হযরত ইব্রাহিম আঃ এর জীবনী- লেখক ডট মি

হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর জীবনী

1

হযরত ইব্রাহিম (আ.) হচ্ছেন, মুসলিম  উম্মাহর জাতির পিতা এবং একমাত্র সত্য ধর্ম ইসলামের একজন কালজয়ী নবী ও রাসুল। তিনি হচ্ছেন আল্লাহর বন্ধু তথা খলিলুল্লাহ। যার নামে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে একটি সুরা পর্যন্ত নাযিল করেছেন। ইসলাম ছাড়াও, হযরত ইব্রাহিম (আ.) কে  ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মের অনুসারীরাও অনেক শ্রদ্ধা ভক্তি করে। আজ আমরা তাঁর জীবনীর কিছু উল্লেখযোগ্য দিক তুলে ধরব।

জন্ম পরিচয়

নূহ (আ.) এর ১১তম অধঃস্তন পুরুষ ছিলেন ইবরাহিম (আ.)। আর হযরত নুহ (আ.) থেকে ইব্রাহিম (আ.) পযর্ন্ত প্রায় ২০০০ বছরের ব্যবধান ছিল। হযরত সালেহর (আ.) এর প্রায় ২০০ বছর পরে ইবরাহিম (আ.) এর আগমন ঘটে। আনুমানিক খৃষ্ট পূর্ব ১৯০০ পূর্বাব্দ থেকে খৃষ্ট পূর্বাব্দে ১৮৬১ সালে হযরত ইবরাহীম (আ.) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মস্থান ধরা হয় পশ্চিম ইরাকের বছরার নিকটবর্তী ‘বাবেল’ শহরকে। তাঁর আনুমানিক মৃত্যু খৃষ্ট পূর্বাব্দ ১৮১৪ সাল থেকে খৃষ্ট পূর্বাব্দ ১৭১৬ সাল। তিনি পবিত্র ইসলাম ধর্মের একজন গুরুত্বপূর্ণ নবি এবং রাসুল। তাঁর নামে পবিত্র কুরআনে একটি সুরা রচিত হয়েছে। ইসলামের মতে তিনি হচ্ছেন  মুসলিম জাতির পিতা। কেননা হযরত আদম (আ.) থেকে হযরত ইব্রাহিম (আ.) পর্যন্ত যে সকল নবি রয়েছে, সেইসব নবি বাদে সর্বশেষ রাসুল মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত ১ লক্ষ ২৪ হাজার পয়গম্বরের প্রায় সবাই ছিলেন হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর বংশধর। একারণে ইসলাম ধর্ম ছাড়াও, ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মেও তাঁকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা এবং ভক্তি করা হয়। এবং তাদেরও ধর্মীয় পিতা বলে তারা দাবি করে। 

নবুওয়াত প্রাপ্তি ও দাওআত 

ইবরাহীম (আ.) যুগে তাঁর দেশে তখন নমরুদের রাজত্ব চলতো। নমরুদ প্রায় ৪০০ বছরও বেশী রাজত্ব করেন। তৎকালীন সময়ে সবাই মূর্তি পূজা করত। যা কখনোই ইব্রাহিম (আ.) ছোট থেকেই মেনে নেননি। যখনই তাঁর জ্ঞান হয়েছে তখনই তিনি মনে করেছেন সূর্য ই বোধহয় আমার রব। কিন্তু দিনের শেষে সূর্য যখন ডুবে যায়, তখনই তাঁর জ্ঞানে তিনি বুঝতে পারেন, সূর্য কখনোই তাঁর রব হতে পারে না কেননা যে সত্যিকারের বর তাঁর কোনো মৃত্যু নেই। এরপর তিনি রাতের তারা দেখে চিন্তা করতে লাগলেন। এই তারারাই বোধহয় আমার রব। কিন্তু রাতের শেষে তারার অস্তিত্ব মিলিয়ে গেলে তিনি বুঝতে পারলেন তারারও নিজস্ব কোনো অস্তিত্ব নেই।

এরপর তিনি অপরূপ সুন্দর চাঁদকে দেখে মনে করলেন, চাঁদই তার রব। কিন্তু রাতের শেষে চাঁদের আলো মিলিয়ে গেলে তিনি বুঝতে পারলেন, চাঁদেরও কোনো নিজস্বতা নেই। এরপর আল্লাহ তাঁকে তাঁর নিজস্ব সত্তার সন্ধান দিলেন। যে সত্তা চির অবিনশ্বর, চিরঞ্জীব। আর সেই স্বত্তা হলো, আল্লাহ। আর এভাবেই হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর সত্যিকারের সন্ধান পেলেন। এরপর আল্লাহ তাঁকে নবুওয়াত দান করলেন। নবুওয়াত পাওয়ার পরই তিনি তাঁর জাতিকে ইসলামের দাওআত দিতে লাগলেন। কেননা হযরত ইবরাহিম (আ.) ছোট থেকেই দেখতে পেয়েছেন যে,  তার জাতি মূর্তি, চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র ইত্যাদির পূজাতে ব্যস্ত। তাদের মধ্যে আল্লাহর একত্ববাদ, মহত্ত্ব ও কুদরত ইত্যাদি কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই।  এই ধরনের পরিস্থিতে হযরত ইবরাহিম (আ.) তাঁর জাতির কাছে আল্লাহর উপর ভরসা করে সত্যের দাওয়াত নিয়ে উপস্থিত হলেন।

কিন্তু তাঁর জাতি তার কথায় কোনো কর্ণপাত করলো না। বরং তারা তাঁকে মূর্তি পূজা না করার কারণে ভৎসনা দিতে লাগলো। এমনকি তাঁর পিতাও তাকে মূর্তি পূজা করার জন্য চাপ দিতে লাগলেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গেলো যে, কোনো মতেই তিনি তাঁর জাতিকে বুঝাতে পারলেন না যে, এই মূর্তি কখনোই কারো উপকার কিংবা অপকার করতে পারে না। এমনকি তারা নিজেদেরও কোনো উপকারে লাগে না।

এমতাবস্থায় কোনো এক উৎসবের দিন সবাই নিজ এলাকা ছেড়ে উৎসবের মেলায় চলে গেলে, তিনি তাঁর জাতির উপাসনালয়ে গিয়ে কুড়াল দিয়ে সকল মূর্তি গুলো ভেঙ্গে দিলেন। এবং যে কুড়ালটি দিয়ে সব ধ্বংস করলেন, সেই কুড়ালটি তিনি বড় মূর্তির কাঁধে রেখে দিলেন।

