সংসার
আফছানা খানম অথৈ
বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের বড় ছেলে আশিক রহমান সংসারের হাল ধরল।তার বেশি দূর লেখাপড়া হয়নি।মাত্র দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে।এর পর ফ্যামিলি চালানোর জন্য তাকে টেক্সি চালানোর কাজ নিতে হলো।নিজের রোজগারের টাকায় সংসার ও ছোট দু’ভাই বোনের লেখাপড়া চালাচ্ছে ঠিকমতো।তবুও মা কেন জানি ছেলেকে ভালো চোখে দেখেন না।সৎ ছেলে বলে কথা, তাই একটু বাঁকা চোখে দেখেন।ছেলে কিন্তু ঠিক আপন মায়ের মতো ভক্তি শ্রদ্ধা করে।তার বউ জোবায়দা বেগম ও শ্বাশুড়ীকে ভক্তি শ্রদ্ধা করে।তবুও শ্বাশুড়ী বউয়ের উপর মাঝে মাঝে চড়াও হন…।
আজে-বাজে ভাষা ব্যবহার করেন।তবুও বউ কিছু বলে না।স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে সবকিছু হজম করে নেন।একদিন শ্বাশুড়ি কটাক্ষ করে বলল,
বউ তোমার কী আক্কেল জ্ঞান বলতে কিচ্ছু নেই?
কেনো মা, কী হয়েছে?
কী হয়নি বলো।সেই সকাল থেকে না খেয়ে অছি।সে খেয়াল আছে?
কী করবো মা।আজ দু’দিন হরতালের জন্য আপনার ছেলে টেক্সি বাইতে পারে নাই।তাই বাজার আনতে পারেনি।
তাই বলে না খেয়ে থাকব?
জ্বি না মা।আপনার ছেলে বাজার করতে গেছে।এক্ষণই এসে পড়বে।
বলতে না বলতে আশিক রহমান বাজার করে আনল।বউয়ের হাতে থলেটা দিয়ে চলে গেল কর্মস্থলে।
তারপর বউ রান্না করে সবাইকে খাওয়াল।নিজে না খেয়ে স্বামীর জন্য কিছু খাবার রেখে দিলো।স্বামী খেতে বসে জিজ্ঞেস করলো,
বউ তুমি খেয়েছ?
সত্য বললে স্বামী মনে কষ্ট পাবে।নিজে না খেয়ে তাকে খেতে বলবে।তাই মিথ্যে বলল,
আমি খেয়েছি।আপনি খেয়ে নিন।
এমনি অর্ধাহারে অনাহারে সংসার চালাচ্ছে জোবায়দা বেগম।জোবায়দা বেগম পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে।স্বামী শ্বাশুড়ী সবাইকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে।এত কষ্টের পর ও ননদ-দেবর দু’জনের পড়ার খরচ দিচ্ছে ঠিকমতো।দেবর আসিফ রহমান শহরে ম্যাসে থেকে পড়ালেখা করছে।আর ননদ সুমি গ্রামের কলেজে এইচ এস সিতে পড়ছে।আসিফ রহমানের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা,তাই ভাইয়ের কাছে টাকার জন্য খবর দিয়েছে।আশিক এত টাকা একসঙ্গে কোথায় পাবে।তাই বসে বসে চিন্তা করছে।স্বামীকে চিন্তাযুক্ত দেখে বউ বলল,
আপনার মন খারাপ কেনো?কি হয়েছে?
