মাজার ও মানবতা

0

 

বাইরে বৃষ্টির ভাব। মনে হচ্ছিল, এখনই অঝোরে বৃষ্টি নামবে। কিন্তু কিছু করার নেই — আমাকে বের হতেই হবে। রোগী দেখতে এসেছি; কাজেই কারও বাড়িতে থেকে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।

চারদিক অন্ধকারময়, মেঘলা আকাশ আর বাতাসে গাছপালার দোল — এক অপার্থিব প্রশান্তি! এমন আবহাওয়ায় রাস্তা দিয়ে হাঁটার আনন্দই আলাদা।

আমি এসেছি একজন গুরুতর রোগী দেখতে যদিও খুব একটা আমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোগী দেখা হয় না। সারাদিন বসি আমাদের দাতব্য চিকিৎসালয়ে — মানুষ আসে, আমি চিকিৎসা করি। কিন্তু আজ রোগীর অবস্থা শুনে ছুটে আসতে হলো।

রাস্তার অবস্থা মোটেও ভালো না। কোনোমতে পৌঁছেছি। বাড়ির লোকজনের কাছ থেকে একটি ছাতা চাইলাম — যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা ভাঙা ছাতা হাতে পেলাম।

বেরিয়ে পড়লাম। যাওয়ার আগে আব্বাসকে ফোন করলাম — ও চিন্তা করবে, তাই জানিয়ে দিলাম।
অনেকক্ষণ হাঁটার পর অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছালাম। বৃষ্টি কেবল ভয় দেখিয়েছে, নামেনি।
আব্বাস আমাকে দেখে দৌড়ে এলো — ব্যাগটা হাতে নিয়ে নিলো। ওর মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।
রুমে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। আকাশের অবস্থা এখনো ভালো না। সিদ্ধান্ত নিলাম, বাড়ি ফিরবো।

আমরা এখানে মাত্র দুজন দায়িত্বে থাকি। এই সময় নতুন রোগী আসার সম্ভাবনা নেই। তাই আব্বাসকেও বললাম, “চলো, বন্ধ করে বাড়ি যাই। তোমাকে নামিয়ে দিব।”
মোটরসাইকেলে ওকে পেছনে বসিয়ে রওনা দিলাম।

আমি শওকত আলী। সদ্য ডাক্তারি শেষ করেছি। এখন এই অজপাড়াগাঁয়ের একটি মাজারকেন্দ্রিক পরিচালিত দাতব্য চিকিৎসালয়ে কাজ করছি।
আব্বাস আমার সহকারী — ভালো মনের, সবসময় হাসিখুশি। আমাকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করে।

আজ হঠাৎ আব্বাস বলল, “ভাই, আপনি তো ডাক্তারি শেষ করেছেন। চাইলে ভালো কোনো প্রাইভেট হাসপাতালে চাকরি নিয়ে ইনকাম করতে পারতেন। এখানে এই অজপাড়াগাঁয়ে এলেন কেন?”
আমি হেসে বললাম, “সে অনেক বড় কাহিনী। বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে। একদম শুরু থেকেই বলতে হবে।”
আব্বাস উৎসাহ নিয়ে বলল, “ভাই, শুরু করেন।”

আমি শুরু করলাম —
“সালটা ২০১০। তখন সদ্য এইচএসসি শেষ করেছি।
একদিন খুব কাছের বন্ধু সাইফ বলল, ‘বন্ধু, চল আজ একটা মাহফিলে যাই।’
আমি বললাম, ‘কীসের মাহফিল?’ কারণ আমরা নির্দিষ্ট মতবাদের বাইরে তেমন যেতাম না।
সে বলল, ‘একটা অলির ওরস উপলক্ষে মাহফিল।’
আমি তো রেগেই গেলাম। বললাম, ‘তুই আমাকে মাজারপূজারী ভণ্ডদের ভিড়ে নিয়ে যেতে চাস?’
তবু ওর পীড়াপীড়িতে রাজি হলাম।

ভাবলাম — বাবার ফাতেহা, হেনতেন বলে টাকা তোলা হবে, গরু-মহিষ কাটা আর নাচানাচি চলবে।
কিন্তু সেখানে গিয়ে চমকে উঠলাম — একদম উল্টো চিত্র।
ছোট ছোট বাচ্চাদের কুরআন তেলাওয়াত প্রতিযোগিতা চলছে। বিকেলে পুরস্কার বিতরণী।
সবাই মসজিদের ভিতরে আসরের নামাজ জামাতে আদায় করল।

নামাজ শেষে গরিবদের মাঝে সাহায্য বিতরণ শুরু হলো — প্রতিটি পরিবারের হাতে খাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিস তুলে দিচ্ছে।
পাশের এক মুরুব্বী জানালেন, “প্রতি বছর এরকম হয় — ইসলামী সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম, গরিবদের সহায়তা, মিলাদ-মোনাজাত।”
আমি অবাক। মাজার মানেই তো শুনেছি খারাপ কিছু। ‘বহিপীর’ আর ‘লালসালু’ পড়ে আমাদের মনে একটা ছাঁচবাঁধা ধারণা তৈরি হয়েছিল — মাজার মানে ব্যবসা, ভণ্ডামি।
কিন্তু এখানে দেখি মানবসেবা। পরে জানতে পারি, তারা সারা বছর দেশের বিভিন্ন জায়গায় মানবসেবামূলক কাজ করে।

সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এতদিন যা শুনেছি, তার সঙ্গে বাস্তবের এত ফারাক!
সেদিন রাতে ঘরে ফিরে অনেক ভাবলাম। বুঝলাম — সব মাজার এক নয়, সব মুরিদ এক নয়।
যারা সত্যিকারের অলি, তারা মানবসেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেন। তাদের অনুসারীরাও সেই আদর্শ ধরে রাখে।
হকের বিপরীতে সবসময়ই বাতিল থাকে। কিন্তু আমরা সমাজ হিসেবে সবকিছু এক পাল্লায় বিচার করি।

নকল তো সব জায়গাতেই আছে। আসলের বিপরীতে স্বার্থান্বেষীরা নকল তুলে আনে।
তেমনি, মাজারের নামে ভণ্ডরা আছে, কিন্তু সত্যিকারের আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারীরা আছেন বলেই আজও কিছু কিছু জায়গায় মূল ইসলামী শিক্ষা জীবিত।
তাদের সঙ্গে অন্যায় যেন না হয় — এই সচেতনতাটাও জরুরি।

সেই রাত আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। ঘুমাতে পারিনি। ভাবছিলাম — আমরা না জেনে কত ভুল করি!

এরপর কিছুদিনের মধ্যে রেজাল্ট দিল। আল্লাহর রহমতে ভালো ফল হলো।
মেডিকেল প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিলাম — চান্স পেলাম।
কিন্তু ভর্তি হওয়ার কিছুদিন আগে বড় ধাক্কা এলো — আমার বাবা, আমাদের পরিবারের আশ্রয়, আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
সব এলোমেলো হয়ে গেল। পড়াশোনার ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার চিন্তা একপ্রকার ছেড়ে দিলাম।
তখন পাশে দাঁড়ালো সাইফ। বলল, “ভাই, হতাশ হবেন না। আমরা যে অলির মাহফিলে গিয়েছিলাম, তাঁর নামে মানবসেবামূলক একটি সংস্থা আছে। ওখানে আবেদন করুন। কিছু সাহায্য পেতে পারেন।”
আমি শেষ ভরসা নিয়ে আবেদন করলাম। শুধু ভর্তি ফি বাবদ কিছু টাকা চেয়েছিলাম।
কিন্তু কর্তৃপক্ষ ডেকে বিস্তারিত শুনে বলল, “পড়াশোনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সমস্ত খরচ আমরা বহন করবো।”

আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তখনই বুঝেছিলাম — মাজার মানে শুধু ব্যবসা নয়, এখানেও রাসূল (সা.)-এর আসল শিক্ষার ধারা এখনো জীবিত আছে।

মেডিকেলে ভর্তি হলাম। পুরো কোর্সজুড়ে তাদের সহায়তায় পড়াশোনা করলাম।
এই বছর ডাক্তারি শেষ করেছি। বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে চাকরির অফার এসেছে। চাইলে ভালো ইনকাম করতে পারতাম।

কিন্তু মনে হলো — যারা আমাকে এত বড় ঋণ দিয়েছে, আমি কি তাদের মতো গরিবদের সেবা করতে পারি না?

এই দাতব্য চিকিৎসালয় সেই সংস্থার একটি শাখা। দেশের আরও অনেক জায়গায় তাদের শাখা রয়েছে।
তাদের মানবতার ডাকে সাড়া দিয়েই আমি এখানে এসেছি — নিজের সামান্য স্বার্থ ত্যাগ করে, মানুষের জন্য কিছু করতে।

 

লেখক: মোবাররম হায়দার

শিক্ষার্থী- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


56
বিজ্ঞাপনঃ মিসির আলি সমগ্র ১: ১০০০ টাকা(১৪% ছাড়ে ৮৬০)

0

Mobarram Haider

Author: Mobarram Haider

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

গল্প ডিভোর্স মেয়ে আফছানা খানম অথৈ

গল্প ডিভোর্সি মেয়ে আফছানা খানম অথৈ তানহার বিয়ে হতে না হতে ডিভোর্স হয়ে যায়।শিক্ষিত সুন্দরী চাকরীজীবি তবুও সংসার টিকাতে পারলো

কবিতা পলাশ সাহার মৃত্যু আফছানা খানম অথৈ

#কবিতা পলাশ সাহার মৃত্যু আফছানা খানম অথৈ পলাশ সাহার জীবনে এসেছিল এক রমনী বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে হলো সে ঘরনী। প্রথম

বিদেশে রয় বেশ

রাজনীতির ঐ লাভটা ভেবে দলে দিচ্ছে যোগ, টাকা কামায় রাজার বেশে করবে নাকি ভোগ। হঠাৎ করেই দালান কোঠা গড়তে যারা

চাষি আমি ভাই

গাঁয়ের চাষি খেত খামারে ফসল বুনি রোজ, ফসল ফলায় নিত্যদিনে অন্নের করি খোঁজ। পাড়াগাঁয়ের খেটে খাওয়া চাষি আমি ভাই, খেত

Leave a Reply