বিড়ালের কান্না

ছোট গল্প- বিড়ালের কান্না

2

বিড়ালের কান্না

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে

 

হোটেলে দুজন আমেরিকান দম্পতি এলেন। এখানে এসে তারা পরিচিত কাউকে দেখতে পেলো না ।দুই তলায় তাদের  সমুদ্র মুখী কক্ষ থেকে বাগান আর যুদ্ধের স্মৃতি স্তম্ভটির দেখা মিলে। বড় বড় পামগাছের বাগানটিতে বসার জায়গা গুলো সবুজ রঙে রাঙানো।

সুন্দর আবহাওয়ায় চিত্রশিল্পী রা তাদের ছবি আঁকার সরঞ্জামাদি নিয়ে ভিড় জমান এখানে। পাম গাছ বেষ্টিত পথ,বাগানের সামনে রঙিন হোটেল আর বিশাল সমুদ্রের মায়া শিল্পীদের মুগ্ধতার কারণ।

ইতালিয়ানরা ব্রোঞ্জের তৈরি আর বৃষ্টি তে ঝলমল করা যুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ দেখার জন্য দূর দুরান্ত থেকে এখানে ছুটে আসে।বৃষ্টি হচ্ছে আর পাম গাছ থেকে টপ টপ করে পানি ঝড়ছে।নুড়িপাথরের রাস্তায় ছোট ছোট জলাশয় তৈরি হচ্ছে।বৃষ্টির মধ্যে সমুদ্রতট এর দীর্ঘ রেখা বরাবর সমুদ্র এসে ভেঙে পড়ছে এবং আবার ফিরে যাচ্ছে।স্মৃতি স্তম্ভের পাশের চত্বর থেকে গাড়ি গুলো ও চলে যাচ্ছে।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে একটি বিড়াল দেখতে পেলেন আমেরিকান বেগমসাহেবা। বিড়ালটি আঁটো সাটো হয়ে টেবিলের নিচে শুয়ে আছে আর ভিজে যাওয়া থেকে রক্ষা পেতে প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে।

সে বললো, ‘আমি বিড়ালটি আনতে নিচে যাচ্ছি।

বিছানা থেকে তার স্বামী বললেন,’আমি কাজটি করে দিতে পারি।’

‘না আমি ই আনতে যাচ্ছি।বেচারা বিড়ালটি নিজেকে শুকনো রাখার খুব চেষ্টা করছে

তার স্বামী বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে পায়ের নিচে বালিশ রেখে বই পড়ায় মগ্ন ছিলেন

আর তার স্ত্রী কে বললেন,’ভিজে যেয়োনা আবার।’

বেগম সাহেবা  নিচে নেমে গেলেন আর হোটেল মালিক তাকে অভিবাদন জানালেন।তার ডেস্ক টি ছিল অফিসের শেষ প্রান্তে।তিনি দেখতে লম্বা এবং বয়স্ক ছিলেন।

বেগম সাহেবা বললেন,’বৃষ্টি হচ্ছে’।তার কাছে হোটেল মালিক কে বেশ ভালো লাগে।

হোটেল মালিক বললেন, ‘হ্যা মহাশয়া অনেক খারাপ আবহাওয়া।’

ভদ্রলোক ডেস্কের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন,রুমে হাল্কা আলো।বেগম সাহেবা তাকে পছন্দ করেন।তার গুরুত্ব সহকারে যে কোনো অভিযোগ গ্রহন করার বিষয়টিও বেগম সাহেবার খুব পছন্দ।ভদ্রলোকের কাজের প্রতি আন্তরিকতার বিষয়টিও তার কাছে বেশ ভালো লাগে।তার আরো ভালো লাগে তাকে সেবা দানের ধরন ও তার হোটেল মালিক হওয়ার অনুভূতি টিও।তার পরিণতবয়স্ক অবয়ব আর প্রশস্ত হাত এর প্রতি বেগমসাহেবার ভালো লাগা তৈরী হয়।