আসিফের সামনে ফাইনাল পরীক্ষা।এত টাকা এক সঙ্গে কোথায় পাব ভাবছি।
চিন্তা করবেন না।আল্লাহপাক এক ব্যবস্থা করে দেবেন।
তা ঠিক। কিন্তু…।
কোন কিন্তু নেই। আমার কানের বালা জোড়া বিক্রি করে ওর জন্য টাকা পাঠিয়ে দিন।
না বউ আমি তোমার কানের বালা জোড়া বিক্রি করতে পারব না।
না কইরেন নাতো।নিয়ে যান। আমি খুশি হয়ে দিয়েছি।
স্ত্রী অনুরোধ রাখতে স্বামী বালা জোড়া বিক্রি করে ছোট ভাইয়ের জন্য টাকা পাঠিয়ে দিলো।এক সময় আসিফ মাস্টার্স কমপ্লিট করে ভালো একটা চাকরী নিলো।তারপর এক বড় লোকের মেয়ের সঙ্গে রিলেশন করে বিয়ে করলো।মা ও বড় ভাই কাউকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলো না।কাউকে না জানিয়ে একদিন বউকে নিয়ে গ্রামে আসল।গ্রামের পরিবেশ আর শহরের পরিবেশের মধ্যে অনেক তফাৎ। গ্রামের বউ’রা শাড়ি কাপড় পরে,মাথায় ঘোমটা দেয়,বোরকা পরে।আর শহরের বউ’রা সেলোয়ার কামিজ ও স্কীনের ফ্যান্ট শার্ট ও গেঞ্জি পরে।অনুরুপ আসিফের স্ত্রী ও স্কীন’র ফ্যান্ট ও গেঞ্জি পরে গ্রামে এসেছে।গ্রামের লোকজন সবাই তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।আসিফের মা জিজ্ঞেস করলো,
আসিফ পুরুষের বেশে এই মেয়ে কেরে?
মা তোমার বউ।আমার স্ত্রী।
কস কী।ফ্যান্ট পরা মেয়ে কেমনে বউ হয়।তওবা তওবা,কী কলির যুগ আইল।মেয়েরা ফ্যান্ট পরে…।
মা এটা যুগের ফ্যাশন। এমন করে বলো না।ফারা টেনশন করবে।
টেনশন করলে আমার কী।এইজন্য কী তোকে পড়ালেখা শিখাইছি।আমাদেরকে না জানিয়ে তুই এমন একটা মেয়ে বিয়ে করতে পারলি?এই জন্য কী তোকে পেটে ধরেছিলাম?
ফারার রাগ হাইতে উঠে গেল।সে কড়া ভাষায় স্বামীকে বলল,
আফিস এই তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে এলে?যত্তসব নোংরা পরিবেশ ব্যাকডেটেড মহিলা।ফ্যাশন বুঝে না।
ফারা আস্তে বলো।উনি আমার মা।
হোয়াট! উনি তোমার মা।উনারমতো একজন নোংরা মহিলাকে কখনো আমি শ্বাশুড়ি হিসেবে মানতা পারব না।চলো এক্ষণই।
বলতে না বলতে ফারা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।পেছনে পেছনে আসিফ ও গেল।এরপর মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো।মায়ের অতি আদরের পেটের গুনধর ছেলে মাকে ভুলে গেল।আশিক কিন্তু সৎ ছেলে হয়েও মাকে ভুলতে পারলো না।ছোট বোন তন্নীর এক সময় পড়ালেখা শেষ হলো।আশিক বাড়ি বন্ধক দিয়ে বোনকে বিয়ে দিলো।বোনের বিয়ের আমেজ কাটতে না কাটতে আশিক একদিন গুরুতরভাবে এক্সিডেন্ট হলো।টাকার অভাবে তার উন্নত চিকিৎসা হলো না।কোনমতে গ্রামের হাসপাতে চিকিৎসা হলো।তাই সে পঙ্গু হয়ে গেল।ধার দেনা করে কিছুদিন সংসার চালালেও পরবর্তীতে তা অসম্ভব হয়ে উঠল।পাওনাদারেরা সবাই আশিককে চেপে ধরলো।আশিক বাধ্য হয়ে বাড়ি বিক্রি করে দেনা শোধ করলো।তারপর মা আর বউকে নিয়ে শহরে পাড়ি দিলো।কোন রকমে বস্তিতে থাকার জায়গা হলো।দু’দিন ধরে পেটে দানা পানি কিছুই পড়েনি।তাই জোবায়েদা বেগম কাজের সন্ধানে বের হলো।কিছুদূর যাবার পর সামনে পড়লো একটা বহুতলা ভবন।জোবায়েদা বেগম গেটের কিনারে গিয়ে কলিংবেলে টিপ দিলো।ভিতর দিকে বেরিয়ে আসল একভদ্র মহিলা।জোবায়েদা বেগমকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
আপনি কে?কাকে চান?
