সীরাত গ্রন্থ পরিচিতি

0

 

সীরাত পাঠের প্রয়োজনীয়তা

কোনো কিছুর পরিচয় না জানলে তার যথাযথ মূল্যায়ন করা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে কোনো মানুষকে মূল্যায়ন করতে হলে তাঁর সম্পর্কে জানতে হবে। আর কাউকে জানতে তার জীবনবৃত্তান্ত জানতে হয়। মানুষের জীবনবৃত্তান্তকে আরবি ভাষায় সিরাত বলে।

সীরাত শব্দের অর্থ কী

সিরাত শব্দের শাব্দিক অর্থ অবশ্য চলন, পদক্ষেপ ও চলার পথ ইত্যাদি। পারিভাষিকভাবে মানুষের জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে রচিত গ্রন্থকে সিরাত বলে। পৃথিবীতে অনেক মহামানব, বিশিষ্ট ব্যক্তির সীরাত গ্রন্থ রচিত হয়েছে।

 

কিন্তু পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি যার জীবনী লেখা হয়েছে তিনি হলেন সাইয়িদুল মুরসালিন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। সিরাতুন্নাবী শব্দের অর্থ নাবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন চরিত। নাবী সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন নিয়ে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে অসংখ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে, এখনও হচ্ছে আর হতেই থাকবে। সুবহানাল্লাহ!

তবে অধিকাংশ সিরাত গ্রন্থ রচিত হয়েছে আরবি ভাষায়। পৃথিবীর প্রাচীন সিরাতগুলোও স্বাভাবিকভাবে আরবি ভাষায় রচিত হয়েছে।

নাবি সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের খণ্ড খণ্ড ঘটনা তো সাহাবা আজমাঈনগণই সংরক্ষণ করেছেন। তাঁর চলা-ফেরা, খাওয়া-পান করা, চেহারা -সূরত, কথা-বার্তা ও সামষ্টিক জীবনাচার সাহাবীগণ হাদীস বা সুন্নাহ হিসেবে সংরক্ষণ করেছেন। কিন্তু তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনবৃত্তান্ত রচিত হয়েছে তাবে’ঈনদের যুগে।

প্রথমের দিকে সিরাত রচনা করেন বিশিষ্ট তাবে’ঈ উরওয়া বিন যুবাইর রহিমাহুল্লাহ, অবান ইবনু উছমান রহিমাহুল্লাহ, ইবনু শিহাব যুহরি রহিমাহুল্লাহ। তবে সর্বপ্রথম যিনি সিরাতুন্নাবী সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী গ্রন্থ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মলাটে আবদ্ধ করেন তিনি হলেন বিশিষ্ট তাবে’ঈ ইবনু ইসহাক (জন্ম ৮৫ হিজরি ও মৃত্যু ১৫১ হিজরি)। তাঁর রচিত গ্রন্থটি হলো “আস সিরাতুন নাবাউয়্যাহ”( السيرة النبوية)। তাঁকে সিরাত শাস্ত্রের জনক বলা হয়। ইবনু ইসহাকের সনদে হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসণ মতভেদ করেছেন। তবে ইতিহাসের ক্ষেত্রে যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য ছিলেন। এরপরও তাঁর রচিত সিরাতটিতে অনেক ইসরাঈলি বর্ণনা ও অনির্ভরযোগ্য বর্ণনা পাওয়া যায়। পরবর্তীতে মুহাক্কিকগণ এই কিতাবের তাহকিক করেছেন।

 

সীরাতে ইবনে হিশাম

ইবনু ইসহাকের সিরাত গ্রন্থের মূল পাণ্ডুলিপিটি একসময় হারিয়ে যায়। তবে তার এক ছাত্রের কাছে একটি পান্ডুলিপি ছিলো। আব্দুল মালিক ইবনু হিশাম (মৃত্যু-২১৮ হিজরি) পরবর্তীতে তাঁর কাছ থেকে নিয়ে একে সংক্ষিপ্তভাবে সংকলন করেন। ইবনু হিশামের সংকলিত ও ব্যাখ্যাকৃত ইবনু ইসহাকের গ্রন্থটি সিরাতু ইবনি হিশাম নামেই পৃথিবীতে প্রসিদ্ধি পায়।