মেলা শেষে যখন সবাই উপাসনালয়ে প্রার্থনা করতে আসলো, তখন দেখলো কে যেন তাদের সকল মূর্তিগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। আবার এও দেখলো, তাদের বড় মূতিটির কিছুই হয়নি এবং তার কাধে কুড়াল রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে, বড় মূর্তি যেন অন্যান্য সকল মূর্তিকে ভেঙ্গে দিয়েছে।

এই অবস্থায় সবাই বলাবলি করলো, আমরা সবাই উৎসবে গেলেও ইব্রাহিম কিন্তু উৎসবে যাইনি। সুতরাং সে ই বলতে পারবে, কে আমাদের মূর্তি গুলোকে ধ্বংস করেছে। এছাড়াও আমাদের মূর্তি গুলোর সাথে কারোরই শত্রুতা নেই একমাত্র ইব্রাহিম ছাড়া। সুতরাং সেই এর পেছনে জড়িত থাকতে পারে।

এরপর সবাই গিয়ে তাঁকে ধরল। বললো, আমাদের মূর্তির এই অবস্থা কেমনে হলো? সে বলল, এই মূর্তি গুলোর এই অবস্থা কেমনে হলো, তা আমাকে জিজ্ঞাসা না করে, মূর্তিদের জিজ্ঞাসা করো। ঐযে যে বড়টা কাঁধে কুড়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেননা আমার তো মনে হচ্ছে, এই সবগুলোকে ঐ বড়টাই ধ্বংস করেছে।

তাঁর কথা শুনে তাঁর জাতির লোকেরা বলল, ইব্রাহিম তুমি তো জানো, এই মূর্তিরা কোনো কথা বলতে পারে না। তখন ইব্রাহিম (আ.) বললেন, দেখো তোমরা এমন সব মূর্তিকে ইলাহ মনে করো, যে নিজে কোনো কথা বলতে পারে না, নিজের কোনো উপকার করতে পারে না। তাকে কেউ ধ্বংস করলে, তাকেও বাধা দিতে পারে না। তাহলে কেন তোমরা এই মূর্তির ইবাদত করো?

হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর কথা শুনে তাঁর জাতির লোকেরা বুঝে নিল যে, এই ইব্রাহিমই তাদের মূর্তি গুলোকে ধ্বংস করেছে। এভাবেই হযরত ইব্রাহিম তাঁর জাতিকে মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে দাওআত দিয়ে গেছেন। 

নমরুদের অগ্নিকুন্ড ও ইব্রাহিম (আ.) কাহিনী

যখন হযরত ইব্রাহিম (আ.) তাঁর জাতিকে মূর্তির বিরুদ্ধে দাওআত দিচ্ছিল, তখনই একদল তাঁর বিরুদ্ধ তৎকালীন তাদের বাদশা নমরুদকে বিচার দিল। তৎকালীন সময়ে ইরাকের বাদশাদের উপাধি ছিল নমরুদ। তিনি নিজেকে খোদা ও মালিক বলে দাবি করতো। যখন ইব্রাহিমের এক আল্লাহর দাওআত চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো, তখনই নমরুদ চিন্তা করলো, যদি ইব্রাহিমের (আ.) এক আল্লাহর দাওয়াত এভাবে দিতে থাকে, তাহলে তার রাজত্ব শেষ হয়ে যাবে। কাজেই নমরুদ চাইলেন ইব্রাহিম (আ.) কে ধ্বংস করার। তাই তিনি তাঁকে তার দরবারে হাজির হতে বললেন। তখন  নমরুদ হযরত ইব্রাহিম (আ.) কে  প্রশ্ন করলেন, কেন তুমি পূর্ব পুরুষদের সৃষ্টি করা ধর্মের বিরোধিতা করো। এবং  আর আমাকেও খোদা মানতে অন্বীকার কর ?

তখন ইব্রাহিম (আ.) বললেন, আমি এক আল্লাহর ইবাদত করি। তার সাথে কাউকে শরিক করিনা। আর এই সমস্ত বিশ্ব-জগৎ তার একক সৃষ্টি করা। তিনি সবকিছুর স্রষ্টা ও মালিক। আমি ও তুমিসহ পৃথিবীর সব কিছুরই  তার একক সৃষ্টি। তাছাড়া তুমি একজন মানুষ। তুমি মূর্তির পূজা কর। অথচ এই মূর্তি কিছুই করতে পারে না। সুতরাং তুমি কিভাবে রব হতে পার?

তখন নমরুদ তাঁকে বললো, তোমার আল্লাহর এমন কোনো গুণ বলো যা আমার মধ্যে নেই? তখন আল্লাহর নবি বলেন, আমার রব  মহান আল্লাহ হচ্ছেন জীবন ও মৃত্যুর মালিক। তখন নমরুদ নিজেকে জীবন-মৃত্যুর মালিক প্রমাণের জন্য তার দরবারের একজনকে হত্যা করলো এবং একজন মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিকে তার অপরাধ ক্ষমা করে দিল। আর এভাবেই সে নিজেকে প্রমাণ দিলো যে সেও জীবন-মৃত্যুর মালিক।

নমরুদের এমন হাস্যকর দাবির পর নবি বললেন, আমর মহান আল্লাহ সূর্য্যকে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে নিয়ে যান। এখন তুমি এর বিপরীতমুখী পরিচালনা কর। হযরত ইব্রাহিম (আ.) এগুলো এই কথায় নমরুদ হতবাক ও নিরুত্তর হয়ে পড়ল। 

তার নিজের এই অপারগতায় নমরুদ অপমানে রাগান্বিত হয়ে উঠলো। এদিকে ইব্রাহিম (আ.) এর বিরুদ্ধে যৌক্তিক কোনো অপরাধ ছিলো না। তবুও তিনি তাদের দেবতাদের অপমান করা ও পূর্ব-পুরুষদের ধর্মের বিরোধিতা করার কারণে তারা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো যে, তারা হযরত ইব্রাহিমকে (আ.) কে আগুনে জ্বালিয়ে মেরে ফেলবেন।

সকলের এই সিদ্ধান্ত যখন বাস্তবে রূপ নিবে, তখন দেখা গেলো নবির বাবাও নবির শত্রু! তিনিও তার ছেলের কর্মে মর্মাহত। তাই তিনিও মেনে নিলেন তার সন্তানের আগত মৃত্যু। আর তার মৃত্যুর জন্য একটা নির্দিষ্ট স্থান বাছাই করা হলো। তারপর সেই জায়গায় কয়েকদিন ধরে আগুন জ্বালাতে লাগল। আগুনের তীব্র তাপে পাশের সকল জায়গা, গাছপালা ঝোপঝাড় সবকিছুই পুড়ে যাচ্ছিল।

