একজন অসহায় নারীর গল্প
আফছানা খানম অথৈ
আমেনা খাতুন একজন গৃহিণী।এক ছেলে এক মেয়ে হওয়ার পর তার স্বামী মারা যায়।এরপর সংসারের হাল ধরতে হলো তাকে।অন্যের বাড়িতে কাজ করে কোন মতে সংসার চালাচ্ছেন আমেনা খাতুন।একদিন কাজ করে ফেরার পথে তার উপর চোখ পড়ল গ্রামের আদম বেপারি বারেক’র।তার কাজ হলো নারীদের বিদেশে চাকরী দেয়ার নাম করে পাচার করা।তিনি আজ আমেনা খাতুনকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন।তারপর বললেন,
আপনি সজল ভাই’র বউ না?
আমেনা খাতুন মাথায় ঘোমটা টেনে ভদ্রভাবে উত্তর দিলো,
জ্বি বারেক ভাই।
তো ভাবি সাব কোত্থেক আসছেন?
হাজী আবদুল কাদেরের বাড়ি থেকে।
ও বাড়িতে কাজ করেন বুঝি?
জ্বি বারেক ভাই।
তিনি আফসোসের স্বরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বলেন,
আহারে!ভাবি সাব আপনার জন্য বড্ড কষ্ট হচ্ছে।এই বয়সে আপনি হলেন বিধবা।তার উপরে অন্যের বাড়িতে কাজ করছেন কত কষ্ট হচ্ছে আপনার।আল্লাহ তুমি এমন কষ্ট আর কাউকে দিওনা।
বারেক ভাই সব আল্লাহ পাকের ইচ্ছা।
ভাবি সাব তা অবশ্য ঠিক বলেছেন।
আমেনা খাতুন এগিয়ে চলল।তখনি বারেক ডাক দিলো,
ভাবি সাব দাঁড়ান।
আমেনা খাতুন থমকে দাঁড়াল।তখনি বারেক এগিয়ে এসে বলল,
ভাবি সাব একটা কথা বলতে চাই?
জ্বি বারেক ভাই বলুন।
ভাবি সাব আপনার কষ্ট আর আমি সইতে পারলাম না।তাই আপনার জন্য একটা চাকরি ঠিক করলাম।
আমেনা খাতুন চমকে উঠে বলল,
বারেক ভাই এই সব কী বলছেন,আমি মুরখ্য মানুষ,আমাকে চাকরী দেবে কে?
ভাবি সাব শুধু শিক্ষিত লোক চাকরী করবে,মুরখ্য লোক বসে থাকবে তা হতে পারে না।বর্তমানে মুরখ্য লোকের ও অনেক চাকরী আছে।
তাই নাকি?
জ্বি ভাবি সাব।
বারেক ভাই তা বুঝলাম,কিন্তু আমাকে চাকরী দিবে কে?
এক গাল মিষ্টি হেসে বারেক উত্তর দিলো,
কী বলেন ভাবি সাব, চাকরী কে দেবে মানে,আপনি শুধু হ্যাঁ বলেন। বাকী সব ব্যবস্থা আমি করে দেব।
সত্যি বলছেন বারেক ভাই?
