হযরত ওমর রা. এর জীবনী- লেখক ডট মি

হযরত ওমর (রা.) এর জীবনী

1

তিমির রাত্রি –‘এশা’র আজান শুনি দূর মসজিদে

প্রিয়া-হারা কান্নার মতো এ-বুকে আসিয়া বিঁধে!

আমির-উল-মুমেনিন,

তোমার স্মৃতি যে আজানের ধ্বনি – জানে না মুয়াজ্জিন!

মুয়াজ্জিনের মতো আমাদেরও অধিকাংশ মুসলমান জানে না, কে এই ব্যক্তি? যাকে নিয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন অনবদ্য কবিতা “ওমর ফারুক।” হ্যাঁ এবার ঠিকই চিনেছেন। এই সেই আমিরুল মুমেনিন! হযরত ওমর ফারুক। যিনি ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ও প্রধান সাহাবীদের অন্যতম। একইসাথে আশারায়ে মোবসশারা অর্থাৎ জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবীদের একজন। যিনি হযরত আবু বকরের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় খলিফা হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। যার শাসনের ব্যাপ্তি ছিলো  তৎকালীন অর্ধ পৃথিবী জুড়ে। অথচ তাঁর ছিলো ধূলোয় মাখা খেজুর পাতার রাজপ্রাসাদ! যা কবির ভাষায়,  

 

“অর্ধ পৃথিবী করেছ শাসন ধুলার তখ‍্‍তে বসি

খেঁজুর পাতার প্রাসাদ তোমার বারে বারে গেছে খসি”

যিনি ছিলেন আল-ফারুক (সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী)। একইসাথে আমিরুল মুমিনিন উপাধিটি সর্বপ্রথম তার ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়েছে। সেইসাথে তিনি ছিলেন ইসলামী আইনের একজন অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ। সাহাবীদের পদ মর্যাদার ক্ষেত্রে আবু বকরের (রা.)  পর ওমরের (রা.) অবস্থান। এছাড়াও হযরত ওমর (রা.) ছিলেন ইসলামের নবি মুহাম্মাদের শ্বশুর, যেহেতু ওমরের মেয়ে হাফসা ছিলেন মুহাম্মাদের স্ত্রী।

মহানবি সা: তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমার পরে যদি কেউ নবি হতেন তাহলে ওমর ইবনুল খাত্তাবই নবি হতেন’ (সুনানে তিরমিজি)।

সূচিপত্র

জন্ম পরিচয় 

হজরত ওমর (রা.) এর জন্ম ৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে কুরাইশ বংশের ‘আদ্দিয়া’ গোত্রে। তাঁর পরিবারের নাম হচ্ছে  “রইস”। হাফস হচ্ছে তাঁর ডাকনাম। তাঁর বাবা হচ্ছেন খাত্তাব ইবনে নুফায়েল এবং মায়ের নাম হানতামা বিনতে হিশাম। তাঁর বাবা ছিলেন  কুরাইশ বংশের একজন বিশিষ্ট সম্মানিত ব্যক্তি।

হজরত ওমর (রা.) ছিলেন শক্তিশালী দীর্ঘকায় একজন ব্যক্তি। যেকারণে কুস্তিগিরী হিসাবে তাঁর প্রচুর খ্যাতি ছিলো। এছাড়াও ওমর (রা.) ছিলেন অসম্ভব বুদ্ধিমান এবং  বীরপুরুষ। একইসাথে তিনি ছিলেন তুখোড় বক্তা। তার প্রধান পেশা ছিলো তেজারত। 

এইসব কারণে তাঁর নামে এক‌টি প্রবাদ চালু ছিল। আর তা হলো,  ‘কুল্ল তাবিলুন আহমাকুন ইল্লা ওমর। ’ এর অর্থ হচ্ছে ওমর ব্যতীত সব লম্বা মানুষ বোকা। তাঁর এই কথার দ্বারা এটা বোঝা যায় যে, রাসুলে কারীমের (সা.) এর ইসলাম প্রচারের আমলে, আরবে যে অল্পসংখ্যক শিক্ষিত লোক ছিলেন, হজরত ওমর (রা.) ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। ঐতিহাসিক বালাযুরী মতে, ‘তৎকালীন সময়ে আরবের কুরাইশদের মধ্যে শুধুমাত্র ১৭ জন লোকই শিক্ষিত ছিলেন এবং তারমধ্যে ওমর ছিলেন একজন। 

হযরত ওমর (রা.) এর প্রাথমিক জীবনী

ওমর মক্কার কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহন করলেও তিনি ছোট থেকেই সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তাঁর বাবাও সাধারণ জীবনযাপন করতেন। এমনকি ওমর (রা.) যৌবনে মক্কার নিকটে তার বাবার উট চরাতেন। তার বাবা বুদ্ধিমত্তার কারণে গোত্রে যথেষ্ট  সম্মান লাভ করেছিলেন। ওমর (রা.) তাঁর বাবা সম্পর্কে বলেছেন,  “আমার বাবা খাত্তাব ছিলেন খুবই কঠোর প্রকৃতির একজন মানুষ। তিনি আমাকে দিয়ে কঠোর পরিশ্রম করাতেন। যদি আমি কোনো কাজ না করতাম তবে তিনি আমাকে প্রচুর মারধর করতেন এবং ক্লান্ত হওয়া পর্যন্ত কাজ করাতেন।”

তৎকালীন যুগে পড়াশোনার তেমন প্রচলন ছিলো না। তারপরও তরুণ বয়সে ওমর (রা.) লিখতে ও পড়তে শেখেন। এমনকি নিজে কবি না হলেও কাব্য ও সাহিত্যের প্রতি তার প্রবল আগ্রহ ছিল। 

একইসাথে সাহিত্যের পাশাপাশি তিনি কুরাইশ ঐতিহ্য অনুযায়ী  সমরবিদ্যা, অশ্বারোহণ ও কুস্তি বিদ্যা ইত্যাদিও আয়ত্ত করেন ছোট বেলা থেকেই। তিনি যথেষ্ট দীর্ঘদেহী ও শারীরিকভাবে শক্তিশালী ছিলেন। এমনকি ভালো কুস্তিগির হিসেবে তার খ্যাতি ছিল। একইসাথে তিনি ছিলেন একজন ভালো সুবক্তা। শুধু তাইনয়, তার বাবার পরে তিনিই তার গোত্রের একজন বিরোধ মীমাংসাকারী হিসাবে অধিষ্ঠিত হন।

ইসলাম পূর্ববর্তী প্রাথমিক জীবনে ওমর (রা.) একজন ব্যবসায়ী হিসেবে বাণিজ্য শুরু করেন। তিনি ব্যবসার উদ্দেশ্যে বাইজেন্টাইন ও সাসানীয় সাম্রাজ্যে বেশ কয়েকবার সফর করেছিলেন। সেখানে তিনি ঐসব রাজ্যের বিশেষ করে  রোমান ও পারসিয়ান পণ্ডিতদের সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেন। এবং তাদের সংস্পর্শে এসে তাদের সমাজ রাজনীতি অর্থনীতি ও ধর্মীয় রীতিনীতি সম্পর্কে তিনি অবগত হন।

এভাবেই তাঁর ইসলাম পূর্ববর্তী দিনগুলি চলছিল। কিন্তু যখন মুহাম্মদ (সা.) ৬১০ সালে ইসলাম প্রচার শুরু করেন, তখন অন্যান্য মক্কাবাসীর মতোই ওমর (রা.) ও  ইসলামের কট্টর বিরোধিতায় লিপ্ত ছিলেন। শুধু তাইনয় তার হাতে সংখ্যালঘু মুসলিমরা নির্যাতিত পর্যন্ত হতে থাকে। এমনকি  বিরোধিতার এক পর্যায়ে তিনি মুহাম্মাদ (সা.) কে পর্যন্ত হত্যা করতে চেয়েছিলেন। কেননা তিনি বিশ্বাস করতেন, একতাই শক্তি। তাই তিনি কুরাইশদের ঐক্যবদ্ধ থাকাকে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসাবে দেখতেন। যেখানে হঠাৎ করে ইসলামের আবির্ভাব সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছিল। ফলে ইসলামের উত্থানকে কুরাইশদের মধ্য বিভাজন সৃষ্টির কারণ মনে করে ইসলামের ধ্বংস কামনা করতেন এবং সেই প্রচেষ্টা চালাতেন।

