“খাবি না তো? তাহলে আয় তোদের খাই।” বলেই বাচ্চাটা উঠে দাড়ালো। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই বাচ্চাটা কেমন একদম আলীর সামনে এসে দাড়ালো। এতোক্ষণে আলীর বোধগম্য হলো নিজেদের বাচতে হবে। মাহিনকে বাচাতে হবে। যে চলে গেছে তাকে তো আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। তবে আর কাউকে যেনো এমন নির্মম মৃত্যুর শিকার না হতে হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে।
এসবের মাঝেই বাচ্চাটা তার একহাত দিয়ে আলীর গলা চেপে ধরলো। মাহিন খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো। বাচ্চাটি নিজের আরেক হাত লম্বা করে মাহিনের দিকে হাত বাড়িয়ে মাহিনেরও গলা চেপে ধরলো। অতঃপর দুজনকেই শূন্যে ভাসিয়ে নিলো।
এদিকে আলী ও মাহিন দু’জনেই মুক্তির আশায় গলা কাটা মুরগির ন্যায় ছটফট করতে লাগলো। উভয়ের’ই জান যায় যায় অবস্থা। কিন্তু এভাবে হেরে গেলে তো চলবে না। বিশেষ কিরে এই অশুভ শক্তির হাতে তো কোনো ক্রমেই না।
এসবে মাহিনের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। কি করে মুক্তি পাবে এই বাচ্চার হাত থেকে তা বুঝতে পারছে না। কিন্তু আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে মৃত্যু নিশ্চিত। আর যতোটুকু সম্ভব আলী নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে। আলী নিজের মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করে আয়তুল কুরসি পড়তে আরম্ভ করলো, তাও জোরে জোরে একপ্রকার চিৎকার করে। আলীর এই কাজে বাচ্চাটাকে বিচলিত হতে দেখে গেলো। মাহিন বুঝে গেলো এখন মাহিনকে কি করতে হবে। যদিও মাহিনের মাথা শূন্য হয়ে আছে। সূরা পড়তে গিয়ে বারবার গুলিয়ে ফেলছে। সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তাই মাহিন এবার আলীকে অনুসরণ করতে লাগলো। আলীর উচ্চারিত প্রতিটি বাক্য নিজে উচ্চারণ করতে লাগলো। আর এটা কাজেও লাগলো বটে। বাচ্চাটা একসময় জোরে এক চিৎকার দিয়ে ছেড়ে দিলো আলী ও মাহিনকে।
বাচ্চাটার থেকে ছাড়া পেতেই আলী ও মাহিন জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিলো কয়েকবার। তারপর আলী আরো কিছু সূরা ও কুরআনের আয়াত পড়ে নিজের ও মাহিনের গায়ে ফু দিলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো হঠাৎ করে বাচ্চাটা গায়েব হয়ে গেছে। সত্যি কি বাচ্চাটা গায়েব হয়ে গেছে নাকি এখানেও লুকিয়ে আছে অন্য কোনো রহস্য?
“এএতোক্ষণ যযা হলো সসব সত্যি ছিলো নাকি ভভ্রম?” মাহিন তোতলানো স্বরে জিজ্ঞেস করলো আলীকে।
“জানি না। তবে এখান থেকে পালাতে হবে।”
“কিন্তু রমেশ!”
মাহিন রমেশের নাম নিতেই আলী চারপাশটা একবার ভালোভাবে দেখলো। কিন্তু আশেপাশে কোথাও রমেশের কোনো চিহ্ন নেই।
“চল একবার ওই কুড়েঘরে দেখে আসি।” বলে উঠে দাড়ালো আলী।
এখনও সবকিছু কেমন স্বপ্ন মনে হচ্ছে দুজনের কাছে। মনে হচ্ছে এতোক্ষণ যা হলো সব একটা দুঃস্বপ্ন। এটা ভেবেই দুজনের মনে আশার প্রদীপ জ্বলেছে। হয়তো ওই কুড়ে ঘরটায় গিয়ে দেখবে রমেশ নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে।
দুজনে যখন কুড়েঘরে প্রবেশ করলো তখন দেখলো রমেশ বসে আছে। সত্যিই কি এটা রমেশ? নাকি রমেশের আদলে অন্য কেউ? আলী ও মাহিন দুজন দুজনের দিকে তাকালো। দুজনের কাছে সব কিছু কেমন গোলকধাঁধার মতো হয়ে গেছে। কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা দুজনের কেউ’ই বুঝতে পারছে না। শুধু সব কিছু কেমন ধোয়াশার মতো মনে হচ্ছে।
এখানের এই নিরবতা ভঙ্গ করে রমেশ বললো,”জায়গাটা মোটেও সুরক্ষিত নয়। চল এখান থেকে পালাতে হবে। ওরা চলে আসার আগে এ জায়গা ত্যাগ করতে হবে।”
কথাটি বলে দাঁড়িয়ে পড়লো রমেশ। আলী ও মাহিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো তারা রমেশকেই দেখছে। রমেশ সামান্য হেসে বললো,”এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন তোরা? ভয় পাচ্ছিস?”