তো আর বলছি কী।আপনি বিমানে করে বিদেশ যাবেন।বড় বড় অফিসে এসির ভিতরে বসে বসে কাজ করবেন।মাসে মাসে লাখ টাকা আয় করবেন।আপনার কোন কষ্ট হবে না।
বিদেশের কথা শুনে আমেনা খাতুন চমকে উঠে বললেন,
বারেক ভাই বিদেশে কেনো,আমার ভয় করছে আমি এসব পারবো না।
ভাবি ভয় করলে চলবে?আপনার ছেলে মেয়েকে মানুষ করতে হবে না?ভালো ভাবে খেতে পরতে থাকতে হবে না?এখানে পড়ে থাকলে কী আপনি ওদেরকে মানুষ করতে পারবেন?ভালো ভাবে খেতে পরতে থাকতে পারবেন?পারবেন না।তাই বলছি এত বড় সুযোগ হাতছাড়া কইরেন না,রাজী হয়ে যান।ছেলে মেয়ে নিয়ে খুব সুখে থাকতে পারবেন।অনেক টাকা মাইনে পাবেন।আপনার কোন কষ্ট হবে না।সব ব্যবস্থা আমি করে দেব।
ঠিক আছে বারেক ভাই আমি একটু ভেবে দেখি।
ভাবি যা বলার কালকের মধ্যে বলতে হবে।তা না হলে ওরা অন্য লোক নিবে।
ঠিক আছে বারেক ভাই আমি এখন গেলাম।কাল আপনার সঙ্গে দেখা করবো।
আমেনা খাতুন একজন অসহায় নারী তার কথা আর কী বলবো। চাকরী আর বিদেশের কথা শুনলে অনেক মধ্যবিত্ত ও হাই লেভেলের মানুষ ভালো মন্দ যাছাই না করে এগিয়ে যায়।তারপর দেখা যায় দালাল কিংবা আদম বেপারির হাতে শোষিত হয়ে খালী হাতে ঘরে ফিরে।এ দৃশ্যটা আজকাল প্রায় আমাদের চোখে পড়ছে।তবুও মানুষ কিন্তু সচেতন হচ্ছে না।একজন বলল চাকরী দেব, বিদেশ নেব, অমনি তাকে বিশ্বাস করে লক্ষ লক্ষ টাকা ইনভেস্ট,তারপর এক সময় দেখা যায় টাকা নিয়ে বস উধাও।তখন মাথায় হাত দিয়ে হাউ মাউ করে কাঁদা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।আজকাল আর একটা ব্যাপার লক্ষ করছি ইসলামি দেশগুলোতে পুরুষদের তুলনায় মহিলা কর্মী নিয়োগ দিচ্ছেন বেশি।অথচ লাখ লাখ পুরুষ বেকার পড়ে আছে।ওদেরকে বিদেশিদের চোখে পড়ছে না,চোখে পড়ছে নারীদের।আর নারীরা তা বিশ্বাস করে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে।তারপর শোষিত নির্যাতিত সতীত্ব নষ্ট করে খালী হাতে বহু কষ্টে দেশে ফিরছে সর্বত্র।এমনি আদম বেপারির বারেক’র পাল্লায় পড়লেন আজ অসহায় আমেনা খাতুন।সুখের আশায় ছেলে মেয়েকে দুসম্পর্কের এক আত্মীয় কাছে রেখে চাকরীর আশায় ছুটে গেলেন বারেক’র কাছে।বারেক তাকে দেখে হাসি মুখে বলল,
ভাবি সাব এসেছেন?
জ্বি বারেক ভাই।আপনি ওদেরকে বলে দেন আমি চাকরী করবো।
ভাবি সাব তাতো বলবো।তো কাল সকালের গাড়িতে আমাদেরকে শহরে যেতে হবে।
এতো তাড়া কেনো বারেক ভাই?
ভাবি সাব ঐ যে বললাম ওরা অন্য লোক নিবে।তাড়াতাড়ি না গেলে কিন্তু আপনার সর্বনাশ হবে।তাই সকালের গাড়িতে যেতে চাইছি আর কী।যদি আপনি আপত্তি করেন চাকরী কিন্তু হাতছাড়া হয়ে যাবে, শেষে আমাকে দোষী করতে পারবেন না।
আমেনা খাতুন মনে করেছিল কথাগুলো সত্যি।তাই বলল,
ঠিক আছে বারেক ভাই আমি যাব।
ভাবি সাব আপনি ভিতরে গিয়ে বসেন।আমি আপনার যাওয়ার ব্যবস্থা করছি।