এই মূহুর্তে কাউকে এখানে ফেলে দেওয়া মাত্রই সে ছাই হয়ে যাবে এমন নিশ্চয়তার পর নমরুদ নবিকে আগুনে ফেলে দিলেন। আর যে আগুনের মালিক হচ্ছেন মহান আল্লাহ, সেই মালিকই আগুনকে হুকুম দিলেন ঠান্ডা হয়ে যেতে। তাও আবার এমন ঠান্ডা, যা মানুষের জন্য আরামদায়ক। আর এভাবেই আল্লাহ তাঁর বন্ধু হযরত ইব্রাহিম (আ.) কে বাঁচিয়ে নিলেন। 

ইব্রাহিম (আ.) এর বিবাহ

হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর প্রথম স্ত্রী ছিলেন সারা। তাঁর সাথে কীভাবে ইব্রাহিম (আ.) এর বিয়ে হয়, সে বিষয়ে ইতিহাস থেকে জানা যায় না। তবে ইব্রাহিম (আ.) এর দ্বিতীয় স্ত্রী হচ্ছেন হাজেরা। যার সম্পর্কে তথ্য আসে যিনি ছিলেন কোনো এক রাজ্যের রাজকন্যা কিংবা দাসী। কোনটি সঠিক তা আল্লাহই ভালো জানেন।

এই দ্বিতীয় বিয়ের ঘটনা খুবই চমৎকার। হযরত ইবরাহীম (আ.) কে  যখন নমরূদ আগুনে ফেলে দিয়েছিলেন, তখন সকলেরই ধারণা ছিলো ইব্রাহিম নিশ্চয়ই ছাই হয়ে গেছে। তাই সবাই যে যার মতো চলে গেছে। পরবর্তীতে আল্লাহ তাঁর রাসুলকে সহী-সালামতে আগুন থেকে বের করে আনলেন। তারপর তখনও তার সম্প্রদায়ের লোকেরা ঈমানের স্বীকৃতি দিলো না।

এই অবস্থায় হযরত ইব্রাহিম সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি অন্য কোথাও চলে যাবেন। যেখানে তিনি স্বাধীনভাবে তাঁর রবের ইবাদত করতে পারবে। এরপর তিনি তাঁর স্ত্রী হযরত সারা (আ.) কে নিয়ে তার জাতি ও  নমরূদের নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য বাবিল শহর থেকে শাম দেশে হিজরত করলেন। এখানে জেনে রাখা উচিত, হযরত সারা (আ.) ছিলেন যুগের শ্রেষ্ঠ সুন্দরীদের একজন। এদিকে শাম দেশের বাদশার চরিত্র ছিলো খারাপ। তার  সভাবজাত ধর্ম ছিল যে কোন সুন্দরী মহিলা দেখলেই তার কাম বেড়ে যেতো।

এ জন্য সে তার দেশের বিভিন্ন স্থানে লোক নিয়োগ করে রেখেছিল। যাদের কাজই ছিল শুধু সুন্দরী সুন্দরী রমণী বিভিন্ন স্থান থেকে পাকড়াও করে বাদশার কাছে ধরে আনা। অতঃপর বাদশার কাছে পেশ করা। এমতাবস্থায় হযরত ইবরাহীম (আ.) তার স্ত্রীকে নিয়ে যখন বাবিলের সীমান্ত ছেড়ে  মিশরের সীমান্তে প্রবেশ করলেন, তখনই বাদশার লোকেরা হযরত ইবরাহীম (আ.) এর কাছে হাজির হয়ে জিজ্ঞেসা করলো, আপনার সাথে এই সুন্দরী মহিলাটি কে?

তখন হযরত ইবরাহীম (আ.) চিন্তা করলেন, কী করলে বা বললে তিনি তাঁর স্ত্রীকে হারাবেন না। কেননা তিনি জানতেন যে, কোনো মহিলার সাথে তার আপন ভাই অথবা পিতা থাকলে তাকে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় না। তাই তিনি বললেন, এ আমার বোন। অর্থাৎ ধর্মীয় বোন। এছাড়াও সারা ছিলেন তার চাচাতো বোন। তিনি চাচাতো

বোনকে বিবাহ করেছিলেন। সেদিক থেকেও তার স্ত্রী ছিলেন তার বংশগত বোন। এ কথা বলার পরও হযরত ইবারাহীম (আ.) রেহাই পেলেন না। 

বাদশাহর লোক হযরত ইব্রাহীম (আ.) কে বন্দী করে। একইসাথে হযরত সারাকে বাদশাহর কাছে উৎসর্গ করার জন্যে তার কাছে পাঠিয়ে দেয়। বাদশার কাছে হযরত সারা আসলে, বাদশাহর কু-প্রস্তাবে হজরত সারা রাজি হয় না। এদিকে বাদশাহ তাঁকে হত্যারও হুমকি দেয়।

এই অবস্থায় হযরত সারা দু’রাকা’আত সালাত আদায় করার অনুমতি চায়। বাদশাও তার কথা মতো তাঁকে সালাত আদায়ের ব্যবস্থা করতে দেয়। হজরত সারা সালাত শেষে আল্লাহ দরবারে ফরিয়াদ করেন, আল্লাহ যেন তাঁর ইজ্জত রক্ষা করেন। 

এদিকে স্ত্রী হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার কারণে সাথে সাথেই হযরত ইবরাহীম (আ.) আল্লাহর সাহায্যের জন্য  সালাতে  দাড়িয়ে গেলেন। এদিকে হযরত সারা সালাত শেষ হলে বাদশা তাকে নিজস্ব কামরায় অসৎ উদ্দেশ্যে চরিতার্থ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাদশা যখনই হযরত সারা (আ.) এর দিকে হাত বাড়াই  তখনই বাদশার হাত সম্পূর্ণ প্যারালাইজড হয়ে যায়। এই অবস্থায় বাদশা সাথে সাথেই হযরত সারা (আ.) এর কাছে ক্ষমা চায়। তখন হযরত সারা (আ.) এর দোয়ার বরকতে বাদশা আবার হাতের মধ্যে পূর্বের শক্তি ফিরে পেল। 

হাত ভালো হয়ে গেলে সে আবার অসৎ উদ্দেশ্যে হাত বাড়াতে চাইলে দ্বিতীয়বারও তার হাত বিকল হয়ে গেল। বাদশা একইভাবে আবার ক্ষমা চেয়ে দোয়া ভিক্ষা চাইলো। তখন আবারও হযরত সারা (আ.) দোয়া করলে তার হাত পুনরায় ভালো হয়ে যায়।  

