অপেক্ষা। পর্ব-০৮। সুমাইয়া আক্তার বৃষ্টি

0

 

চারদিকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনা যাচ্ছে। আমেনা বেগম নামজ শেষ করে মেয়ের পছন্দের পুলি পিঠা বানাতে ব্যাস্ত। মেয়েটা ভিতরে ভিতরে অনেক বেশি ভেঙ্গে পেরেছে তা উনি বেশ বুঝতে পারছেন। তাই তো মেয়ের পছন্দের পিঠা বানিয়ে মেয়ের মুখে হাসি ফুটাতে চান। এর’ই মাঝে সেখানে পাশের বাসার রহিমা খাতুনের আগমন ঘটে। উনাকে দেখে আমেনা বেগম খানিকটা অনুমান করে ফেলেছেন কি বলতে এসেছেন তিনি। তারপরও মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,”আসেন আপা, বসেন।”

রহিমা খাতুন বসতে বসতে বললেন,”তা পিঠা বানান নাকি?”

“হ আপা, মাইয়াডার এই পিঠা অনেক পছন্দের।”

“তা মাইয়া কি কইরা বেড়ায় তার খুঁজ খবর রাহেন নি আপা? আপনেরে আগেও একদিন কইছিলাম তহন তো হুনলেন না। এহন যে পুরা গেরামে জানছে ব্যাপারটা কি ভালা হইছে?”

“আমার মাইয়ারে আমি চিনি আপা। আমার মাইয়া এমন কিছু করে নাই। আর কুতুব ভাই কি রকম মানুষ এইডা তো এই গেরামের সবাই জানে।”

“সবাই জানলেই কি আপা? নিন্দা করার সুযোগ পাইলে কি কেউ ছাড়ে? এইডি বাদ দেন। যেই কারনে আয়ছিলাম। সবুজ কালকে আইয়া কইলো এতো কিছুর পরও নাকি জুবায়ের আলোরে নিতে চায়। ভাইবা দেইহেন আপা। আলোর নামে যেই বদনাম ছড়াইছে এই গেরামের ভালা কোনো পোলা বিয়ার প্রস্তাব দিবো নাকি সন্দেহ।”

“আমার মাইয়া লেহাপড়া করতাছে আপা। নিজেরটা নিজে কইরাই খাইতে পারবো। আমার মাইয়ার এতো দুর্দিন এহনো আসে নাই যে বিয়াইত্তা বয়স্ক পোলার কাছে বিয়া বইতে হইবো। আর সবটাই আল্লাহর হাতে। আল্লাহ আমার মাইয়ার কপালে বিয়া লেখলে কেউ ঠেকাইতে পারবো না। আর না লেখলে আমরা চাইলেও কেউ বিয়া দিতে পারমু না।”

আমেনা বেগমের কথা রহিমা খাতুনের পছন্দ হলো না। তাই সেখানে আর বসলেন না। তবে যেতে যেতে বললেন,”ঠিকই বলছেন আপা। আইজকা যাই, মেলা কাম পইরা আছে। তোয় একটু ভাইবা দেইহেন।”

এতোক্ষণ আলোর রুম থেকে সব কিছুই শুনতে পেয়েছে আলো ও রোশান। আলো মাথা নিচু করে আছে, চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে মুক্তোর ন্যায় অশ্রু কনা। আর সেদিকে একধ্যানে তাকিয়ে দু হাত মুঠোবন্দি করে রাগে ফুসছে রোশান। তারপর চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে উপরের দিকে মুখ করে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস চালায় রোশান। ক্ষানিকটা সময় পার হতেই আলোর দিকে তাকিয়ে দেখে এখনো নীরবে কেদে চলেছে আলো। আলোর মুখের নিচে হাত বাড়িয়ে দিতেই দু ফোটা অশ্রুকণা রোশানের হাতে পরে। যা দেখে আলো রোশানের দিকে মাথা তুলে অবাক করা চাহনিতে তাকালো। রোশান এবার আনমনে বিরবির করে বললো,”আপনার চোখের পানি আমায় এতো যন্ত্রণা কেন দিচ্ছে আলো?” কিন্তু এ কথা আলোর কর্ণগোচর হলো না।

