শশ্মানের সেই রাত। পর্ব-০৩। সুমাইয়া আক্তার বৃষ্টি

0

 

ঘড়ির কাটা জানান দিচ্ছে এখন রাত তিনটে বেজে দুই মিনিট। মাহিন ভয়ে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে। আর মনে মনে সকল প্রকার সূরাহ, কোরআনের আয়াত পড়ে যাচ্ছে যা সে জানে। বাকি দুজন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। মাহিন ওদের ডাকেনি কারন একটাই। ওরা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে ঘুমোক। ওদের কেনো ডেকে ভয়ে ফেলবে মাহিন? কিন্তু মিনিট পাচেক পরেই আলী আড়মোড় ভেঙ্গে উঠে বসলো। আর দেখলো মাহিন আগুনের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বিরবির করে বলছে। আর রমেশ ঘুমোচ্ছে। আলী যে উঠে বসে আছে সেটা এখনো মাহিন খেয়াল করেনি। মাহিন তো এখন নিজের মাঝে ডুবে আছে। তার আশেপাশে কি হচ্ছে সেদিকে কোনো ধ্যান নেই। আর না মাহিন চায় ধ্যান দিতে। মাহিনের ভয় হয়, আবার যদি কিছু হয় তাহলে? আলী কিছুক্ষণ মাহিনের দিকে তাকিয়ে রইলো। মাহিনকে কেমন যেনো একটা দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো কিছু একটা নিয়ে ভয়ে আছে। সাথে করে একটু পর পর মাহিনের দেহ মৃদু ভাবে কেঁপে উঠছে। আগুনের তেজ তো এখন অনেকটাই কম। হয়তো শীত করছে। এটাই ভেবে নিলো আলী। তারপর আশেপাশে কিছু একটা খুজতে শুরু করলো। আর পেয়েও গেলো। মাহিনের ওপাশটায় কিছুটা শুকনো ডাল পরে আছে। আলী উঠে ডাল গুলো নিয়ে আবার আগের যায়গায় ফিরে এলো। এখনো মাহিনের কোনো হেলদোল নেই। তার পাশ থেকে আলী উঠে ডাল এনে আবার বসলো তাও মাহিন একটু আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো না। আলী একপলক মাহিনের দিকে তাকিয়ে আবার আগুনের দিকে তাকালো। তারপর শুকনো ডালগুলো একে একে আগুনে দিয়ে আগুনের পরিমানটা বাড়িয়ে দিতে দিতে মাহিনকে শুধালো,”কিরে, ঘুমোস নি?”

এতোক্ষণে মাহিন আলীর দিকে চোখ তুলে তাকালো। আর বললো,” তু তুই? উঠে পড়লি যে?”

আলী মাহিনের চোখের দিকে তাকালো। মাহিনের চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভয় যেন উপচে পড়ছে, শরীর এখনো ক্ষণে ক্ষণে কেপে উঠছে।

“কিরে তুই কি কিছু নিয়ে ঘাবড়ে আছিস?”

আলীর প্রশ্নে মাহিন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। মূলত মাহিন চায় না তার প্রাণপ্রিয় দুই বন্ধুকে ভয়ের মধ্যে ফেলতে। তাই অমতা অমতা করে বলতে লাগলো,”ক কই না তো। আ আমি ভয় পেতে যা যাবো কেন?”

“এভাবে তুতলাচ্ছিস কেন? কোনো কিছু নিয়ে ঘাবড়ে আছিস? বল আমাকে মাহিন। আমি আছি তো।”

” আরে না না, তেমন কিছুই না। ঘুমো তুই।”

“তুই ঘুমোবি না?”

“ঘুম আসছে না। একটু পর ঘুমোবো।”

আলী আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। কারন আলী বুঝে গেছে মাহিন কিছু বলবে না এখন। তাই আলী চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো। আর একটু পর পর চোখ মেলে মাহিনের দিকে খেয়াল রাখতে শুরু করলো।

তিনটা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট। এতোক্ষণ যাবত চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকার দরুন আলীর মাঝে ঘুমের ভাবটা অনেকটাই চলে এলো। হয়তো একটু পরই আলী ঘুমের গভীর অতলে তলিয়ে যাবে। কিন্তু হঠাৎ করে আলীর মনে হলো বাহির থেকে কয়েকজন লোকের আনাগোনার শব্দ পাচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটা এতোটা আমলে নিলো না আলী। তন্দ্রায় তলিয়ে যেতে লাগলো।

মিনিট তিনেক পরেই আলী ধরফরিয়ে উঠে বসলো। এভাবে উঠতে দেখে মাহিন কিছুটা ঘাবড়ে গেলো। কেননা প্রথমে রমেশ, পরে মাহিন দুজনের সাথেই কিছু না কিছু একটা হয়েছে। সেই হিসেবে এখন আলীর পালা। এটা ভেবেই মাহিন উৎকন্ঠা নিয়ে আলীকে শুধালো,”কি হয়েছে আলী? এভাবে উঠে বসলি যে?”