এভাবেই সে আবারও তৃতীয় বারের মতো খারাপ উদ্দেশ্যে হাত বাড়াতে চাইলে তৃতীয় বারও তার হাত অবশ হয়ে গেল। বাদশা এবার অনেক কাকুতি মিনতি কারে ক্ষমা চাইলো এবং সে ওয়াদা করলো যে, আর কখনও সে এমন কাজ করবো না। তখন হযরত সারা (আ.) আবার আল্লাহর কাছে দোয়া করলে সে আবার হাতের মধ্যে পূর্বের শক্তি ফিরে পেল। অতপর বাদশা দেখে এই মহিলা খুবই সৎ এবং নেককার। তাই তিনি তার ভুল বুঝতে পেরে তাকে মুক্তি দিয়ে দিল। একইসাথে তাকে একটি বাঁদীও দিল। যার নাম ছিলো হাজেরা। 

হযরত সারা (আ.) ও হাজেরা উভয়ে হযরত ইবরাহীম (আ.) এর নিকট পৌঁছলেন। এরপর তিনি স্বামী ইব্রাহিম (আ.) কে তার সব ঘটনা খুলে বললেন। এবং বাঁদি হিসাবে হাজেরার কথাও বললেন। এদিকে এতদিন পর্যন্ত ইব্রাহিম (আ.) এর কোনো সন্তান ছিলো না। তাই হযরত সারা তাঁর বাদী হাজেরা কে বিয়ে করার জন্য ইব্রাহিম (আ.) কে বললেন। তিনি এও বললেন,  “হতে পারে এর মাধ্যমে হলেও আল্লাহ আপনাকে সন্তান দিবেন।” তার কথা হযরত ইব্রাহিম (আ.) বাঁদি হাজেরাকে আজাদ করে বিবাহ করলেন। একইসাথে দোয়া করলেন, “হে আমার রব! আমাকে এমন সন্তান দান করুন যে হবে সৎকর্মশীলদের থেকে। (সুরা সাফফাত, আয়াত-১০০)

এই দোয়ার ফলশ্রুতিতে হাজেরার (আ.) গর্ভে হযরত ইসমাঈল (আ.) এর জন্ম হয়। এদিকে হাজেরা মা হবার পর সারাহ (আ.) ও মা হবার ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু ঐ সময় ইব্রাহিম (আ.) এবং সারাহ (আ.) উভয়ই  জাগে কিন্তু সেসময় সারাহ ও ইবরাহীম দুজনই ছিলেন বৃদ্ধ। 

অতপর তারা আল্লাহর কাছে দোয়া করলে আল্লাহ তাদের ইচ্ছা পূরণ করেন। অর্থাৎ বৃদ্ধ বয়সেও তারা সন্তানের মুখ দেখল। এইবার হযরত সারা (আ.) এর গর্ভে হযরত ইসহাক (আ.) এর জন্ম হলো। যিনি ইসমাঈল (আ.) এর থেকে

১৩ বছরের ছোট ছিলেন।

ইব্রাহিম (আ.) এর সন্তানদের নাম

ইব্রাহিম (আ.) এর সরাসরি সন্তান কয়জন, তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। কোনো কোনো সূত্র মতে তার চার পুত্র ছিলেন। কিছু সূত্র মতে তাঁর ৬ থেকে ১২ জন পুত্র ছিল বলেও উল্লেখ আছে। তবে এটা ঠিক যে তাঁর সরাসরি পুত্র হিসেবে কেবল ইসমাইল ও ইসহাকের বর্ণনাটিই ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। অন্যদের ব্যাপারে ঐতিহাসিক উল্লেখযোগ্য তেমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। অন্যান্যদের ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের প্রমাণ খুবই দুর্বল।  যার ব্যতিক্রমে রয়েছে মাদিয়ান ও কান্তুরাহর গর্বে ইব্রাহিমের পুত্র। মাদিয়ান নামে তাঁর  বংশধরদের দ্বারাই একটি শহর তৈরি হয়েছিল। যে শহরের মধ্য হতেই শুয়াইব (আ.) আসেন এবং তাদের মধ্যে ইসলাম প্রচার করেন বলে কিছু কিছু ইতিহস থেকে জানা যায়।

ইব্রাহিম (আ.) এর বংশ তালিকা

ইব্রাহিম (আ.) কে যেহেতু ইহুদি খ্রিস্টান এবং মুসলিম সবাই মানে, সেহেতু তাঁর বিষয়ে নানান অভিমত পাওয়া যায়। একইভাবে তাঁর বংশধারা নিয়েও রয়েছে যথেষ্ট মতভেদ। ইমাম তাবারীর (রহ:) এর  মতে, ইব্রাহিম (আ.) এর  বংশ তালিকা হলো,  ইব্রাহিম, তিনি তাঁর পিতা  আযর, তিনি তার পিতা নাহুর, তিনি তার পিতা সারুগ, তিনি তার পিতা আরগু, তিনি তার পিতা ফালেগ, তিনি তার পিতা আবির, তিনি তার পিতা শালেখ, তিনি  তার পিতা কেনান, তিনি তার পিতা আরফাখশাদ, তিনি তার পিতা সাম, তিনি তার পিতা নূহ। 

তবে ইমাম ইবনে কাসীর এর বর্ণনা মতে- 

নূহ (আ.) থেকে সাম, সাম থেকে আরফাখশায, আরফাখশায থেকে শালেহ, শালেহ থেকে আবির, আবির থেকে ফালিগ, ফালিগ থেকে রাঊ, রাঊ থেকে সারুগ, সারুগ থেকে নাহুর, নাহুর থেকে তাসারুখ, তাসারুখ থেকে ইব্রাহীম। এভাবেই বংশধারা চলে এসেছে।

আমরা যদি ইব্রাহিম (আ.) থেকে মুহাম্মদ সাঃ পর্যন্ত একটি বংশধারা টানি, তাহলে তা দাঁড়াবে-

