ফিকহের ক্ষেত্রে মানুষজন ইমাম আবূ হানীফাহ রহ. এর ওপর নির্ভরশীল

1

InShot 20230522 173849415

 

এটি হানাফী মাযহাবের কারো উক্তি নয়। এই হিরকোক্তিটি ২০০ হিজরী শতাব্দীর মুজতাহিদ ও শাফে’ঈ মাযহাবের প্রবর্তক ইমাম শাফে’ঈ রহ. এর। হাম্বলী মাযহাবের বিশিষ্ট ফকীহ ইমাম ইবনুল জাওযীসহ উম্মাহর সকল গ্রহণযোগ্য ইমাম ও ইতিহাসবিদগণ নিজেদের কিতাবে কওলটি উদ্ধৃত করেন। যেমন-

قالَ الشافعي رحمة اللَّه عليه: الناس عيال عَلى أبي حنيفة فِي الفقه.

অর্থ: শাফে’ঈ রহ. বলেন, ফিকহের ক্ষেত্রে মানুষজন ইমাম আবূ হানীফাহ রহ. এর ওপর নির্ভরশীল।

তথ্যসূত্র: আল-মুনতাযাম —ইবনুল জাওযী: ৮/১৩১, তাহযীবুল আসমা ওয়াল-লুগাত —নববী: ২/২২০, আত-তাকমীল ফিল জারহি ওয়াত-তা’দীল —ইবনে কাসীর: ২/৩৭৭, তবাকাতুল হুফফায —সয়ূতী: ১/৭০, তাহযীবুল কামাল —মিয্যী: ২৯/৪৩৩, তাযকিরাতুল হুফফায —যাহাবী: ১/১২৭, আল-ইবার —যাহাবী: ১/১৬৪, তাযহীবু তাহযীবুল কামাল —যাহাবী: ৯/২২১, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা —যাহাবী: ৬/৪০৩, মানাকিবে আবী হানীফাহ —যাহাবী: পৃ. ৩০, তারীখুল ইসলাম —যাহাবী: ৯/১৯৩

আসলে জ্ঞানীই বোঝে জ্ঞানীর কদর। তাই তো তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এই মহা সত্যটি স্বীকার করে নিয়েছেন। আসলে সত্য এমন এক জিনিস যে, কোনো সত্যপিয়াসী চাইলেও তা অস্বীকার করতে পারে না। মূলত সত্যের সেবকদের কাছে সত্য নিজেই এসে ধরা দেয়। কারণ, সত্য আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত।

 

উত্থাপিত আপত্তি

কিন্তু কিছু ক্ষুদ্রমনা হতভাগাও আছে, যারা সুপ্রমাণিত সত্যকে প্রত্যাখ্যান করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। তেমনি কিছু হতভাগা লোকদের নিয়ে আজকের এই আলোচনা। তারা ইমাম শাফে’ঈর উপরিউক্ত উক্তিটিকে তাঁর উক্তি হিসেবে অস্বীকার করছে! তাদের দাবি, এই উক্তির সনদ সহীহ নয়, কারণ এই সনদে হামজাহ বিন আলী নামে একজন মাজহূল রাবী আছেন।

আমাদের জবাব

প্রথম কথা হলো, উক্ত রাবীকে মুসলিম উম্মাহর ছোট বড় কোনো একজন ইমামও মাজহূল বলেননি। তাছাড়া ইতিহাসের গ্রহণযোগ্য কিতাবাদীতে তার নাম, ডাকনাম, উপনাম, বাবার নাম, দাদার নাম, পরদাদার নাম, দেশের নাম, পদবী, মৃত্যু-সন, মৃত্যু-মাস, মৃত্যুস্থান, তিনি কার থেকে হাদীস শ্রবণ করেছেন এসবসহ পূর্ণাঙ্গ পরিচয়ও সুবিধৃত রয়েছে। তাহলে তিনি অজ্ঞাত হন কীভাবে? আসুন, তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচয়টা জানা যাক। সুবিখ্যাত ইতিহাস রচয়িতা ও বিদগ্ধ মুহাদ্দিস, ইমাম হাফেয ইবনে ইউনুস আল মিসরী রহ. মিশরের বড় বড় আলেমদের জীবনী নিয়ে লিখিত তাঁর ‘তারীখে ইবনে ইউনুস’-এ লিখেন-