তার প্রতি ভালো লাগা ধরে রেখেই সে দরজা খুলে বাইরে তাকালো।অঝোর ধারায় বৃষ্টি পরছে।রাবারের ক্যাপ পরা একজন ক্যাফের চত্বর পাড় হচ্ছিলেন।বিড়ালটি ডান দিক টার আশেপাশেই কোথাও হবে।সম্ভবত বিড়ালটি ছাদের নিচ দিয়ে সোজা চলে গিয়েছে।দরজার সামনে পা রাখতেই তার পিছনে ছাতা মেলে ধরা হলো।তাদের কক্ষ দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা সেবিকার ই কাজ এটি।

ইতালিয়ান ভাষায় মহিলাটি বললো’আপনি অবশ্যই ভিজবেন না’।নিশ্চই হোটেল মালিক তাকে পাঠিয়েছেন।

বেগম সাহেবা ছাতা সহ মহিলাটিকে নিয়ে নুড়ি পাথরের পথে  হেঁটে এলেন তাদের কক্ষের জানালা পর্যন্ত। বৃষ্টিতে ভেজা উজ্জ্বল সবুজ রঙের টেবিল টি পরে আছে এখানে কিন্তু বিড়ালটি আর নেই।সে সাথে সাথেই ভেঙে পড়লেন।হোটেল সেবিকা তার দিকে তাকালেন।

 ‘কি হয়েছে, মহাশয়া?’

‘এখানে একটি বিড়াল ছিল’, বেগম সাহেবা বললেন।

‘একটি বিড়াল?’

সেবিকা হেসে বললো,’একটি বিড়াল এই বৃষ্টিতে?’

‘হ্যা-বললেন বেগম সাহেবা,এই টেবিলের নিচে ই  ছিল’।

‘অহ!আমার সত্যিই এটা কে নেয়ার খুব ইচ্ছা ছিল।আমি একটি বিড়ালছানা চাই চাই।’

কথা গুলো শুনে  সেবিকার চেহারা মলিন হয়ে গেলো।

‘মহাশয়া চলুন’,সে বললো।’আমাদের ভিতরে চলে যেতেই হবে নইলে আপনি ভিজে যাবেন।’

‘আমিও তাই ভাবছি’,বেগম সাহেবা বললেন।

নুড়ি পাথরের সেই রাস্তা ধরেই তারা দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। সেবিকা ছাতা বন্ধ করার জন্য বাইরে দাঁড়ালো। আমেরিকান বেগম সাহেবা অফিসের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়,মালিক মাথা নত করলেন। ছোট খাটো কিছু একটা বেগম সাহেবা কে কুরে কুরে খাচ্ছে।মালিক তা খুব সামান্যই আন্দাজ করতে পারলেন কিন্তু বিষয় টাকে তিনি খুব  গুরুত্ব দিলেন।ক্ষণস্থায়ী হলেও মেয়েটির কাছে এটির গুরুত্ব ছিল অনেক।সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো।রুমের দরজা খুলে সে জর্জ কে বিছানায় পাঠে মগ্ন অবস্থায় দেখতে পেলো। 

বই রেখে সে জিজ্ঞাসা করলো,’বিড়াল টি পেয়েছিলে?’

‘বিড়ালটি চলে গিয়েছিলো ‘

‘কি আশ্চর্য বিড়ালটি গেলো কোথায়,’ বই থেকে চোখ সরিয়ে সে জিজ্ঞাসা করলো।

বেগম সাহেবা বিছানায় বসলো।

সে বললো,’বিড়াল টি পাওয়ার অনেক ইচ্ছা ছিল আমার,’।’আমি জানিনা কেনো বিড়াল টি পাওয়ার প্রবল ইচ্ছা জেগেছিল আমার।আমার বিড়াল টি চাই চাই।বৃষ্টিতে বিড়াল ভিজছে,এটা কি কোনো মজার বিষয় হতে পারে।’

জর্জ আবার পড়তে লাগলো।

সে উঠে গিয়ে ড্রেসিংটেবিল এর সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে।সে এপাশ ওপাশ ফিরে নিজেকে দেখছে।তারপর সে তার মাথার পিছনের দিক আর ঘাড় দেখা শুরু করলো।

