- লেখিকা :লামিয়া
- পার্ট:১
ঢাকার ব্যস্ত শহর যেন কখনও থামে না। বিকেল নামছে ধীরে ধীরে, সূর্যটা ঝিমিয়ে পড়েছে, কিন্তু শহরের হর্ন আর ধোঁয়া থামেনি। ঠিক এমন এক বিকেলে কলেজগেট পেরিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল ইয়ানা শেখ। ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী, শান্ত স্বভাবের হলেও চোখে মুখে প্রাণবন্ত একটা আভা। হাতে তার প্রিয় ডায়েরি আর কাঁধে একটা নীল ব্যাগ।
এই কয়েকদিনে সে কয়েকবার দেখেছে একটা ছেলেকে—দামি গাড়ি থেকে নামছে, ফোনে গম্ভীরভাবে কথা বলছে, বা একটা কফিশপে বসে নিরবভাবে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা রুঢ হলেও চেহারা যেমন নজরকাড়া, তেমনি চোখদুটোতে অদ্ভুত একটা অভিব্যক্তি। অকারণে হাসে না বললেই চলে।
ছেলেটি আর কেউ নয় তাজরিয়ান খাঁন—খান কোম্পানির তরুণ সিইও। বয়স মাত্র বাইশ, কিন্তু তার কথাবার্তা আর চালচলনে যেন সব বয়সের মানুষই হাড় মানবে। সুন্দর, আত্মবিশ্বাসী আর কিছুটা রুঢ। অনেকেই তাকে অহংকারী ভাবে, কিন্তু যারা কাছের, তারা জানে—তাজরিয়ানের ভেতরটা অনেকটা নরম।
আজকের দিনটা হঠাৎ করেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, যদিও সেটা বুঝে ওঠার সময় তখনও আসেনি।
তাজরিয়ান তার ছোট বোন ইশরাতকে কলেজে ভর্তি করাতে এসেছে। ভেতরে ঢুকে খোঁজ নিতে গিয়ে ইয়ানার মুখোমুখি হলো সে—একটা ডেস্কের পাশে ইয়ানা কিছু ফর্ম হাতে ব্যস্ত, স্টাফদের সাহায্য করছিল।
—“আপনার বোনকে ভর্তি সংক্রান্ত কিছু লাগলে আমি সাহায্য করতে পারি,” ইয়ানা বিনীতভাবে বলল।
তন্ময় তার দিকে তাকাল, একটু চিনতে পারার ভাব চোখেমুখে।
—”আপনি এখানে কাজ করেন?”
—”না, আমি এখানকার ছাত্রী। মাঝে মাঝে হেল্প করি।”
কথাবার্তা খুব সাধারণ, তেমন কিছু না। কিন্তু দুজনেই জানত—এই তাদের তৃতীয়বার দেখা।এই তৃতীয়বারে এসে যে তাজরিয়ান ইয়ানাকে দেখলো তা নয়, ইয়ানার আড়ালে তন্ময়ও তাকে দেখেছে। ইয়ানাকে তন্ময়ের চোখে পড়ারই কথা ইয়ানাও দেখতে কম সুন্দরী নয়। ঘন কালো চুল, একটা হাস্যজ্জল মূখর্শি,মায়াবি আখিঁজোড়া তার সাথে ঠোঁটে মিষ্টি হাসি লেগেই থাকে।
কাজ শেষে কলেজ গেটের বাইরে হেঁটে এল দুজন। এর মধ্যে ইসরাতকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে তাজরিয়ান। তাজরিয়ানের গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে সামনে, কিন্তু সে হঠাৎ বলে বসে—
—”এক কাপ কফি খাওয়া যায়। সময় আছে?”
ইয়ানা একটু থেমে বলে, “সময় আছেই।”
পাশের ছোট্ট কফিশপে ঢোকে তারা। অর্ডার দেওয়ার পর দুজনই চুপচাপ বসে থাকে, কেউ কারও দিকে খুব একটা তাকায় না। কথাও হয় সামান্য, যেন একে অপরকে বুঝে ওঠার আগে একটু সময় দরকার।
তাজরিয়ান পকেট থেকে ফোন বের করে, বলল—
—”আপনার নাম্বারটা দেওয়া যায়?”
এই ঠিক তখনই, ইয়ানার ফোনটা বেজে ওঠে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ‘আব্বু কলিং’। সে চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে।
—”আমি যাই, দেরি হয়ে গেছে। আবার দেখা হলে নাহয় দেয়া যাবে। ”
বিনা প্রতিক্রিয়ায় তাজরিয়ান তাকিয়ে থাকে, কিছু বলে না। ইয়ানা ব্যস্তপায়ে কফিশপ থেকে বেরিয়ে যায়।
কয়েক মিনিট বসে থেকে তাজরিয়ান উঠে দাঁড়ায়, গাড়িতে ওঠে। তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই।
তারপর কেটে যায় দিন, সপ্তাহ, মাস।
তারা কেউ আর একে অপরকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করে না। প্রত্যেকে নিজের জগতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে—তাজরিয়ান ব্যবসায়িক মিটিং, শহর ঘোরা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভারে ক্লান্ত; আর ইয়ানা কলেজের ক্লাস, টিউশনি আর মধ্যবিত্ত জীবনের ছোট ছোট স্বপ্নে আটকে থাকে।
তাদের গল্প শুরু হয়নি এখনও।
শুধু একটা অস্পষ্ট দেখা, একটা নিরব বিকেল, আর জমে থাকা কিছু কথা…
(চলবে…?)