حمزة بن على بن العباس بن الربيع بن عبد رب الغبرىّ: مصرى، يكنى أبا عمارة. توفى فى شهر رمضان سنة سبع وثلاثمائة. سمع من يونس بن عبد الأعلى، وطبقته. كتبت عنه

হামজাহ বিন আলী বিন আল আব্বাস বিন আর-রাবী’ বিন আব্দে রব্ব আল-গুবারী। তিনি মিশরের বাসিন্দা, তাঁর উপাধি আবু ‘উমারাহ, (ডাকনাম: গুবারী) তিনি ৩০৭ হিজরী সনের রামাদ্বান মাসে মারা যান। তিনি হাদীস শ্রবণ করেছেন ইউনুস বিন আব্দুল আ’লা থেকে। তার অবস্থান: তাঁর থেকে আমি হাদীস লিখেছি। [তারীখে ইবনে ইউনুস: ১/১৩৭]

লক্ষনীয়, মিশরের বড় বড় আলেমদের নিয়ে লিখিত জীবনচরিতের মাঝে তার নাম থাকা প্রমাণ করে যে, তিনি মিশরের বড় বড় আলেমদের থেকে ছিলেন।

তাঁর ব্যাপারে ইবনে হাজার আসকালানী রহ. ‘তাবসীরাতুল মুনতাবিহ’ গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। সেখানেও তিনি তাঁকে মাজহূল আখ্যায়িত করেননি। দেখুন- তাবসীরাতুল মুনতাবিহ: ৩/১০৩১।

৪৭৫ হিজরীর বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ইমাম ইবনে মাকূলা রহ. রাবীদের নাম, ডাকনাম, বংশ-পরিচয় সংক্রান্ত গ্রন্থ ‘আল-ইকমালে’ও তাঁর আলোচনা করেছেন, তিনিও তাঁকে মাজহূল আখ্যায়িত করেননি। দেখুন- আল-ইকমাল: ৭/৩৩।

ইমাম সান’আনী রহ. রাবীদের বংশ-পরিচয় সংক্রান্ত গ্রন্থ ‘আল-আনসাবে’ও তাঁর আলোচনা এনেছেন। সেখানেও তিনি তাঁকে মাজহূল আখ্যায়িত করেননি। দেখুন- আল-আনসাব: ১০/১৬। তাছাড়া মাজহূল হলে তার বংশ-পরিচয় আলোচনা করবেনই বা কীভাবে?। উক্ত কিতাবে তার আলোচনা আসাটাই প্রমাণ, তিনি পারিভাষিক অর্থে মাজহূল নন।

ইয়েমেনের সমকালীন বিখ্যাত মুহাক্কিক ড. মুহাম্মাদ আহমাদ আব্দুল্লাহ আল-আনসি তাঁর ‘মিসবাহুল আরীব’ গ্রন্থেও তাঁর আলোচনা করেন। সেখানেও তিনি তাকে মাজহূল আখ্যায়িত করেননি। দেখুন- মিসবাহুল আরীব: ৪/৭২। অথচ এই গ্রন্থের প্রত্যেক মাজহূল রাবীকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে ‘মাজহূল’ আখ্যায়িত করা হয়েছে। দেখুন রাবী নং ৬৩৮০, ৬৩৮২, ৬৩৮৬, ৬৩৮৭, ৬৩৮৮। এখানে উদাহরণস্বরূপ কেবল এক পৃষ্ঠা থেকেই পাঁচটি সংখ্যা উল্লেখ করা হলো- যাদেরকে সরাসরি মাজহূল আখ্যায়িত করা হয়েছে। এমনিভাবে প্রত্যেক পৃষ্ঠাতেই ৫-৬টি করে মাজহূল-আখ্যায়িত রাবী রয়েছে।

তো এখন কথা হলো, যদি হামজাহ বিন আলী বাস্তবিকপক্ষে মাজহূলই হবেন তাহলে অন্যান্য মাজহূল রাবীকে যেভাবে মাজহূল আখ্যায়িত করা হয়েছে, একইভাবে হামজাহ বিন আলীকে মাজহূল আখ্যায়িত করা হয়নি কেনো?