আলী বিচলিত হয়ে বললো,”মনে হলো কে জানি আমার সারাদেহে বাজে ভাবে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। আর গলার ডান পাশটায় নখ দাবিয়ে দিয়েছিলো।”

মাহিন চায় না আলী ভয় পাক। তাই আলীর মন থেকে ব্যাপারটা সরিয়ে ফেলতে চাইলো।

“ওটা তোর ভ্রম হয়তো। ঘুমিয়ে পড়।”

“হবে হয়তো। কিন্তু তুই ঘুমোচ্ছিস না কেন?”

“আমার ঘুম আসছে না। তুই ঘুমিয়ে পড়।”

আলী মাহিনের কথা মতো চোখ বন্ধ করে নিলো। কিন্তু কি একটা ভেবে জানি গলার ডান পাশে হাত দিলো। কেমন ভিজা ভিজা লাগছে জায়গাটা। হাতটা সামনে এনে ধরতেই নজরে পড়লো রক্তজবার মতো তরল পদার্থ। আলী ভাবতে লাগলো কি ছিলো এটা। আসলেই কি ভ্রম? নাকি অন্য কিছু? তবে আলী মুখে টু শব্দটিও করলো না। একবার মাহিনের পানে তাকালো। আলীর কেন জানি মনে হচ্ছে মাহিন এই বিষয়ে কিছু একটা জানে।

আলী আবারও শুয়ে পরলো। খানিক সময় পর আলী আবারও উঠে বসলো। কি যেনো একটা বুঝার চেষ্টা করছে। তা দেখে মাহিন আবারও ভয়ে ভয়ে শুধালো,”কিরে? আবার উঠে পড়লি যে?”

আলী নিজের তর্জনী আঙুল ঠোঁট যুগলের উপর রেখে ধ্যান দিয়ে কিছু একটা শুনার চেষ্টা করতে লাগলো। তারপর মাহিনকে শুধালো,”তুই কি কোনো কান্নার স্বর পাচ্ছিস?”

মাহিনের ভয়টা এবার বেড়ে গেলো। তবে কি সেই কান্নার স্বর আলীও শুনতে পাচ্ছে?

“ও কিছু না। সব তোর মনের ভুল। শুয়ে পড় তো তুই।”

আলী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মাহিনের চোখের দিকে।

“তুই কি কিছু লুকোনোর চেষ্টা করছিস আমার থেকে?”

“আব নাহ তো! আমি কি লুকোনোর চেষ্টা করবো?”

“জানিস মাহিন, কান্নার স্বরটা অত্যন্ত করুন। শুনে আমারই গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এই স্বর শুনে মনে হচ্ছে যে কাদছে তার থেকে তার অনেক প্রিয় কিছু হারিয়ে গেছে। এতো রাতে এখানে কে এভাবে কাঁদছে চল তো গিয়ে দেখি।”

“আলী সব তোর মনের ভুল। ধ্যান দিস না ওইদিকে।শুয়ে পড় প্লিজ।”

কিন্তু আলী শুনলো না। আলী দ্রুত গতিতে উঠে বাহিরে চলে গেলো। আর তা দেখে মাহিন ভয় পেয়ে গেলো। কারন হিসাব মোতাবেক এবার যে আলীর পালা। তাই ভেবেই মাহিনও ছুটলো আলীর পিছু। কুড়ে ঘরটাতে রয়ে গেলো শুধু রমেশ। যে কি-না গভীর তন্দ্রায় তলিয়ে আছে। তবে ভাঙ্গবে কি এই তন্দ্রা কভু? জেগে উঠবে কি রমেশ?

আলীকে মাহিন নানা ভাবে থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আলী থামবার পাত্র নয়। আলী জানতে চায় এতো রাতে এখানে কে কান্না করছে। তবে একটা জিনিস আলীর নজরে এলো। আর তা হলো এটা একটা শশ্মান। যা দেখে আলী খানিকটা আঁচ করে নিলো এই কান্নাটা কিসের হতে পারে। কারন সাধারণ কোনো মেয়ে এতো রাতে এভাবে এখানে কাঁদবে না।

আলী একসময় দাঁড়িয়ে পড়লো। অতঃপর মাহিনের দিকে ঘুরে শুধালো,”মাহিন তুই কি সত্যি কিছু লুকোচ্ছিস না?”

