গল্পঃ অনুপমার চোখে
লেখকঃ বকুল রায়
Part 01
ঢাকার ব্যস্ত সড়কগুলো আমার কাছে সবসময় যেন এক রঙিন ক্যানভাস। ছোটবেলা থেকে আমি ছবি আঁকতে ভালোবাসতাম। আমার মা সবসময় বলতেন, “বকুল, তোর আঁকায় প্রাণ আছে।” আমি ঠিক সেই প্রাণটুকুই দিতে চেয়েছিলাম আমার কাজে। তাই তো ছোট শহর লালমনিরহাট ছেড়ে ঢাকা শহরে এসে অ্যানিমেশন কোম্পানিতে কাজ শুরু করলাম।
আমার পদ—জুনিয়র অ্যানিমেটর। কাজটা শেখার মতো, একটু চ্যালেঞ্জিং, কিন্তু আনন্দের। অফিসটা খুবই বড় নয়, তবে কাজের পরিবেশ ভালো। সহকর্মীরা হাসিখুশি। প্রথম দিন অফিসে ঢুকতেই আমার চোখে পড়ে এক মেয়ে। তার চোখে একটা অদ্ভুত শান্তি। মুখে চাপা হাসি, সাদা শাড়ি পরা। যেন চলন্ত কোনো শিল্প। সে ছিল অনুপমা।
অনুপমার সাথেই আমার প্রথম পরিচয়, মিটিং রুমে। সবার সাথে আলাপ করানোর সময় বস আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল। “বকুল, এ হচ্ছে অনুপমা। তোমার মতোই জুনিয়র অ্যানিমেটর। তোমাদের একসাথে কাজ করতে হবে।”
আমি হাসলাম। সেও। অথচ সেই হাসির আড়ালে তার চোখে এক অদ্ভুত শূন্যতা খুঁজে পেলাম। কেন জানি, মনে হলো, সে একা। আমিও তো একা।
আমাদের প্রথম কাজ ছিল একটা বিজ্ঞাপনের অ্যানিমেশন বানানো। দুইজন মিলে গল্প, চরিত্র আর রঙের প্ল্যান নিয়ে আলোচনা করলাম। অনুপমা খুব চুপচাপ। কথা বলে কম, কাজ করে বেশি। আমার ছবি আঁকার প্রতি ভালোবাসা দেখে সে একটু অবাক হয়েছিল। বলেছিল, “তোমার কাজ বেশ সূক্ষ্ম। এই কোম্পানিতে তুমিই ভালো করবে।”
তার কথাগুলো কেন জানি আমার মনে গেঁথে গেল। সেদিন রাতে বাসায় ফিরে তার চোখের শূন্যতা আর কথার গুণগুণ শব্দ মাথা থেকে বের করতে পারলাম না। মনে হলো, এই মেয়ে যেন এক গভীর রহস্য।
পরের দিন থেকে কাজের চাপ আরও বেড়ে গেল। ক্লায়েন্টের ডেডলাইন, বসের নির্দেশ, আর আমাদের দুজনের নতুন মিলে কাজ করার অভিজ্ঞতা—সব মিলিয়ে দিনগুলো যেন এক নতুন অধ্যায়।
অনুপমা কাজ করতে করতে মাঝে মাঝে বিরতিতে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াত। বাইরের ব্যস্ত ঢাকা শহরের দিকে চেয়ে থাকত নিঃশব্দে। আমি কয়েকবার ভেবেছিলাম তার পাশে গিয়ে দাঁড়াই, কথা বলি। কিন্তু কী বলব, সেটা ঠিক করতে পারিনি।
একদিন, অফিস থেকে ফেরার পথে হঠাৎ দেখলাম, সে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একটা শিশুকে কিছু খেতে দিচ্ছে। আমি থেমে গেলাম।
“এটা তোমার রোজের অভ্যাস?” আমি মৃদু হাসি দিয়ে জানতে চাইলাম।
“না, তেমন কিছু না,” সে উত্তর দিল। তার কণ্ঠে এক ধরনের কোমলতা ছিল, যা তার চুপচাপ স্বভাবের সাথে মানানসই।
“তুমি খুব অন্যরকম,” বলে ফেললাম।
সে এক ঝলক তাকাল। “সবাই কি একরকম হতে পারে?”
তার কথায় আমি চুপ হয়ে গেলাম। মানুষটা রহস্যময়। কাজের জায়গায় সে খুব প্রফেশনাল, কিন্তু এর বাইরে তাকে বোঝা কঠিন।
একদিন অফিসে লাঞ্চের সময়, আমি তাকে আমার কাজের পুরোনো স্কেচবুকটা দেখালাম। ছবিগুলো দেখে তার চোখে একটা উজ্জ্বলতা ফুটে উঠল।
“তুমি খুব ভালো আঁকো,” সে বলল।
“ধন্যবাদ। এগুলো আমার ছোটবেলা থেকে করা কাজ। তুমি তো কিছু বললে না। তুমি কী পছন্দ করো?”
অনুপমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “আমি প্রকৃতি ভালোবাসি। পাখিদের, গাছেদের। এসবই যেন আমাকে শান্তি দেয়।”
তার সাথে সেই প্রথম খোলাখুলি কথা হলো। আমাদের কথাগুলো ছোট ছোট বিন্দুর মতো ছিল, কিন্তু সেই বিন্দুগুলো একসাথে মিলে যেন একটা অদ্ভুত রঙিন ছবি আঁকল।
এরপর থেকে আমাদের বন্ধুত্ব একটু একটু করে গড়ে উঠল। তবে বন্ধুত্বে একটা দূরত্ব ছিল। যেন আমরা দুজনেই কিছু বলতে চাই, কিন্তু বলি না।
কিছুদিন পর, বস আমাদের দুজনকে এক নতুন প্রজেক্টে দায়িত্ব দিলেন। এটাই ছিল আমাদের প্রথম বড় কাজ। এই প্রজেক্টের গল্পটা ছিল একটা ভাঙা সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে। দুজন মানুষের গল্প, যারা একে অপরকে ভালোবাসত কিন্তু পরিস্থিতির চাপে আলাদা হয়ে যায়।
কাজ করতে করতে আমি হঠাৎ বুঝতে পারলাম, অনুপমার চোখে এই গল্পটা শুনে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা ফুটে ওঠে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার কি কখনো এমন কিছু ঘটেছে?”
সে মৃদু হেসে বলল, “গল্পের চরিত্র আর বাস্তব জীবনের মানুষ অনেক ভিন্ন। কাজের সাথে বাস্তব মেশাতে নেই।”
তার কথা আমাকে কিছুটা অদ্ভুত লেগেছিল। মনে হচ্ছিল, তার ভেতরে অনেক কথা লুকিয়ে আছে, যেগুলো সে কাউকে জানাতে চায় না।
গল্পটা এখান থেকে আরও এগিয়ে যাবে। আমাদের কাজের সম্পর্ক আর অনুপমার জীবনের গোপন গল্প একসময় একসাথে মিশে যাবে।
ঢাকার বাতাসে এক ধরনের অস্থিরতা আছে। শহরটা যেন সারাক্ষণ দৌড়াচ্ছে, আর আমি এই দৌড়ের মাঝে কোথাও নিজের জায়গা খুঁজছি। কিন্তু আমার জন্য সবচেয়ে শান্তির মুহূর্ত ছিল অফিসে অনুপমার পাশে বসে কাজ করা।
আমাদের নতুন প্রজেক্ট নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। গল্পের মূল চরিত্র দুজনের মধ্যেকার দূরত্ব কীভাবে আঁকা হবে, সেটা ঠিক করার দায়িত্ব ছিল আমাদের। আমি স্কেচ করছিলাম, আর অনুপমা সেগুলো এনিমেট করার পরিকল্পনা করছিল।
“তুমি কি কখনো অনুভব করেছ, মানুষ আর সম্পর্ক অনেকটা রঙের মতো?” হঠাৎ সে প্রশ্ন করল।
“মানে?” আমি অবাক হয়ে তাকালাম।
“কিছু সম্পর্ক উজ্জ্বল, কিছু ফিকে। আবার কিছু এমন রং যা ধীরে ধীরে মুছে যায়,” সে গভীর স্বরে বলল।
তার কথা শুনে আমার মনে হলো, সে যেন নিজের জীবনের গল্প বলছে। আমি জিজ্ঞেস করতে চেয়েও চুপ করে গেলাম। মনে হলো, সময় এলে হয়তো সে নিজেই বলবে।
সেদিন কাজ শেষ করে বাসায় ফেরার সময় একটা অদ্ভুত অনুভূতি আমাকে পেয়ে বসল। আমার কি অনুপমার প্রতি অনুভূতি বদলে যাচ্ছে? হয়তো সে আমার জীবনের এমন এক মানুষ, যার কাছ থেকে আমি দূরে থাকতে পারব না।
পরদিন, কাজের ফাঁকে তাকে জানালাম, “তুমি বলেছিলে রঙের কথা। কিন্তু তুমি কি জানো, কোনো কোনো রং কখনো মুছে যায় না? তারা থেকে যায় চিরকাল, হয়তো কোথাও আড়ালে।”
সে একটু চমকে তাকাল আমার দিকে। কিছু বলল না, কিন্তু তার চোখে এক ঝলক আলো ফুটে উঠল। সেই আলো যেন ঢাকার রাতের আলোকে হার মানিয়ে দিতে পারে।
আমাদের প্রজেক্টের কাজ এগোচ্ছিল, আর তার সাথে আমাদের কথোপকথনের গভীরতাও। আমি জানতে পারলাম, অনুপমা প্রকৃতিকে ভালোবাসে কারণ তার কাছে প্রকৃতি শান্তি দেয়। ছোটবেলায় সে ঢাকার এক কোণে বেড়ে উঠেছে, যেখানে একটাই গাছ ছিল তাদের বাড়ির সামনে। সে সেই গাছের নিচে বসে ছবি আঁকত।
“তাহলে তুমি ছবি আঁকতে কেন ছাড়লে?” আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম।
“সময় মানুষকে অনেক কিছু ছাড়তে বাধ্য করে,” সে হালকা হাসল। “তবে হয়তো একদিন আবার আঁকব। হয়তো।”
আমি চুপ হয়ে গেলাম। তার জীবনের ভাঙাগড়ার গল্প আমাকে ক্রমশ গভীরে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম, সে শুধু কাজের সহকর্মী নয়। তার প্রতি আমার মনের গভীরে একটা আলাদা টান জন্ম নিচ্ছে।
ঢাকার আলোতে ভেসে যাওয়া এক সন্ধ্যায়, আমি প্রথমবার নিজের মনের কথা নিজেকে স্বীকার করলাম। আমি অনুপমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।
(চলবে)…….

অসাধারণ
ধন্যবাদ