মূলত এর থেকে বোঝা যায়, অবশ্যই তিনি মাজহূল নন। মাজহূল হলে তাঁকেও অন্যদের মতো ‘মাজহূল’ আখ্যায়িত করা হতো। আর সাধারণত কোনো একজন রাবীকে মাজহূল বলতে হলে- এ ব্যাপারে ইমামদের কওল থাকতে হয়; নিজের মনমতো কাউকে মাজহূল বলা যায় না।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, বিখ্যাত ঐতিহাসিক হাফিযুল হাদীস ইমাম ইবনে ইউনুস রহ. তাঁর ইতিহাস গ্রন্থ ‘তারীখে ইবনে ইউনুস’ এ বলেন- তাঁর থেকে আমি হাদীস লিখেছি বা তাঁর ব্যাপারে আমি অন্যত্র বিশদ আলোচনা করেছি। দেখুন- [তারীখে ইবনে ইউনুস: ১/১৩৭] কিন্তু দুঃখজনক কথা হচ্ছে, তার উক্ত গ্রন্থটি আমাদের সংগ্রহে নেই।

অতএব, তাঁর ব্যাপারে মাজহূলের যে অভিযোগ করা হয়েছে সেটি আর বলবৎ থাকলো না।

 

উক্ত বর্ণনা যেসব কারণে সহীহ

১. সমকালীন নন্দিত মুহাক্কিক ড.বাশশার আওয়াদ হামজাহ বিন আলীর উক্ত বর্ণনাকে اسناده صحيح (এর সনদ সহীহ) বলেছেন। দেখুন- তারীখে বাগদাদ: ১৫/৪৭৪

২. হাফেয যাহাবী রহ. তাঁর ‘তারীখুল ইসলাম’ গ্রন্থে ইমাম শাফে’ঈর ব্যাপারে এই হামজাহ বিন আলীর বর্ণনা গ্রহণ করেছেন, অতঃপর তাবীল করেছেন। কিন্তু যাহাবী রহ. এখানেও তাঁকে মাজহূল আখ্যা দেননি এবং তাঁর বর্ণনাকেও বাতিল আখ্যায়িত করেননি। বরং তাঁর বক্তব্যকে গ্রহণ করে তিনি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যাখ্যা করেছেন। দেখুন- তারীখুল ইসলাম: ১৪/১৮৪।

অতএব, এর দ্বারাও সু্স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, হাফেয যাহাবীর দৃষ্টিতে তাঁর বর্ণনা গ্রহণযোগ্য।

৩. অসংখ্য গ্রন্থের রচয়িতা ইমাম ইবনুল মুকরি রহ. এর মতো সুপ্রসিদ্ধ ইমামও হামযাহ বিন আলী থেকে সরাসরি রেওয়ায়েত গ্রহণ করেছেন। শুধু ইমাম ইবনুল মুকরিই নন, তাঁর থেকে আরো অন্যান্য সুপ্রসিদ্ধ হাফেযুল হাদীস, ইমাম ও ঐতিহাসিকগণও সরাসরি রেওয়ায়েত গ্রহণ করেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন, সুনির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক ও বিদগ্ধ মুহাদ্দিস, ‘তারীখে ইবনে ইউনুস’ এর রচয়িতা, হাফিযুল হাদীস, আল-মুতকিন, ইমাম ইবনে ইউনুস রহ.। দেখুন- মু’জামে ইবনুল মুকরি: বর্ণনা নং ৭৭৬, ৭৭৭, মিসবাহুল আরীব: ৪/৭২, তারীখে ইবনে ইউনুস: ১/১৩৭, তারীখুল ইসলাম: ৫/১৪৬, মানাকিবে শাফে’ঈ: ৭৮, আল-ইনতিকা: ৯০।