এভাবেই যখন তাঁর দিনগুলি চলছিল, তখন হঠাৎই তাঁর জীবনে ঘটে যায় এক আকস্মিক ঘটনা। যে ঘটনার বর্ণনা বেশ কয়েক ভাবে ঐতিহাসিকগণ বর্ণনা করেছেন। আর ঘটনাটি ঘটেছিল ৬১৬ সালে। একটি বর্ণনা যা ইবনে সাদ, ইবনে হিশাম, দারকুতনী ও ইবনে আসীরের বর্ননা করেছেন। একদা ওমর (রা.) নবি মুহাম্মদ (সা.) কে হত্যার উদ্দেশ্যেই বের হয়েছিলেন। যাত্রাপথে তার বন্ধু নাইম বিন আবদুল্লাহর সাথে তার সাক্ষাৎ হয়।  নাইম গোপনে গোপনে মুসলিম হয়েছিলেন তা ওমরের জানা ছিলো না। ওমর তাকে বলেন যে তিনি মুহাম্মদকে হত্যার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। আজ তাঁকে হত্যা করেই ছাড়বেন। তখন তাঁর এই বন্ধু মারফত তার বোন ও ভগ্নিপতির ইসলাম গ্রহণের বিষয়ে জানতে পারেন।

এই খবর জানতে পেরে রেগেমেঘে ওমর তার বোনের বাড়ির দিকে রওনা হলেন।  ঘরের বাইরে থেকেই তিনি কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলেন। এসময় তার ভগ্নিপতি খাব্বাব ইবনুল আরাত তাদের সুরা তাহা বিষয়ে তেলাওয়াত করছিলেন।  ওমর ঘরে প্রবেশের সাথে সাথে  তারা ঐ পাণ্ডুলিপিটি লুকিয়ে ফেলেন। 

কিন্তু চৌকশ ওমর সব বুঝতে পারেন এবং তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। সত্য স্বীকার না করার কারণে ওমর একপর্যায়ে তাদের উপর হাত তোলেন। এমনকি তারা রক্তাক্ত পর্যন্ত হয়। এরপর বোনের কথায়  তার মনে পরিবর্তন হয়। তখন তিনি স্নেহপূর্ণভাবে পাণ্ডুলিপিটি দেখতে চান। কিন্তু ওমর অপবিত্র এবং রাগান্বিত বিধায় তার বোন তাকে পবিত্র হওয়ার জন্য গোসল করতে বলেন। ওমর গোসল করে পবিত্র ও শান্ত হয়ে এলে বোন সুরা তাহার আয়াতগুলো পাঠ করেন। এতেই তার মন ইসলামে বিগলিত হয়। এরপর তিনি মুহাম্মদ (সা.) কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। যখন ওমর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তখন তার বয়স ছিল ৩৯ বছর।

ইসলাম গ্রহণের পর পরই ওমর তার ইসলাম গ্রহণের কথা মুসলিমদের সবচেয়ে কঠোর প্রতিপক্ষ আবু জাহলকে স্পষ্ট করে জানান। শুধু তাইনয় এতদিন গোপনে সালাত আদায় করলেও ওমরের ইসলাম গ্রহণের পর প্রকাশ্যে কাবার সামনে নামাজ আদায় করাতে শুরু করে মুসলিমরা।

ওমরই প্রথম ব্যাক্তি যিনি ইসলাম গ্রহণের পর গোপনীয়তা পরিহার করে প্রকাশ্যে তিনি মুসলিমদের নিয়ে বাইরে আসেন। একইসাথে  কাবা প্রাঙ্গণে সকল নব্য মুসলমানদের নিয়ে উপস্থিত হন। তিনি ছাড়াও হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন। আর সেদিনই  মুহাম্মদ (সা.) তাকে “ফারুক” উপাধি দেন।

উপরোক্ত বর্ণনা ছাড়াও আহমদ ইবনে হাম্বল ও ইবনে হিশামের বর্ননা মতে, ওমরের ইসলাম গ্রহণের আরেকটি ঘটনা এসেছে যে, কোনো এক রাতে ওমর রাসুল মুহাম্মদ (সা.) কে কাবার প্রাঙ্গণে নামাজরত অবস্থায় অনুসরণ করছিলেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) কুরআনের আয়াত নামাজে তেলাওয়াত করছিলেন। তার মুখে কুরআনের বাণী শুনে তার মনে হলো, এটি কোনো মানুষের রচিত নয়, বরং অবশ্যই কোনো না কোনো ঈশ্বরের বাণী। তখন তিনি মুহাম্মাদকে তার ইসলামের প্রতি অনুরাগের কথা জানালেন।

প্রখ্যাত মুহাদ্দিস বুখারীর বর্ননায় আরও এসেছে, ঈমান আনার আগে, ওমর ইবনে খাত্তাব তার বোন ফাতিমা ও ভগ্নিপতি সাঈদকে ইসলাম গ্রহণের কারণে দড়ি দিয়ে বেধে মারধর করতেন। তবে ইসলাম গ্রহণের পর তিনি কিছুটা ভীত হয়ে পড়েন। এবং এই  অবস্থায় লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলেন। স্থানীয় জণগণ তার ধর্মান্তরিত হওয়া জানতে পেরে তাকে মারতে আসলে আল-আস ইবনে ওয়াইল তাকে রক্ষা করেন। তবে এটা সর্বজনবিদিত সত্য যে,  ওমরের ইসলাম গ্রহণের কারণে  মুসলমানদের মনোবল যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। 

হযরত ওমর (রা.) এর শাসন আমল

হযরত আবু বকর (রা.) এর শাসনামলে ওমর (রা.) ছিলেন তার একজন প্রধান সচিব ও উপদেষ্টা। আবু বকর (রা.) মৃত্যুর পূর্বে ওমর (রা.) কে তার উত্তরসূরী হিসাবে নিয়োগ দিয়ে যান। এই হিসাবে হজরত ওমর (রা.) ২৩ জমাদিউস সানি ১৩ হিজরি মোতাবেক ২৪ আগস্ট ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় খলিফা হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

খিলাফতে অধিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথেই তিনি নিম্নোক্ত ভাষণ দেন,   ‘হে আল্লাহ! আমি দুর্বল, আমাকে তুমি শক্তি দাও। হে আল্লাহ! আমি রূঢ় মেজাজের অধিকারী, আমাকে তুমি কোমলপ্রাণ বানাও। হে আল্লাহ! আমি কৃপণ, আমাকে তুমি দানশীল বানাও’ (ইবনে সা‘দ, আত-তাবাকাত)। 

হযরত ওমর (রা.) তার বুদ্ধিমত্তা, রাজনৈতিক সচেতনতা, ইচ্ছাশক্তি, নিরপেক্ষতা, ন্যায়বিচার এবং দরিদ্র ও অসহায়দের প্রতি সদয় আচরণের জন্য পরিচিত ছিলেন। খেলাফতের দায়িত্ব পাওয়ার সাথে সাথেই তিনি শাসনব্যবস্থাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। একইসাথে রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে ব্যাপক ভূমিকা গ্রহণ করেন। 