এছাড়াও আরবি ভাষায় প্রসিদ্ধ প্রাচীন কিছু সিরাত হলো-

১. আশ‌শিফাউ বি তায়রিফি হুকূকিল মুসতফা- লেখক, আবুল ফজল কাজি ইয়াজ মালিকি( মৃত্যু -৫৪৪ হিজরি)

২. আল মাওয়াহিবুল লাদুননিয়াহ বিল মিনিহিল মুহাম্মাদিইয়া -লেখক, আহমাদ বিন মুহাম্মাদ শাহাবুদ্দিন আল কুসতুলানি ( মৃত্যু -৯৩২ হিজরি)

৩. যাদুল মায়াদ ফি হাদই খইরিল ইবাদ- লেখক, আল্লামা ইবনুল কইয়িম আল জাউযি ( মৃত্যু -৭৫১ হিজরি)

এছাড়াও বর্তমানে আরো অনেক নির্ভরযোগ্য আরবী সিরাত গ্রন্থও পাওয়া যায়।

আরবি ভাষা ছাড়াও আমাদের সাব কন্টিনেন্টের ইলমি ভাষা উর্দুতেও অনেক সিরাত গ্রন্থ লিখিত হয়েছে। বৃহৎ কলেবরের সিরাতও রয়েছে আবার সংক্ষিপ্ত আকারের সিরাতও রয়েছে। এর অনেকগুলো আমাদের বাংলা ভাষায় অনূদিতও হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ।

 

সীরাতে খাতামুল আম্বিয়া

এর মধ্যে ‘সিরাতে খাতিমুল আম্বিয়া’ কিতাবটির কথা না বললেই নয়। কিতাবটি আমাদের কওমী মাদ্রাসার প্রাইমারি লেভেলের ক্লাশগুলোর পাঠ্য বই হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে। এটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু নির্ভরযোগ্য সীরাত গ্রন্থ। সংক্ষিপ্ত হলেও কিতাবটিতে নাবি সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের সকল প্রধান ঘটনাগুলো স্থান পেয়েছে। আর এই কিতাবের ভাষ্যগুলো নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে নেওয়া হয়েছে। কিতাবটি রচনা করেছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলিম ও ইসলামী চিন্তাবিদ, পাকিস্তানের সাবেক মুফতিয়ে আজম মুফতি মুহাম্মাদ শফী রহিমাহুল্লাহ (জন্ম ১৩১৪ হিজরি, মৃত্যু ১৩৯৬ হিজরি)। বইটিতে মুখ্য চাহিদার বিভিন্ন বিষয় সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে, পাশাপাশি পাশ্চাত্যবাদী আর নাস্তিকদের বিভিন্ন সন্দেহমূলক প্রশ্নের জবাবও সংক্ষিপ্তভাবে দেওয়া হয়েছে।

 

সীরাতে মুস্তাফা

এরপর উর্দু ভাষায় লিখিত আরেকটি নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হলো ‘সীরাতে মোস্তফা সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’। এটি একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থ। পৃথিবীতে সীরাত নিয়ে রচিত অধিকাংশ নির্ভরযোগ্য গ্রন্থের সারনির্যাস এখানে এসে গেছে। এর বর্ণনাগুলো সহীহ সনদে প্রমাণিত। পাশাপাশি এটিতেও নাবি সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে কাফিরদের প্রোপাগান্ডারর জবাব দেওয়া হয়েছে। এই বিখ্যাত কিতাবটি রচনা করেছেন ভারতবর্ষের বিখ্যাত আলিম হজরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইদ্রিস কান্ধলভী রহিমাহুল্লাহ (জন্ম ১৮৯৯ ইসায়ি ও মৃত্যু ১৯৭৪ ইসায়ি)।