দীর্ঘ একটা শ্বাস ছেড়ে জোবায়দা বেগম উত্তর দিলো,
আমি এক হতভাগি।ঘরে অসুস্থ স্বামীকে রেখে এসেছি।আজ দু’দিন ধরে পেটে দানাপানি কিছু পড়ে নাই।আমায় একটা কাজ দিবেন?
ঘর মোছা,রান্না-বান্নার কাজ করতে পারবেতো?
জ্বি হ্যাঁ পারবো।
ভদ্র মহিলার দয়া হলো।সে জোবায়দা বেগমকে কাজের বুয়া হিসেবে নিয়োগ দিলো।জোবায়েদা বেগম বুয়ার কাজ করে কোন রকমে সংসার চালাচ্ছে।
এদিকে ছোট ভাই আসিফ বউ নিয়ে রাজার হালে আছে।মা ভাই বোন কারো কোন খবর নিচ্ছে না।তার স্ত্রী মা হতে চলেছে।সে তার খুব টেককেয়ার করে।এখনো সে স্কীনের ফ্যান্ট ও গেঞ্জি পরে মডেল বেশে চলাফেরা করে।তার এক সই পর্দানশীন ও নামাজি।সে একদিন তাকে মডেল বেশে দেখে বলল,
সই তোকে একটা কথা বলতে চাই?
বল কী বলবি?
আগে বল রাগ করবি নাতো?
না করবো না।বল।
প্রেগন্যান্ট অবস্থায় এমন মডেল বেশে চলাফেরা করা উচিৎ না।
কেনো কী হয়েছে?
হয়তো অনেক কিছু।এত বিশদ ব্যাখ্যা দেয়া এই মুহূর্ত সম্ভব নয়।আমি সংক্ষেপে দু’চারটা কথা বলছি।তুই মনোযোগ দিয়ে শুন,
বুজুর্গি লোকেরা বলেন,প্রেগন্যান্ট অবস্থায় মা যা করে,বাচ্চা ও তাই করে।তাই মাকে খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হয়।ভালো কাজ করতে হয়।নামাজ পড়তে হয়,পর্দা করতে হয়। শরীয়ত মোতাবেক পোশাক পরতে হয়।তবে সুসন্তানের মা হওয়া যায়। এর ব্যতিরেকে নয়।
কারণ বেপর্দায় মডেল বেশে চলাফেরা করা নারীদের উপর কখনো আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়না।প্লিজ তুই এখন এসব মডেল পোশাক ছাড়।
ফারা কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে,উপহাস করে বলল,
আমি কখনো মডেল পোশাক পরিবর্তন করবো না।দেখি আমার কী ক্ষতি হয়।
এরফাঁকে কিছুদিন কেটে গেল।ফারা তার স্বামীকে নিয়ে ঘুরতে বের হলো,বাইকে চড়ে।
কিছু বখাটের চোখ পড়তে আজেবাজে কথা বলে,শিষ দেয়।আসিফ শুনেও না শুনার ভান করে এগিয়ে গেল।কিছুদূর যাবার পর একটা ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে বাইক ছিটকে পড়লো।ফারা ও তার স্বামী গুরুতর আহত হয়।লোকজন তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করায়।আসিফের জ্ঞান ফিরে আসলেও ফারার জ্ঞান ফিরে আসেনি।তার মিসক্যারেজ হওয়ার কারণে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। দু’দিন পর তার জ্ঞান ফিরে আসে।জ্ঞান ফেরার পর সে দেখে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে।পাশে মা-বাবা দু’জন বসে আছে।তখনি সে বলল,
ড্যাডি আমি এখানে কেনো?আমার কী হয়েছে?
