বাহির থেকে ভেসে আসছে বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দ। বৃষ্টির বেগটা কিছুটা কমে এসেছে। ঝিরিঝিরি ধারায় হালকা বৃষ্টিপাত হচ্ছে বাহিরে। আকাশ কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে। বাহিরে কিছু আলোর দেখা মিললো এতোক্ষণে। কিন্তু এসবে কোনো ধ্যানই নেই এই তিন যুবকের। তারা তো ঘুমে মগ্ন। তবে বর্তমানে মাহিনের ঘুমটা একটু হালকা হয়ে এলো। কিন্তু মাহিনের কানে কেমন একটা মৃদু চিকন গলার স্বর ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে তাকে কেউ ডাকছে। কি অদ্ভুত সেই করুন কন্ঠস্বর! কি অদ্ভুত তার আর্তনাদ! মাহিনের মনে হচ্ছে সেই স্বর তাকে ডেকে বলছে,”মাহিন! মাহিন! এই মাহিন! মাহিন! একটু এদিকে আসো না! কিছু বলার ছিলো তোমায়। মাহিন!” কিন্তু এই স্বর কোনো ছেলে নাকি মেয়ের সেটাই বুঝা যাচ্ছে না। ঘুমের রেশ আরো একটু কাটতেই হাতে থাকা ওয়াটার প্রুফ ডিজিটাল ওয়াচটায় সময় দেখে বুঝলো রাত দুটো বেজে সাতাশ মিনিট। আড়মোড় ভেঙ্গে উঠে বসলো মাহিন। এক পলক রমেশ আর আলীর দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো কি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে তারা। তাদের দিকে তাকিয়েই ভাবতে লাগলো, এই তো প্রতিদিনকার মতো আজ রাতেও বের হয়েছিলো তারা। উদ্দেশ্য অজানা গন্তব্যে ঘুরে বেড়ানো। কিন্তু কে জানতো এভাবে এই রাতে এমন একটা জায়গায় ফেসে যাবে। এসব ভাবনার মাঝেই আবার সেই করুন স্বর ভেসে আসলো মাহিনের কানে। কিন্তু এবার শুধু তার নাম ধরেই ডাকছে না। বরং উচ্চস্বরে কান্না করে যাচ্ছে। কি ভয়ংকর সেই কান্না! হঠাৎ হঠাৎ আবার গগনবিদারী চিৎকার করে যাচ্ছে। শুনে মনে হচ্ছে কোনো মৃত ব্যক্তির জন্য কান্না করছে। মাহিন কান খাড়া করে বুঝার চেষ্টা করলো কোনদিক দিয়ে এই স্বর ভেসে আসছে। তখনি মাহিনের চোখ পড়লো বেড়ার সূক্ষ্ম এক ছিদ্রে। সেখান দিয়ে বাহিরের কিছু লাল রঙের আলো ছাউনিতে প্রবেশ করছে। দেখে মনে হচ্ছে আগুনের আলো। কিন্তু এই বৃষ্টির মধ্যে কে আগুন জ্বালাবে? আর বৃষ্টির মধ্যে আগুনই বা কিভাবে জ্বলবে? ব্যাপারটা পরিষ্কার করার জন্য মাহিন ওই ছিদ্রের দিকে একটু এগিয়ে গেলো। তারপর নিজের এক চোখ বন্ধ করে অপর চোখ দিয়ে ওই বেড়ার ফুটো দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু যা দেখলো তা দেখার জন্য মাহিন মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। এ কিভাবে সম্ভব? এই হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে আগুনের কুন্ডলী কিভাবে জ্বলছে? তাও আকাশে উড়ন্ত অবস্থায়? মাহিন নিজ চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মাহিনের বারবার মনে হচ্ছে যে এটা কোনো স্বপ্ন হবে হয়তো। ব্যপারটা পুরোপুরি ভাবে জানার জন্য মাহিন আর কিছু না ভেবে ছাউনির দরজা পেরিয়ে বেড়িয়ে গেলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো মাহিন বের হওয়ার সাথে সাথেই সেই কান্নার স্বর থেমে গেলো। এতোক্ষণ তো এই স্বর একনাগাড়ে কেদে যাচ্ছিলো। কিন্তু এখন থামলো কেন? মাহিন নিজের মনেই নিজেকে প্রশ্ন করলো। তারপর সেদিকটায় গেলো, যেখানে এগুনের কুন্ডলী দেখেছিলো। কিন্তু এখানে তো কিছু নেই। তাহলে কি সব কিছু মাহিনের ভ্রম ছিলো? তাই হবে হয়তো। নয়তো এতো রাতে এখানে মাহিনকে কে ডাকবে? আর কে-ই বা কান্না করবে? আর এই বৃষ্টির মধ্যে উড়ন্ত আগুনের কুন্ডলী? এতো কস্মিনকালেও সম্ভব না। হ্যাঁ, এতোক্ষণ যা কিছু মাহিন শুনেছে যা কিছু দেখেছে সবই ছিলো মাহিনের ভ্রম। মাহিন নিজেকে এসব বলেই বুঝ দিলো। আবার ফিরে আসতে লাগলো ছাউনির দরজার দিকে। কিন্তু মাহিন এখন একটা জিনিস খেয়াল করলো। যা আগে মাহিন