বাংলা ভাষায় অনূদিত আরেকটি বিখ্যাত সিরাত হলো ‘আর রাহীক্বুল মাখতুম’। এটিও আহলে ইলমদের কাছে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছে। মাঝারি কলেবরের মধ্যে এটি একটি ভালো গ্রন্থ। এটি লিখেছেন ভারতের একজন প্রসিদ্ধ বড় আলিম আল্লামা ছফিউর রহমান মুবারকপুরী (মৃত্যু ২০০৬ ইসাঈ)।

এছাড়াও আরও একটি বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য সিরাত হলো মুফাক্কিরে ইসলাম সাইয়িদ আবুল হাসান আলী আন নাদাবি রহিমাহুল্লাহর ‘নবীয়ে রহমত’। মূল বইটি উর্দু ভাষায় রচিত হলেও বর্তমানে বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

আরেকটি বিখ্যাত সিরাত গ্রন্থ হলো মাওলানা আব্দুল মাজিদ দরিয়াবাদী রহিমাহুল্লাহর উর্দুর বাংলা অনুবাদ ‘তোমার স্মরণে হে রাসূল ’। বইটি যথেষ্ট মানসম্মত।

বাংলা ভাষায় রচিত কবি গোলাম মোস্তফার রচিত ‘বিশ্বনবী’ বইটি বহুল প্রচারিত। তবে বইটি যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য নয় বলে উলামাগণ জানিয়েছেন।

 

সীরাত গ্রন্থের তালিকা

রাসুলের জীবনাদর্শ নিয়ে অসংখ্য সিরাত গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এখানে কয়েকটি সীরাত গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত তালিকা উল্লেখ করা হলো।

  1. সীরাতে খাতামুল আম্বিয়া
  2. আস-সীরাতুন্নাবাউয়্যাহ
  3. সীরাতে ইবনে হিশাম
  4. সীরাতে মোস্তফা
  5. নবীয়ে রহমত
  6. তোমার স্মরণে হে রাসুল
  7. আর-রাহীকুল মাখতূম

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে রাসুলের জীবনী গ্রন্থ পাঠ করে রাসূলের আদর্শ অনুযায়ী চলার তৌফিক দান করুন। আমীন।

 

সঙ্কলন: আব্দুস সালাম

সম্পাদনা: লুবাব হাসান সাফওয়ান


56
বিজ্ঞাপনঃ মিসির আলি সমগ্র ১: ১০০০ টাকা(১৪% ছাড়ে ৮৬০)

0

লুবাব হাসান সাফ‌ওয়ান

Author: লুবাব হাসান সাফ‌ওয়ান

লুবাব হাসান সাফ‌ওয়ান ঠিকানা: নোয়াখাল কর্ম: ছাত্র পড়াশোনা: আল-ইফতা ওয়াল হাদীস [চলমান] প্রতিষ্ঠান: মাদরাসাতু ফায়দ্বিল 'উলূম নোয়াখালী

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

হযরত আলী (রা:) এর জীবনী

হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রাঃ) ছিলেন ইসলামের ইতিহাসে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব, যিনি সাহস, জ্ঞান, ন্যায়বিচার এবং তাকওয়ার জন্য সুপরিচিত।

খলিফা ওমর বিন আবদুল আজিজের নসিহত : একটি চিরন্তন আদর্শ ও বর্তমান উম্মাহর বাস্তবতা

ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে খলিফা ওমর বিন আবদুল আজিজ একটি যুদ্ধের প্রাক্কালে তার সেনাপতি মানসুর বিন গালিবের উদ্দেশ্যে একটি উপদেশপূর্ণ

কবিতা আল কোরআনের প্রতীক আফছানা খানম অথৈ

আল কোরআনের প্রতীক আফছানা খানম অথৈ মা আমেনার গর্ভেতে জন্ম নিলো এক মহামানবের, নাম হলো তার মুহাম্মদ রাসুল আসলো ভবের

ফোরাত নদীতে স্বর্নের পাহাড় আফছানা খানম অথৈ

ফোরাত নদীতে স্বর্নের পাহাড় আফছানা খানম অথৈ ইমাম মাহাদী (আ:) আগমনের পূর্বে ফোরাত নদীর তীরে স্বর্নের পাহাড় ভেসে উঠা কেয়ামতের

Leave a Reply