শাসক হিসেবে ওমর দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের কল্যাণের জন্য সারাটা জীবন কাজ করে গেছেন। তার প্রমাণ আমরা পাই, রিদ্দার যুদ্ধে। যে যুদ্ধে কয়েক হাজার বিদ্রোহী ও ধর্মত্যাগীকে দাস হিসেবে বন্দী করা হয়েছিল। ওমর সকল যুদ্ধবন্দিদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে সাথে সাথে তাদের মুক্তিরও নির্দেশ দেন। এই ঘোষণা বেদুইন গোত্রগুলোর মধ্যে ওমরের তুমুল জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করে। ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সময় উনার সরকার এককেন্দ্রীক ব্যবস্থায় পরিচালিত হতো। এতে খলিফা ছিলেন সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ।

তিনি তাঁর পুরো সাম্রাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন। একইসাথে  আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া এসব অঞ্চলের কিছু স্বায়ত্তশাসিত এলাকা খিলাফতের সার্বভৌমত্ব আয়ত্তে আসে। প্রদেশগুলো প্রাদেশিক গভর্নর বা ওয়ালি কর্তৃক শাসিত হত। ওমর শূরা সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে ব্যক্তিগতভাবে ওয়ালিদের নিযুক্ত করতেন। নিম্নে আমরা হযরত ওমরের শাসনামলের বিস্তারিত একটি চিত্র তুলে ধরা হলো। 

হযরত ওমর (রা.)- এর প্রশাসনিক ভিত্তি

শাসনব্যবস্থার মূল ভিত্তি

ঐতিহাসিকদের মতে হযরত ওমর (রা.) এর শাসনব্যবস্থা চারটি মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। আর তা হলাে- 

  • আল কুরআন, 
  • আল হাদিস, 
  • আল ইজমা 
  • আল কেয়াস।

প্রজাতন্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা

হযরত ওমর (রা.) প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন। প্রতিটি সাধারণ মানুষের পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করাই ছিলো তার শাসনব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য। সম্পূর্ণ গণতন্ত্রের ভিত্তিতে তিনি তার ইসলামী হুকুমত পরিচালনা করতেন। 

ইসলামী জাতীয়তাবাদীতা

তিনি ইসলামের অতন্দ্র প্রহরী। তাই তিনি ইসলামী জাতীয়তাবাদ অক্ষুন্ন রাখার উদ্দেশ্যে খায়বার থেকে ইহুদিদের ও নাজরান থেকে খ্রিস্টানদের উচ্ছেদ করে মুসলমানদের থেকে আলাদা করে  বসবাসের ব্যবস্থা করেছিলেন। 

মজলিসে শূরা

হজরত ওমর (রা.) এর শাসন ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল মজলিসে শূরা। রাষ্ট্রের সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মজলিসে শূরার পরামর্শের মাধ্যমেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হতো। আর মজলিসে শূরায় তাঁরাই অন্তর্ভূক্ত ছিলেন, যারা বিজ্ঞ অভিজ্ঞ এবং  বিদগ্ধ ব্যক্তিবর্গ। এই শূরা পরিষদ মজলিসে আম ও মজলিসে খাস এই দু’ভাগে বিভক্ত ছিল। 

  • মজলিস-ই আমি হচ্ছে সাধারণ পরিষদ। যা বয়ােজ্যেষ্ঠ সাহাবা এবং মদিনার গণ্যমান্য লোক নিয়ে গঠিত ছিল। কোনাে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের জন্য মদিনার প্রধান মসজিদে খলিফা এ পরিষদের সভা ডাকতেন। এই পরিষদের সদস্য ছিলেন, হজরত আলী, আবদুর রহমান ইবনে আউফ, মুআজ ইবনে জাবাল, উবাই ইবনে কাব, জায়েদ ইবনে ছাবেত (রা.) এর মতো বিশিষ্ট সাহাবিরা। যারা সরাসরি রাষ্ট্রীয় যেকোনো সিদ্ধান্ত জড়িত থাকতো। বিভিন্ন জরুরী প্রয়োজনে খলিফা এই সভা ডাকতেন। 

 

  • মজলিস-ই খাসি বা  বিশেষ পরিষদ। দৈনন্দিন বিভিন্ন প্রয়োজনে নানান এন্তেজাম ও আলাপ আলােচনার জন্য তিনি এ মজলিস-ই খাসের পরামর্শ নিতেন। এ পরিষদে কেবল মুহাজিরদের মধ্য হতে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি উপস্থিত থাকতেন।

দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ 

স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে থেকে যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারি কাজে লোক নিয়োগের ব্যবস্থা করা ছিলো হজরত ওমর (রা.) প্রজাতন্ত্রের একটি যুগান্তকারি সাফল্য। একইসাথে   সরাসরি সরকারি  দায়িত্বে নিয়োজিতরা  কেউ যেন অবৈধ উপার্জন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারে, সে জন্য তাদের কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা নেওয়া হতো।

কর্মকর্তাদের আচরণবিধি নিয়ন্ত্রণ

হযরত ওমর (রা.) মজলিসে শূরার পরামর্শক্রমে সরকারি কর্মকর্তাদের আচরণবিধি প্রণয়ন করতেন। এই আচরণ বিধি মােতাবেক কোনাে সরকারি কর্মকর্তা কী কী খাবে, কী কী পোশাক পড়বে তা নিয়ন্ত্রিত হতো। একইসাথে তাদের ব্যক্তিগত বিভিন্ন প্রয়োজনও নিয়ন্ত্রণ করা হতো। যেমন দরজায় দারােয়ান ও উৎকৃষ্ট মানের তুর্কি ঘােড়া ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। সেইসাথে  সরকারের দায়িত্বের অংশ হিসেবে রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া এবং মৃতের জানাযায় শরীক হওয়া বাধ্যমূলক করা। 

নগরে মতামত গ্রহণ

রাজ্যের যেকোনো প্রয়োজনে নগরের মতামত গ্রহণ করা ছিলো খলিফা ওমরের শাসনামলের একটি বৈশিষ্ট্য। বিশেষ করে প্রদেশ ও জেলায় শাসনকর্তা কিংবা কোনো কর্মকর্তা নিয়ােগের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণের মতামত গ্রহণ করতেন।

সাম্যবাদী শাসন ব্যবস্থা

হযরত ওমর (রা.) শাসন ব্যবস্থাকে সাজিয়েছিলেন ইসলামের সাম্য, স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব ও গণতান্ত্রিক নীতি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর। ফলে তার শাসনামলে  শাসক ও শাসিতের মধ্যে কোনাে ভেদাভেদ ছিলো না। এমনকি  নিজে সাধারণ প্রজা অপেক্ষা বেশি সুযােগ সুবিধা ভােগ করেননি। তার নিকট সকলেই ছিলো সমান।

শাসনতান্ত্রিক সংস্কার

ওমর (রা.) তাঁর শাসনামলে বিভিন্ন  শাসনতান্ত্রিক সংস্কার করেছিলেন। তারমধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে-

কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা

হযরত ওমর (রা.) কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে মূল ক্ষমতার একটি ভিত্তি গড়ে তোলেন। যেখানে তিনি  সরকারের সর্বাধিনায়ক হন। একইসাথে বিভিন্ন উচ্চ পদে যােগ্যতম সাহাবীদের নিয়ােগ করার মাধ্যমে সাম্য ও ন্যায়নীতিভিত্তিক আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা

কেন্দ্রীয় সরকারের অনুকূলে শাসনকার্যের সুবিধার জন্য হযরত ওমর (রা.) তার সমগ্র সাম্রাজ্যকে ১৪টি প্রদেশে এবং প্রদেশগুলােকে বিভিন্ন জেলায় বিভক্ত করেন। এগুলো হলো, 

  • মদিনা,
  • কুফা, 
  • সরা, 
  • সুসতাত, 
  • মিসর, 
  • দামেস্ক, 
  • হিমস, 
  • প্যালেস্টাইন, 
  • মােসেল।

