোগ নেই।কারণ এমনিতে আমার বিয়ে নিয়ে উনারা খুব টেনশনে আছেন।
তাহলে তো কোন কথায় নেই।কালই আমার মা-বাবা গিয়ে বিয়ের কথা পাকা করবে।
চলো শপিং করতে।
রাকিব সাহেব এখন থাক।বিয়ের সময় কেনা-কাটা করা যাবে।
খরচটা দ্বিগুন হয়ে যাবে না?
হুম বিয়ে না হতে এত হিসেব।
অবশ্যই বিনা প্রয়োজনে অপচয় করা ভালো না।
ঠিক আছে চলো।
দুজন দুজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরে গেল।রাকিব ইভার ব্যাপারে তার ভাবীকে সব বলল।তিনি তার শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে সব বুঝিয়ে বললেন।তারা আর অমত করলো না।রাকিবের মা-বাবা , ভাবী ইভাকে দেখতে আসল।ইভাও রাকিবের ব্যাপারে সব তার বড় ভাবীকে বলে রেখেছে।তাই আর কোন সমস্যা হলো না।ইভার পরিবারের লোকজন সাদরে তাদেরকে বরণ করলো।ইভা সাজু-গুজু করে রাকিবের মা-বাবার সামনে আসল এবং ভদ্রভাবে সালাম দিলো।উনারা সালামের জবাব দিয়ে তাকে বসতে বললেন।তারপর রাকিবের বড় ভাবী বলল,
মা রাকিব’র পছন্দ আছে?
ঠিক বলেছ বউ মা।তারা আর দেরী করলেন না।আংটি পরিয়ে দিলেন।সঙ্গে সঙ্গে বিয়ের দিন তারিখ ফাইনাল করলেন।এক সপ্তাহ পর বিয়ে।দু’পরিবারের লোকজনের মুখে হাসি খুশি ভাবসাব।
কারণ দু’পরিবারের লোকজন দুজনের বিয়ে নিয়ে খুব টেনশনে ছিলো।যাক এতদিন পর সুখের বাজনা বাজল।
দু’বাড়িতে বিয়ের ধুমধাম বাজনা বাজছে।সময়মতো বিয়ে হলো। রাকিব ইভাকে বউ করে নিয়ে গেল।গভীর রাত সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।জেগে আছে রাকিব ইভা।দুজন চুপচাপ বসে আছে।কেউ কিছু বলছে না।ইভা রাকিবকে পরখ করার জন্য বলল,
রাকিব আমার ঘুম পাচ্ছে,আমি ঘুমাব।
ইভা কি বললে, আমি শুনতে পাইনি আবার বলো।
আমি ঘুমাবো।
শুন ইভা আমি দীর্ঘ পাঁচ বছর অপূর্ণ ভালোবাসা বুকে নিয়ে খুব টেনশনে ছিলাম।আজ আমাদের “ভালোবাসায় পরিপূর্ণতা” লাভ করেছে।আজ আমাদের খুব আনন্দের দিন।আজ সারারাত আমরা খুব মজা করবো।
রাকিবের ধৈর্য আর মানছে না,ইভাকে জড়িয়ে ধরে…।
ইভা রাকিবের ভালোবাসায় পরিপূর্ণতার গল্প এখানে শেষ।নতুন বছরের নতুন দিনে তাদের সংসার জীবন শুরু হলো।
