আরো ভালোভাবে জানতে একজন জৈন ধর্মাবলম্বী ব্যক্তির মুখেই শুনুন(ভিডিওটি নেয়া হয়েছেন The Muslim Lantern চ্যানেল থেকে)-
বাংলাদেশে জৈন ধর্মের খুব একটা প্রসার দেখা যায় না, তবে ভারতে এই ধর্মের অনেক অনুসারী রয়েছে। এটি বৌদ্ধ ধর্মের সমসাময়িক একটি ধর্মবিশ্বাস। সংস্কৃত শব্দ ‘জিন’ থেকে জৈন শব্দটির উৎপত্তি যার অর্থ জয় করা।
মানুষের আকাঙ্ক্ষা, আসক্তি, লোভ, ক্রোধ, অহংকার এগুলোকে যারা জয় করতে পারে তাদেরকে বলা হয় জিন এবং তাদের আচরিত ধর্মমতকে বলা হয় জৈন ধর্ম। ভারতে প্রায় ১ কোটির মত জৈন ধর্মের অনুসারি রয়েছে যারা এই ধর্ম পালন করে। তাছাড়া ইউরোপ, আমেরিকায় অনেক প্রবাসী এই ধর্মমত পালন করে।
মৌলিক শিক্ষা এবং বিশ্বাস
চব্বিশজন তীর্থঙ্কর এই মতবাদ প্রচার করেন। পার্শ্বনাথ এবং মহাবীরের শিক্ষা থেকে এই ধর্মমতের বিকাশ ঘটেছে, তাই ধরে নেয়া হয় এই চব্বিশজন তীর্থঙ্কর ও মহাবীর এই ধর্মের প্রবর্তন ও প্রচারক ও প্রতিষ্ঠাতা। এই ধর্মের মৌলিক শিক্ষাগুলো হচ্ছে-
- অহিংসা
- দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থাকা অর্থাৎ, অনেক মানুষের অনেক ধরণের মত থাকা- এটাকে বলা হয় অনেকান্তবাদ
- অপরিগ্রহ- কারো প্রতি পজেসিভ না হওয়া, নিজের প্রয়োজনের চেয়ে বেশী কোন কিছু না নেওয়া
- চুরি না করা
- ব্রহ্মচার্য পালন করা
২ নম্বর বিষয়টি বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে। এই ধর্মে মনে করা হয় মানুষের যেকোন বিষয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকে, আলোচনার মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌছানো সম্ভব। একজনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে খন্ডিত সত্যে পৌছানো যায়, সঠিক ধারণা পাওয়া যায় না।
আমরা সবাই কানার হাতি দেখার ব্যাপারটা জানি। অনেকগুলো অন্ধ লোককে হাতি দেখতে দিলে তারা বলবে হাতি কুলোর মত, হাতি দেয়ালের মত, হাতি কাচির মত ইত্যাদি। হাতি আসলে সবকিছুর মত, আমরা বাস্তব জীবনে এই সাধারণ শিক্ষাটাও প্রয়োগ করি না।
জৈন ধর্মগ্রন্থ
জৈনদের প্রধান ধর্মগ্রন্থের নাম ‘আগাম’ বা, ‘আগামা’। এটি আসলে একটি গ্রন্থ নয়, একাধিক গ্রন্থের সমষ্টি। অর্ধ মাগধি প্রাকৃত ভাষায় লেখা এই বইয়ে তীর্থঙ্কর মহাবীরের উপদেশ লেখা আছে। অনেক সময় এটিকে বলা হয় আগাম সূত্র।
এই গ্রন্থগুলো ইসলাম ধর্মের কুরআনের মতো পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধানের কোন বই নয়, এগুলো জৈন ধর্মের দর্শনের বই। নিচে কয়েকটি বইয়ের নাম দেয়া হলো-