পুলিশ বিভাগ প্রতিষ্ঠা

সাধারণ জনগণের জান মালের নিরাপত্তা দিতে এবং রাজ্যে  অপরাধ প্রবণতা প্রতিরােধকল্পে হযরত ওমর (রা.) সর্বপ্রথম একটি সুশৃঙ্খল ও সুগঠিত পুলিশ বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। এই বাহিনীর সার্বিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রিত হতো  ‘দিওয়ানুল আহদাত’ নামে একটি বিভাগের মাধ্যমে। 

শাস্তির ব্যবস্থা

সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের  প্রতি খলিফা ওমর (রা.) এর সাধারণ নির্দেশ ছিলো হজ্জের সময় যেন সবাই মক্কাতেই উপস্থিত থাকে। এর কারণ হচ্ছে, এই সময় বিপুলসংখ্যক লোক হজ্জ্ব উপলক্ষে মক্কায় সমবেত হতো। তখন খলিফা ওমর নিজেই জনসাধারণের কাছ থেকে তাঁর সকল কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ শুনতেন।

কয়েদখানা নির্মাণ

খলিফা ওমর (রা.) সরকারি খরচে  সাফওয়ান ইবনে উমাইয়ার বাড়ি ক্রয় করেন। এবং পরবর্তীতে এই বাড়িকে জেলখানায় রূপান্তর করেন। এছাড়াও প্রতিটি প্রদেশে এবং জেলাতেও একটি করে জেলখানা নির্মাণের নির্দেশ প্রদান করেন।

তদন্ত বিভাগ

বিভিন্ন সময় সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আসত, তা তদন্তের জন্য খলিফা ওমর (রা.) একটি তদন্ত বিভাগ তৈরি করেন। যার দায়িত্ব দেওয়া হয় মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা আনসারী নামে বিশিষ্ট্য সাহাবীকে।

তদন্ত কমিশন

বিচার প্রার্থীদের সুষ্ঠু বিচারের লক্ষ্যে জরুরী কোনো কোনো ঘটনার তদন্তের জন্য খলিফা ওমর একাধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি  তদন্ত কমিশন গঠন করেন। যাদের কাজ ছিলো প্রকৃত সত্য বের করে আনা। যাতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।  

গুপ্তচর বিভাগ প্রতিষ্ঠা

হযরত ওমর তাঁর শাসন ব্যবস্থাকে দুর্নীতিমুক্ত রাখার জন্য একটি  গুপ্তচর বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। যাতে করে তিনি প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের কার্যাবলি সম্পর্কে সম্যক ধারণালাভ করতে পারেন।

স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা

খলিফা ওমর (রা.) এর শাসনামলে তিনি বিচার বিভাগকে সর্বদা  নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা রেখেছিলেন। যাতে  একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।  তার আমলে কাযীরা পবিত্র কুরআন ও হাদিসের ফয়সালা মতেই বিচার করতেন। এই কাজের জন্য ওমর (রা.) কাযীদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাতা দিতেন। 

দৃষ্টান্তমূলক বিচার

খলিফার কাছে সবাই সমান। এই বিধান কথায় নয়, কাজে পরিণত করার জন্য তিনি ব্যাপকভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তিনি আল্লাহর নির্দেশ পালনের ক্ষেত্রে কোনো নিন্দুকের নিন্দার কোনো পরোয়া করেননি। এমনকি  দণ্ড কার্যকর করতে গিয়ে তিনি তাঁর ছেলেকেই মেরে ফেলেছিলেন।

সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আদালত

ওমরের শাসনামলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিলো ব্যাপক সংখ্যক আদালত। তিনি তাঁর রাজ্যের সর্বত্র জনসংখ্যানুপাতে অসংখ্য আদালত প্রতিষ্ঠা ও বিচারক নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। তাঁর সময়ে এমন জনপদ ছিল না যেখানে অন্তত একজন বিচারক ছিলেন না। এমনকি মুসলিম ব্যাতীত অন্যান্য অমুসলিমদের জন্যও তাদের ধর্মীয় আইনসম্মত বিচারকাজ পরিচালনার জন্য পৃথক আদালত প্রতিষ্ঠা করেন। 

রাষ্ট্রীয় আয় ও ব্যয়ের বিভিন্ন খাত

হযরত ওমর (রা.) আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রীয় আয়ের কয়েকটি উৎস নির্ধারণ করেন। যেমন-

রাজস্ব কর

হযরত ওমর (রা.) পূর্ববর্তী যাবতীয় রাজস্বনীতি পরিবর্তে শুধুমাত্র কুরআন সুন্নাহর আলোকে  রাজস্বব্যবস্থা চালু করেছিলেন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রয়োজনের ভিত্তিতে  তিনি রাজস্ব আয়ের বিভিন্ন শ্রেণিবিন্যাস করেন। তার শাসনামলে যাকাত, খারাজ, জিযিয়া, গনীমত, ফায় ও উশর ইত্যাদি ছিল রাষ্ট্রের প্রধান আয়ের উৎস।

সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব 

খলিফা ওমর ছিলেন খুবই তীক্ষ্ণ প্রকৃতির মানুষ। তাই তিনি তার সরকারি কাজে কোনো কর্মকর্তা নিয়োগকালে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিস্তারিত তথ্য তাঁর কাছে জমা রাখতেন।  অতঃপর কখনো যদি কারো সম্পদে অস্বাভাবিক উন্নতি দেখা দিলে তিনি তার বিরুদ্ধে তৎক্ষণাৎ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন।  

বায়তুল মাল 

হযরত ওমর (রা.) তাঁর রাজ্যের যাবতীয় রাজস্ব ও সরকারি টাকাপয়সার হিসাবের জন্য  ‘বায়তুল মাল’ নামে একটি রাজস্ব কোষাগার প্রতিষ্ঠা করেন। যার প্রধান কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত করা হয়  আবদুল্লাহ ইবনে আরকামকে।

মুদ্রার সংস্কার

ঐতিহাসিকদের মতে হযরত  ওমরের শাসনামলে ইসলামী সাম্রাজ্যে অনেক মুদ্রার অনুপ্রবেশ ঘটে। তাই তিনি দিনার ও দিরহামের মধ্যে ১ : ১০ অনুপাত নির্ধারণ করে দেন।

ভূমিকর নির্ধারণ

হযরত ওমর (রা.) এর আমলে প্রথম ভূমিকর নির্ধারণ করা হয়। প্রতিটি জমি জরিপ করে উৎপাদিত শস্য অনুসারে ভূমিকর নির্ধারণ করা হয়। 

দিওয়ানুল খারাজ

সময়ের সাথে সাথে ইসলামী সাম্রাজ্য বৃদ্ধির কারণে সঠিক আয় ব্যয়ের হিসাব রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। তাই তিনি  আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসাব রাখার জন্য ‘দিওয়ানুল খারাজ’ নামে একটি নতুন রাজস্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। রাষ্ট্রীয় সকল আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখাই ছিল এর প্রধান দায়িত্ব। 

কর্মচারীদের বেতন ভাতা

হযরত ওমরের শাসনামলে সকল সরকারি কর্মচারীদের কর্মকর্তাদের যােগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও মেধানুসারে বেতন নির্ধারিত ছিলো। একজন  প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার দিরহাম পর্যন্ত ভাতা দেয়া হতাে। একইসাথে তারা গনীমতেরও অংশ পেতেন।

জনশুমারি 

পৃথিবীর ইতিহাসে হযরত ওমর (রা.)-ই সর্বপ্রথম জনশুমারির মাধ্যমে জনসংখ্যা গণনা করেছিলেন। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো সাম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার লােকের ভিত্তিতে নানান সুবিধা প্রদান করা।

সামরিক সংস্কার

সৈনিকের শ্রেণিবিভাগ

খলিফা ওমর (রা.) সেনাবাহিনীকে পদাতিক, অশ্বারােহী, তীরন্দাজ, বাহক, সেবক ইত্যাদি নানানভাগে বিভক্ত করেন।

