ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর জীবনী- লেখক ডট মি

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) জীবনী

1

 

ইসলাম হচ্ছে একমাত্র মহা সত্য ধর্ম। যেখানে প্রতিটি মুসলমানকে ইসলামের নানান নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। রাসুলুল্লাহ সা. পরবর্তীতে যে কয়জন মনীষী এই ইসলামের খেদমত করে গেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন  ইমাম আবু হানিফা (রহ.)। যার কৃতিত্বের কারণে  কিয়ামত পর্যন্ত মানুষ তাঁকে স্বরণ করবে। এই মহান বুজুর্গের অবদানকে আমরা কখনোই অস্বীকার করতে পারবো না। আজ আমরা এই মহৎ জ্ঞানী গুণী মনীষীর জীবনী সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

 

সূচিপত্র

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর জন্ম 

হযরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ছিলেন ইরাকের কুফা নগরীর একজন বাসিন্দা। তিনি ছোট থেকেই কুফা নগরীতে লালিত-পালিত হন। যখন তিনি জন্মলাভ করেন, তখন  উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান এর শাসনামল চলছিল। তৎকালীন সময়  ৬৯৯ খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসের ৫ তারিখ এবং হিজরি ৮০ সালে শাবান মাসের ৪ তারিখে ইমামে আযম হযরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.)  জন্মগ্রহণ করেন।

ইমাম আবু হানিফা  (রহ.) এর পিতা হচ্ছেন   সাবিত বিন যুতী কাবুল। তিনি  আফগানিস্তানের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ছিলেন। আবু হানিফা তাঁর পিতার বৃদ্ধ বয়সের সন্তান। তাই শৈশবেই ইমাম আবু হানিফা (রহ.) পিতৃহারা হন। 

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর প্রকৃত নাম হচ্ছে নুমান বিন সাবিত। কিন্তু তাঁকে সবাই আবু হানিফা বা হানিফার বাবা নামেই চেনে। আবু হানিফা হচ্ছে তাঁর উপনাম যাকে কুনিয়াত বলা হয়। আর এই নামেই তিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তাঁর উপাধি হচ্ছে ইমামে আযম।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) কে অনেকেই অ-আরবীয় বলে থাকেন। তার কারণ হিসাবে বলা হয় আবু হানিফা (রহ.) এর দাদার নাম ছিলো যুতী। দাদার নামে অ-আরবীয় উপনাম যুতী থাকার কারণে তাকে বংশধরের দিক থেকে অ-আরবীয় বলে ধরা হয়। তবে বিভিন্ন ইতিহাসবিদ তাঁর বংশ সম্পর্কে বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। কেউ তাঁকে পারসিক বংশদ্ভূত বলেও দাবি করেছেন। তবে ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও নির্ভরযোগ্য মতামত হলো তিনি কাবুলের পারসিক বংশদ্ভূত।

কাপড় ব্যবসায়ী আবু হানিফা

হযরত আবু হানিফা (রহ.) জীবনের শুরুর দিকে ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ কাপড় ব্যবসায়ী। তার পিতা সাবিত বিন যুতী যেহেতু  একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলেন। সেই সুবাদে তিনিও একজন ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। তার বিশেষ কারণ হচ্ছে মাত্র ১৬ বছর বয়সে আবু হানিফা (রহ.) পিতৃহারা হওয়া। বাবা মারা যাওয়ার পর তাকেই যুবক বয়সে এই ব্যবসার দায়িত্ব নিতে হয়। 

যেহেতু তার বাবা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলেন, সেহেতু তিনি সেই সুবাদেই তিনি প্রচুর বিত্তের মালিক ছিলেন। তাঁর সময়কার বিশিষ্ট আলেমদের মধ্যে সম্ভবত তিনিই ছিলেন এমন ব্যক্তি যিনি রাষ্ট্রীয় অনুদান বা বিত্তবানদের হাদীয়া-তোহফার পরোয়া না করে, নিজের উপার্জনের দ্বারাই জীবিকা নির্বাহ সহ ইলমের সেবা করতেন। একইসাথে  তার নিকট সমবেত সকল গরীব শিক্ষার্থীদের যাবতীয় ব্যয়ভারও তিনি  নিজের দায়িত্বে  ব্যবস্থা করতেন। 

তাঁর ব্যাপক কর্মদক্ষতার মাধ্যমে ব্যবসা প্রসারিত করার পাশাপাশি কাপড়ের  কারখানাও স্থাপন করেন। এতে করে অল্প দিনের মধ্যেই তিনি সবার কাছে ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি নিজেকে একজন পুরোদস্তুর একজন ব্যবসায়ী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেও, শুধু একজন ব্যক্তি বুঝেছিলেন ইমান আবু হানিফা দুনিয়ার ব্যবসা নয় বরং আখিরাতের ব্যবসায়ী হিসাবেই বেশী উপযুক্ত। আর তিনি হলেন ইমাম শাবী (রহ.)। এই ইমাম শাবী (রহ.) এর ক্ষণিকের সান্নিধ্য তার জীবনের সম্পূর্ণ মোড় পাল্টিয়ে দেয়। তিনি ইমাম আবু হানিফা (রহ.)  কে দেখে তাঁর মধ্যে থাকা বারুদকে জাগিয়ে দিয়েছিলেন। আর এই  ইমাম শাবী (রহ.)-ই তাকে ইলমের ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। আর তিনি জ্ঞানার্জনের প্রতি প্রচন্ড আগ্রহী হয়ে উঠেন।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)  এর ইলম অর্জন 