“যার-তার কথা শুনে নিজের এতো মহামূল্যবান চোখের পানি ঝড়তে দিবেন না আলো। জমিয়ে রাখুন নিজের কাছে। যেদিন সব কিছুর হিসাব সবাইকে শুধে আসলে বুঝিয়ে দিতে পারবেন সেদিন না হয় কাঁদবেন, খুশির কান্না। আপনি কাঁদলে সবাই আপনাকে দুর্বল ভেবে বসে থাকবে। এতে করে আপনাকেই সবার কাছ থেকে বারবার আঘাত পেতে হবে। সবাইকে এই সুযোগটা দিবেন না আলো। নিজেকে স্ট্রং ভাবে গড়ে তুলুন। যেনো কেউ আপনাকে কিছু বলতে গেলেও হাজার বার ভাবে। আর যা আপনি করেন নি তার জন্য কেঁদে কি প্রমান করতে চান আলো? কেনো নিজেকে সবার সামনে অপরাধী সাব্যস্ত করছেন?”

আলো স্বভাবগত ভাবে কান্নার জন্য এবারও রোশানের কথার পীঠে কিছু বলতে পারলো না। যা দেখে রোশান বিরক্ত হলো।

“আপনাকে কিছু বলাই বোকামো আলো। আপনার দ্বারা কিছুই হবে না। দোষ না করেও সারাজীবন দোষী হয়ে থাকতে হবে আপনাকে।”

রোশান আজ আর আলোকে পড়ালো না। উঠে চলে গেলো। যাওয়ার সময় অবশ্য আমেনা বেগম পিঠে খেয়ে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু রোশান খায় নি। রোশানের তো রাগ লাগছে এটা ভেবে যে মেয়েটা এতো সহজ সরল কেন। একটু স্ট্রং হলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো?

“ওই মাষ্টার দাঁড়াও।”

যোহরের নামাজ শেষ করে বাড়ি ফিরছিলেন জহির রায়হান। পথে কেউ নিজেকে ডাকছে বুঝতে পেরে শব্দের উৎস অনুসরণ করে ডান দিকে তাকালেন। দেখলেন গ্রামের এক বৃদ্ধ প্রবীণ উনাকে ডাকছেন। সাথে বাহাদুর মিয়াও আছেন। এখন জহির রায়হানকে কি বলা হবে সেটা উনি জানেন। তারপরও এ ব্যাপারে আগে আগেই কিছু না বলে সেখানে গিয়ে দু’জনকে সালাম জানালেন।

“তোমাগো পোলা মাইয়ার নামে এগুলা কি হুনি মাষ্টার?”

জহির রায়হান কিছু বলার আগেই বাহাদুর মিয়া প্রতিবাদ করলেন,”চাচা আপনেরে আমি কোন সময় থেইকা বুঝাইতাছি, এগুলা সব ফাও কথা। যেমন ছড়াইছে এমন কিছুই না।”

“আহা! তুমি চুপ করো বাহাদুর। তোমার কথা হুনছি এতোক্ষন। এহন মাষ্টারের কথা হুইনা লই।”

“চাচা আপনি কুতুব ভাইজানকে তো চিনেনই। তার স্বভাব সম্পর্কেও সবার জানা। ছেলে-মেয়ে দু’জনকে হয়তো একসাথে দেখেছে তাই এমন একটা কথা বলে দিয়েছে।”

“বুঝলাম তোয় তোমার মাইয়ার বয়স কম হইছে নি? আর কতো লেহা পড়া করাইবা? বিয়া সাদি দেওন লাগতো না? আর এই বাহাদুর তোমার পোলারে কি এমনে আকাইম্মা বানাইয়া ঘরে বসাই রাখার জন্য পয়দা করছো? কাম-কাজে কি পাঠাইবা না?”