- কল্পসূত্র
- ততবর্তসূত্র
- উমাস্বতি
- সময়সার
- রত্নকারণ্ড ইত্যাদি
শ্বেতাম্বর জৈনরা মনে করে এগুলোই মূল বই, কিন্তু দিগম্বর জৈনরা মনে করে মূল গ্রন্থ হারিয়ে গেছে। মহাবীরের একটি উক্তি আপনাদের সাথে শেয়ার করি-
Do not injure, abuse, oppress, enslave, insult, torment, torture, or kill any creature or living being
বৌদ্ধ ধর্মের সাথে এর সাদৃশ্য রয়েছে। এই ধর্মে পঞ্চমহাব্রতের কথা বলা হয়েছে-
- অহিংসা
- সত্য
- অস্তেয়(চুরি না করা)
- ব্রহ্মচর্য(যৌনাচার থেকে দূরে থাকা)
- অপরিগ্রহ (জাগতিক বিষয়ে অনাসক্তি)
পড়ুন- বৌদ্ধ ধর্ম ও জৈন ধর্মের পার্থক্য
ঈশ্বরের ধারণা
বৌদ্ধ দর্শন যেমন ঈশ্বররের ধারণা গ্রহণ করে না, এটিও তেমন প্রচলিত ঈশ্বরের ধারণা গ্রহণ করে না। প্রত্যেক আত্মার মাঝেই মোক্ষলাভ(হিন্দু ধর্মেও এই ধারণাটা আছে) এবং ঈশ্বর হওয়ার উপযুক্ত উপাদান আছে। এমন কোন স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না যিনি সব কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং ধ্বংস করবেন। সবাই একইসাথে সৃষ্টির অংশ এবং স্রষ্টা।
রত্নত্রয়ঃ ত্রিশরণ মন্ত্র না থাকলেও এই ধর্মে রত্নত্রয় রয়েছে-
- সম্যক দর্শন
- সম্যক জ্ঞান
- সম্যক চরিত্র
নয়টি মৌলিক আদর্শ এই মতবাদে বিশ্বাসী মানুষেরা অনুশীলন করে–
- জীব
- অজীব(জড়)
- অশ্রব(জীব ও অজীবের সংযোগ)
- বন্ধ(কর্ম জীববে সত্য জানা থেকে বিরত রাখে)
- সংবর(কর্মকে স্তব্ধ করা সম্ভব)
- নির্জরা(তপস্যার মাধ্যমে কর্মকে পরিহার করা)
- মোক্ষ(মুক্ত আত্মা যা কর্মকে পরিহার করে পবিত্রতা লাভ করেছে)
- পাপ
- পূণ্য
- স্যাদবাদ
সংস্কৃত ‘স্যাদ’ শব্দের অর্থ ‘হয়তো’। এটিকে অনেকান্তবাদ থেকে উদ্ভুত ধারণা বলা চলে-
- স্যাদ- অস্তি(আছে)
- স্যাদ -নাস্তি(নেই)
- স্যাদ অস্তি-নাস্তি(আছে এবং নেই)
- স্যাদ অস্তি অবক্তব্য(আছে, বর্ণনার অতীত)
- স্যাদ নাস্তি অবক্তব্য(নেই, বর্ণনার অতীত)
- স্যাদ অস্তি-নাস্তি অবক্তব্য(আছে, নেই এবং বর্ণনার অতীত)
- স্যাদ অবক্তব্য(বর্ণনার অতীত)
উপরে যে স্যাদবাদ দেখানো হল এটি সত্যের জটিল ও বহুমুখী প্রকাশ, এর অস্বীকার করা গোড়ামীজনিত বিপথগামীতা বলে এই ধর্মে ধরে নেয়া হয়। মৌর্য সম্রাজ্যে এই ধর্ম কিছুটা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে।
আরো পড়ুন-
তথ্যসূত্রঃ
জৈন ধর্ম- বাংলাপিডিয়া
Jainism- Philosophy of Religion