আর, যার থেকে সুপ্রসিদ্ধ ও সুনির্ভরযোগ্য ইমামগণ সরাসরি রেওয়ায়েত করেন তাঁর বর্ণনা গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। কারণ, তিনি গ্রহণযোগ্য না হলে উম্মাহর ইমামগণ তাঁর থেকে বর্ণনা গ্রহণ করতেন না। অতএব, ইমামগণ কর্তৃক হামযাহ বিন আলীর বর্ণনা পত্যক্ষ ও পরোক্ষ- উভয়ভাবে গ্রহণ করার দ্বারা বোঝা গেলো যে তিনি নির্ভরযোগ্য।

৪. ইমাম শাফে’ঈর এই উক্তিটি গ্রহণযোগ্য হওয়ার সবচেয়ে বড় দলীল এই যে, উম্মাহের সকল ইমাম ও ওলামায়ে কেরাম বিনা বাক্যে তাঁর এ উক্তিটি গ্রহণ করে নিয়েছেন। অদ্যাবধি কোনো একজন ইমামও এ উক্তিটি নিয়ে কোনো ধরনের আপত্তি উত্থাপন করেননি। এমনকি উক্তিটি গ্রহণযোগ্য নয় বা দুর্বল এদিকে ইশারাও করেননি, বরং সকলেই উক্তিটি ইমাম আবূ হানীফাহ’র প্রশংসায় ব্যবহার করেছেন।

মূলত ইমাম শাফে’ঈ থেকে ইমাম আবু হানীফাহ’র ব্যাপারে উক্ত বর্ণনা মুতাওয়াতির (অকাট্য ও নিরবচ্ছিন্ন) পর্যায়ের। কারণ, সমস্ত গ্রহণযোগ্য ও হিদায়াতপ্রাপ্ত ইমামগণ ইমাম আবূ হানীফাহ’র প্রশংসায় ইমাম শাফে’ঈর উক্ত কথাটি বিনাবাক্যে কবূল করে নিয়েছেন। এ উক্তিটি যে মুতাওয়াতির- এ ব্যাপারে আমরা শেষদিকে দলীলনির্ভর আলোচনা করবো।এর আগে আমরা ইতিহাসের গ্রহণযোগ্য কিতাবাদী থেকে উক্তিটির সত্যতা জেনে নেবো।

ইতিহাসের সমস্ত গ্রহণযোগ্য কিতাবেই তাঁর উক্ত বানীটি স্বর্ণের মতো জ্বলজ্বল করছে! সকল গ্রহণযোগ্য ইমাম ও ওলামাগণই ইমাম আ’যমের ব্যাপারে ইমাম শাফে’ঈর এই উক্তিটি অতি উদারভাবে গ্রহণ করে নিয়েছেন এবং এর দ্বারা নিজেদের কিতাবকে অলংকৃত করেছেন। যেমন: হাফেয যাহাবী, হাফেয ইবনে কাসীর, ইমাম নববী, হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী, ইমাম ইবনুল জাওযী, আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহ.। শুধু তাঁরা নন, জমানার সকল হকপন্থী ওলামায়ে কেরামগণই, এমনকি সমকালীন আহলে হাদীস শায়খগণও এই উক্তিটি প্রমাণস্বরূপ নিয়ে থাকেন এবং পরম শ্রদ্ধাভরে এই উক্তিটি দ্বারা ইমামগণের পারস্পরিক হৃদ্যতা ও উদারতার উদাহরণ দিয়ে থাকেন।

এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এতো এতো ইলমের অধিকারী ইমামগণ কি সকলেই কাকতালীয়ভাবে একটা অবাস্তব বুলি আওড়িয়ে যাচ্ছেন? যাইহোক, উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি কিতাব থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি।

ইমাম নববী রহ. 

ইমাম নববী রহ. তাঁর ‘তাহযীবুল আসমা ওয়াল-লুগাত’ গ্ৰন্থে ইমাম আবূ হানীফাহ রহ. এর আলোচনা করতে গিয়ে বলেন-

عن الشافعى، قال: الناس عيال على أبى حنيفة فى الفقه.

অর্থ: শাফে’ঈ রহ. বর্ণিত- তিনি বলেন, ফিকহী জগতের মানুষজন ইমাম আবূ হানীফাহ’র ওপর নির্ভরশীল। [তাহযীবুল আসমা ওয়াল-লুগাত: ২/২২০]

হাফেয ইবনে কাসীর রহ.

