ভুত
আফছানা খানম অথৈ
বিজ্ঞান এখনো ভুত নামক প্রাণির কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাননি।তাদের মতে এটা ভিত্তিহীন, এর কোন অস্তিত্ব নেই। কিন্তু মনুষ্য জাতি কখনো তা স্বীকার করে না। তাদের মতে ভুত নামক এক প্রকার মারাত্বক ক্ষতিকর প্রাণি আছে, যা সারাক্ষণ মানুষের পাশাপাশি ছায়ার মতো হাওয়ার সাথে বসবাস করে।বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রুপ ধারণ করে মানুষের সামনে হাজির হয়। আর সুযোগ বুঝে ছোবল মারে,গায়ে আছর করে। তখন আর মানুষ আগের মতো থাকেনা। আচরণ ও স্বভাব চরিত্র অন্য রকম হয়ে যায়।আপন জনের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে যেতে চেষ্টা করে। চেঞ্জ ঠিক থাকেনা। মেন্টাল রোগী মনে হয়। বেঁধে রাখা ছড়া আর কোন উপায় নেই।কোন রকমে সুযোগ পেয়েছে তো পালিয়েছে। আর এই সুত্র ধরে ভুতে না পাওয়া কিছু রোগী যেমন টাইফয়েড় ও ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হওয়া রোগী চিকিৎসার অভাবে আলা বোলা হয়ে গেলে তাকে ও ভুতে ধরেছে মনে করে গুনিন ডেকে ঝাড ফুঁক দিতে দিতে মেরে ফেলা হয় অনেক ক্ষেত্রে। মানুষ এখনো চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞ।তাই এ কু’সংস্কারে আক্রান্ত হয়ে মারা পড়ে প্রতিদিন অনেক লোক, কে তার হিসেব রাখে। ছোটবেলা থেকে এই ভুতের গল্প শুনতে শুনতে কান জ্বালা পালা। এখনো তার ইতি টানতে পারলাম না।বড় হয়ে ও ভুতের গল্প বেশ করে শুনছি ও আশ পাশের দু’একজনকে ভুতে পেতে দেখেছি।
কিচুদিন পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনা।সুমন তার চাচাতো ভাই সোহানকে নিয়ে রাতে মাছ ধরতে যাওয়ার প্ল্যান করেছিল।দিনে কথা হলো রাত আটটা’র পর তারা মাছ ধরতে বের হবে টেডা নিয়ে,যাকে অনেকে কোঁচ ও বলে থাকে।দেখা গেলো রাত আটটা না বাজতে সোহান এসে হাজির।সুমন তাকে দেখে বলে উঠল,
সোহান তুই এসেছিস?
জ্বি ভাইয়া চলুন।
দু’জন টেডা আর থলে নিয়ে মাছ ধরতে বের হলো। জমিতে তখন সাইল ধান। বর্ষার শেষ সিজন।জমিতে হাটুর নিচে পানি। এই জমিতে টর্চ লাইট মেরে টেডা দিয়ে মাছ ধরা অনেকের সখ।আজ সুমন ও সোহান সখ করে মাছ ধরতে বের হলো। সোহানের হাতে থলে আর সুমন টেডা দিয়ে মাছ ধরছে। সৈল,লাটা,কৈ মাছে থলো প্রায় ভর্তি হয়ে গেছে। এমন সময় সোহান বলল,
ভাইয়া চলো আমরা ঐ চিকন খালটাতে মাছ ধরতে যাবো।
না সোহান ঐ দিকে যাওয়া খুব রিক্স।তাছাড়া রাত ও অনেক হয়ে গেছে। চল, আমরা বাসায় ফিরে যাবো।
ভাইয়া আমরা দুভাই আছি না। কোন ভয় নেই। ভুত,টুত আমাদের কিছুই করতে পারবে না।