“না না, ভয় কেন পাবো? চল এখান থেকে। জায়গাটা মোটেও ভালো না।” মাহিন বললো।
তবে আলী কিছু বললো না। আসলে আলী বুঝতে পারছে না কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা। তাই আলী রমেশকে পরখ করতে লাগলো।
তিনজন দ্রুতবেগে হেটে যেতে লাগলো এই জায়গা থেকে বের হওয়ার জন্য। কিন্তু চারপাশ থেকে কেমন যেনো আঁশটে গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে এই গন্ধের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
“আশেপাশে কোনোদিকে না তাকিয়ে দুজনে হাত ধরে দৌড় দিবি তোরা বুঝেছিস? আর তোরা তোদের কুরআনের যতো আয়াত সূরা জানিস সব পড়তে থাকবি। যতোক্ষণ না এই এলাকা ছাড়ছিস ততোক্ষণে থামবি না। আর সোজা বাড়ি যাবি না আগে মসজিদে যাবি। আমরা যেপথে এসেছি সে পথেই বড় এক মসজিদ আছে।” ভীত স্বরে বললো রমেশ। আলী প্রতিত্তোরে কেবল হুম বললো। কেন যেনো আলীর কাছে রমেশকে একটু অন্যরকম লাগছে।
মাহিন আলীর হাত ধরে রমেশের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো রমেশের হাত ধরার জন্য। কিন্তু রমেশ সরে দাড়ালো। মাহিন রমেশের দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি নিক্ষেপ করলে রমেশ বললো,”আমার কথা ভাবিস না। আমার আর কিছুই হবে না। তোরা যা প্লিজ, বেশি সময় নেই। ওরা এখনি এসে পড়বে।”
“ওরা কারা?” আলী জিজ্ঞেস করলো।
“সময় হলেই সবটা জানতে পারবি। তোদের আমাদের বন্ধুত্বের দোহায় লাগে যা প্লিজ। আমার কথাটা একটু শোন। আমি তোদের পিছনেই থাকবো।” রমেশ প্রতিত্তোরে বললো।
আলী আর মাহিন আর কোনো উপায় না পেয়ে দুজনে হাত ধরে দৌড়াতে শুরু করলো। সাথে যে যতো সূরা ও কুরআনের আয়াত জানে সব পড়তে লাগলো। রমেশের কথা মতো মসজিদের দেখাও পেয়ে গেলো। তাই কোনো কিছু না ভেবেই মসজিদে প্রবেশ করলো দুজনে।
মসজিদে প্রবেশের পর দুজনে বুঝলো রমেশ ওদের সাথে নেই। এদিকে দুজনের শব্দ পেয়ে মসজিদের ইমাম সাহেব ভিতর থেকে তাদের দিকে এগিয়ে এলেন। উনি একটু আগেই উঠেছেন আজান দেওয়ার জন্য।
দুজনকে দেখে ইমাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,”তোমরা কারা বাবা? আর তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে তোমরা অনেক ভয় পেয়েছো!”
তারপর আলী ও মাহিন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটা খুলে বললো। আর ইমাম সাহেবও খুব মনোযোগ সহকারে সবটা শুনলেন। দুজনের পুরো কথা শুনার পর ইমাম সাহেব সূরা পড়ে দুজনের গায়ে ফু দিয়ে দিলেন। আর বললেন,”তোমরা ভালো করেছো বাড়ি না ফিরে সোজা এখানে এসে। নয়লে তোমাদের পিছু পিছু এই দুষ্টু জ্বিন গুলোও তোমাদের বাড়ি পৌছে যেতো। এরা খুবই খারাপ জ্বিন। এদের তোমরা পিশাচও বলতে পারো। তোমাদের ভাগ্য ভালো তোমরা বেঁচে ফিরেছো।”
মাহিন ও আলী দুজনেরই নিজেদের কেমন পাগল পাগল মনে হচ্ছে। দুজন বুঝতে পারছে না কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা। রমেশের মরে যাওয়াটা সত্যি ছিলো নাকি বেঁচে থাকাটা! আর বেঁচে থাকলে হুট করে কোথায় গায়েব হয়ে গেলো?
সূর্য উঠার পর আর দুজনে বাড়ি যায় নি। সকাল দশটার দিকে মসজিদের ইমাম সাহেবকে নিয়ে কালকে রাতের সেই শশ্মানে গেলো। সেখানে গিয়ে দেখলো অনেকগুলো লোক একটা জায়গায় ভিড় জমিয়ে রেখেছে। সেই ভির ঠেলে দুজন যখন দেখতে গেলো ভিড়ের কারন তখন দেখলো রমেশের রক্তাক্ত দেহটা পড়ে আছে। এক হাত ও মাথা নেই। মাথা ও হাতের জায়গায় কলাগাছের পাতা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।
সেদিন আশেপাশের অনেক জায়গা খুজে দেখা হয়েছে কিন্তু কোথাও রমেশের মাথা ও হাত খুজে পাওয়া যায় নি।
কেটে গেলো অনেকটা সময়। এখন আর আলী ও মাহিনের বাহিরে ঘুরতে যওয়া হয় না। এই ঘুরতে যাওয়ার জন্যই তো প্রাণ হারালো রমেশ। সেদিন রাতে যদি ঘুরতে বের না হতো তাহলে আজ রমেশ সবার মাঝে বেঁচে থাকতো।
কিন্তু এতোকিছুর মাঝেও আলী ও মাহিনের মনে হয় রমেশ এখনো ওদের সাথে আছে। কেননা রাতে কখনো কোনো প্রয়োজনে বাহিরে গেলে একটা ছায়া সবসময় তাদের সাথে থাকে। আবার কখনো কখনো মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে জানালা দিয়ে দেখা যায় রমেশ বাড়ির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে চোখ পড়ে গেলে মলিন হেসে অদৃশ্য হয়ে যায়। এখন মাহিন ও আলীর মনে কেবল একটাই প্রশ্ন জাগে। এটা কি সত্যিই রমেশ? নাকি রমেশের বেশে অন্য কেউ!
~সমাপ্ত

ভালো লিখেছেন কবি