একইভাবে হাফেয ইবনে কাসীর রহ. তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘আত-তাকমীল ফিল জারহি ওয়াত-তা’দীল’ গ্ৰন্থেও একই কথা বলেন-

قال: الناس عيال على أبى حنيفة فى الفقه.

অর্থ: শাফে’ঈ রহ. বলেন, মানুষজন ফিকহের ক্ষেত্রে ইমাম আবূ হানীফাহ’র পরিবারতুল্য। [আত-তাকমীল ফিল জারহি ওয়াত-তা’দীল: ২/৩৭৭]

আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহ.

আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহ. ‘হাফেযুল হাদীস’দের জীবনী সংক্রান্ত গ্রন্থ ‘তবাকাতুল হুফফায’-এ ইমাম আবূ হানীফাহ রহ. এর জীবনী আলোচনা করতে গিয়ে বলেন-

وقالَ الشّافِعِي النّاس فِي الفِقْه عِيال على أبي حنيفَة

অর্থ: শাফে’ঈ রহ. বলেছেন, মানুষজন ফিকহের ক্ষেত্রে ইমাম আবূ হানীফাহ’র এর ওপর নির্ভরশীল। [তবাকাতুল হুফফায: ১/৭০]

হাফেয মিয্যী রহ. 

হাফেয যাহাবীর উস্তাদ হাফেয মিয্যী রহ. তাঁর “তাহযীবুল কামাল”-এ ইমাম আবূ হানীফাহ রহ. এর প্রশংসায় লিখেন-

الشافعي يَقُولُ: الناس عيال عَلى أبي حنيفة فِي الفقه.

অর্থ: শাফে’ঈ রহ. বলেন- ফিকহের ক্ষেত্রে লোকেরা ইমাম আবূ হানীফাহ’র ওপর নির্ভরশীল। [তাহযীবুল কামাল: ২৯/৪৩৩]

হাফেয যাহাবী রহ.

হাফেয যাহাবী রহ. তো শাফে’ঈ মাযহাবের অনুসারী হওয়া সত্বেও ইমাম আবূ হানীফাহ রহ. ও তাঁর দুই ছাত্রকে নিয়ে ‘মানাকিবে আবী হানীফাহ ওয়া সাহিবায়হি’ নামে স্বতন্ত্র একটা গ্রন্থই রচনা করেন। এই স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনার ব্যাপারে তিনি তাঁর সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘সিয়ারু আ’লামিন নুবালা’য় বলেন, “ইমাম আবূ হানীফাহ রহ. এমন ব্যক্তি যে, তাঁর জীবনী ও জ্ঞান-গরিমা নিয়ে পূর্ণভাবে লিখতে গেলে বড় বড় দুই খণ্ডের স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনার দাবি রাখে” [সিয়ার: ৬/৪০৩]।

তাইতো তিনি তাঁর অন্যান্য গ্রন্থে বাকিদের সাথে ইমাম আবূ হানীফাহ রহ. এর আলোচনা করা সত্ত্বেও তাঁকে নিয়ে আলাদা একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থে তিনি লিখেন-

الشافعي يَقُولُ: الناس عيال عَلى أبي حنيفة فِي الفقه.

অর্থ: শাফে’ঈ রহ. বলেন- ফিকহের ক্ষেত্রে লোকেরা ইমাম আবূ হানীফাহ’র ওপর নির্ভরশীল। [মানাকিবে আবী হানীফাহ: পৃ. ৩০]

তিনি তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘সিয়ারু আ’লামিন নুবালা’-তেও একই কথা লিখেন-

وقالَ الشّافِعِيُّ: النّاسُ فِي الفِقْهِ عِيالٌ عَلى أبِي حَنِيفَةَ

অর্থ: শাফে’ঈ রহ. বলেন- ফিকহের ক্ষেত্রে লোকেরা ইমাম আবূ হানীফাহ’র ওপর নির্ভরশীল। [সিয়ারু আ’লামিন নুবালা: ৬/৪০৩]

তিনি হাফেয মিয্যী রহ. এর ‘তাহযীবুল কামাল’-এর ওপর একটি শরাহ গ্রন্থ রচনা করেছেন। ঐ গ্রন্থেও তিনি উপরিউক্ত উক্তিটি উল্লেখ করেন-

الشافعي قال: الناس في الفقه عيال على أبي حنيفة.