সুৃমন ভাবল সোহান যখন এত করে বলছে সমস্যা হবে না।তাছাড়া ঐখালে প্রচুর মাছ। রাত তখন প্রায় দশটা। দু’ভাই খাল পাড়ে গিয়ে উপস্থিত হলো।ও গড!একি অবস্থা খালে মাছ আর পানি এক সাথে মিশে থৈ থৈ করছে। সুমন কোনটা ধরে কোনটা ধরবে। হঠাৎ একটা বড় সৈল মাছ দেখে সে খপ করে টেডা মেরে দিলো।মাছ আর যাই কই, আটকে গেল। সুৃৃমন মাছ খুলে সোহানের দিকে এগিয়ে দিতে দেখে, সে কাঁচা মাছ খাচ্ছে। শুধু তাই নয় তার চেহারা সম্পূর্ণ অন্য রকম। কি বিভৎস্য চেহারা, চোখ দুটো ইয়া বড় লাল, দুই কাঁধে, মুখের আকৃতি অন্যরকম ভয়ঙ্কর আগুন বের হচ্ছে ,বডি ইয়া বড় লম্বা,দেখতে মানুষের কংকালের মতো। তখনি সুমনের অনুমান হলো ছোট বেলায় মুরব্বীদের মুখে যে প্রায় ভুতের গল্প শুনতাম, এতো সেই ভুত, সোহান নয়।কথাটা মনে পড়তেই তার সমস্ত শরীর থত্থর করে কেঁপে উঠল। শরীর অবশ হয়ে আসছে। চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে। ভয়ে দিশেহারা, আর ভুত তা বুঝতে পারলো। তখনি সুমনকে তাদের দল,বল,ডেকে গন্তব্য স্থলে নিয়ে যাওয়ার জন্য টানা হেঁচডা শুরু….।
সুমন ও থেমে নেই তাকে ঝাপটা মেরে দিলো দৌড়, ভাগ্যিস তার হাতের লাইট জ্বালানো ছিল।সে ভয়ঙ্কর পথ ওভার করে মাঝ রাস্তায় এসে অজ্ঞান হয়ে পড়লো।রাত তখন প্রায় বারোটা। এত রাতে লোকজনের যাতায়াত প্রায় কমে গেছে। হঠাৎ দু’জন লোক পাশের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল,এদিকে চোখ পড়তেই দেখল, একটা জ্বলন্ত লাইট জ্বলছে, অন্ধকারে আর কিছুই অনুভব করা যাচ্ছে না। তারা এগিয়ে এলো,এসে একি দেখল! একটা লোক অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। মুখ ঘুরাতে দেখে এতো অন্য কেউ নয়, আসিফ স্যারের বড় ছেলে সুমন। তারা পাজাকোলা করে তাকে বাসায় নিয়ে আসল।
ছেলেকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখে মা কেঁদে উঠে বলল,
কি ব্যাপার তোমরা কারা? আমার ছেলের এ অবস্থা কে করেছে? সোহান কোথায়?
মায়ের তিনটা প্রশ্নের উত্তর তারা এক সঙ্গে দিলো,
খালাম্মা আমরা এসবের কিছুই জানি না। তাকে রাস্তায় এ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে নিয়ে আসলাম।
তাদের কথা শুনে মা ঠিক বুঝতে পারলেন, সুমনের কি হয়েছে। তিনি তাড়াতাড়ি একটা গুনিন ডেকে আনলেন এবং তাকে সুমনের মাছ ধরার ব্যাপারটা খুলে বললেন,
গুনিন মাথা নেড়ে সাঁয় দিলো,
হু বুঝবার পারছি ।
ভাবী সাহেবা চিন্তা কইরেন না। সব ঠিক অইয়া যাইব।মাছ ধরার ব্যাপার তো, তাই বড় ভুতে লগ্নি অইছে। আমি এখনি তাড়ানোর ব্যবস্থা করতাছি।
তিনি তন্ত্রমন্ত্র অনেক সময় ধরে পড়ে তার গায়ে ফুঁ দিলেন। তারপর তেলপড়া, পানিপড়া, তাবিজ, কবজ দিয়ে বললেন,
ভাবী সাহেবা এসব ভালো কইরা ব্যবহার করবেন। আর তাবিজটা ভালো কইরা হাতে বাইন্দা দিবেন।নইলে ভুত লগ্নি অইয়া যাইব। সালাম ভাবী সাহেবা, গেলাম।ভালো মন্দ জানাইয়েন।
গুনিন চলে গেল,মা সাদিয়া আফরিন ছেলের নাকে মুখে, হাতে পায়ে, সমস্ত শরীরে তেলপড়া,পানিপড়া ভালো করে মালিশ করে দিলেন। তারপর তাবিজটা ভালো করে হাতে বেঁধে দিলেন।তার কিছুক্ষণ পরে সুমন চোখ মেলে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
মা আমি কোথায়?
কোথায় মানে? আমাদের ঘরে। কি হয়েছে তোর?