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) মাত্র ১৬ বছর বয়সে বাবার সাথে হজ্বে যান। সেখান তিনি প্রথম  ইলমে হাদিসের দরসে যোগ দেন। অল্প বয়সে কর্মজীবন শুরু করলেও পরিবারের ইচ্ছা এবং সাহায্য সহযোগিতায় তিনি দ্বীনের জ্ঞানার্জনের জন্য ঝাপিয়ে পড়েন। যে কারণে মাত্র ২০ বছরের মধ্যেই ফিকহ ও হাদিসে বেশ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। আর তাতে অল্প বয়সেই নোমান নামক ছেলেটি হয়ে যায় বিশ্ববিখ্যাত ইমাম। 

ইতিহাস থেকে জানা যায় আবু হানিফার প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু হয় ইমাম জাফর সাদিক এর হাত ধরে। আর খুব অল্প বয়সেই ইমাম আবু হানিফা (রহ.)  অসাধারণ মেধা ও তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তিতে তাফসির গ্রন্থ, হাদিস গ্রন্থ, বালাগাতসহ অন্যান্য শাস্ত্রের প্রাথমিক জ্ঞানলাভ করেন। এ সময়ের মধ্যেই তিনি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর বিশিষ্ট খাদেম সাহাবী হযরত আনাস ইবনে মালিক (রহ.) এর খিদমতে হাজির হন। কিন্তু অল্প বয়সের জন্য কোনাে হাদিস শিখতে ব্যর্থ হন।

এরইমধ্যে ১০০ হিজরিতে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ইলমে ফিকহ অর্জনের জন্য সমকালীন ফকিহ ইমাম হাম্মাদ বিন আবু সুলাইমান আল-আশআরী এর শিক্ষালয়ে ভর্তি হন। ইমাম হাম্মাদই ছিলেন তার প্রকৃত ওস্তাদ। ইমাম হাম্মাদ হচ্ছেন ইবরাহিম নখঈ’র (রহ.) এর  প্রিয় ছাত্র। আর ইবরাহিম ইবনে নখঈ (রহ.) শিক্ষা লাভ করেছিলেন হজরত আলী (রা.) এবং হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে।

আর এই ইমাম হাম্মাদই একাধারে বিশ বছর ধরে নোমান ইবনে সাবিতকে ইমামে আজম হিসাবে গড়ে তোলেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর জ্ঞানের পিপাসা এতো বেশী ছিলো যে, ১৩০ হিজরি থেকে ১৩৬ হিজরি পর্যন্ত টানা ৬টি বছর হারামাইন শরিফাইনে অবস্থান করেন। এবং সেখানকার বিখ্যাত মুহাদ্দিসদের কাছ থেকে হাদিস আহরণ করেন। এভাবেই এক পর্যায়ে কুফার বিভিন্ন মুহাদ্দিসদের কাছে হাদিস অধ্যয়ন শুরু করে শেষ করেন। যে কারণে  ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর শিক্ষকের সংখ্যা হয় প্রায় চার হাজার।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)  এর কর্মজীবন

একজন ব্যবসায়ীর সন্তান হিসাবে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ব্যবসা করেই জীবন নির্বাহ করতেন। যখন তাঁর দ্বীনের অধ্যায়ন শেষ হয়, তারপর থেকেই তিনি পৈত্রিক কাপড়ের ব্যবসা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি তার ব্যবসাকে গ্রামে থেকে শহরের বিভিন্ন জায়গায় বিস্তৃত করেন। সমকালীন সময়ে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)  এর মতো ধন সম্পত্তি আর কারো ছিলো না। এত সম্পত্তির মালিক হয়েও তিনি সাধারণের মতো জীবনযাপন করতেন এবং তাঁর বিপুল অর্থ সম্পদ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও সেবামূলক কাজে ব্যয় করতেন।

ইমামে আযমের শিক্ষাগুরু ইমাম হাম্মাদ (রহ.) ১২০ হিজরিতে ইন্তেকাল করলে তিনি  ব্যবসায়ের পাশাপাশি তার ওস্তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেন। আর তিনি মৃত্যুর পূর্বে ১৫০ হিজরি পর্যন্ত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় প্রচুর শিক্ষার্থী তাঁর কাছে ফিকহ শাস্ত্র (ইসলামিক আইন শাস্ত্র) শিখেন এবং চর্চা করেন। তাঁর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম হলো, ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মদ, ইমাম যুফার প্রমুখ বিখ্যাত মনীষীগণ। 

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)  সাথে সাহাবিগণের সাক্ষাৎ  

হযরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) -ই একমাত্র ইমাম, যার সাথে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মহান সাহাবিদের সাক্ষাৎ হয়েছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায় তিনি সর্বমোট সাতজন সাহাবির (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সাথে ইমাম আবু হানিফার দেখা হয়েছিল।  এই সাতজন সাহাবির নাম হল:

 

  • ওয়াসেলা ইবনুল আসকা (ওফাত: ৮৫ হিজরি)
  • আনাস ইবনে মালিক (ওফাত: ৯৩ হিজরি)
  • জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (ওফাত: ৯৪ হিজরি) 
  • আব্দুল্লাহ ইবনে আবি আওফা (ওফাত: ৮৭ হিজরি)
  • আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়দি (ওফাত: ৯৯ হিজরি)
  • সহল ইবনে সা’আদ (ওফাত: ৮৮ হিজরি)
  • আবু তোফায়েল (ওফাত: ১১০ হিজরি)

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)   কিসের জন্য বিখ্যাত ছিলেন