জহির রায়হান জানে এখানে আলোকে সাবলম্বী বানানোর কথা বললে সবাই হাসাহাসি করবে। কারন এই গ্রামে এখন পর্যন্ত কোনো মেয়ে সাবলম্বী হয়নি। নিজে অর্থ উপার্জন করেনি। তাই ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে চাইলেন।

“চাচা, সামনে তো মেয়েটার পরীক্ষা। পরীক্ষা ভালোভাবে দিক, পরে ভেবে দেখা যাবে।”

জহির রায়হানের কথা শেষ হতেই বাহাদুর মিয়া নিজের ছেলের পক্ষ নিয়ে বললেন,”আমার পোলাটা অনেক আদরের চাচা। এই বয়সেই দায়িত্ব দিবার চাইতাছি না। কয়েকটা বছর যাক।”

জহির রায়হান ও বাহাদুর মিয়া কারোরই কথা পছন্দ হলো না প্রবীণ আলাউদ্দিন এর। সেটা উনার মুখ দেখেই আন্দাজ করা যায়।

“তা তোমাগো পারিবারিক বিষয় নিয়া আমি আর কি কইতে পারি। তোয় হুইনা রাখো, পোলা মাইয়া দুইজনেরই কিন্তু বিয়ার বয়স হইছে। ওদের একলগে ঘুরঘুর করতে না কইরা দিও। বেশি টান থাকলে বিয়া করাই দেও দুইজনের। তাও আমাগো গেরামে জানি এইরকম আর কোনো কথা না রটে কোনো দিন।”

বাহাদুর মিয়া ও জহির রায়হান প্রবীনের কথায় সম্মতি জানিয়ে সেখান থেকে প্রস্হান করলেন।

এদিকে তাফীফের কথা মতো রাতে আলো নিজের জানালা খুলে জানালার ধারে বসে থাকে। আর তাফীফ এসে দূর থেকে তার প্রিয়তমাকে এক নজর দেখার জন্য সকল ভয় ফেলে রেখে ছুটে আসে। দুটো মানুষ আদান-প্রদান করে তাদের ভালোবাসায় সিক্ত দৃষ্টি। কিন্তু তারা কখনো খেয়াল করলো না এখানে একজন তৃতীয় ব্যক্তি সর্বদা উপস্থিত থাকে। যে কিনা তাফীফের আগে এসে আলোকে দেখতে থাকে। যতোক্ষণ না আলো জানালা বন্ধ করে ততোক্ষণ সে জানালার পানে তাকিয়ে থাকে আলোকে একটু দেখার আশায়। এখন কথা হলো কে সেই ব্যাক্তি? তার দৃষ্টিতে আলোর জন্য কি থাকে? লালসা নাকি ভালোবাসা?

চলবে….


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

0

Sumaiya Akter Bristy

Author: Sumaiya Akter Bristy

❝শুভ্রচিন্তার উদ্ভব ঘটে যার কথা ভেবে সে যদি মোহ হয় দোষ বা কি তাতে?❞ ~Sumaiya Akter Bristy

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

গল্প চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ

চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ মেহেরপুর একটি সুন্দর গ্রাম।এই গ্রামে কিছু অদ্ভুত নিয়মকানুন চালু আছে,যা অন্যকোন গ্রামে নেই।এই গ্রামে নারীরা

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ রানু বউ হয়ে এসেছে চার পাঁচ মাস হলো।এরই মধ্যে তার স্বামী স্কলারশিপ এর

গল্প মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ

মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ আবিদ হায়দার বেড়াতে এসেছে গ্রামে তার বন্ধু ফুয়াদ'র বাসায়।অবশ্য সে একা না,তার সঙ্গে আছে,বন্ধু সজল

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ আলেয়া বউ হয়ে এসেছে চার বছর হলো।এখনো মা হতে পারেনি। এজন্য রীতিমতো তাকে কটু কথা

2 Replies to “অপেক্ষা। পর্ব-০৮। সুমাইয়া আক্তার বৃষ্টি”

Leave a Reply