মায়ের কথাতে সুমনের টনক নড়ল।আস্তে আস্তে তার সব মনে পড়ে গেল। এদিকে সকাল হতে না হতে তার বাড়িঘর লোকজনে ভর্তি। চাচাতো ভাই সোহান কিন্তু সবার আগে এলো।তাকে দেখা মাত্রই সুমন জিজ্ঞেস করলো,
সোহান গতরাতে তুই কোথায় ছিলি? কোথায় আাবার, বাসায় ছিলাম। তোমার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম।কিন্তু তুমি যাওনি। তারপর ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠা মাত্রই তোমার খবর শুনে ছুটে এলাম। কি হয়েছে ভাইয়া তোমার?
সুমন ভাবে, এবার আমি বুঝতে পেরেছি সোহান সেজে কে আমার সঙ্গে অভিনয় করেছে।তাকে চুপ থাকতে দেখে সোহান বলল,
ভাইয়া চুপ করে আছ কেন?সবাই বলাবলি করছে তোমাকে ভুতে পেয়েছে? কথাটা কি সত্যি?
সুমন মাথা নেড়ে সাঁয় দিলো,
হু ভাই ঠিক শুনেছিস।
কি বল ভাইয়া! তো ভুত দেখতে কেমন?
বলছি শুন,এতদিন দাদা-দাদী,নানা-নানীর কাছে যে ভুতের গল্প শুনেছি আাজ তা সত্যে পরিণত হলো।এরা মানুষের সঙ্গে মিশতে বিভিন্ন রুপ ধারণ করে, মানুষের বেশে, ভাই-বোন মা-বাবা, চাচা-চাচী, ইত্যাদি আত্নীয়-স্বজনের রুপ ধারণ করে….।
কখনো অন্যরুপ, গরু ছাগল,মহিষ,বিডাল,হাতি শেয়াল,কুকুর, ইত্যাদির রুপ ধারণ করে মানুষের সঙ্গে মিশে। তারপর কৌশল করে অচেনা পথে নিয়ে ভুতের রুপধারণ করে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করে, এবং কখনো কখনো মেরে ফেলে।আজ আমার অবস্থা ও সেই রকম হয়েছে। সোহান সেজে আমাকে মাছ ধরতে ডেকে নিয়ে গেল। তারপর ঐ চিকন খাল পাড়ে নিয়ে ভুতের রুপ ধারণ করে আমাকে মেরে ফেলার ষডযন্ত্র।অসংখ্য ভুত আমার চারপাশ ঘিরে….।
তারা দেখতে কেমন?
তারা কেমন শুনলে ভয় পেয়ে যাবি? প্লিজ তবুও বল ভাইয়া।
শুন বলছি,কারো কাঁধে চোখ,বিভৎস চেহারা,মুখ দিয়ে আগুন আর আগুন, কারো গায়ে সাদা পশম, ইয়া বড় লম্বা, দেখতে অনেকটা বন মানুষের মতো,আবার কেউ কেউ দেখতে মানুযের কঙ্কালের মতো, চোখ দুটো পেছনে আরও অনেক অনেক….।
তারপর কি হলো ভাইয়া?
কি হলো মানে! এসব ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখার পর কেউ কি স্থির থাকতে পারে। ভয়ে আমার সমস্ত শরীর থত্থর করে কাঁপছে। তবুও বুকে সাহস রেখে আল্লাহ পাকের পবিত্র কালামের কিছু দোয়া, সুর ইখলাস,সুরা নাস,সুরা ফালাক,সুরা ফাতেহা,দোয়া ইউনুস,আয়াতুল কুরছি পাঠ করে আমার গায়ে ফুঁ দিতে দিতে….।
ভাগ্যিস তারা আমার কাছে ঘেষতে পারেনি।কারণ আল্লাহ পাকের কালামের দোয়া পাঠ কখনো বিফলে যায়না। ভুত,পেত,জ্বীন পরী সবাই এই পবিত্র কালামকে ভয় পায়।আর এই সুযোগে আমি দিলাম দৌড়। কখন যে অজ্ঞান হয়ে পড়লাম তার কিছুই আমার মনে নেই।আল্লাহপাকের অশেষ মেহেরবানীতে আমি সেই দিন ভয়ঙ্কর “ভুতের” হাত থেকে বেঁচে গেলাম।আল্লাহ পাকের কাছে লাখ লাখ শোকরিয়া। আমীন।।

চমৎকার লিখেছেন। অনেক সুন্দর লেখা। আমি সবসময় আপনার লেখা পড়ি। আচ্ছা আপনাকে অন্য একটা প্রশ্ন করি ( যদি কিছু মনে না করেন)। এখানে কর্তৃপক্ষকে মেসেজ দিতে হলে কার বরাবর লিখতে হবে? To এর ঘরে কার পদবী বা নাম লিখতে হবে?
ভালো মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