ইসলামি ইতিহসে হযরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি ইসলামের বিভিন্ন আইনকানুন এবং মাসলা মাসায়েলের জন্য তৎকালীন সময় থেকে আজও বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি ছিলেন জগৎ বিখ্যাত তর্কবাগীশ। তাঁর তীক্ষ্ণ মেধা, প্রতিভা, অসাধারণ ধীশক্তি, দীনি অতুলনীয় জ্ঞান, অসাধারণ বাগ্মিতা ইত্যাদি গুণাবলির কারণে তিনি এখনো সর্বশ্রেষ্ঠ ইসলামি আইনজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আছেন।  

ইমাম আযম আবু হানিফা (রহ.) এর পূর্বে কেউই ইসলামি ফিকহ শাস্ত্র নিয়ে গবেষণা করেনি। যেকারণে  ইসলামি ফিকহ শাস্ত্র নিয়ে কোনাে স্বতন্ত্র শাস্ত্র ছিল না। সর্বপ্রথম ইমাম আবু হানিফা (রহ.)   ফিকহ শাস্ত্র কে বিন্যস্ত করে স্বতন্ত্র শাস্ত্রের মর্যাদায় উন্নীত করেন। 

শুধু তাইনয় ইসলামি ফিকহ শাস্ত্র সম্পাদনার কাজ সুসম্পন্ন করার জন্য তিনি ১৩২ হিজরিতে একটি কার্যকর পরিকল্পনাও গ্রহণ করেছিলেন। এইজন্য নিজের ৪০ জন শ্রেষ্ঠ ফকিহ শিক্ষার্থীকে নিয়ে একটি ‘সম্পাদনা পরিষদ’ গঠন করেন। একইসাথে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ দশজন ছাত্রকে নিয়ে “পর্যালােচনা পরিষদ” গঠন করেন। আর এভাবেই তিনি ফিকহ সংকলনের বিধিবদ্ধ ধারার প্রথম সূচনা করেন।

তাঁর নিবিড় তত্ত্বাবধানে, প্রত্যক্ষ মতামতদানে ও বিশ্লেষণ এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে সুদীর্ঘ বাইশ বছর পর ফিকহ শাস্ত্রের প্রথম ও পূর্ণাঙ্গ সংকলন সমাপ্ত হয়। এই সংকলনে প্রাথমিকভাবে ৮৩ হাজার মাসয়ালা স্থান পায়। যার নাম রাখা হয় ‘কুতুবে হানাফিয়া’। যা তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করে গিয়েছিলেন। যারফলে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এতে ৫ লাখ মতান্তরে ১২ লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি মাসয়ালা সংকলিত হয়। ফিকহ শাস্ত্রে তাঁর অবদানের কথা স্বীকার করে ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, ‘ফিকহ শাস্ত্রের সব মানুষই ছিলেন আবু হানিফার (রহ.) পরিবারভুক্ত।’  (আছারুল ফিকহিল ইসলামী)

এছাড়াও তাঁর পাঠদানের দীর্ঘ জীবনে বিপুল পরিমাণ ছাত্রকে ফকিহরূপে তৈরি করেছেন। যেকারণে তৎকালীন সময়ের বিশাল মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রায় সব শহরেই বিচারপতির আসনে ছিলেন তাঁর ছাত্ররা। তার প্রিয় এবং অন্যতম ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) ছিলেন প্রধান বিচারপতি। উপরের উল্লিখিত কারণে তিনি এখন পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বে বিখ্যাত হয়ে আছেন। 

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর মৃত্যু

ইমাম আবু হানিফার মৃত্যু সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। আমরা আল্লামা মক্কি রহ. থেকে জানতে পারি, উমারি শাসনামলে কুফার প্রশাসক ছিলেন ইবনে হুবাইরা। তৎকালীন সময়ে ইরাকের বিশৃঙ্খলা যখন তীব্র আকার ধারণ করে, তখন তিনি ইরাকের বিশিষ্ট আলেম, উলামা ফকিহদেরকে নিজের রাজপ্রাসাদের  সামনে একত্রিত করলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, ইবনে আবু লাইলা, ইবনে শুবরুমা রহ. এবং দাউদ ইবনে আবি হিন্দাজ প্রমুখ। 

তিনি তাঁর রাজ্যের এই চরম পরিস্থিতিতে প্রত্যেককে এক একটি পদ দিয়ে দিলেন। একইসাথে ইমাম আবু হানিফা রহ. কেও সর্বোচ্চ একটি পদে আসীন করতে প্রস্তাব দিলেন। আর তাঁর পদটি হলো, সরকারি মোহর মারা। অর্থাৎ তাঁকে এমন একটি মোহর দেওয়া হবে, যার  সীলমোহর ছাড়া কোনো অধ্যাদেশ জারি এবং সরকারি কোষাগার থেকে কোনো অর্থ বের হতে পারবে  না।

ইমাম আবু হানিফা রহ. তার এই পদ সরাসরি অস্বীকার করলেন। ইবনে হুবাইরা তার এ প্রস্তাব গ্রহণ না করার কারণে আবু হানিফার উপর জুলুম-নির্যাতন চালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। শাসকের এমন কথা শুনে উপস্থিত সকল ফকিহ গিয়ে ইমাম আবু হানিফা রহ.-কে অনুরোধ করলেন, যাতে তিনি নিজের জন্য বিপদ ঢেকে না আনেন। কিন্তু সকলের কথার উপর তাঁর সিদ্ধান্তকেই তিনি প্রাধান্য দিলেন। 