আমেনা খাতুন ভিতরে গিয়ে বসলো।খুব সুন্দর সাজানো গোছানো পরিপাটি একটা রুম।খাট সোফা ড্রেসিং টেবিল ফ্যানের বাতাস সব আমেনা খাতুনকে খুব মুগ্ধ করলো।মুহূর্তে তিনি স্বপ্নের ভুবনে হারিয়ে গেলেন।মনে পড়লো বারেক ভাই কথাগুলো।বারেক ভাই ঠিক বলেছেন বিদেশ না গেল এমন বাড়ি বানানো যাবে না,ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখে থাকা যাবে না।আল্লাহ আমার আশা পূরণ করুণ, যেন বারেক ভাই’র মতো এমন একটা বাড়ি বানাতে পারি।
ভাবনার অবসান হতে না হতে বারেক’র পি এস খাবার এনে টেবিলে রেখে বলল,
ভাবি সাব খাবার দিয়েছি খেয়ে নেন।
আমেনা খাতুন তাকিয়ে দেখে অনেক দামি দামি খাবার মাছ,গোস্ত, রোস্ট,বিরিয়ানি…।
আমেনা খাতুন ইচ্ছে মতো খেয়ে শুয়ে পড়লো।সকাল হতে না হতে বারেক আমেনা খাতুন ও আরও দুজন মহিলা নিয়ে সকালের গাড়িতে রওয়ানা দিলো।দুতিন দিনের মধ্যে পাসপোর্ট ভিসা রেডি করে আমেনা খাতুন সহ দুজন মহিলাকে বিদেশে পাঠিয়ে দিলো বারেক।আমেনা খাতুনের চাকরী হলো এক বিদেশির বাসায়।ঘরের কাজের বুয়ার পরিবর্তে তাকে নিয়োগ দেয়া হলো যৌন দাসী হিসেবে।বাবা ছেলে দুজন মিলে রোজ রোজ আমেনা খাতুনের সঙ্গে আকাম কুকাম করে।আমেনা খাতুন বাধা দিলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে এক জাগায় বন্দী করে রাখে।
এদিকে আমেনা যে আত্মীয়ের কাছে ছেলে মেয়ে দুটো রেখে এসেছে সে বারেকের কাছে এসে আমেনা খাতুনের কথা জিজ্ঞেস করতে সে বলে,
খালাম্মা আপনি কোন চিন্তা কইরেন না।ভাবি সাব সময় মতো টাকা পাঠিয়ে দেবে।
তা বুঝলাম কিন্তু আজ দুমাস হয়ে গেল এখনো তার কোন খবর পাচ্ছি না।আমি ওতো গরীব মানুষ বাচ্চা দুটোর খরচ পাতি দেই কোত্থেকে?
তা অবশ্য ঠিক বলেছেন খালাম্মা।
আমেনাকে বিদেশ পাঠিয়ে লাখ লাখ টাকা আয় করেছে বারেক।এখান থেকে কটা টাকা দিলে বা কি তাই পাঁচশ টাকার একটা নোট উনার হাতে গুজে দিয়ে বলল,
খালাম্মা এই টাকাগুলো রাখেন।ওদের যা লাগে কিনে দিয়েন। ভাবি সাব টাকা পাঠাইলে আমি খবর দেব।
কোন মতে ওদেরকে বিদায় করে বারেক স্বস্থির নি:শ্বাস ফেলল।এরপর যতবার আমেনার খালা তার খবর নিতে এসেছে ততবার ছাপ ছাপ জবাব দিয়েছে,
আমি কিছু জানি না,সে কোথায় আছে।
এদিকে আমেনা খাতুন ধর্ষিতা হতে হতে এক সময় খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন।তারা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।ডাক্তারী চিকিৎসায় সে একটু সুস্থ হয়ে উঠে।তারপর ডাক্তারের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সে পালিয়ে এসে এক বাঙালির কাছে আশ্রয় নেয়।তাদের কাছে সবকথা প্রকাশের পর তারা কিছু টাকা দিয়ে তাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়।বিমান থেকে নেমে সে রাস্তার পাশ দিয়ে এলোমেলো ভাবে হাটছে।তখনি তার উপর চোখ পড়লো আরেক অমানুষের। সে তার কাছা কাছি গিয়ে বলল,
বোন তুমি এমনভাবে হাটস কেনো,তোমার কি হয়েছে?
আমেনা খাতুন কোন কথার জবাব না দিয়ে তার মুখ পানে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।লোকটি আবার বলল,
বোন কথা বলছ না কেনো,তুমি মনে হয় অসুস্থ,কোথায় যাবে?
