(১৭)
কুলাউড়াতে আসার পনের দিন পর বিকেল বেলা বসে আছি পুকুরের পশ্চিম পাড়ে, একটা তাল গাছের নিচে। শরণ পুকুর ঘাটে বসতে এসে আমাকে দেখে ওখানে এসে সেও বসে।
কেমন আছ অধরা? কবে আসলে?
দু সপ্তাহ হয়ে গেছে!
দু সপ্তাহ! ওহ এই দু সপ্তাহ আমি অফিসের কাজে এত ব্যস্ত ছিলাম একদম সময় পাইনি তাই তোমার সাথে ও দেখা হয় নি। তারপর কি খবর ছুটি কেমন কাটালে?
অনেক আনন্দে, ভাইয়ার বিয়ে, বান্ধবীদের সাথে আড্ডা ভীষণ ভালো কেটেছে। কিন্তু এখানে এসে আবার মন খারাপ হয়ে যায়।
কেন?
তুমাকে খুঁজতে খুঁজতে পাইনি!
ওহ্ তাই। আচ্ছা আমি আবার তুমার মন ভালো
করে দেব।
কিভাবে?
কাল আমার অফিস ছুটি চল আমরা শ্রীমঙ্গল থেকে বেড়িয়ে আসি।
শ্রীমঙ্গল! দারুণ হবে। কিন্তু খালামনি আমাকে যেতে দেবেন?
আমি বললে অবশ্যই দেবেন।
টিক আছে আমিও বলব তুমিও কথা বলে দেখ।
বলব সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে এখন চলো উঠা যাক।
শরণ পুকুরে অজু করে পাশের মসজিদের দিকে চলে যায় আমি ঘরে চলে আসি।
বৃহস্পতিবার। শরণের অফিস ছুটি। গতরাতে রাহি শরণ আমি তিনজনে মিলে খালাকে রাজি করিয়ে নেই। খুব ভোরে নাস্তা করে বেরিয়ে পড়ি খালুর গাড়ি নিয়ে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে। আঁকা বাঁকা পথ ধরে পাহাড়ী ডালু বেয়ে নৈসর্গীক সৌন্দর্য উপভোগ করে গাড়ি নিয়ে ছুটে চলি গন্তব্যের দিকে। রাস্তার পাশ দিয়ে উঁচু উঁচু পাহাড় জড়িয়ে চা বাগান খুবই মনোমুগ্ধকর। তাকালে চোখ ফিরাতে ইচ্ছে হয় না। অবশেষে গাড়ি এসে থামল একটি ছোট্ট বাংলো বাড়িতে। নিরিবিলি ও মনোরম পরিবেশ। পাশেই একটা উন্নতমানের রেষ্টুরেন্ট আছে । সবকিছু পছন্দ মত হয়েছে কারণ খালু জানতেন এ রকম জায়গা আমাদের উপযুক্ত তাই তিনি আগে থেকেই এই বাংলোতে আমাদের জন্য বুকিং দিয়ে রেখেছিলেন। এখন আমরা ফ্রেশ হয়ে রেস্টুরেন্টে হেভি নাস্তা করে বের হয়ে পড়ি বাংলোর ধারে কাছের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করার জন্য। ছোট ছোট কয়েকটা চা বাগানে ঘুরে বেড়াই, চা বাগানের শ্রমিকদের সাথে কথা বলি, তাদের পরিশ্রমের কথা শুনি, ফাঁকে ফাঁকে তাদের জীবনের ছোট ছোট কথা গুলিও শুনে নেই। চার পাঁচজন মহিলার কাছে জানতে পারি তাদের স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়ের জন্য স্কুলের জামা প্রয়োজন। আমরা ফিরে আসি বাংলোতে। এসে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে লাঞ্চ (Lunch) করে পনেরো বিশ মিনিট রেষ্ট করে নেই। তারপর আবার বের হয়ে পড়ি চোখ ও আত্মার প্রশান্তির উদ্দেশ্যে। চিড়িয়াখানা, পার্ক, মন্দির আর বিশাল বিশাল এরিয়া জুড়ে চা বাগান তো আছেই। দেখার কোন শেষ নেই। পরের দিন এই এরিয়ার সবচেয়ে বড় যে বাগান ওখানে বেড়াতে যাই। খুব মজা করে তিনজন মিলে কথা বলছি আর চারপাশ ঘুরে বেড়াচ্ছি। তখনই ঘটল অঘটন। কখন যে আমি অন্য একটা পথ ধরে হাঁটতে শুরু করি বুঝতেই পারিনি। যত সামনে যাই ভালো লাগে শুধুই ভালোলাগে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে হয় না প্রকৃতির এ সৌন্দর্য দেখে । হাঁটতে হাঁটতে চা বাগান থেকে ত্রিমুখী রাস্তায় এসে নামি। কিছু দূর থেকে শুনতে পাই কে যেন গান গাইছে