‘আচ্ছা আমার চুল বড় করলে কেমন হবে,তোমার কি মনে হয়?’সে জিজ্ঞাসা করে আবার নিজেকে দেখা শুরু করলো।

জর্জ তার ঘাড়ের দিকে তাকিয়ে বললো ‘যেমন আছে তেমন ই ভালো লাগছে’।

‘আমার কাছে মোটেও ভালো লাগছে না’,সে বললো।’ছেলেদের মতো নিজেকে দেখতে আমার একদম ই ভালো লাগছে না’।

জর্জ একটু নড়েচড়ে বসলো।যখন সে কথা বলা শুরু করলো তখন সে তার থেকে আর চোখ ফেরালো না আর বললো ‘তুমি দেখতে মায়াবী।’

বেগম সাহেবা আয়না রেখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।ক্রমশই  অন্ধকার নামছে।

‘তারপর সে বললো,আমি চুল গুলো এমন লম্বা করবো যাতে সুন্দর একটা খোপা বাধতে পারবো অনায়াসে আর

তাতে আমি সত্যি ই শান্তি পাবো।আমি একটা বিড়াল চাই আর সেটি আমার কোলে রাখবো,খুনসুটি তে মেতে উঠবো তার সাথে যখন ইচ্ছে হবে তখনই।

‘অহ আচ্ছা তাই?’,বিছানা থেকে জর্জ বললো।

আমার আরো ইচ্ছে করছে মোমবাতির আলোয় রুপোর থালাতে টেবিলে বসে আহার করতে।আমি চাই আয়নার সামনে বসে চুল আচড়াতে, আমি চাই একটি বিড়াল আর কিছু নতুন পোশাক।

‘আহা থামো আমাকে পড়তে দাও’,বিছানা থেকে জর্জ বলে আবার পড়তে লাগলো।

তার স্ত্রী বাইরে তাকালো।বেশ অন্ধকার চারপাশ।পাম গাছ বেয়ে এখনো বৃষ্টি গড়িয়ে পড়ছে।

‘যাই হোক,আমি একটি বিড়াল চাই’,সে বললো,’বিড়াল চাই আমার এক্ষুনি বিড়াল চাই’।আমার যদি লম্বা চুল ও না থাকে কিংবা কোনো আনন্দ ই না থাকে একটা বিড়াল তো আমার থাকতেই পারে।’

জর্জ তার কথায় কান দিচ্ছে না।সে পড়ছে।বেগম সাহেবা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো যেখান থেকে স্কয়ারে আলো এসে পরছে।

কেও এককজন দরজায় কড়া নাড়ছে।

‘আসছি’,জর্জ বই থেকে চোখ তুলে বললো।

দরজায় হোটেল সেবিকা দাঁড়িয়ে আছে।তার হাতে রয়েছে একটি বিশাল খাঁচা। খাঁচায় একটি বিড়াল।

সে বললো,’হোটেল মালিক এই বিড়াল টি মহাশয়ার জন্য পাঠিয়েছে।’

 

 

মূল লেখক: আর্ননেস্ট হেমিংওয়েহেমিংওয়ে

অনুবাদক: মৌমিতা মেহেরীন

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি 

আরো পড়ুন-


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

2

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

গল্প চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ

চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ মেহেরপুর একটি সুন্দর গ্রাম।এই গ্রামে কিছু অদ্ভুত নিয়মকানুন চালু আছে,যা অন্যকোন গ্রামে নেই।এই গ্রামে নারীরা

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ রানু বউ হয়ে এসেছে চার পাঁচ মাস হলো।এরই মধ্যে তার স্বামী স্কলারশিপ এর

গল্প মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ

মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ আবিদ হায়দার বেড়াতে এসেছে গ্রামে তার বন্ধু ফুয়াদ'র বাসায়।অবশ্য সে একা না,তার সঙ্গে আছে,বন্ধু সজল

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ আলেয়া বউ হয়ে এসেছে চার বছর হলো।এখনো মা হতে পারেনি। এজন্য রীতিমতো তাকে কটু কথা

2 Replies to “ছোট গল্প- বিড়ালের কান্না”

Leave a Reply