ইব্রাহিম থেকে পুত্র ইসমাইল এবং পুত্র ইসহাক, এভাবে তাঁর পুত্র ইয়াকুব, ভাগ্নে লুত,আবার ইয়াকুবের (আ.) এর ১২ পুত্র, ইউসুফ (আ.), মুসা (আ.), হারুন (আ.), দাউদ (আ.), সুলায়মান (আ.), আইয়ুব (আ.), ইয়াসা (আ.) ইউনুস (আ.), জাকারিয়া (আ.), ইয়াহিয়া (আ.), ইমরান (আ.), মরিয়াম (আ.), ঈসা (আ.) ইলিয়াস (নবী) (আ.), মুহাম্মদ সাঃ। এরা হচ্ছেন ইব্রাহিম (আ.) এর বংশধর যারা ছিলেন ইমানদার  নবি রাসুল (আ.)। যা সুরা আন আমের ৮৩ থেকে ৮৭ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। 

হযরত ইবরাহিম (আ.) থেকে তাঁর পুত্র ইসমাঈল, তাঁর পুত্র কায়দার থেকে তার পুত্র আরাম, তার পুত্র আওযা থেকে তার পুত্র মাযি,  তার পুত্র সুমাই থেকে তার পুত্র জারাহ, তার পুত্র নাহেছ থেকে তার পুত্র মাকছার, তার পুত্র আইহাম থেকে তার পুত্র আফনাদ, তার পুত্র আইশার থেকে তার পুত্র যায়শান, তার পুত্র আই থেকে তার পুত্র আরউই,  তার পুত্র ইয়ালহান থেকে তার পুত্র ইয়াহাজান, তার পুত্র ইয়াসরেবী থেকে তার পুত্র সুনবর, তার পুত্র হামদান থেকে তার পুত্র আদদায়া, তার পুত্র ওবায়েদ থেকে তার পুত্র আবকার,  তার পুত্র আয়েয থেকে তার পুত্র মাখি, তার পুত্র নাহেশ থেকে তার পুত্র জাহেম, তার পুত্র তারেখ থেকে তার পুত্র ইয়াদলাফ,  তার পুত্র বালদাস থেকে তার পুত্র হাজা, তার পুত্র নাশেদ থেকে তার পুত্র আওয়াম, তার পুত্র উবাই থেকে তার পুত্র কামোয়াল, তার পুত্র পোজ থেকে তার পুত্র আওছ,  তার পুত্র ছালামান থেকে তার পুত্র হামিছা, তার পুত্র আওফ থেকে তার পুত্র আদনান।

এভাবে ১২২ খ্রিস্টপূর্ব আদনান থেকে তার পুত্র মায়া’দ ৮৯ খ্রিস্টপূর্ব, তার পুত্র ৫৬ খ্রিস্টপূর্ব নাযার থেকে তার পুত্র মোদার ২৩ খ্রিস্টপূর্ব, তার পুত্র ১০ খ্রিষ্টাব্দে ইলিয়াস থেকে তার পুত্র মাদরেকা (আমের) ৪৩ খ্রিষ্টাব্দ, তার পুত্র ৭৬ খ্রিষ্টাব্দে খোযায়মা থেকে তার পুত্র কেনানা ১০৯ খ্রিষ্টাব্দ, তার পুত্র ১৪২খ্রিষ্টাব্দে নযর কায়েস থেকে তার পুত্র মালেক ১৭৫ খ্রিষ্টাব্দ, তার পুত্র ফাহার ২০৮ খ্রিষ্টাব্দে (কোরায়েশ উপাধি এবং তাঁর নামে কোরায়েশ গোত্র), তার পুত্র গালেব ২৪১ খ্রিষ্টাব্দে থেকে তার পুত্র লোয়াই ২৭৪ খ্রিষ্টাব্দে, তার পুত্র ৩০৭ খ্রিষ্টাব্দে কা’ব থেকে তার পুত্র ৩৪০ খ্রিষ্টাব্দে মাররা, তার পুত্র ৩৭৩ খ্রিষ্টাব্দে কেলাব থেকে তার পুত্র ৪০৬ খ্রিষ্টাব্দে কুসাই (যায়েদ), তার পুত্র ৪৩৯ খ্রিষ্টাব্দে আবদ মাননাফ (মুগীরা) থেকে তার পুত্র ৪৬৪ খ্রিষ্টাব্দে হাশেম (আমর), তার পুত্র ৪৯৭ খ্রিষ্টাব্দে আবদুল মোত্তালেব (শায়বা) থেকে তার পুত্র ৫৪৫ খ্রিষ্টাব্দে আবদুল্লাহ এবং তার পুত্র ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে হচ্ছেন মোহাম্মদ (সা.)

ইব্রাহিম (আ.) এর কোরবানির ইতিহাস

হযরত ইব্রাহিম এবং সারার ঘরে হযরত ইসমাইল (আ.) এর জন্মের পর, আল্লাহর এক আদেশে হযরত ইব্রাহিম (আ.) তাঁর স্ত্রী হযরত হাজেরা ও একমাত্র ছেলেকে আরবের মক্কায় কাবা ঘরের নিকটবর্তী সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের পাদদেশে নির্জন স্থানে রেখে আসেন। এই অবস্থায় তিনি তাদের সামান্য খেজুর ও এক মসক পানি রেখে আসেন। যখন হযরত ইব্রাহীম (আ.) হঠাৎ করেই তাঁদের এ অবস্থায় রেখে চলে যাচ্ছিলেন,  তখন হযরত হাজেরা শুধু একটি প্রশ্নই করছিলেন। আপনি আল্লাহর নির্দেশে আমাদের এ নির্জন স্থানে রেখে চলে যাচ্ছেন? হযরত ইব্রাহীম (আ.) ক্ষীণকন্ঠে জবাব দিয়েছিলেন, হ্যাঁ। তখন  হযরত হাজেরা আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করে তাঁর শিশু সন্তানকে নিয়ে সেখানে অবস্থান করলেন।

হযরত হাজেরা ও তাঁর শিশু সন্তানের খারাপ ও পানি যখন শেষ হয়ে গেল, তখন তিনি খাবার এবং পানির সন্ধানে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করলেন। কিন্তু কোথাও তিনি পানির দেখা পেলেন না। এভাবে তিনি ৭বার পানির জন্য ছুটাছুটি করেন। শেষে যখন  তিনি তার সন্তানের কাছে ফিরে এলেন, তখন দেখতে পেলেন তাঁর শিশু পুত্র ইসমাইল (আ.) পায়ের গোড়ায় মাটির নিচ থেকে পানির ফোয়ারা প্রবাহিত হতে লাগল। এটা হচ্ছে বর্তমানে সেই ফোয়ারা বা কূপ যা ‘জমজম’ নামে সারা বিশ্বে সবার কাছে পরিচিত। এই কূপের পানি আজও অত্যন্ত মিষ্টি মধুর সুপেয় এবং বরকতময় পানীয়  হিসেবে সকল মুসলমানদের কাছে পরিচিত।