অনেক্ষণ পরে আমানে খাতুন বলল,
আমি কদমপুর ষ্টেশনে যাব।
বোন আমি ও সেই দিকে যাব,তুমি আমার রিক্সায় উঠ এক সাথে যাওয়া যাবে।
আমেনা খাতুনের এখন ভালো মন্দ যাছাই করার মতো ব্রেন নেই।তাই লোকটির কথায় রাজী হয়ে রিক্সায় উঠে বসলো।এখানে ঘটল আরেক কাণ্ড,আমেনা খাতুন এতটা এবনরমাল হয়ে গিয়েছেন যে টাকা কোথায় রাখবেন সে খেয়াল ও তার নেই।তাই ওদের দেয়া টাকাগুলো কাগজ দিয়ে মুডিয়ে সে হাতের মধ্যে রেখেছে।আর এই টাকা কটার দিকে চোখ পড়লো ঐ অমানুষটার।সে জিজ্ঞেস করলো,
বোন তোমার হাতে এটা কিসের পুটলা?
এটা টাকার পুটলা।
টাকার কথা শুনে লোকটি বলল,
এভাবে রেখেছ কেনো, পকেটমার নিয়ে যাবে তো?
না ভাই আমি হাত মুটিয়ে রেখেছি নিতে পারবে না।
কি যে বলো বোন আজকালের যা অবস্থা, পকেট শুদ্ধ টাকা চিনতাই হয়ে যাচ্ছে কেউ টের পাচ্ছে না।আর তুমি বলছ হাত থেকে নিতে পারবে না,এটা কোন কথা হলো?টাকাগুলো আমাকে দাও, আমি মানিব্যগে রাখি, ষ্টেশনে গেলে দিয়ে দেব।
আমেনা খাতুন আর অমত করলো না,টাকাগুলো লোকটির হাতে দিলো।ষ্টেশন আসতে লোকটি রিক্সা থেকে নেমে পুটলাটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
বোন এই নাও তোমার টাকা।
আমেনা খাতুন টাকার পুটলাটা নিয়ে টিকেট কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল।টিকেট কিনতে পুটলাটা খুলে দেখে টাকা নেই পুরা পুটলা কাগজ দিয়ে ভরা।সে এগিয়ে এসে চারদিক তাকাল। দেখল লোকটা ষ্টেশনের একটু দূরে আঁড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তখনি আমেনা খাতুন আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে খপ করে ধরে বলল,
এই মানুষরুপি জানোয়ার?ভাই সেজে আমার মতো অসহায় নারীর টাকা চিনতাই করলি?তোর বিবেকে একটু ও বাঁধল না।তাড়াতাড়ি আমার টাকা দে।তা না হলে আমি তোকে পুলিশে দেব।
লোকটি আমেনা খাতুনকে কড়া ধমক দিয়ে বলল,
এই মিথ্যে বলার আর জায়গা পাওনা না না?এমন অভিনয় আর কজনের সাথে করেছ? কে নিয়েছে তোমার টাকা?ছাড় বলছি আমাকে।তানা হলে…।
তানা হলে কি করবি?,থামলি কেনো বল?কথায় বলে না চোরের বড় গলা।ভালোই ভালোই টাকা দেহ্,। তানা হলে কপালে খারাপি অছে।
বললে হলো ছাড় বলছি আমাকে?
আমেনা খাতুন কিন্তু থেমে থাকল না।তর্ক করে চলেছে।তখনি ঘটনাস্থলে লোকজন ও পুলিশ উপস্থিত হলো।দুজনকে থানায় ধরে নিয়ে গেল।প্রথমে পুলিশ লোকটির জবান বন্দি শুনল।তারপর আমেনা খাতুনের জবান বন্দি শুনতে চাইলে সে তার অসহায় জীবনের সকল ঘটনা পুলিশের কাছে প্রকাশ করলো।সবকথা শুনার পর পুলিশ বারেক’র বিরুদ্ধে নারী পাচারের মামলা দায়ের করলো।অপরিচিত লোকটাকে ও রেহাই দিলো না। চিনতাইকারী হিসেবে মামলা দায়ের করে জেলে দিলো।তারপর অসহায় আমেনা খাতুনকে পুলিশের হেফাজতে গ্রামের বাড়িতে পৌছে দিলো।আর বারেককে ও ছাড়ল না।দ্রুত গতিতে এরেস্ট করে থানায় নিয়ে গেল।
ঃসমাপ্তঃ

সুন্দর লিখেছেন🖤