তিনি বললেন, প্রশাসক যদি আমাকে ওয়াসেত শহরের সমস্ত মসজিদের দরজা গণনার নির্দেশও দিলেও, তা আমি পালন করতে রাজি নই। এটা আমার দ্বারা কিভাবে সম্ভব যে, শাসক কাউকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ জারি করবেন আর আমি তাতে সীলমোহর দিব? আল্লাহর শপথ! এমনটি আমি কখনো করতে পারি না।

এই ঘটনার পর শাসকগোষ্ঠী তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। সেখানে তাঁকে যথেষ্ট নির্যাতন করা হয়। এরপর অনেক অসহ্য নির্যাতন ভোগ করার পর একসময় অবশেষে তিনি কারামুক্ত হন। কারামুক্ত হয়ে তিনি  নিরাপদে মক্কা মুকাররমা পৌঁছান।  এই ঘটনা ১৩০ হিজরির। এরপর আব্বাসি শাসন প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত তিনি মক্কায় বসবাস করেন। একসময় তিনি খলিফা আবু জাফর মানসুরের শাসনামলে কুফায় ফিরে আসেন। আল্লামা মুওয়াফফাক মক্কি রহ. জানান, “খলিফা মানসুর তাঁকে প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণের প্রস্তাব দিলে তিনি তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। এতে খলিফা মানসুর খুবই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেন। এবং তিনি তাঁর জামা-কাপড় খুলে উন্মুক্ত দরবারে বেত্রাঘাত করলেন। ফলে আবু হানিফার শরীর থেকে রক্ত ঝরতে লাগল। প্রচন্ড আঘাতে তাঁর পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল। অথচ এতো অত্যাচারের পরও তিনি বলতে লাগলেন, “আমি এই পদের উপযুক্ত নই।”

তাঁর কথা শুনে খলিফা রেগে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। এবং বললেন, “আপনি মিথ্যা বলছেন!” এবার ইমাম সাহেব বলে উঠলেন, “এবার তো আপনি নিজেই ফয়সালা করে দিলেন আমি অযোগ্য। কেননা কোনো মিথ্যুক ব্যক্তিকে এমন গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় পদ অর্পণ করা জায়েয নয়।”

আবু হানিফার এমন কথা শুনে খলিফা তখন শপথ করে বললেন, “আপনাকে অবশ্যই এ পদ গ্রহণ করতে হবে।” তার প্রত্যুত্তরে ইমাম সাহেবও শপথ করে বললেন, “আমি কখনো তা গ্রহণ করব না।” অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে ইমাম আবু হানিফার এমন  দুঃসাহস ও দৃঢ়তা দেখে পুরো মজলিসের সভাসদবৃন্দ নির্বাক-স্তব্ধ হয়ে গেল। 

হাজেব ইবনে রবি ক্রুব্ধ হয়ে বলে উঠল,  “আবু হানিফা! তুমি আমিরুল মুমিনিনের বিরুদ্ধে কসম করছ! ইমাম আবু হানিফা নিঃসংকোচে জবাব দিলেন, “আমিরুল মুমিনিনের জন্য কসমের কাফ্ফারা আদায় করা আমার চেয়ে সহজ।” খলিফা এই শুনে আরও রাগে-দুঃখে স্তব্ধ হয়ে গেল। এবং তিনি রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ছিলেন। এমনকি তার উত্থান-পতনেরও চিন্তা ছিল না। 

তৎক্ষণাৎ খলিফার চাচা আব্দুছ ছামাদ ইবনে আলী ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন, মহামান্য খলিফা আপনি আর সামনে এগোবেন না। কেন আপনি নিজের উপর গজব টেনে আনছেন? তিনি ইরাকের একজন বিখ্যাত ফকিহ। চাচার এই সাবধান বাণী শুনে খলিফাও বিষয়টি বুঝতে পারলেন। এবং তার অপরাধের খেসারত হিসেবে প্রত্যেক বেত্রাঘাতের বিনিময়ে একহাজার দিরহাম অনুপাতে ত্রিশ হাজার দিরহাম ক্ষতিপূরণ দিলেন। 

তৎকালীন সময়ে এটা একটা বিরাট বড় অঙ্কের টাকা ছিল। কিন্তু বিপুল অঙ্কের এই অর্থ ইমাম আবু হানিফা  নিকট আনা হলে তিনি তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন। কেউ কেউ বলল, আপনি এই অর্থ নিয়ে দান করে দিন! তখন তিনি ক্রুব্ধ হয়ে বললেন: এদের কাছে কি কোনো হালাল-পবিত্র সম্পদ কি আছে? যা নিয়ে আমি দীন-দরিদ্রদের মাঝে দান করতে পারি? 

হযরত ইমাম আযম আবু হানিফা এভাবেই তৎকালীন সকল  রাজা- বাদশাদের উপহার  এভাবেই প্রত্যাখ্যান করেছেন। বিচরপতির পদের জন্য বারবার চাপ দেওয়া হলেও তা এভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। অবশেষে তাঁকে এই অপরাধের কারণে কারাগারে পাঠানো হয়। ইবনে হাজার মক্কি তাঁর লেখায় বর্ণনা করেন: খলিফা মানসুর ইমাম আযম রহ-কে বিচারপতির আসন গ্রহণের জন্য বার বার অনুরোধ করেন। তিনি এও বলেন, সমস্ত ইসলামি রাষ্ট্রের সকল বিচারপতি আপনার অধীন থাকবে। কিন্তু ইমাম সাহেব তা সর্বদাই সরাসরি অস্বীকার করেন। 