সৈনিকদের ভাতা

তার আমলে সকল সৈন্যদের বেতনের একটা পরিমাণ নির্ধারিত ছিল। একইসাথে সরকারিভাবে তাদের পােশাক-পরিচ্ছদও সরবরাহ করা হতাে।

ভূমি সংস্কার

প্রান্তিক কৃষকদের জমি প্রদান

হযরত ওমর (রা.) বিজিত রাজ্যের সকল জমি রাষ্ট্রীয় দখলে এনে কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। এছাড়াও অনাবাদি জমি ভূমিহীন গরিব কৃষকদের মাঝে ন্যায্যতার সহিত চাষ করার জন্য ভাগ করে দেন।

অগ্রাধিকার ভিত্তিক কৃষি কাজ

বিভিন্ন যুদ্ধে যেসব এলাকা ইসলামী সাম্রাজ্যের অধীনে আসতো, সেইসব এলাকার স্থায়ী বাসিন্দারা ছিলো কৃষি কাজে অত্যন্ত দক্ষ। এদিকে আরবের লােকেরা ছিলো কৃষিকাজে অনভিজ্ঞ। এই কারণে কৃষি কাজের উন্নতিকল্পে আরব মুসলমানদেরকে বিজিত এলাকায় জমি ক্রয় ও কৃষি কাজ না করার নির্দেশ দেন, যাতে জমি নষ্ট না হয় এবং উৎপাদন কাজ ব্যাহত না হয়।

জনহিতকর কার্যাবলী

হিজরী সনের প্রতিষ্ঠা

হযরত ওমর (রা.) এর অমর কীর্তি হচ্ছে হিজরী সাল প্রবর্তন করা বা  ইসলামী ক্যালেন্ডার তৈরি করা।

শহর বিনির্মাণ

হযরত ওমর (রা.) এর খেলাফতকালে বসরা, কুফা ও ফেস্তাত নামে তিন তিনটি আধুনিক নতুন শহর স্থাপিত হয়।

ইবাদতখানা নির্মাণ

ঐতিহাসিকদের মতে হযরত ওমরের আমলে ব্যাপক সংখ্যক  মসজিদ, মক্তব, মাদরাসা এমনকি অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্যও ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মিত হয়।

দাসপ্রথার বিলুপ্তি

ঐতিহাসিকদের মতে দাসপ্রথার বিলুপ্তি করাই ছিলো  হযরত ওমর (রা.) এর অনন্য কৃতিত্ব।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা

শিক্ষিত হওয়ার কারণে হযরত ওমর শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে হযরত ওমর (রা.) তাঁর সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য মাদরাসা ও বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেন। 

যােগাযােগ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ

ইসলামী সাম্রাজ্যের জনকল্যাণে বহুমখী কর্মসূচির মধ্যে যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন ছিল তাঁর শাসনামলে অন্যতম একটি উল্লেখযোগ্য দিক। নতুন নতুন শহরের জন্য তিনি রাস্তাঘাট নির্মাণ করেন। এ ছাড়াও গৃহনির্মাণ, সেতু, খাল, দূর্গ ইত্যাদি নির্মাণ করে একটি আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন।

হযরত ওমর (রা.) রাতের আধারে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেড়াতেন কেন

মানব-প্রেমিক! আজিকে তোমারে স্মরি,

মনে পড়ে যত মহত্ত্ব-কথা – সেদিন সে বিভাবরী

নগর-ভ্রমণে বাহিরিয়া তুমি দেখিতে পাইলে দূরে

মায়েরে ঘিরিয়া ক্ষুধাতুর দুটি শিশু সকরুণ সুরে

কাঁদিতেছে আর দুঃখিণী মাতা ছেলেরে ভুলাতে, হায়,

উনানে শূণ্য হাঁড়ি চড়াইয়া কাঁদিয়া অকূলে চায়!

শুনিয়া সকল – কাঁদিতে কাঁদিতে ছুটে গেলে মদিনাতে

বয়তুল-মাল হইতে লইয়া ঘৃত আটা নিজ হাতে,

বলিলে, “এসব চাপাইয়া দাও আর পিঠের পরে,

আমি লয়ে যাব বহিয়া এ-সব দুখিনী মায়ের ঘরে।”

কবি নজরুল ইসলাম সঠিক ভাবেই ওমরের চরিত্র চিত্রায়িত করতে পেরেছিলেন। তাঁর কবিতাতেই ফুটে উঠেছে হযরত ওমর কেন রাত্রিতে একাকী ঘুরে বেড়াতেন। 

হযরত খলিফা ওমর ছিলেন দুঃখী, দরিদ্রের, দুস্থ, অবহেলিতের,  সত্যিকারের একজন সেবক। মানুষের দুঃখ দুর্দশা তার মনে চরমভাবে আঘাত হানত।  জনগণের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করাকেই নিজের জীবনের ব্রত হিসাবে নিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, 

“ফোরাত নদীর তীরে একটি ছাগলও যদি অনাহারে মারা যায় তবে, আমি ওমরকে আল্লাহর কাছে এজন্যে জবাবদিহি করতে হবে।” 

এইটা তার শুধু বিশ্বাস নয় বরং তিনি তা কাজে প্রমাণ করে গেছেন। এই জন্যই তিনি রাতের আঁধারে ছদ্মবেশ নগরীর আনাচে-কানাচে একাকী ঘুরে বেড়াতেন।

 

একরাতে তিনি হাররা ওয়াকিম দিয়ে যাচ্ছিলেন। যাওয়ার পথে তিনি দেখলেন এক তাঁবুর সামনে এক মহিলা চুলায় একটা পাত্রে কিছু জ্বাল দিচ্ছেন। আর তাকে ঘিরে কয়েকটি শিশু কাঁদছে। তিনি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘শিশুরা কাঁদছে কেন?’ 

মহিলার জবাব দিলেন, “ক্ষুধার যন্ত্রণায়”

“তুমি চুলায় কী রান্না করছ?” “কিছুই না। পাত্রের পানি জ্বাল দিয়ে ফুটাচ্ছি। আর অপেক্ষা করছি কখন কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে ওরা ঘুমিয়ে পড়ে।”

মহিলার এমন জবাবে ওমর কাঁদতে শুরু করলেন। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে দৌড় দিলেন রাষ্ট্রীয় গুদামের দিকে। সেখানে একটি প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী একটি বস্তায় ভরলেন। উপস্থিত তাঁর একজন সহচর আসলামকে বললেন, বস্তাটা তার পিঠে উঠিয়ে দিতে। একজন খলিফার মুখে এমন কথা শুনে আসলাম আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন, “আমিরুল মোমেনিন, আপনি সামনে এগোতে থাকেন,  আমি বস্তা পিঠে করে নিয়ে আসছি।”

তার কথায় ওমরের উত্তর ছিলো, 

“তুমি কি শেষ বিচারের দিবসে আমার পাপের বোঝা বহন করবে? অতএব আমার বোঝা আমার পিঠে তুলে দাও।”

ওমর নিজের পিঠে করে খাদ্যসামগ্রী বোঝাই বস্তা নিয়ে মহিলার কাছে উপস্থিত হলেন। এবং নিজেই চুলার ওপরে ফুটন্ত পানির পাত্রে আটা ও চর্বি মিশিয়ে জ্বাল দিলেন। 

যখন ধীরে ধীরে মোটা রুটি প্রস্তুত হলো, তখন তিনি নিজে তা শিশুদের পরিবেশন করলেন। আর  শিশুরা তৃপ্তির সাথে রুটি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। অবশিষ্ট খাদ্যসামগ্রী তিনি ওই নারীকে দিয়ে তিনি আল্লাহর কাছে ক্ষমা এবং তাঁর শুকরিয়া আদায় করতে করতে ফিরে এলেন। আর এভাবেই খলিফা ওমর রাতের নিশিতে বিপন্ন মানুষের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়তেন।

 