মাহিন বুঝতে পারলো এই মুহূর্তে আলীকে সবটা বলে দেওয়া উচিত। তাই মাহিন শুরু থেকে সবটা খুলে বললো আলীকে। এরই মাঝে কান্নার স্বর থেমে গেলো। তবে দূর হতে ভেসে আসতে লাগলো শিয়ালের ডাক। একাধারে বেশ কয়েকটা শিয়াল ডেকে যাচ্ছে। এই গুমোট পরিবেশে ডাকটা অত্যন্ত ভয়ানক শুনাচ্ছে। হীম শীতল বাতাস শুয়ে দিয়ে যাচ্ছে তাদের। মনে কেমন অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। শরীরের পশম কাঁটা দিয়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে।

একসময় তাদের মনে হলো পাশ থেকে কেমন একটা অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসছে। কি সেটা দেখার জন্য দুজনেই যখন সেদিকটায় তাকালো দুজনকেই এক অপ্রত্যাশিত ঘটনার সাক্ষী হতে হলো। যা তারা কস্মিনকালেও ভাবতে পারে নি।

তারা দেখলো সাত বছরের ছোট্ট ফুটফুটে এক বাচ্চা মেয়ে রমেশের হাতটা চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। রমেশ পড়ে আছে রক্তাক্ত অবস্থা। অর্ধেকটা মাথা কেমন
থিতলে গেছে। মনে হচ্ছে ভারী কিছু দিয়ে একাধিক বার আঘাত করা হয়েছে। চোখ যুগল খোলা। মনে হচ্ছে এই চোখ যুগল কিছু বলতে চাইছে।

মাহিন আর আলী বুঝতে পারছে না এই মুহুর্তে কি করা উচিত। দুজনের চোখ দিয়ে বর্ষার ন্যায় অঝোর ধারায় পানি পড়ছে। নিজেদের প্রাণপ্রিয় বন্ধুর এতোটা ভয়াবহ পরিণতি দেখতে হবে তা তারা স্বপ্নেও ভাবে নি। বার-বার মনে হচ্ছে এ কেবলমাত্র একটা বাজে স্বপ্ন। ঘুম ভাঙ্গলেই দেখবে রমেশ তাদের সাথেই আছে।

আলী এক পা সামনে যেতেই বাচ্চাটা ওদের দুজনের দিকে তাকালো। তারপর বিদঘুটে এক হাসি দিয়ে দুজনের উদ্যেশে শুধালো,”কিরে খাবি তোরা? দিবো তোদের?”

এই বলে রমেশের এক চোখ খাবলা মেরে তুলে ফেললো। সেটা দুজনের দিকে ধরে বললো,”নে খা। খেয়ে দেখ একটু।”

আলী ও মাহিনের এই অবস্থা দেখে মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করতে লাগলো। মনে হচ্ছে পুরো শরীর কাঁপছে। বুকের ভিতর অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে রমেশের এই হাল দেখে। এখান থেকে পালানোর কথাটাও তাদের মাথায় আসছে না। কেমন স্হির হয়ে দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছে দুজনে।

“খাবি না তো? তাহলে আয় তোদের খাই।” বলেই বাচ্চাটা উঠে দাড়ালো।

চলবে….


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

0

Sumaiya Akter Bristy

Author: Sumaiya Akter Bristy

❝শুভ্রচিন্তার উদ্ভব ঘটে যার কথা ভেবে সে যদি মোহ হয় দোষ বা কি তাতে?❞ ~Sumaiya Akter Bristy

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

গল্প চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ

চেয়ারম্যানের মেয়ে আফছানা খানম অথৈ মেহেরপুর একটি সুন্দর গ্রাম।এই গ্রামে কিছু অদ্ভুত নিয়মকানুন চালু আছে,যা অন্যকোন গ্রামে নেই।এই গ্রামে নারীরা

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ

গল্প মেয়েরা ও মানুষ আফছানা খানম অথৈ রানু বউ হয়ে এসেছে চার পাঁচ মাস হলো।এরই মধ্যে তার স্বামী স্কলারশিপ এর

গল্প মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ

মেয়ে সাক্ষী আফছানা খানম অথৈ আবিদ হায়দার বেড়াতে এসেছে গ্রামে তার বন্ধু ফুয়াদ'র বাসায়।অবশ্য সে একা না,তার সঙ্গে আছে,বন্ধু সজল

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ

গল্প বন্ধ্যা আফছানা খানম অথৈ আলেয়া বউ হয়ে এসেছে চার বছর হলো।এখনো মা হতে পারেনি। এজন্য রীতিমতো তাকে কটু কথা

One Reply to “শশ্মানের সেই রাত। পর্ব-০৩। সুমাইয়া আক্তার বৃষ্টি”

Leave a Reply