আর এভাবেই যা হওয়ার তাই হলো। খলিফা তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করে চমর অত্যাচার এবং যন্ত্রনা দিতে থাকলেন। এরপর ধীরে ধীরে তাঁর উপর অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা থাকলে, একসময় তিনি মৃত্যু বরণ করেন। 

তাঁর করুন মৃত্যু নিয়ে কোনো কোনো কিতাবে এসেছে, একদিন কারাগারে  একশত বেত্রাঘাত করা হল। ফলে তাঁর পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল। আর এভাবেই একদিন তাঁর মৃত্যু হল। 

‘খাইরাতুল হিসান’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত, “ইমাম সাহেব যখন মৃত্যুর উপলব্ধি করলেন, তৎক্ষণাৎ সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন। আর এভাবেই ৭৬৭ খ্রিস্টাব্দ ১৪ জুন এবং ১৫০ হিজরি সালে ৬৭ বছর বয়সে ইমাম আবু হানিফা কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)  সম্পর্কে অন্যান্যদের অভিমত 

তৎকালীন সময় থেকে আজও হযরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর অসংখ্য বিরুদ্ধবাদী থাকলেও, যুগে যুগে বিখ্যাত জ্ঞানী গুণীজনেরা তাঁর অবদানের কথা কখনোই অস্বীকার করতে পারেননি। তাই তাঁর সম্পর্কে অনেক ইমামই বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

চার বিশিষ্ট ইমামদের একজন হযরত ইমাম মালেক (রহ.) বলেছেন, ‘আবু হানিফা (রহ.) এমন এক ব্যক্তি ছিলেন, তিনি যদি ইচ্ছা করতেন, এই স্তম্ভটিকে সোনা প্রমাণিত করবেন, তবে নিঃসন্দেহে তিনি তা করতে সক্ষম।’ (জামিউ বয়ানিল ইলম) ।

ইমাম বুখারির অন্যতম শিক্ষাগুরু মক্কী বিন ইব্রাহীম (রহ.), যাঁর কাছ থেকে ইমাম বুখারি (রহ.) বেশির ভাগ ‘সুলাসিয়াত’ হাদিস সমূহ বর্ণনা করেছেন। এই শিক্ষক মক্কী বিন ইব্রাহীমও ছিলেন ইমাম হানিফা (রহ.)-এর ছাত্র। তিনি ইমামে আযম  সম্পর্কে বলেছিলেন ‘আবু হানিফা তাঁর সময়কালের শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন।’ (মানাকেবে ইমাম আজম রহ.) ।

আবিদ ইবনি সালিহ বলেন, ‘ইমাম আবু হানিফা (রহ.) হাদিসের নাসিখ ও মানসুখ বিচার বিবেচনার ব্যাপারে খুব সতর্ক ছিলেন।’ ইমাম আবু হানিফা  (রহ.) তাঁর শহরে যেসব হাদিস পৌঁছেছে তার মধ্যে রাসুল (সা.)-এর তিরোধানের সময়কার সর্বশেষ আমল কী ছিল সেসব তাঁর মুখস্থ ছিল।

ইয়াহিয়া ইবনে নাসর বলেন, ‘একদিন আমি ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর ঘরে যখন প্রবেশ করি। তখন সেখানে তাঁর কিতাবে ভরপুর ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এগুলো কী? তিনি বললেন, এগুলো সব হাদিসের কিতাব, যার মধ্যে আমি সামান্য কিছু বর্ণনা করেছি, সেগুলো আমার কাছে ফলপ্রদ মনে হয়েছে। (আস সুন্নাহ, উকদু জাওয়াহিরিল মুনীকাহ)

তাঁর ছাত্র হজরত ইবনে মুবারক (রহ.) বলেন, “আল্লাহ তাআলা যদি ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ও সুফিয়ান সাওরি (রহ.) দ্বারা আমাকে সার্বিক ভাবে সাহায্য না করতেন, তবে আমি অন্য মানুষের মতোই থাকতাম। 

তাঁর সমসাময়িক ইমাম আমাশ রহ. বলেন। নিঃসন্দেহে ইমাম আবু হানিফা রহ ছিলেন তৎকালী সময়ে একজন বড় ফকিহ।

ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, “যে ব্যক্তি ফিকহশাস্ত্র শিখতে চায় সে যেন ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর ছাত্রদের অবশ্যই  আঁকড়ে ধরে।”

জাফর ইবনে রবি রহ. বলেছেন,  “আমি পাঁচ বছর যাবত তাঁর খেদমতে কাটিয়েছি। তাঁর চেয়ে মিতভাষী আর কাউকে দেখি নি। ফিকহের যেকোনো বিষয় জিজ্ঞাসা করা হলে একদম খুলে খুলে বর্ণনা করতেন।”

আবু নুয়াইম বলেন, “তিনি মাসয়ালায় গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন।”

ইবনে মুবারক (রহ.) বলেন, ‘মানুষের মাঝে সবচেয়ে বড় ফিকহবিশারদ হলেন ইমাম আবু হানিফা (রহ.), আমি ফিকহশাস্ত্রে তাঁর মতো যোগ্য আর কাউকে দেখিনি।’ 

হজরত ইবনে মুঈন বলেন, “ইমাম আবু হানিফা (রহ.) হাদিসে সিকাহ (বিশ্বস্ত) ছিলেন।”

হজরত সুলায়মান ইবনে আবু শায়ক বলেন, “ইমাম আবু হানিফা (রহ.) একজন বুজুর্গ ও দাতা ছিলেন।”

তাঁর সমসাময়িক বিশিষ্ট মুহাদ্দিছ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ তাঁকে বলতেন ইলমের সারনির্যাস। 