হযরত ওমর (রা.) এর মৃত্যুর ঘটনা

আমরা সবাই জানি ২৪ হিজরীতে ওমর (রা.) মৃত্যু বরণ করেন। আসলে তাঁর মৃত্যু নয় বরং তাকে হত্যা করা হয়েছিল। এই জঘন্য ঘটনাটি ২৩ হিজরিতর শেষের দিকে ঘটে।  তিনি জানতেন যে তিনি বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন। তাই আল্লাহর কাছে সর্বদা ফরিয়াদ করতেন, “হে আল্লাহ! আমাকে আপনার রাস্তায় শাহাদাত নসিব করুন এবং রাসুলের শহরে মৃত্যুদান করুন।”

অগ্নিপূজারী গোলাম ফিরোজ

হযরত ওমর (রা.) হজ্ব থেকে ফিরে এসে সরকারি দায়িত্বে পূর্ণ মনোনিবেশ করেন। ইতিহাসবিদরা বর্ণনা করেন, মদীনায় তখন অগ্নিপূজক গোলাম ফিরোজ আবু লুলু বসবাস করতো।

অগ্নি পূজারী গোলাম ফিরোজ হচ্ছে হযরত ওমরের হত্যাকারী। সে ২১ হিজরীতে পারস্যের সর্বশেষ যুদ্ধ নিহাওয়ান্দাতে যুদ্ধে বন্দী হয়ে এসেছিল। পরবর্তীতে তাকে মদীনায় আনা হলে সে  হযরত মুগিরা (রা.) এর ভাগের মধ্যে পড়ে।

এই গোলাম ছিলো একজন ভালো চিত্রকর, কাঠমিস্ত্রি এবং কামার ছিল। সে হাতের তৈরি বিভিন্ন জিনিষ তৈরিতে অত্যন্ত দক্ষ ছিল। তৎকালীন সময়ে কোনো গোলাম কোনো কাজে পারদর্শী হলে, তাকে সেই কাজ করার সুযোগ দেওয়া হতো। এর বিনিময়ে সে তার মালিককে কিছু খরচ দিতো। যাকে খারাজ বা কর বলা হয়।

একদিকে তখনকার ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা বৃদ্ধি পাওয়ার পর ওমর (রা.) অমুসলিমদের মদীনায় থাকতে দিতেন না। যে কারণে এই গোলামও স্বাধীন কাজ করার জন্য মদীনায় থাকার যোগ্যতা রাখে না। কিন্তু তার শৈল্পিক কাজের মাধ্যমে মদীনাবাসীর উপকৃত হওয়ার কারণে, হযরত মুগিরা (রা.) ওমর (রা.) এর নিকট সুপারিশ করেন যে,  ফিরোজকে যেন মদীনায় থাকার অনুমতি দেন। আর তার কথার ভিত্তিতে হযরত ওমর ফিরোজকে মদিনায় থাকার অনুমতি প্রদান করেন। আর এভাবেই তারা দিনাতিপাত করছিল। 

ফিরোজের অভিযোগ

এদিকে ফিরোজ কাজ করে যথেষ্ট আয় রোজগার করলেও, সে তাঁর মুনিব হযরত মুগিরা বিন শুবা (রা.) কে নির্ধারিত কর দিতে অস্বীকার করে। ফলে ঐ সাহাবী হযরত ওমর (রা.) এর কাছে অভিযোগ করেন। 

অভিযোগের ভিত্তিতে হযরত ওমর দেখতে পান যে, ফিরোজ যথেষ্ট ভালো আয় করেন। এবং তার মালিককের প্রাপ্য করও ন্যায়সঙ্গত। সুতরাং ফিরোজের অভিযোগ তিনি খারিজ করে দেন। ফিরোজ তখন এই বলে চলে যায় যে, 

“তার ইনসাফের দাঁড়িপাল্লা আমি ছাড়া সবার জন্যই অবারিত।”

ফিরোজের অসন্তুষ্ট মনোভাবে চলে যাওয়া খলিফা ওমরের ভালো লাগেনি। তিনি চান না কেউ তাঁর কাছ থেকে অসন্তুষ্টি নিয়ে ফিরে যাক। তাই তিনি হযরত মুগিরা (রা.) এর নিকট তার কর কমিয়ে দেয়ার জন্য সুপারিশ করার কথা চিন্তা করলেন।

কয়েকদিন পর খলিফার সাথে ফিরোজের সাথে দেখা হলে ওমর (রা.) বললেন,

শুনলাম তুমি নাকি ভালো চাক্কি বানাতে পার? আমাকে কি একটি বানিয়ে দিবে?”

সে তখন প্রতিশোধের ভঙ্গিতে বললো, 

“আমি এমন চাক্কি বানাবো যে পূর্ব এবং পশ্চিমে বসবাসকারী সকলেই তা দেখতে পারবে।”

হযরত ওমর (রা.) তার কথার মর্মার্থ বুঝতে পারলেন যে, এই গোলাম তাঁর প্রতি প্রতিশোধ নেওয়ার ধান্ধায় আছে। তারপরও তিনি তাকে তার রাস্তায় ছেড়ে দিলেন। হযরত ওমর তাকে ছেড়ে দিলেও সে ওমরকে ভুলে যায় নি। আর তাই সে ২৭ জিলহজ্জ বুধবার হযরত ওমরকে হত্যার পরিপূর্ণ পরিকল্পনা করে।

পরিকল্পনা মোতাবেক ঐ দিন  আমিরুল মুমিনীন হযরত ওমর প্রতিদিনের মতো ফজরের নামাজ পড়ানোর জন্য মেহরাবে উপস্থিত হন। যখনই তিনি তাকবীরে তাহরীমা বলেন, তখনই আগে থেকে সেখানে লুকিয়ে থাকা ফিরোজ বেরিয়ে আসে।

আর বেরিয়ে এসেই সে ওমর (রা.) এর পিঠে খঞ্জর দ্বারা পরপর ছয়টি আঘাত করে বসে। এতো আঘাত সহ্য করার পরও অসম সাহসী ও পাহাড়সম হিম্মতের অধিকারী খলিফা ওমর (রা.) কোনোরূপ টু-শব্দও করেন নি।

হঠাৎই এমন আঘাতে তিনি মারাত্মক আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ফিরোজের আক্রমণটি এতটাই আকস্মিক ছিল যে, পেছনের কাতারে দাড়ানো মুসল্লিরাও কিছু টের পান নি।

যখন মুসল্লিরা ইমাম ওমর (রা.) এর কেরাতের আওয়াজ শুনতে পেলেন না, তখন তার পেছনে থাকা কাতারের লোকেরা তাসবিহ বলে লোকমা দিতে থাকে। এরমধ্যেই ফিরোজ পালিয়ে যেতে থাকে। কেউ কেউ বিষয়টি বুঝতে পেরে তাকে ধরার চেষ্টা করেন। কিন্তু সে তাদেরকেও খঞ্জর দ্বারা আঘাত করে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়।

ফিরোজের খঞ্জরের মারাত্মক আঘাতে প্রায় ১৩ জন মুসলমান নিমিষেই রক্তাক্ত হয়ে পড়ে যান। তার এমন দক্ষ খঞ্জর চালানোর দক্ষতার কথা আগে কেউ জানতো না। তার আঘাতের জোর এতটাই তীব্র ছিল যে, প্রায় ৯ জন মুসলমান সেখানেই  সেখানে মারা যান। ফিরোজ জানে যে সে অবশ্যই ধরা পড়ে যাবে। তাই সে গ্রেপ্তার হওয়া থেকে বাঁচার জন্য নিজেই  নিজের গলায় খঞ্জর চালিয়ে আত্মহত্যা করে।

এদিকে আমিরুল মুমিনীন আহত হয়ে মেহরাবে পড়ে ছিলেন। তার তখনো কোনো হুশ ছিল। তিনি তখন বাকি নামাজ পড়ানোর জন্য আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) কে সামনে এগিয়ে দেন। তিনি যথেষ্ট সংক্ষেপে দু রাকাত নামাজ পড়ান। ফিরোজের ধারালো খঞ্জটি ওমর (রা.) এর পেট ও পিঠ ছিঁড়ে ফেলেছিল। তারপরও তাঁর হুশ নিজের নিয়ন্ত্রণে ছিল। 

নামাজ শেষ হওয়ার পর তিনি জানতে চান, “ইবনে আব্বাস! দেখ তো লোকটা কে ছিল?”