অর্থ: শাফে’ঈ রহ. বলেন- ফিকহের ক্ষেত্রে লোকেরা ইমাম আবূ হানীফাহ’র ওপর নির্ভরশীল। [তাযহীবু তাহযীবুল কামাল: ৯/২২১]

তার অন্য একটি গ্রন্থ ‘আল-ইবার’। ঐ গ্রন্থেও তিনি একই কথা লিখেন-

 قال الشافعي: الناس في الفقه عيال على أبي حنيفة.

অর্থ: শাফে’ঈ রহ. বলেন- ফিকহের ক্ষেত্রে লোকেরা ইমাম আবূ হানীফাহ’র ওপর নির্ভরশীল। [আল-ইবার: ১/১৬৪]

তাঁর আরো একটি সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘তারীখুল ইসলাম’। এই গ্রন্থে তিনি ইসলামের ইতিহাস সংকলন করেছেন এবং এতে মহান মহান ব্যক্তিদের আলোচনাও এসেছে। ইমাম আবূ হানীফাহ রহ. এর আলোচনায় তিনি লিখেন-

قال الشافعي: الناس في الفقه عيال على أبي حنيفة.

অর্থ: শাফে’ঈ রহ. বলেন- ফিকহের ক্ষেত্রে লোকেরা ইমাম আবূ হানীফাহ’র ওপর নির্ভরশীল। [তারীখুল ইসলাম: ৯/১৯৩]

তিনি ‘তাযকিরাতুল হুফফায’ নামে হাফিযুল হাদীস রাবীগণের জীবনী সংক্রান্ত একটি মহামূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। এই জীবনচরিতেও তিনি ইমাম আবূ হানীফাহ রহ. এর প্রশংসায় ইমাম শাফে’ঈর উপরিউক্ত মন্তব্যটি উল্লেখ করেন-

قال الشافعي: الناس في الفقه عيال على أبي حنيفة.

অর্থ: শাফে’ঈ রহ. বলেন- ফিকহের ক্ষেত্রে লোকেরা ইমাম আবূ হানীফাহ’র ওপর নির্ভরশীল। [তাযকিরাতুল হুফফায: ১/১২৭]

ইমাম ইবনুল জাওযী রহ. 

হাম্বলী মাযহাবের বিশিষ্ট ফকীহ ইবনুল জাওযী রহ. স্বীয় গ্রন্থে লিখেন-

قالَ الشافعي رحمة اللَّه عليه: الناس عيال عَلى أبي حنيفة فِي الفقه.

অর্থ: শাফে’ঈ রহ. বলেন, ফিকহী জগতে মানুষজন ইমাম আবূ হানীফাহ’র ওপর নির্ভরশীল। [আল-মুনতাযাম: ৮/১৩১]

সালেহ আল মুনাজ্জিদ

লা-মাযহাবদের পরম শ্রদ্ধেয় আলেম বিশিষ্ট সালাফী শায়খ সালেহ আল মুনাজ্জিদ এক প্রশ্নের জবাবে বলেন-

وقال الشافعي : الناس في الفقه عيال على أبي حنيفة

অর্থ: শাফে’ঈ রহ. বলেন, লোকেরা ফিকহের ক্ষেত্রে ইমাম আবূ হানীফাহ’র ওপর নির্ভরশীল। [ইসলাম কিউএ ইনফো, প্রশ্ন নং ৪৬৯৯২]

প্রিয় পাঠক, আমি চাইলে এই বর্ণনাটি ইতিহাসের আরো অসংখ্য গ্রহণযোগ্য কিতাব থেকে দেখাতে পারবো, কিন্তু জ্ঞানীদের জন্য ইশারাই কাফী, তাই আমি বিরত হচ্ছি। [প্রয়োজনে পরবর্তীতে সংযুক্ত করে দেওয়া হবে]

