বাংলা নববর্ষ প্রচলন করেন কে? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা এই লেখার মাধ্যমে খোজার চেষ্টা করব। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে বছরের প্রথম দিনকে বলা হয় পহেলা বৈশাখ।
বছরের ১২ মাস হচ্ছে- বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য, আষাড়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ন, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র। এর শুরুর ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তির ব্যাপারটা অনেকেরই অজানা।আজকে সেটা নিয়ে কিছু লিখতে যাচ্ছি।
বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখের প্রবর্তক কে?
দুটি প্রচলিত মত আছে বাংলা সাল গণণা এবং পহেলা বৈশাখের ব্যাপারে। নিশ্চিত করে আমি বলতে পারছি না, কে শুরু করেছিলেন। তবে, বাংলা সাল এবং মাসের নামগুলো অনেক আগে থেকেই ছিলো, সম্রাট আকবরের নির্দেশে সূর্য্যভিত্তিক আধুনিকায়ন করেছিলেন ফতেউল্লাহ শিরাজী।
প্রচলিত মত ১ঃ পহেলা বৈশাখের প্রবর্তক বিক্রম
বিক্রমী বর্ষপঞ্জি নামে একটি ক্যালেন্ডার প্রচলিত রয়েছে যেটাকে সম্ভবত বিভিন্ন হিন্দু আচার-অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহার করা হয়। বাংলার বাইরে অন্যান্য অঞ্চলে এই সাল গণণা খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দে শুরু হলেও বাংলায় এটি শুরু হয় রাজা শশাঙ্কের সময়ে অর্থাৎ, ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে।
আকবরের শাসনামলের অনেক আগে থেকেই দুটি শিব মন্দিরে বঙ্গাব্দ শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরে সম্রাট আকবর তার শাসনামলে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে রাজজ্যোতিষী ফতেউল্লাহ শিরাজির সহায়তায় এটি পরিবর্তন করে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য আনেন।
প্রচলিত মত ২ঃ বাংলা নববর্ষ প্রচলন করেন সম্রাট আকবর
বাংলা সন বা, বাংলা সাল নামে যেহেতু ডাকা হয় সন ও সাল শব্দ দুটি যথাক্রমে আরবি এবং ফারসি শব্দ। সুতরাং এর শুরুটা মোঘলদের কেউ করেছিলেন।
তারিখ- ই- ইলাহি তে সূর্য্যভিত্তিক ক্যালেন্ডারে এর প্রমাণ মেলে। পরবর্তীতে শকাব্দে থাকা নামগুলোর নামের সাথে মিল রেখে মাসের নামগুলো করা হয়।
বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস
আমি প্রচলিত দুটি মতের মাঝে পার্থক্য দেখছি না। মুসলিম বা, হিন্দু হওয়ার কারণে এবং একইসাথে হীনমন্যতায় ভোগার কারণে সম্রাট আকবর কিংবা, রাজা শশাঙ্ককে বাংলা সালের কৃতিত্ব দেয়াটা অযৌক্তিক।
শকাব্দ অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল, বারো মাস ছিল- কিন্তু সৌর বর্ষপঞ্জী সেটাকে বলা যায় না। বিক্রমী বর্ষপঞ্জী তৈরির কৃতিত্ব অবশ্যই বিক্রমাদিত্যের।
যেহেতু সম্রাট আকবরের প্রজারা মাসের সাথে মিল রেখে খাজনা দিতে পারছিলো না(ফসল ঠিক সময়ে পাওয়া যেত না), তাই তিনি ফতেউল্লাহ শিরাজিকে নির্দেশ দেন সমস্যা সমাধানের।
ফল হিসেবে অনেকটা আজকের বাংলা ক্যালেন্ডারের মত একটি ক্যালেন্ডার আমরা পেয়েছি। এর কৃতিত্ব আকবরের আছে বটে, মূল কাজটি করেছিলেন ফতেউল্লাহ শিরাজি।
বাংলা ক্যালেন্ডারের সংশোধনঃ
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা একাডেমী কর্তৃক বাংলা সালের কিছু সমস্যা দূর করার দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। সমস্যাটা ছিলো লিপইয়ার নিয়ে, বাংলা সালে লিপইয়ার নেই – ৩৬৫ দিন আছে।
১৯৬৬ সালে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৫৪ সালে মেঘনাদ সাহার দেয়া (ভারতের শকাব্দ সংশোধন বিষয়ক) প্রস্তাব অনুসরণ করে বাংলা সালের প্রথম মাসগুলো ৩১ দিনে এবং শেষের দিকের মাসগুলো ৩০ দিনে করার প্রস্তাব দেন।
মেঘনাদ সাহার প্রস্তাবে ছিলো লিপইয়ারে চৈত্র মাস ৩১ দিনে হবে, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর প্রস্তাবে ফাল্গুন মাস ৩১ দিনে হবে- মূল ধারণা একই। তখনও সম্ভবত বাংলা মাস ৩০,৩১,৩২ দিনে ছিলো। ১৯৯৫ সালে বর্তমান রূপটি দেয়া হয়।
‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুসারে ২০১৫ সালে আরো একবার ক্যালেন্ডার সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেখানে সভাপতি হিসেবে ছিলেন শামসুজ্জামান খান, এছাড়া অজয় রায়, জামিল চৌধুরি প্রমুখ এই কমিটিতে ছিলেন। পরে আর আমরা সংস্কার হতে দেখিনি।
ভারতে এবং বাংলাদেশে নববর্ষ কেন দুই দিনে?
বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৪ এপ্রিল নববর্ষ পালিত হয়, কিন্ত ভারতে কোনবছর ১৪ এপ্রিল, আবার কোনবছর ১৫ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ পালিত হয়।
এর কারণ ১৯৬৬ সালে বাংলা একাডেমী যে সংস্কার করেছিলো সেটা ভারতীয় বাংলা আকাদেমী করেনি। ১৯৯৫ সালের সংস্কারে ফাল্গুন মাসের সাথে লিপইয়ারে ১ দিন যোগ করায় এখন ২১ শে ফেব্রুয়ারি ৮ ফাল্গুন হয় না, হয় ৯ ফাল্গুন।
ধর্মীয়ভাবে বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচলিত বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসরণ করতে পারে না। সেক্ষেত্রে চন্দ্র-সূর্য্যের সমস্যা রয়েছে। তাই, দুইটি ক্যালেন্ডারই অনুসরণ করতে হয়।
বাংলা নববর্ষের সাথে ধর্মীয় যোগসূত্র কতটুকু আছে, কতটুকু নেই সেটা নিয়ে বিশ্লেষণ এখানে অন্তর্ভূক্ত করিনি। চৈত্রসংক্রান্তি বা, চড়ক পুজো এগুলোর আলোচনাও এখানে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে।
বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ সহ অন্যান্য বাংলাভাষীদের মধ্যে একই দিনে নববর্ষ পালনের রীতি থাকলে আমি খুশী হতাম।
আর, পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা এবং পান্তা ইলিশ খাওয়ার সাথে ধর্মকে না মেশালেই মনে হয় ভালো হয়(চৈত্রসংক্রান্তি কিংবা, শিবের পূজা আর পহেলা বৈশাখ আলাদাভাবে দেখা ও পালন করা উচিত)।
বাংলা নববর্ষ প্রতিবেদন বা, বাংলা নববর্ষ অনুচ্ছেদ লেখার ক্ষেত্রে এই লেখাটি আপনার কাজে লাগতে পারে।
পহেলা বৈশাখ সম্পর্কে ১০টি বাক্য
১. পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির একটি অন্যতম প্রধান উৎসব এবং বাংলা বছরের প্রথম দিন।
২. পহেলা বৈশাখ সাধারণত ১৪ই এপ্রিল বাংলাদেশে এবং ১৫ই এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গে উদযাপিত হয়।
৩. ১৪ এপ্রিল সকালে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাংলা বছরের প্রথম দিন শুরু হয়।
৪. নারীরা সাদা-পলকা লাল শাড়ি এবং পুরুষেরা এই দিনে পাঞ্জাবি পরে।
৫. ১লা বৈশাখের প্রধান আকর্ষণ হল হালখাতা, যেখানে ব্যবসায়ীরা পুরনো হিসাবের খাতা শেষ করে নতুন খাতা খোলে।
৬. বটমূলে গান গাওয়ার পাশাপাশি পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন পিঠা, পায়েস এবং পান্তা ইলিশের মতো খাবার উপভোগ করা হয়।
৭. এই দিনে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যেখানে নৃত্য, গান, এবং নাটক পরিবেশন করা হয়।
৮. ছোট বাচ্চারা এই দিনে গ্রামীণ মেলায় বিভিন্ন ধরনের খেলনা এবং খাবার কিনে আনন্দ উপভোগ করে।
৯. অনেক জায়গায় ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে নতুন করে সাজানো হয় এবং বাড়ির দরজায় নতুন আলপনা আঁকা হয়।
১০. এটি বাঙালি জাতির ঐক্য এবং সংস্কৃতির প্রতীক, যা সকল বয়স ও ধর্মের মানুষকে একত্রিত করে ।
আরো পড়ুন-
- মৌলিক গণতন্ত্র অধ্যাদেশ কে জারি করেন ?
- পলাশ ফুলের ছবি
- ত্রিপুরা গান
- চর্যাপদ কথন
- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান
তথ্যসূত্রঃ
- যে কারণে দুই বাংলায় দুইদিনে পহেলা বৈশাখ(dw.com)
- বঙ্গাব্দ (উইকিপিডিয়া)
- বাংলা বর্ষপঞ্জি (blog.bdnews24.com)
- পহেলা বৈশাখ(উইকিপিডিয়া)
- আরেক দফা সংস্কার হতে যাচ্ছে বাংলা বর্ষপঞ্জি (প্রথম আলো)
Great
খুবই চমৎকার তথ্যবহুল। অনেক ভালো লেগেছে
উপকারী