মা হাজেরা যখন তাঁর সন্তান কাছেই পানির সন্ধান পেলেন, তখন তিনি তাঁর পানির মশক ভরে নিলেন। একইসাথে তিনি নিজেও তৃপ্তির সাথে পানি পান করলেন। এতে করে ক্ষুধার্ত হজরত হাজেরার ক্ষুধা নিবারণ হল, সেইসাথে  তাঁর শিশু পুত্রের জন্যেও দুধেরও ব্যবস্থা হলো। অসহায় মা হজরত হাজেরা তার সন্তানের জন্য সাফা ও মারওয়ায়  দৌড়াদৌড়ি করার কারণে সে ঘটনাকে স্বরণীয় করার জন্য আল্লাহ তায়ালা হজ্জ্ব ও ওমরাহ পালনকারীদের জন্যে সাফা মারওয়া পাহাড়ে ৭ বার করে দৌড়ানোর বিধান জারি করেছেন।

এভাবেই মা হাজেরা তাঁর সন্তান নিয়ে সেখানে দিনযাপন করতে লাগলেন। এরপর একসময়  হযরত ইসমাইল (আ.) যখন হাঁটা-চলা ও খেলাধুলা করার বয়সে উপনীত হল, তখন হযরত ইব্রাহীম (আ.) কে আল্লাহ স্বপ্নে একটি আদেশ দিলেন। 

হযরত ইব্রাহিম (আ.) যিলহজ্জ মাসের রাত্রে তিনি সর্ব প্রথম স্বপ্নটি দেখলেন। স্বপ্ন দেখার পর থেকে ঐ দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি এই স্বপ্নের বৃতান্ত খুঁজতে লাগলেন। তিনি চিন্তায় বিভোর হলেন যে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে সুস্বপ্ন না কি দুঃস্বপ্ন। এভাবে তিনি ৯ম রাতেও ঐ একই স্বপ্ন দেখলেন।  তখন তিনি এট বুঝতে সমর্থ হলেন যে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি সত্যিকার স্বপ্ন। এভাবেই তিনি ১০ম রাতেও আবার ঐ একই স্বপ্ন দেখলেন।   তাই ঐ দিনেই তিনি কুরবানী করতে মনস্থির করলেন। তাঁর পরপর তিনদিন স্বপ্নের জন্য তিনি তিন রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁর মনের এই  প্রতিক্রিয়ার জন্যই বর্তমান হজ্জ্বে উক্ত ৩টি দিনকে বিশেষ নামে বিশেষিত করা হয়েছে-

হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর ৮ম দিনের স্বপ্নের অনুসারে যিল হজ্জের ৮ম  দিনের নাম “ইয়াওমুত তারবিয়াহ” তথা  চিন্তাভাবনার দিন বলে উল্লেখ করা। একইভাবে ৯ম দিন কে  “ইয়াওমুল আরাফাহ” বা জানার দিন। এবং ১০ম দিনকে  “ইয়াওমুন নাহর” বা কুরবানীর দিন বলা হয়। যা হচ্ছে হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর সুন্নাহ। 

পবিত্র কুরআনে হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর কুরবানির বিষয়টি সুরা সফফাতে এভাবে এসেছে, 

“সুতরাং আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দান করলাম। অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইব্রাহীম তাকে বললঃ বৎস! আমি স্বপ্নে দেখিযে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখ। সে বললঃ পিতাঃ! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন। যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহীম তাকে যবেহ করার জন্যে শায়িত করল। তখন আমি তাকে ডেকে বললামঃ হে ইব্রাহীম, তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে! আমি এভাবেই সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে দিলাম যবেহ করার জন্যে এক মহান জন্তু। আমি তার জন্যে এ বিষয়টি পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিয়েছি যে, ইব্রাহীমের প্রতি সালাম বর্ষিত হোক। (সুরা: আস-সাফফাত, আয়াত: ১০১ -১০৯)

এভাবেই আল্লাহ তাঁর প্রিয় মানুষদের পরীক্ষা করেন। এখানে ইব্রাহিমের ছেলেকে কুরবানি করার মূল উদ্দেশ্য ছিলো পরীক্ষা। আল্লাহ দেখতে চেয়েছিলেন যে, ইব্রাহিম (আ.) বৃদ্ধ বয়সে যে সন্তান লাভ করেছে এবং যে সন্তানকে আল্লাহর নির্দেশে মক্কার মরুভূমিতে একলা ফেলে এসেছিল। সেই সন্তানকে কি নবি ইব্রাহিম কুরবানি করতে পারবে?

এটাই ছিলো আল্লাহর পরীক্ষা। যে পরীক্ষা দিতে গিয়ে ইব্রাহিম (আ.) তাঁর স্ত্রী হাজেরা কে বললো, 

“ছেলেকে ভাল সুন্দর পোশাক পরিয়ে দাও। তাকে নিয়ে একটি কাজে যাব।” 

এদিকে শয়তানও বসে নেই। সে হাজেরাকে ধোকা দেওয়ার পাঁয়তারা করতে লাগলো। একইসাথে ছেলে ইসমাইল (আ.) কেও ধোকা দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের বর্ননা মতে, শয়তান পর পর তিন বার হযরত ইব্রাহীম (আ.) কে নানাভাবে ধোঁকা দেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। আর প্রত্যেকবার তিনি ৭টি কঙ্কর মেরে শয়তান কে বিতাড়িত করেছিলেন। আর একারণেই পবিত্র হজ্জ্বে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করা হজ্জের একটি আহকাম। 

এভাবে হযরত ইব্রাহীম (আ.) তার ছেলেকে এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে  বললেন,  “হে আমার ছেলে, আমি স্বপ্ন দেখতেছি যে, আমি যেন তোমাকে কুরবানী করছি। এখন এ বিষয়ে তোমার অভিমত কি?” ইব্রাহিম (আ.) এর এই কথায় তাঁর ছেলে বলল,  “হে আমার পিতা, আপনাকে যা আদেশ করা  হয়েছে আপনি তাই করুন। অবশ্যই আমাকে ধৈর্য্যশীলদের অর্ন্তভুক্ত পাবেন। (সুরা সাফফাত ১০২)