তো, উপরিউক্ত বর্ণনাসমূহ থেকে জানা গেলো যে, ইমাম শাফে’ঈ রহ. থেকে ইমাম আবু হানীফাহ’র ব্যাপারে উক্ত বর্ণনা মুতাওয়াতির পর্যায়ের। কারণ, সমস্ত গ্রহণযোগ্য ইমামগণ ইমাম আবু হানীফাহ’র প্রশংসায় ইমাম শাফে’ঈর উক্তিটি বিনা বাক্যে গ্রহণ করে নিয়েছেন। আর উম্মাহের ইমামগণ যদি সকলেই কোনো কথা বিনা বাক্যে গ্রহণ করে নেন সেটা ইজমা/মুতাওয়াতির এর মত হয়ে যায়। এটি আমার বানানো কোনো কথা নয়, বরং এটিই সর্বসম্মত কথা; বিশেষ করে লা-মাযহাব ওলামায়ে কেরামদেরই কথা।

সবশেষে আমি উপরিউক্ত কওল সম্পর্কে সমকালীন আলেম বিশিষ্ট সালাফী গবেষক শায়খ ড. আব্দুর রহীম আত-তাহহান এর মন্তব্য উল্লেখ করছি। তিনি বলেন,

والكلام كما قلت متواتر عن الإمام الشافعى رضى الله عنه وأرضاه

অর্থ: এ উক্তির ব্যাপারে আমার মন্তব্য হলো, এটি ইমাম শাফে’ঈ রহ. থেকে মুতাওয়াতিরভাবে প্রমাণিত। [খুতাব ওয়া দুরূসুশ শায়খ আত-তাহহান: ৫৩/২৪]

৫. বর্ণনাটি গ্রহণযোগ্য হওয়ার পঞ্চমতম কারণ হচ্ছে, এই বর্ণনাটি একক নয় বরং সম্পূর্ণ সহীহ সনদে এ বর্ণনার আরো একাধিক ‘শাওয়াহেদ/মুতাবি’ বর্ণনা রয়েছে। অর্থাৎ হামযাহ বিন আলী ব্যতীত অন্যান্য সুনির্ভরযোগ্য ও সুপ্রসিদ্ধ রাবীগণও ইমাম শাফে’ঈ থেকে উক্তিটি বর্ণনা করেছেন। যেমন- [আগামী পর্বে সেগুলো বিস্তারিত উল্লেখ করা হবে।]

 

লুবাব হাসান সাফওয়ান


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

1

লুবাব হাসান সাফ‌ওয়ান

Author: লুবাব হাসান সাফ‌ওয়ান

লুবাব হাসান সাফ‌ওয়ান। ঠিকানা: নোয়াখালী। কর্ম: ছাত্র। পড়াশোনা: আল-ইফতা ওয়াল হাদীস [চলমান] প্রতিষ্ঠান: মাদরাসাতু ফায়দ্বিল 'উলূম নোয়াখালী।

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

কবিতা আল কোরআনের প্রতীক আফছানা খানম অথৈ

আল কোরআনের প্রতীক আফছানা খানম অথৈ মা আমেনার গর্ভেতে জন্ম নিলো এক মহামানবের, নাম হলো তার মুহাম্মদ রাসুল আসলো ভবের

ফোরাত নদীতে স্বর্নের পাহাড় আফছানা খানম অথৈ

ফোরাত নদীতে স্বর্নের পাহাড় আফছানা খানম অথৈ ইমাম মাহাদী (আ:) আগমনের পূর্বে ফোরাত নদীর তীরে স্বর্নের পাহাড় ভেসে উঠা কেয়ামতের

কবিতা দাজ্জাল আফছানা খানম অথৈ

দাজ্জাল আফছানা খানম অথৈ কেয়ামতের পূর্বে দাজ্জাল আসবে নিজেকে খোদা বলে দাবি করবে, কাফের মুনাফিক যাবে তার দলে ঈমানদার মুমিন

গল্প হযরত মুহাম্মদ (সা:) জীবনের গল্প আফছানা খানম অথৈ

জন্ম:হযরত মুহাম্মদ (সা:) বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত মক্কা নগরীর কুরাইশ গোত্রে বনি হাশিম বংশে ৫৭০ খৃষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন।তার পিতার

Leave a Reply