তুমি বাইক এক্সিডেন্ট করেছ।
ও তাই।আমার বেবি?
তোমার মিসক্যারেজ হয়ে গেছে।
মিসক্যারেজের কথা শুনার পর তার ভিতরে মনুষ্যত্ববোধ জেগে উঠল।সে তার ভুল বুঝতে পারলো।মনে পড়ে গেল বান্ধবী ও শ্বাশুড়ির কথাগুলো।তখনি আলকালচার্ড পোশাক পরিবর্তন করে শরীয়তি পোশাক পরলো।তারপর স্বামীকে বলল,
আসিফ চলো আমরা গ্রামে ফিরে যাব।
কেনো ফারা?তাছাড়া গ্রামের ব্যাকডেটেড মানুষের সাথে তুমি থাকতে পারবেতো?
আসিফ ওরা ব্যাকডেটেড নয়।বরং আমরা খারাপ।যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে আমরা আল্লাহ রাসুলের বিধি বিধান ভুলে গেছি।তাই আজ আমাদের এ ভয়াবহ করুণ অবস্থা।আজ থেকে সঠিক ও সত্য পথে চলব।মা,বড় ভাই,ভাবী সবার সঙ্গে সংসার করবো।
সত্যি বলছ ফারা?
হুম সত্যি।
আসিফ আর দেরী করলো না।বউকে নিয়ে গ্রামে ফিরে এলো।বোরকা পরা ফারাকে দেখে গ্রামের লোকজন বলল,
আসিফ এই মহিলা কে?
আমার স্ত্রী ফারা।
তখনি ঈমাম চাচা বলল,
মা তোমাকে এবার বউয়ের মতো লাগছে।
দোয়া করবেন চাচা যেন সবসময় ভালো পথে থাকতে পারি।
গ্রামের লোকজন এবার ফারাকে দেখে খুশি হলো।আসিফ তার ভাইয়ের খবর জানতে চাইলে ঈমাম চাচা তার করুণ অবস্থার কথা প্রকাশ করলো।সবকথা শুনার পর আসিফের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।সে আর দেরী করলো না।শহরে ফিরে এসে ভাই ভাবীকে খঁজতে শুরু করলো।অনেক খোঁজাখুঁজির পর একদিন বাসায় ফেরার পথে আসিফ দেখল,তার ভাবী রাস্তার পাশে বেয়ে হেঁটে যাচ্ছে।তখনি গাড়ি থামিয়ে সে ডাক দেয়,
ভাবী দাঁড়াও?
ভাবী থমকে দাঁড়াল।আসিফ এগিয়ে এসে বলল,
ভাবী আমি আসিফ।মা বড় ভাই কোথায়?
তা শুনে তুমি কী করবে?
আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবো।বলো উনারা কোথায়?
এসো আমার সঙ্গে।
ভাবীকে নিয় আসিফ ছুটে আসল তার মা বড় ভাই’র কাছে।নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে নিলো।তারপর সবাইকে বাসায় নিয়ে আসল।ফারা শ্বাশুড়ির পা চেপে ধরে বলল,
মা আমি বিরাট বড় ভুল করেছি।আমায় ক্ষমা করুণ।
মা তোমার পরিবর্তন দেখে আমি খুব খুশি।আল্লাহপাক তোমাকে হেদায়েত দান করুক।
মা দোয়া করবেন, আমি যেন আর ভুল পথে না যায়।আজ থেকে আমরা সবাই এক সঙ্গে “সংসার” করবো।কেউ কাউকে ভুল বুঝবো না।আমিন।।
সত্যি তো?
জ্বি হ্যাঁ মা সত্যি সত্যি সত্যি।
ঃসমাপ্তঃ