তখন তিনি জেনে এসে জানলেন, লোকটি ছিলো মুগিরা বিন শুবা (রা.) এর গোলাম। ওমর (রা.) তখন বললেন, ও আচ্ছা। তাহলে সেই কারিগর!

তারা বললো, জি হ্যাঁ। সেই।

এরপর ওমর (রা.) বললেন, “আল্লাহ তাকে ধ্বংস করুন। আমি তো তার ব্যাপারে ইনসাফের ফায়সালা দিয়েছিলাম।”

তিনি আরো বলেন, “আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে, তিনি কালিমা পড়ুয়া কারো হাতে আমার মৃত্যুদান করেন নি।”

মৃত্যু ওমরের অসিয়ত

রক্তাক্ত অবস্থায় ওমর (রা.) কে  ‍উঠিয়ে ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। আঘাত এতটাই মারাত্মক ছিল যে, কোনোক্রমেই রক্ত বন্ধ করা যাচ্ছিল না। এই জন্য তিনি বারবার হুশ হারিয়ে ফেলেছিলেন।  তাকে খাবার হিসেবে প্রথমে নাবিজ ও দুধ দেয়া হয়। কিন্তু সব খাবার দাবার ক্ষতস্থান দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল।

তাঁর এই পরিস্থিতি দেখে চিকিৎসকরা তার জীবনের ব্যাপারে নিরাশা প্রকাশ করেন।  পুত্র আব্দুল্লাহ (রা.) তার দায়িত্বে থাকা ‍ঋণের হিসাব করেন। দেখা যায় তার ঋণের পরিমাণ ৮৬ হাজার দিরহাম। এই ঋণের টাকা কোনটির পর কোনটি আদায় করতে হবে, সে বিষয়ে তিনি সন্তানকে বুঝিয়ে দেন।

পরবর্তী খলিফা নিয়ে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সে জন্য  তিনি অত্যন্ত যৌক্তিক ফায়সালা করেন। তিনি ছয়জন মহান সাহাবীর নাম উল্লেখ করেন। তারা হলেন, হযরত উসমান, আলী, আব্দুর রহমান ইবনে আউফ, তালহা, যুবায়ের, সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) এর সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। তিনি বলেন, “আমার মৃত্যুর তিনদিনের মধ্যেই যেন উনারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে কাউকে আমির নির্বাচন করে নেন।”

ওমর (রা.) যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তার নিজের ছেলেকে উক্ত কমিটিতে রাখেন নি। তিনি শুধু তাকে পরামর্শসভায় অংশগ্রহণের অনুমতি দিয়েছিলেন।

ওমরের শেষ ইচ্ছা

ওমর (রা.) এর প্রবল ইচ্ছা ছিল প্রিয়তম মানুষ হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর পাশে দাফন হওয়ার। তাই তিনি আয়েশা (রা.) এর নিকট আবেদন করলেন। তখন আয়েশা (রা.) তাকে বলেন, “আমি জায়গাটি আমার জন্য পছন্দ রেখেছিলাম। কিন্তু আমি ওমরকে প্রাধান্য দিচ্ছি।”

ওমর (রা.) যখন এটা জানতে পারেন তখন তিনি বলেন, “এ চেয়ে বড় কোনো তামান্না আর নেই।”

শেষ নিঃশেষ ত্যাগ 

হযরত ওমর (রা.) আহত হওয়ার তিন দিন পর ২৪ হিজরীর মহরম মাসের ১ তারিখে পৃথিবীর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেন। সাহাবী হযরত সুহাইব বিন রুমি (রা.) ওমর (রা.) অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই নামাজের ইমামতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। আর তাই তিনি তাঁর  জানাযাও পড়ান। শুধু তাইনয় পরবর্তী খলিফা নির্বাচন হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি নামাজের দায়িত্ব পালন করেন।

জানাযার পর ওমর (রা.) কে রাসুল সা. ও আবু বকর (রা.) এর পাশে সমহিত করা হয়। হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বলেন, ওমর (রা.) এর মৃত্যুর সময় বয়স ছিল ৫৮/৫৯ বছর।

হযরত ওমর (রা.) ছিলেন ইসলামের তথা গােটা বিশ্বের আকাশে এক দীপ্তিমান নক্ষত্র।  হজরত ওমর (রা.) শুধু বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিজেতাদের অন্যতমই ছিলেন না, বরং আদর্শ শাসক হিসেবেও তিনি বিশ্ব ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি স্বীয় আভা বিকিরণ করে ইসলামী জগৎকে ধন্য করেছেন। তার শাসননীতি যুগ থেকে যুগান্তর ধরে যে কোনাে রাষ্ট্রবিদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করবে।

হযরত ওমর (রা.) এর জীবনী বই 

 

  • গল্পে হযরত ওমর (রা.), ইকবাল কবীর মোহন
  • হযরত ওমর (রা.) জীবন, মুহম্মদ জালালউদ্দীন বিশ্বাস
  • গল্পে গল্পে হযরত ওমর ফারুক (রা.) ১০০ ঘটনা, মুহাম্মদ সিদ্দিক আল মিনশাবি
  • হযরত ওমর ফারূক (রা.) জীবনকথা, ড. শায়খ আলী তানতাবী রাহ.
  • আলোর দিগন্তে হযরত ওমর (রা.), ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী
  • হযরত ওমর ফারূক রা. -১ম খণ্ড, ডক্টর মুহাম্মদ হুসায়ন হায়কল
  • ওহীর সংবাদ ওরা জান্নাতী (হযরত ওমর (রা.)), ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী
  • হযরত ওমর ফারুক রা. এর ১০০ ঘটনাবলী, মুফতী রুহুল আমীন যশোরী
  • ইতিহাসের সোনালী পাতা থেকে হযরত ওমর (রা.), মাওলানা ডক্টর শাহ্‌ মুহাম্মাদ আবদুর রাহীম
  • হাদিসে কিরতাস এবং হযরত ওমর (রা.) এর ভূমিকা, আব্দুল করীম মুশতাক
  • ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রা.), মোবারক করীম জওহর

পাঠকদেরপ্রশ্নোত্তর

হযরত ওমর (রা.) এর স্ত্রীর নাম কি

হযরত ওমরের স্ত্রীদের নাম ও তাদের সন্তানদের তালিকা-

 

হযরত ওমর (রা.) তাঁর জীবনে সর্বমোট নয়টি বিয়ে করেন। তার সন্তান সংখ্যা ছিলো ১৪ জন। ছিল। তাদের মধ্যে ১০ জন ছেলে ও ৪ জন মেয়ে।

 

  • স্ত্রী : জয়নব বিনতে মাজুন (যার সাথে বিয়ে হয় জাহিলিয়ার যুগে)

ছেলে : আবদুল্লাহ ইবনে ওমর

ছেলে : আবদুর রহমান ইবনে ওমর (জেষ্ঠ্য জন)

ছেলে : আবদুর রহমান ইবনে ওমর

মেয়ে : হাফসা বিনতে ওমর

  • স্ত্রী : উম্মে কুলসুম বিনতে জারউয়িলা খুজিমা (তালাকপ্রাপ্ত)

ছেলে : উবাইদুল্লাহ ইবনে ওমর

ছেলে : জায়েদ ইবনে ওমর

  • স্ত্রী : কুতাইবা বিনতে আবি উমাইয়া আল মাখজুমি (তালাকপ্রাপ্ত)
  • স্ত্রী : উম্মে হাকিম বিনতে আল হারিস ইবনে হিশাম