বিখ্যাত বুজুর্গ ফুযাইল ইবনে আয়ায রহ. বলেন: “ইমাম আযম ইমাম আবু হানিফা রহ: ছিলেন একজন মহান ফকিহ, বিত্তশালী, দানবীর, দিনরাত অধ্যবসায়ে লিপ্ত, আবেদী, নির্জনবাসে অভ্যস্ত ও মিতভাষী। হালাল-হারামের বিষয়ে ছিলেন আপোষহীন।  শাসকদের ধন-সম্পদের প্রতি তাঁর ছিল প্রচণ্ড ঘৃণা।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)  কিতাব সমূহ

 

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) রচিত কিতাব সমূহ হলো, 

  • আল-ফিকাহুল আকবর।
  • আল-ফিকাহুল আবসাত।
  • কিতাব আল আলিম অয়াল মুতাআল্লিম।
  • আর-রিসালা।
  • অসিয়া ইলা তিল মিজিহি আল কাজী আবি ইউসুফ।
  • মারিফাতুল মাজাহিব।
  • কিতাবু মাখারিজ ফিল হিয়াল।
  • রিসালা ফিল ফারাইয।
  • মুজাদালা লি আহাদিদ দাহ রিন।
  • কিতাবের মাক সুদ ফিস সারফ।
  • আল-অসিয়া।
  • রিসালা ইলা উসমান আল বাত্তি।
  • মুখাতাবাতু আবি হানিফা মাআ জাফর ইবনে মুহাম্মদ।
  • বাআজ ফতোয়া আবি হানিফা।
  • অসিয়া ইলা ইবনিহি হাম্মাদ।
  • দুআউ আবি হানিফা।
  • মুসনাদে আবি হানিফা ।
  • আল কাসিদা আল কাফিয়া (আননুমানিয়া)।
  • আল জাওয়াবিত আস সালাসা।
  •  অসিয়া ইলা তিল মিজিহি ইউসুফ ইবনে খালিদ।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)   জীবনী গ্রন্থ সমূহ 

  • ইমাম আবু হানিফা (রা.) জীবন ও কর্ম, আবুল হাসানাত কাসিম
  • ইমাম আবু হানিফা (রহ.), মাও. মোঃ সাইদুর রহমান
  • ইমাম আবু হানিফা রহ. এর চিঠি, মাওলানা আশেক এলাহী বুলন্দশহরী রহ.
  • ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর বিস্ময়কর ঘটনাবলী, মাওলানা আব্দুল কাইয়ূম হাক্কানী
  • ইমাম আবু হানিফা রহ.: যুগ ও জীবন, মুহাম্মদ আবু জাহারা
  • ইমাম আযম আবু হানিফা, মুহাম্মদ সিদ্দিক আল মুনশাবি
  • ইমাম আ’যম আবু হানিফা রহ., মুফতী মীযানুর রহমান কাসেমী
  • ইমাম আযম আবু হানিফা রা.১০০ ঘটনা, ইমাম আবু বকর খতিব আল-বাগদাদি রহ.
  • ইমাম আ’যম হযরত আবু হানিফা (রহঃ), আল্লামা শিবলী নোমানী রহ.
  • হযরত ইমাম আবু হানিফা, ফজলুর রহমান আনওয়ারী
  • ইতিহাসের কাঠগড়ায় ইমাম আবু হানিফা (র.), মুফতী রফিকুল ইসলাম আনওয়ার
  • ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর বিস্ময়কর ঘটনাবলী, মাওলানা আব্দুল কাইউম সুবহানী
  • ইমাম আযম আবু হানিফা (রহ.), সাদেক শিবলী জামান

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)  এর জীবনী সম্পর্কে বিভিন্ন গ্রন্থাবলী 

১. ইমাম আবু হানিফা (রহ.)  এর জীবনী সম্পর্কে প্রথম  কিতাব রচনা করেন, আহমাদ ইবনুস সালত (মৃত: ৩০৮ হি:)। এরপর বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম ত্বহাবী রহ. ও ইমাম আবু হানিফা (রহ.) (রহঃ) এর জীবনীর উপর আলাদা গ্রন্থ  রচনা করেন। অত:পর, কাজী মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান ইমাম আবু হানিফা (রহ.)  এর উপর “তুহফাতুস সুলতান ফি মানাকিবিন নু’মান” নামে একটা স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেন। ইমাম ত্বহাবী রহ. এর অন্যতম ছাত্র আবুল কাসেম ইবনুল আওয়াম রহ. “ফাযায়িলু আবি হানিফা ও আসহাবিহি” নামে একটা আলাদা গ্রন্থ রচনা করেন।  ইমাম আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ আল-হারেসী (মৃত: ৩৪৫ হি:) ইমাম আবু হানিফা (রহ.)  এর জীবনীর উপর “কাশফুল আসতার” নামে একটি গ্রন্থ লেখেন। এছাড়াও ইমাম আবু ইয়াহইয়া যাকারিয়া ইবনে ইয়াহইয়া নিসাপুরী ইমাম আবু হানিফা (রহ.)  এর জীবনীর উপর একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ লেখেন।