“সারাদিন তুমায় ভেবে হল না আমার কোন কাজ
হল না তুমাকে পাওয়া”।
একটা পথ ধরে কিছু দূর এগিয়ে যাই দেখি অদূরে রাস্তার পাশে গাছের ছায়ায় বসে একটা ছেলে গান গাইছে। আরও এগিয়ে গিয়ে একটু দূরত্বে বসে পড়ে শুনতে থাকি
“দিন যে বৃথাই গেল আজ,
সারাদিন গাছের ছায়ায় উদাসী দুপুর কেটেছে,
যা শুনে ভোবছি এসেছ সে শুধু পাতারই আওয়াজ” গান শেষ করে ছেলেটা উঠে দাঁড়ায় পিছন ফিরে আমায় দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে! আমিও কি বলব ভেবে পাই না। তখনি ছেলেটা বলল- আপনি কে? বললাম-আমি অধরা।
কোথা থেকে এসেছেন?
আমি সঞ্চয়পুর থেকে এসেছি। এখানে আমরা তিনজন বেড়াতে এসেছি।
ওই আচ্ছা তা ওরা দুজন কোথায়?
ওরা কোথায়, ওহ্ আল্লাহ তখনি মনে পড়ে ওদের থেকে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। আমি ভীত হয়ে পড়ি। বললাম- ওরা এখন কোথায় আমি জানি না, তবে তাদের সাথেই ছিলাম, আমি তাদের থেকে আলাদা হয়ে কবে যে এখানে এসে পড়েছি বুঝতে পারিনি।
এখন কি করবেন?
যা করার পরে করবো এখন একটু বসে আপনার সাথে গল্প করি।
ঠিক আছেন বসেন।
বসে পড়ে জিঞ্জেস করি-এত সুন্দর করে গান করেন কিভাবে?
গান গাইতে গাইতে অভ্যাস হয়ে গেছে।
আপনি কি কোথাও গান শিখেছেন?
না, ছোট বেলা থেকে গান শুনতে আমার ভালো লাগে। বড় হয়ে একা একা গান গাইতাম। তাই মন খারাপ হলে মাঝে মাঝে এখানে এসে বসে গান গাই।
যদি কিছু মনে না করেন একটা প্রশ্ন করতে পারি?
আমি জানি কি প্রশ্ন করবেন “মন খারাপ হয় কেন এইতো?
বললাম-ঠিক তাই, জানতে ইচ্ছা হচ্ছে!
লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলা শুরু করে ছেলেটা- আমার বাবা একজন ফরেষ্ট অফিসার। চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জেলায় আমি বাবা মায়ের সাথে থেকেছি। গত দশ বছর ধরেই এখানে আছি আমরা। আমাদের বাসার পাশে আরেকটা বাসা আছে। ওরা স্থায়ী তাদের জন্মস্থানই এটা।
ওই বাসার একটা মেয়েকে আমার ভালো লাগত। কেমন যেন ছিল। সহজভাবে হেসে হেসে কথা বলতো। সিদেসাদা টাইপের। আমি তখন নবম শ্রেণীতে পড়তাম সে ছিল সপ্তম শ্রেণীতে। একসময় ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ওর বাবা আমেরিকায় থাকেন। গত এক বছর হল ওরা সবাই আমেরিকায় পাড়ি জমায়। আমার দাদা মারা যাওয়ায় আমরা গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম। তাই ওরা চলে যাওয়ার সময় ওর সাথে কথা হয়নি আমার। এখানে বসে মাঝে মাঝে আমরা গল্প করতাম। তাই ওর কথা মনে পড়ে যখন খুব খারাপ লাগে, এখানে এসে বসি পুরাতন স্মৃতি হাতড়ে বেড়াই আর তার জন্য অপেক্ষা করি। আগামী বছর বাবার বদলি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এখান থেকে চলে গেলে আমার অবস্থা কি হবে ভাবতে পারছিনা..!