বা বাকি দুজনের কেউই খেয়াল করেনি। তারা তো এখন শশ্মানের এক ছাউনিতে রয়েছে। এই ভেবেই মাহিনের ভিতরটা কেমন কেপে উঠলো। একপ্রকার ভয় ঢুকে গেলো মাহিনের মনে। আর নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো,”এতোক্ষণ যা হয়েছে শুধুই কি আমার ভ্রম? আর রমেশের তখনকার সেই অদ্ভুত ব্যবহার! সেটা কি ছিলো?” মাহিনের ভয় পাওয়ার কারনটাও অবশ্য ভুল নয়। কেননা প্রবীণদের কাছ থেকে শশ্মান নিয়ে এতো লোমহর্ষক ঘটনা শুনেছে যে সেসব কিছু কেমন একে একে মাহিনের মনে পড়ে যাচ্ছে। আর মাহিনের মনে হচ্ছে সেই সব কিছুই হয়তো মাহিনের সাথে ঘটবে আজ। মাহিন মনে সাহস জুগিয়ে দ্রুতপায়ে হেটে চললো দরজার দিকে। এবার বুঝি ভয়টা একটু কমলো। প্রাণপ্রিয় দুই বন্ধুকে দেখে মনে কেমন সাহস চলে এলো। কিন্তু এই সাহসের সময় সীমা দীর্ঘক্ষন থাকলো না। যখনই মাহিন দরজায় পা রাখলো তখনই আবার সেই করুন আর্তনাদ ভেসে এলো মাহিনের কানে। এবার মাহিনের মনে হচ্ছে নিজের শরীরটা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। আবারো ভয় জেঁকে বসলো মাহিনের মনে। কিন্তু নিসন্দেহে এই তিন যুবক অনেকটা সাহসী। তাইতো রাত বিরাতে ঘুরে বেড়ানো এদের শখ। দীর্ঘ এক শ্বাস নিয়ে মাহিন পিছন ফিরে তাকালো। কিন্তু উহুম! কোনো শব্দ নেই তো! মাহিন আবারো দরজার দিকে ফিরে এক কদম সামনে এগিয়ে গেলো। আর এক কদম সামনে এগোবে তার আগেই কানে এলো আবারও সেই আর্তনাদ। মাহিন আর সামনে এগোতে পারলো না। এই হিমশীতল ঠান্ডার মধ্যেও মাহিনের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের দেখা মিলছে। দ্বিতীয় বার পিছন ফিরে তাকাবে কিনা সেই দ্বিধা-দ্বন্দে ভুগছে মাহিন। এদিক দিয়ে কান্নার স্বর ধীরে ধীরে বেড়েই যাচ্ছে। এবার মাহিনের মাথাটা মনে হচ্ছে ফেটে যাবে। এর-ই মাঝে কেউ আবারো মাহিনের নাম ধরে ডেকে উঠলো। মাহিন না চাইতেও হুট করে পিছনে ঘুরে গেলো। মাহিনের এই মূহুর্তে মনে হচ্ছে মাহিনের বডি এখন অন্য কেউ নিয়ন্ত্রণ করেছে। নয়লে মাহিন তো চায় নি পিছনে ফিরতে। তবে কেনো ফিরলো? আর অদ্ভুত ভাবে মাহিন পিছনে ফিরার সাথে সাথেই আবারো সব থেমে গেলো। এসব কি হচ্ছে মাহিনের সাথে? মাহিন কেমন যেনো সব তাল গোল পাকিয়ে ফেলছে। মাহিন আবারো দীর্ঘ এক শ্বাস টেনে নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো। তারপর কিছু একটা ভেবে দরজার দিকে না ঘুরেই উল্টো হয়ে দরজার ভিতরে যাওয়ার জন্য এক কদম পিছিয়ে গেলো। না, এবার আর কিছু হয়নি। মাহিন আরো এক কদম পিছিয়ে গেলো। এবারো কিছু হয়নি। মাহিন মনে আবারো কিছুটা সাহস পেলো। যার জন্য প্রায় অনেকটা দৌড়ের মতো করেই পিছনে চার-ছয়েক কদম পিছিয়ে গেলো। এবারো সব স্বাভাবিকই ছিলো।
আগুন প্রায় নিভার পথে। এমনিতে ভয়ে মাহিনের হাত-পা কাপছে, তারউপর এই আগুন নিভে গেলে কি একটা অবস্থা হবে ভেবে মাহিনের ভয় আরো দ্বিগুন বেড়ে যাচ্ছে। বিগত বিশ মিনিট যাবত মাহিন আলী আর রমেশের মাঝে চুপটি করে বসে আছে। কি করবে তা বুঝতে পারছে না। তবে কতোটুকু মাহিন ঠিকই বুঝতে পেরেছে যে এখানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। বৃষ্টির থেকে রেহাই পেতে তারা এখানটায় দৌড়ে এসেছিলো। আর তখন তাদের মধ্যে কেউই আশপাশটা খেয়ালই করে নি। তখন তাদের একটু আশ্রয়ের প্রয়োজন ছিলো। তাই আশেপাশে তাকানো তারা দরকার বলে মনে করে নি। আর রমেশ যখন পানিতে নামছিলো তখন তো তাদের দুজনেই অনেকটা ঘুমের ঘোরে ছিলো। তাই হয়তো তখনও ব্যাপারটা তাদের নজরে পরেনি। কিন্তু এখন! এখন তো মাহিন জানে যে তারা শশ্মানে রয়েছে। ইতিমধ্যে এতো কিছু ঘটে গেলো। রাত পুরোটা তো এখনো পরেই আছেই।
চলবে…..

অনেক ভাল লিখনি।বেশ মন কাড়ল।
ভালো লিখেছেন কবি