এভাবে ইমাম আবু আহমাদ মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মদ নিসাপুরী (মৃত:৩৫৭ হি:) ইমাম আবু হানিফা (রহ.)  এর উপর বিশ খন্ডের একটি কিতাব রচনা করেন। একইভাবে, ইমাম আবু আব্দুল্লাহ আহমাদ ইবনে আলী আস-সাইমুরী (মৃত:৪৩৬ হি:), ইমাম আবু ইয়াকুব ইউসুফ ইবনে আহমাদ ইবনে ইউসুফ আল-মক্কী আস-সায়দালানী রহ., ইমাম ইবনে আব্দুল বার রহ. (মৃত:৪৬২), ইমাম আলী ইবনে আব্দুল আযীয় জহিরুদ্দীন মারগিনানী রহ.(মৃত:৫০৬ হি:), ইমাম জারুল্লাহ যামাখশারী রহ. (মৃত: ৫৩৮ হি:), ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ আল-কারদারী (মৃত: ৭২৭ হি:) ইত্যাদি মহৎ এবং জগৎ বিখ্যাত ইমাম মুহানদ্দিসগণ হযরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.)র উপর অসংখ্য গ্রন্থ লিখেছেন।  এছাড়াও তাঁর বিরুদ্ধেও অসংখ্য কিতাব অনেক বড় বড় আলেমগণ লিখেছেন। 

 

আমরা হযরত আবু হানিফার জীবনী বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারলাম, তিনি ছিলেন 

একজন যুগশ্রেষ্ঠ ইমাম। ইসলামে ফিকহ ও হাদীস বিভাগে তার অবদান ও শ্রেষ্ঠত্ব আজ পর্যন্ত কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না।  তার তাকওয়া, খােদাভীতি, দানশীলতা এবং অমায়িকতা ছিল সর্বজন বিদিত। উম্মতে মুহাম্মদী কুরআন ও হাদীসের সঠিক অনুসরণ করতে পারার জন্য তাঁর অবদান আমরা কেউ অস্বীকার করতে পারি না। তিনি শেষ জীবন পর্যন্ত কুরআন ও হাদীস গবেষণা করে যাবতীয় বিধি-বিধান বের করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। আমরা এখনো তাঁর অবদানের উপরই দ্বীন পালন করছি। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতের একটি সম্মানিত স্থান দান করুন, আমিন 

প্রশ্নোত্তর 

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর আসল নাম কি?

আবু হানিফা নামের অর্থ হলো, হানিফার বাবা। তিনি এই নামেই সবার কাছে পরিচিত।  অথচ তাঁর আসল নাম হচ্ছে নোমান বিন সাবিত। কিংবা নোমান ইবনে সাবিত। যার অর্থ হলো সাবিতের ছেলে নোমান। সেই হিসাবে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)র আসল নাম হচ্ছে নোমান। এছাড়াও বংশীয় ভাবে তাঁর নাম হচ্ছে, নোমান ইবনে সাবিত ইবনে যুতা ইবনে মারযুবান। 

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)  ওস্তাদ কে? 

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)  এর প্রকৃত উস্তাদ হচ্ছেন, ইমাম হাম্মাদ বিন আবু সুলাইমান আল-আশআরী। যার কাছে তিনি দীর্ঘ ২০ বছর পড়াশোনা করেন। 

ইমাম মালেক কি ইমাম আবু হানিফা (রহ.)  এর  ছাত্র ছিলেন? 

অনেকেই মনে করেন ইমাম মালেক ইমাম আবু হানিফা (রহ.)র ছাত্র ছিলেন। কিন্তু এমন কোনো প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না। যদিও তাদের বয়সের পার্থক্য ছিলো মাত্র ১৩। তবে তাদের মধ্যে সাক্ষাৎ হয়েছে এমন কথা বিভিন্ন সুত্রে শোনা যায়। 

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)   কি তাবেয়ী ছিলেন? 

ইসলামি সকল স্কলারদের মতে হযরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) একজন তাবেয়ী ছিলেন। কেননা তিনি সাত সাতজন সাহাবীর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। 

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) পীর কে ছিলেন? 

আমাদের উপমহাদেশে যারা সুফিবাদী সুন্নি, তারা তাদের পীরতন্ত্র জারি রাখার জন্য দাবি করেন যে, ইমাম আবু হানিফা (রহ.)ও পীরের মুরিদ ছিলেন। অর্থাৎ তাঁরও পীর ছিলো। কিন্তু এ কথা সর্বজনবিদিতভাবে সত্য যে, তিনি কোনো পীরের মুরিদ নন। তাঁর কোনো পীর ছিলো না। এমনকি তিনি নিজেও কোনো পীর নন। তারও কোনো মুরিদ নেই ছিলো না। তবে তার শিক্ষাগুরু তথা উস্তাদ রয়েছে। যার নাম ইমাম হাম্মাদ বিন আবু সুলাইমান আল-আশআরী।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)   কি আল্লাহকে দেখেছেন

অনেক কল্পকাহিনীতে এসেছে যে, ইমাম আবু হানিফা (রহ.) অনেকবার আল্লাহকে দেখেছেন। তবে এই কথা ইমাম আবু হানিফা (রহ.) থেকে সহীহ সনদে প্রমাণিত নয়।  যদি কেউ এই কথা সহীহ সনদে প্রমাণিত বলে ধারণা করে থাকে, তাহলে সেটা হবে খাব ও স্বপ্নমাত্র। আর ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপ্নে কোনো কিছু দেখা এবং জাগ্রত অবস্থায় বাস্তবে কিছু দেখা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। কেননা  স্বপ্নে মানুষ যা দেখে কিংবা  শুনে অথবা  অনুভব করে তা কখনোই তার পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা অনুভূত হয় না। 

পবিত্র হাদিসে এসেছে,  যে স্বপ্ন ভালো খারাপ থাকতে পারে। যা ভালো তা গ্রহণ করব যা খারাপ তা বর্জন করব। এছাড়াও একমাত্র নবি রাসুল আলাইহিমুস সালাম ছাড়া অন্যদের কোনো স্বপ্ন কখনোই শরীয়ত হতে পারে না।