মেয়ে : ফাতিমা বিনতে ওমর

  • স্ত্রী : জামিলা বিনতে আসিম ইবনে সাবিত ইবনে আবিল আকলাহ (তিনি আউস গোত্রের সদস্য ছিলেন)

ছেলে : আসিম ইবনে ওমর

  • স্ত্রী : আতিকা বিনতে জায়েদ ইবনে আমর ইবনে নুফায়েল

ছেলে : ইয়াদ ইবনে ওমর

  • স্ত্রী : উম্মে কুলসুম বিনতে আলি (আলি ইবনে আবি তালিবের মেয়ে)

ছেলে : জায়েদ ইবনে ওমর (“ইবনুল খালিফাতাইন” বা “দুই খলিফার (আলি ও ওমরের) সন্তান” বলে পরিচিত)

মেয়ে: রুকাইয়া বিনতে ওমর

  • স্ত্রী : লুহাইহা

ছেলে: আবদুর রহমান ইবনে ওমর (সর্বকনিষ্ঠ জন)

  • স্ত্রী : ফুকাইহা

মেয়ে: জয়নব বিনতে ওমর

  • জুবায়ের ইবনে বাক্কার (আবু শাহমাহ বলে পরিচিত) নামে তার আরেক সন্তান ছিল তবে তার মা কে তা জানা যায় না।

হযরত ওমর (রা.) এর হত্যাকারীর নাম কি?

হযরত ওমরের হত্যাকারী ছিলেন একজন দাস। তার নাম ছিলো পিরুজ নাহাওয়ান্দি যাকে সবাই আবু লুলু নামে চিনতো। 

হযরত ওমর (রা.) এর শাসন আমল কত বছর? 

হযরত আবু বকর (রা.) এর পরবর্তী খলিফা নির্বাচন হন হযরত ওমর (রা.)। তিনি দীর্ঘদিন যাবত সৎ সাহসিকতা ও সততা এবং ন্যায়পরায়নতার সহিত তাঁর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাঁর খলিফা হওয়ার তারিখ ছিলো ২৩ আগস্ট ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ। এবং তার মৃত্যু হয়েছিল  ৩ নভেম্বর ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে। এই হিসাবে তাঁর শাসনামল দাঁড়ায় প্রায় ১০ বছর দুই মাস দশ দিন। 

হযরত ওমর (রা.) এর জীবনী মুভি বাংলা ডাবিং

“ওমর (রা.) সিরিজ” নামে একটি টিভি সিরিয়াল আরবি ভাষায় নির্মিত হয়। যার পরিচালক ছিলেন হাতেম আলী। যে নাটকে অভিনয় করেছিলেন, সামের ইসমাইল, গাসসান মাসুদ, হাসান আল জুন্দি, মুনা ওয়াসেফ প্রমুখ। সর্বমোট ত্রিশ পর্বের এই সিরিজটি খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রা.)-এর সম্পূর্ণ জীবন সম্পর্কে নির্মিত। যেখানে তাঁর জীবনের আঠারো বছর থেকে শুরু করে মৃত্যুকালীন সময়ের মধ্যকার প্রবাহমান প্রাসঙ্গিক ও পারিপার্শ্বিক সমসাময়িক ঘটনাবলি সমূহ প্রাধান্য পেয়েছে।

এই ধারাবাহিক নাটকটি ইসলামিক ব্যক্তিত্ব ইউসূফ আল-কারযাভী ও সালমান আল আওদাহ-এর প্রত্যক্ষ স্পনসরে নির্মিত। নাটকটি  ২০১২ সালের ২০ শে জুলাই থেকে তথা পবিত্র রমজানের ত্রিশদিন ব্যাপী মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে এবং একই সঙ্গে তুরস্কের এটিভি ও ইন্দোনেশিয়ার এমএনসিটিভিতে প্রচারিত হয়। 

এছাড়াও ইউটিউবে এর পর্বগুলো টেলিভিশনে প্রচারের পরপরই ইংরেজি সাবটাইটেল সহ প্রকাশ করা হয়। পরবর্তীতে বাংলা সাবটাইটেলেও নাটকটি পাওয়া যায়। যারা হিন্দি, উর্দু ভাষা বোঝেন, তারা সিরিজটি দেখতে পারেন- 

হযরত ওমর (রা.) কে ফারুক উপাধি দেওয়া হয়েছিল কেন?

 

“আল ফারুক” নামের অর্থ হলো সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। হযরত ওমর (রা.) ছিলেন একজন কট্টর মুসলিম বিদ্বেষী। কিন্তু এই কট্টর কঠিন মানুষটি যখন কুরআন তথা ইসলামের ছায়াতলে আসে, তখন তিনি সত্য এবং মিথ্যার পার্থক্য নিরুপণ করতে পেরেছিলেন সঠিকভাবেই। 

অথচ এই সেই ওমর! যে কিনা খোলা তলোয়ার নিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে। কিন্তু যখনই জানতে পারলেন তাঁর বোনও মুসলিম হয়েছেন, তিনি সাথে সাথে সত্য যাচাই করতে তার ঘরে যান।

আর ঘরে তাদের পেয়ে তিনি রাগান্বিত হন। কিন্তু যখনই বোনের কথা শুনে পবিত্র কুরআনের বাণী শ্রবণ করলেন। তখনই তিনি সত্য ধর্মের তালাশ পেয়ে গেলেন। যেকারণে কুরআনের বাণী শোনার সাথে সাথেই তিনি রাসুলের (সা.) দরবারে হাজির হয়ে ইসলামকে কবুল করলেন। আর এভাবেই তিনি সত্য ইসলামকে কবুল করে এবং মিথ্যা ধর্ম মূর্তিপূজাকে ঘৃণা করার কারণে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে আল ফারুক উপাধিতে ভূষিত করেন।

 

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী

পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।

আপনি আরো যা পড়তে পারেন-


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

1

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী

Author: সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী জন্ম চট্টগ্রামে। জীবিকার প্রয়োজনে একসময় প্রবাসী ছিলেন। প্রবাসের সেই কঠিন সময়ে লেখেলেখির হাতেখড়ি। গল্প, কবিতা, সাহিত্যের পাশাপাশি প্রবাসী বাংলা পত্রিকায়ও নিয়মিত কলাম লিখেছেন। প্রবাসের সেই চাকচিক্যের মায়া ত্যাগ করে মানুষের ভালোবাসার টানে দেশে এখন স্থায়ী বসবাস। বর্তমানে বেসরকারি চাকুরিজীবী। তাঁর ভালোলাগে বই পড়তে এবং পরিবারকে সময় দিতে।

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

কবিতা আল কোরআনের প্রতীক আফছানা খানম অথৈ

আল কোরআনের প্রতীক আফছানা খানম অথৈ মা আমেনার গর্ভেতে জন্ম নিলো এক মহামানবের, নাম হলো তার মুহাম্মদ রাসুল আসলো ভবের

ফোরাত নদীতে স্বর্নের পাহাড় আফছানা খানম অথৈ

ফোরাত নদীতে স্বর্নের পাহাড় আফছানা খানম অথৈ ইমাম মাহাদী (আ:) আগমনের পূর্বে ফোরাত নদীর তীরে স্বর্নের পাহাড় ভেসে উঠা কেয়ামতের

কবিতা দাজ্জাল আফছানা খানম অথৈ

দাজ্জাল আফছানা খানম অথৈ কেয়ামতের পূর্বে দাজ্জাল আসবে নিজেকে খোদা বলে দাবি করবে, কাফের মুনাফিক যাবে তার দলে ঈমানদার মুমিন

গল্প হযরত মুহাম্মদ (সা:) জীবনের গল্প আফছানা খানম অথৈ

জন্ম:হযরত মুহাম্মদ (সা:) বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত মক্কা নগরীর কুরাইশ গোত্রে বনি হাশিম বংশে ৫৭০ খৃষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন।তার পিতার

Leave a Reply