পিতা এবং পুত্র যখন উভয়ই সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তাঁরা আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়ন করবেন, তখন হযরত ইব্রাহীম (আ.) তাঁর সন্তানকে যবেহ করার জন্য কাত করে শোয়ালেন। তখন তাঁর ছেলে হযরত ইসমাইল (আ.) পিতাকে বললেন, “আপনি কি আমাকে চোখে দেখা অবস্থায় যবেহ করতে পারবেন? আপনার কি ছেলের জন্য মায়া হবে না? আর মায়া লেগে গেলে আপনার ছুরি নাও চলতে পারে। এছাড়া আমিও হয়ত অধৈর্য্য হয়ে ছটফট করতে পারি। এতে আপনার নির্দেশ পালনে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। তাই ভালো হয়, যদি আপনি আমাকে শক্ত করে বেধে নেন এবং আমাকে উপুড় করে শুইয়ে দেন। এতে করে আমি আপনি কেউ কারো মুখ দেখবো না। 

কথা গুলো বলতে ইসমাইল (আ.) এর এতটুকুও বুকে বাধলো না। কিন্তু তাঁর পিতার বুকে যেন এক একটি তীরের খোঁচার মতো বিধলো। যতোই কষ্ট হোক না কেন, আল্লাহর আদেশই শিরোধার্য। ঐতিহাসিক মিনা প্রান্তরেই হৃদয়বিদারক লোমহর্ষক এই ঘটনা ঘটে।

তাই আর আগ পিছ চিন্তা না করেই ইব্রাহিম (আ.) তাঁর সন্তানের গলায় ছুরি চালিয়ে দিল। কিন্তু একি! ছুরি তো কিছুতেই কিছু কাটছে না! ইমাম সুদ্দী (রা.) বর্ণনা করেন, একদিকে আল্লাহ হযরত ইব্রাহীম (আ.) কে হুকুম দিয়েছেন নিজ হাতে তোমার প্রিয় সন্তানকে কুরবানী কর। অন্য দিকে ছুরিকে নির্দেশ দিয়েছেন তুমি কিছুতেই কাটতে পারবে না। যেকারণে  ছুরি ও ইসমাইল (আ.) এর ঘাড়ের মাঝখানে আল্লাহর এমন কুদরতী চলে যে,  ইব্রাহিম (আ.) বার বার ছুরি চালালেও কোন কাজ হচ্ছিলনা।

এ পরিস্তিতিতে যখন বিশ্ব জগৎ স্তম্ভিত, হতবাক ও শ্বাসরুদ্ধ।  তখন মহান আল্লাহ তার রহস্য উন্মোচন করলেন। তিনি নির্দেশ দিলেন জিবরাইল (আ.) কে, যেন জান্নাত থেকে একটি দুম্বা পাঠানোর জন্য। আর ইসমাইল (আ.) এর পরিবর্তে হযরত ইব্রাহিম চোখ বাধা অবস্থায় সেই দুম্বাকেই জবেহ করলো। আর এভাবেই আল্লাহ তাঁর নবির থেকে পরীক্ষা নিলেন। 

হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) সহ অনেক সাহাবীদের মতে ইব্রাহীমের কাছে যে দুম্বাটি পাঠানো হয়েছিল সেটি জান্নাতে ৪০ বছর ধরে লালন পালন হয়ে আসছিল। হযরত ইব্রাহিম (আ.) যখন ইসমাইল (আ.) এর গলায় ছুরি দিয়ে  যবেহ করছিলেন। তখনই জিব্রাইল (আ.) বলেছিলেন আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার। এরপর ইব্রাহিম (আ.) ও বলেন আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহেল হামদ। এর পর থেকেই এই তাকবিরটি চিরস্থায়ী একটি  সুন্নাতে পরিনত হয়েছিল।

এই সুমহান ঘটনা এবং ইব্রাহিম (আ.) এর পরীক্ষাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের কুপ্রবৃত্তিকে বিসর্জন দেওয়ার জন্যই  সামর্থবানদের কুরবানি করা ওয়াজিব করা হয়েছে।

ইব্রাহিম (আ.) এর জীবনী 

  • হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর ভ্রমণ, সানিয়াসনাইন খান
  • হযরত ইব্রাহিম (আ)_ এর কাহিনী শুনি, ইকবাল কবীর মোহন
  • হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর জীবনী, হাজেরা বেগম
  • ছোটদের জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.), কাজী ওমর ফারুক
  • হযরত ইব্রাহিম (আ) কিভাবে আল্লাহকে চিনতে পারলো, সানিয়াসনাইন খান
  • মিল্লাতে ইব্রাহিম (আ.), মোহাম্মদ আমিনুল হক
  • হযরত ইবরাহীম (আ), মাওলানা (আ.)ন.ম আবদুল মান্নান
  • হযরত ইবরাহীম (আ), মাওলানা (আ.)ন.ম আবদুল মান্নান
  • হযরত ইবরাহীম (আ.), আল্লামা ইব্নে কাছীর (রহ.)
  • একজন ইব্রাহিম, আশরাফুল হক রাজীব
  • মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.) ঘটনাবহুল জীবন, এ. এস. এম. আজিজুল হক আনসারী
  • ছোটদের ডা. মোহাম্মাদ ইব্রাহিম, দেলোয়ার বিন রসিদ 

পাঠকদের প্রশ্নের উত্তরঃ

ইব্রাহিম (আ.) এর বাবার নাম কি?

হযরত ইব্রাহিম (আ.) কে ইহুদি খ্রিস্টান এবং মুসলিম এরা সবাই মান্য করে। তাই বিভিন্ন ইতিহাসে উনার পিতার বিভিন্ন নাম পাওয়া যায়। যেমন, পবিত্র কুরআনে ইব্রাহীম (আ.) এর পিতার নাম আযর বলা হয়েছে। ইব্রাহিম (আ.) এর  পিতার নাম ছিল দুটি। একটি নাম হচ্ছে  আসল, অপরটি হচ্ছে উপনাম। তবে সাহাবী ইবনে আব্বাস সহ অনেক মুহাদ্দিসদের মতে আযর ছিল মূলত মুর্তির নাম। আর ইব্রাহিম (আ.) এর পিতা সে মুর্তির পুজারী ছিলে। ফলে তাকে আযর উপনামে ডাকা হতো। আবার কারো কারো মতে, আযর ছিল আসল নাম। অপর নাম ছিল তারেহ।সবাই তাকে তারেহ নামে চিনতো।

ইব্রাহিম (আ.) কত বছর বয়সে সন্তান লাভ করেন?

মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) বৃদ্ধ বয়স হয়ে যাওয়ার পরও সন্তানের পিতা হতে পারেননি। তাঁকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত সন্তান না দেওয়া ছিলো আল্লাহর একটি পরীক্ষা। যে পরীক্ষাও ইব্রাহিম (আ.) উত্তীর্ণ হন। কেননা সন্তান না থাকার পরও তাঁর কোনো আফসোস ছিলো না। তাই যখন হঠাৎ ফিরিশতাদের মাধ্যমে তিনি জানতে পারলেন, আল্লাহ তাকে সন্তান দেওয়ার সুসংবাদ দিচ্ছেন। তখন তিনি ও তাঁর স্ত্রী সারা খুবই আশ্চর্যান্বিত হলেন। যা পবিত্র কুরআনে এভাবে এসেছে,

 

তাঁর স্ত্রীও নিকটেই দাড়িয়েছিল, সে হেসে ফেলল। অতঃপর আমি তাকে ইসহাকের জন্মের সুখবর দিলাম এবং ইসহাকের পরের ইয়াকুবেরও। সে বলল-কি দুর্ভাগ্য আমার! আমি সন্তান প্রসব করব? অথচ আমি বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে এসে উপনীত হয়েছি আর আমার স্বামীও বৃদ্ধ, এতো ভারী আশ্চর্য কথা। তারা বলল-তুমি আল্লাহর হুকুম সম্পর্কে বিস্ময়বোধ করছ? হে গৃহবাসীরা, তোমাদের উপর আল্লাহর রহমত ও প্রভুত বরকত রয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ প্রশংসিত মহিমাময়। (সুরা: হুদ, আয়াত: ৭১-৭৩)

 

উক্ত আয়াত সমূহের তাফসিরে এসেছে যে, কিছু ফেরেশতা মানুষের বেশে হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর কাছে এসেছিলেন। তাঁরা  তাঁকে এই বৃদ্ধ বয়সেও পিতা হওয়ার সুসংবাদ দিয়েছিলেন। যে কথা শুনে তাঁর স্ত্রী সারা খুবই আশ্চর্যান্বিত হন। কেননা হযরত ইব্রাহিম (আ.) এবং তিনি উভয়ই ছিলেন বৃদ্ধ। যে বয়সে সন্তান দান করা জাগতিক ভাবে অসম্ভব।

কিন্তু পড়ন্ত বয়সেও সন্তান জন্ম দেওয়ার বিষয়টি সত্যিই অবাক করার মতো হলেও আল্লাহর কাছে কখনোই কোনো কিছু অসাধ্য নয়।  পৃথিবীর সব কিছুই তাঁর ইচ্ছার শক্তির অধীনে ব্যস্ত। পৃথিবীর কোনো শক্তি বা কোনো নিয়মই আল্লাহর শক্তির সঙ্গে তুলনীয় নয়। কেননা তিনি অসীম ক্ষমতাধর এবং পরাক্রমশালী।

হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর স্ত্রীর আশ্চর্য হওয়ার কথা শুনে, ফেরেশতারা তাঁকে আল্লাহর কুদরতের কথা স্মরণ করিয়ে দেন এবং এই নবী পরিবারের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের কথাও তাদের মনে করিয়ে দেন। যারফলে হযরত ইব্রাহিম (আ.) ১০০ বছর এবং তাঁর স্ত্রী ৯০ বছরের হলেও তাদের সন্তান ইয়াকুব এবং ইসহাক (আ.) জন্মগ্রহন করেন।

ইব্রাহিম (আ.) এর দোয়া কোনটি? 

আমরা জানি হযরত ইব্রাহিম (আ.) অনেক বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের বাবা হন। যে বয়সে সন্তান দান একপ্রকার অসম্ভব। যাইহোক আমরা অনেকেই সন্তান লাভের জন্য অনেক কিছু করলেও আল্লাহর শিক্ষা দেওয়া ইব্রাহিম (আ.) এর সন্তান লাভের দোয়া জানি না। তাই আসুন জেনে নিই ইব্রাহিম (আ.) দোয়াটি।

এই দোয়াটি এসেছে পবিত্র কুরআনে সুরা সফফাতে।

رَبِّ هَب لي مِنَ الصّالِحينَ

রাব্বি হাবলি মিনাস সালিহিন।

অর্থ : ‘হে আমার রব, আমাকে সৎকর্মশীল সন্তান দান করুন’। (সুরা সাফফাত : আয়াত ১০০)

বৃদ্ধ বয়সে হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর কাছে এই দোয়া পড়ে সন্তান লাভের আশা করেছিলেন। আর আল্লাহ তার দোয়া কবুল করে তাকে সন্তান দান করেছিলেন।

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী 

পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম 

 

আপনি আরো যা পড়তে পারেন


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

1

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী

Author: সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী জন্ম চট্টগ্রামে। জীবিকার প্রয়োজনে একসময় প্রবাসী ছিলেন। প্রবাসের সেই কঠিন সময়ে লেখেলেখির হাতেখড়ি। গল্প, কবিতা, সাহিত্যের পাশাপাশি প্রবাসী বাংলা পত্রিকায়ও নিয়মিত কলাম লিখেছেন। প্রবাসের সেই চাকচিক্যের মায়া ত্যাগ করে মানুষের ভালোবাসার টানে দেশে এখন স্থায়ী বসবাস। বর্তমানে বেসরকারি চাকুরিজীবী। তাঁর ভালোলাগে বই পড়তে এবং পরিবারকে সময় দিতে।

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

কবিতা আল কোরআনের প্রতীক আফছানা খানম অথৈ

আল কোরআনের প্রতীক আফছানা খানম অথৈ মা আমেনার গর্ভেতে জন্ম নিলো এক মহামানবের, নাম হলো তার মুহাম্মদ রাসুল আসলো ভবের

ফোরাত নদীতে স্বর্নের পাহাড় আফছানা খানম অথৈ

ফোরাত নদীতে স্বর্নের পাহাড় আফছানা খানম অথৈ ইমাম মাহাদী (আ:) আগমনের পূর্বে ফোরাত নদীর তীরে স্বর্নের পাহাড় ভেসে উঠা কেয়ামতের

কবিতা দাজ্জাল আফছানা খানম অথৈ

দাজ্জাল আফছানা খানম অথৈ কেয়ামতের পূর্বে দাজ্জাল আসবে নিজেকে খোদা বলে দাবি করবে, কাফের মুনাফিক যাবে তার দলে ঈমানদার মুমিন

গল্প হযরত মুহাম্মদ (সা:) জীবনের গল্প আফছানা খানম অথৈ

জন্ম:হযরত মুহাম্মদ (সা:) বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত মক্কা নগরীর কুরাইশ গোত্রে বনি হাশিম বংশে ৫৭০ খৃষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন।তার পিতার

2 Replies to “হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর জীবনী”

Leave a Reply