সুতরাং কেউ যদি স্বপ্নে আল্লাহ তাআলাকে দেখেছে মনে করলে,  সেটি যে প্রকৃত দেখা নয় এবং চর্মচক্ষু দ্বারা দেখা ও অনুভব করা নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই ধরনের স্বপ্ন দেখা হচ্ছে, মূলত উদাহরণ ও দৃষ্টান্ত স্বরূপ কোনো ভালো গুণ বা অবস্থার দর্শন। স্বপ্নদ্রষ্টার অবস্থা চিন্তা করে সেই উদাহরণ ও দৃষ্টান্ত বিভিন্ন হতে পারে। 

কেননা আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ঘোষণা দেন, “কোন কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়। তিনি সব শুনেন, সব দেখেন।” (সূরাঃ আশ-শুরা, আয়াতঃ ১১)

 

এছাড়াও আল্লাহ নিজেই পবিত্র কুরআনে ঘোষণা দিয়েছেন, পৃথিবীর চর্মচক্ষু কেউ তাকে ইহজগতে দেখতে পাবে না। শুধু তাইনয় পবিত্র হাদিসে এসেছে,  আল্লাহর মুমিন ও নেক বান্দাগণ আখেরাতে জান্নাতে আল্লাহ তাআলার দিদার লাভে ধন্য হবে।

 

সুতরাং দুনিয়ার মানুষ কখনোই পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা আল্লাহকে দেখতে পাবে না। আমাদের উপমহাদেশে যারা সুফিবাদী সুন্নি রয়েছে, তারা ইমাম আবু হানিফা (রহ.)র নামে মিথ্যাচার করার জন্য এমন বলে থাকেন। সুতরাং এই কথা কখনোই সত্য হতে পারে না।  

 

ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) কি রামাযানে ৬১ বার কুরআন খতম করতেন? 

উপরোক্ত দাবির কোনো সত্যতা নেই। একইসাথে এটি রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত বিরোধী। কেননা আবদুল্লাহ ইবনু ‘আম্‌র (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তিন দিনের কম সময়ে যে লোক কুরআন পাঠ করল সে কুরআনের কিছুই বুঝেনি। সহীহঃ সহীহ আবূ দাঊদ (১২৬০), মিশকাত (২২০১), সহীহাহ্‌ (১৫১৩), জামে’ আত-তিরমিজি, হাদিস নং ২৯৪৯)

 

এছাড়াও এই বিষয়টি অসম্ভব। এই ধরনের অলৌকিক অতিরঞ্জিত কথা ও ঘটনা কখনোই ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর। মতো বড় একজন বুজুগর্গের মর্যাদাকে বৃদ্ধি করে না। বরং এইসব কথা বিভিন্নভাবে তাঁর মান মর্যদাকে ক্ষুণ্ণ করে। (আল-আক্বাইদ আল-ইসলামিয়াহ, পৃঃ ৪৫)। এই ঘটনা ছাড়াও আরো অনেক অলৌকিক ঘটনা তাঁর নামে সমাজে বহুলভাবে প্রচলিত আছে, যেগুলির কোনো ভিত্তি নেই।

 

আপনি আরো যা পড়তে পারেন

 


Screenshot 3
বিজ্ঞাপনঃ বই কিনুন, বই পড়ুন

1

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী

Author: সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী জন্ম চট্টগ্রামে। জীবিকার প্রয়োজনে একসময় প্রবাসী ছিলেন। প্রবাসের সেই কঠিন সময়ে লেখেলেখির হাতেখড়ি। গল্প, কবিতা, সাহিত্যের পাশাপাশি প্রবাসী বাংলা পত্রিকায়ও নিয়মিত কলাম লিখেছেন। প্রবাসের সেই চাকচিক্যের মায়া ত্যাগ করে মানুষের ভালোবাসার টানে দেশে এখন স্থায়ী বসবাস। বর্তমানে বেসরকারি চাকুরিজীবী। তাঁর ভালোলাগে বই পড়তে এবং পরিবারকে সময় দিতে।

নিচের লেখাগুলো আপনার পছন্দ হতে পারে

কবিতা আল কোরআনের প্রতীক আফছানা খানম অথৈ

আল কোরআনের প্রতীক আফছানা খানম অথৈ মা আমেনার গর্ভেতে জন্ম নিলো এক মহামানবের, নাম হলো তার মুহাম্মদ রাসুল আসলো ভবের

ফোরাত নদীতে স্বর্নের পাহাড় আফছানা খানম অথৈ

ফোরাত নদীতে স্বর্নের পাহাড় আফছানা খানম অথৈ ইমাম মাহাদী (আ:) আগমনের পূর্বে ফোরাত নদীর তীরে স্বর্নের পাহাড় ভেসে উঠা কেয়ামতের

কবিতা দাজ্জাল আফছানা খানম অথৈ

দাজ্জাল আফছানা খানম অথৈ কেয়ামতের পূর্বে দাজ্জাল আসবে নিজেকে খোদা বলে দাবি করবে, কাফের মুনাফিক যাবে তার দলে ঈমানদার মুমিন

গল্প হযরত মুহাম্মদ (সা:) জীবনের গল্প আফছানা খানম অথৈ

জন্ম:হযরত মুহাম্মদ (সা:) বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত মক্কা নগরীর কুরাইশ গোত্রে বনি হাশিম বংশে ৫৭০ খৃষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন।তার পিতার

2 Replies to “ইমাম আবু হানিফা (রহ.) জীবনী”

Leave a Reply