ছেলেটির চোখ দিয়ে অবিরাম পানি গড়িয়ে পড়ছে। ওর কথা শুনতে শুনতে আমি বুবা হয়ে যাচ্ছি। ওর কি দশা হবে আমার মত। খুবই অস্বস্থি ( (abnormal) ফিল করছি। কি বলবো না বলবো ভেবে পাচ্ছি না। তবুও নিজেকে শক্ত করে বললাম- পুরাতন কথা মনে করিয়ে দিয়ে আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি আমায় মাফ করবেন।
ছেলেটি এবার চোখ মুছে নিয়ে বলল- না ঠিক আছে। বলতে পেরেছি বলে ভালো লাগছে।
বললাম- আপনার কথা আমার অনেকদিন মনে থাকবে।
আপনার কথাও। চলুন আপনাকে বাংলোতে পৌঁছে দিয়ে আসি সন্ধ্যা হয়ে আসছে!
না ঠিক আছে আমি একা যেতে পারব।
সময় হলে আমাদের বাড়ি বেড়াতে আসবেন। সামনেই আমাদের বাসা।
আচ্ছা সময় পেলে আসব বলেই ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যে রাস্তায় গেছিলাম ওই রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করি…..!
এতক্ষণে শরণ রাহি আমায় পাগলের মত খুঁজতে খুঁজতে এই রাস্তায় এসে নামে। দূরে আমায় দেখে দৌড়ে কাছে এসে একটার পর একটা প্রশ্ন তীরের মত ছুঁড়ে দেয়-কোথায় ছিলে এতক্ষণ? আমাদের না বলে এভাবে গেলে কেন? কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে?
আমি কথা বলতে পারছিনা। এখনো ওই ছেলেটার কথার রেশ কাটেনি।
শরণ বলল- অধরা কথা বলছনা কেন? তুমি ঠিক আছ তো? তুমার কিছু হয়নি তো?
এবার নিরবতা ভেঙ্গে বললাম-I’m sorry। আমি বুঝতে পারিনি কিভাবে যে তুমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। তবে আমি ঠিক আছি, ভালো আছি। রাহি বলে – Thanks Allah চলো ভাইয়া আজই আমরা বাসায় ফিরে যাই।
রাহি বললাম তো আমার ভূল হয়ে গেছে আর এমন হবে না।
শরণ বলল-ঠিক আছে চল এখন বাংলোয় ফিরে যাই।
তিনজন নিরব পাশাপাশি হাটতে শুরু করি….
দর্শনীয় স্থান ঘুরে ঘুরে কবে যে দুই দিন পার গেছে বুঝতেই পারিনি। আজ শনিবার। বিকেলের দিকে চা বাগানের শ্রমিকদের গাঁয়ে বেড়াতে যাই। উঁচু নিচু ছোট ছোট ডিবি কোথাও সমতল ভূমি আবার কোথাও পাশ দিয়ে ছোট খাল বয়ে গেছে। এলোমেলো ভাবে ছড়ানো তাদের ঘর। বেশির ভাগ ঘর মাঠি ও বাঁশের বেড়ার তৈরি। চারপাশ বেশ পরিস্কার ও পরিচ্ছন্ন। তাদের মাঝে গারো, সাঁওতাল ও কিছু সংখ্যক ডুম উপজাতি বাস করে। ভালো লাগে কিছু সময় তাদের সাথে কাটাই। তাদের প্রচলিত খাবার দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করে।
কথা বলে জানতে পারি এখানে অনেক শিশু স্কুলে যায়। পড়াশুনায় তারা বেশ আগ্রহী। জেনেছিলাম তাদের অনেকের স্কুল ড্রেছ প্রয়োজন, তাই প্রথমদিন তাদের স্থানীয় টেইলরের কাছে গিয়ে কাপড় কিনা থেকে আর্জেন্ট সেলাই করা পর্যন্ত অর্ডার করে টাকা দিয়ে এসেছিলাম। আজ এগুলো তাদের জন্য নিয়ে এসেছি। শরণ- রাহি এগুলো বিতরণ করে তাদের মাঝে। নতুন জামা পেয়ে তারা খুব খুশি। এই কচি কচি ছেলে মেয়ের ফুলের মত নিষ্পাপ হাসি উপহারকে পুঁজি করে আমরা ফিরে আসি বাংলোতে এবং সন্ধ্যার দিকে বাংলোর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠি বাসার উদ্দেশ্যে!

ভালো লিখেছেন কবি