শিরক কী, মানুষ কীভাবে শিরক করে
ইসলামই একমাত্র ধর্ম যেখানে স্রষ্টা অর্থাৎ আল্লাহ তার কোনো ক্ষমতাতেই কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করেননি। আল্লাহই একমাত্র একক ইলাহ যিনি সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী। সৃষ্টির শুরু থেকেই আল্লাহ তাওহিদের এই একটি বাণীই প্রচার করেছেন। তারপরও যুগে যুগে মানুষ আল্লাহর বিভিন্ন ক্ষমতার সাথে তাঁর সৃষ্টিকে অংশীদার সাব্যস্ত করেছে। আর এই অংশীদার করাই হলো শিরক। যা ক্ষমার অযোগ্য একটি অপরাধ। আজ আমরা জানার চেষ্টা করবো শিরক কী, কীভাবে মানুষ শিরক করে।
শিরকের অর্থ
শিরকের অর্থ হলো অংশীদার স্থাপন করা। অর্থাৎ কোনো বিযয়ে একজনের সাথে অন্য কারো শরীক সাব্যস্ত করাই হলো শিরক। শিরক শব্দটি যখন আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত হয় তখন এর অর্থ দাঁড়ায়, আল্লাহর কোনো ইবাদত বা ক্ষমতার সাথে অন্য কাউকে শরিক বা অংশীদার করা।
অর্থাৎ আল্লাহর তাওহিদ সম্বলিত যেসব গুণাবলী রয়েছে, সেইসব গুণাবলী আল্লাহরও আছে সেইসাথে অন্য কারোরও আছে এমন ধারণা বা বিশ্বাস করাটাই হচ্ছে আল্লাহর সাথে শিরক করা। প্রকৃতপক্ষে যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে তারাই শিরক করে। অর্থাৎ যারা ঈমান এনে বা না এনে আল্লাহকেও বিশ্বাস করে, পাশাপাশি আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে তাঁর শরীক সাব্যস্ত করে তারাই হচ্ছে শিরককারী মুশরিক। সোজা কথায় আল্লাহকে ইলাহ মেনে তাঁর সাথে তাঁর প্রিয় বান্দা, নবি, রাসূল, ফিরিশতা, দেবদেবী ইত্যাদিকেও আল্লাহর মতো ক্ষমতাশালী মনে করাই হচ্ছে শিরক।
শিরকের প্রকারভেদ
তাওহিদের মতো শিরকও তিন প্রকার। অর্থাৎ তাওহিদের তিনটি বিষয়ের সাথে শরিক স্থাপন করাই হলো শিরক। এই তিনটি বিষয়ের সাথে কেউ শরিক স্থাপন করলে সে মুশরিক হয়ে যায়।
এই তিনটি বিষয় হলো,
১ .আল্লাহর রুবূবীয়্যাহর সাথে শিরক
২. আল্লাহর উলুহিয়্যাহর সাথে শিরক
৩. আল্লাহর আসমা ওয়াস সিফাতের সাথে শিরক
আল্লাহর রুবূবীয়্যাহর সাথে শিরক
তাওহিদুল রুবূবীয়্যাহ হলো, আল্লাহ-ই আমাদের একমাত্র রব। অর্থাৎ সৃষ্টি, রাজত্ব, কর্তৃত্ব ও পরিচালনা এবং একমাত্র আইনপ্রণেতা ইত্যাদিতে আল্লাহকে এক, একক এবং অদ্বিতীয় হিসাবে বিশ্বাস করার নাম তাওহিদে রুবূবীয়্যাহ।
যারা আল্লাহর এই গুণ স্বীকারের পাশাপাশি অন্যান্য কোনো উপাস্যকে বা আল্লাহর কোনো বান্দাকে একই গুণের অধিকারী মনে তাহলে তা হবে আল্লাহর রুবূবীয়্যাহর সাথে শিরক। এটি তিনটি ভাগে বিভক্ত।
ক) সৃষ্টিতে আল্লাহর একত্বের সাথে শিরক: আল্লাহ একাই সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা। তিনি ছাড়া অন্য কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“আল্লাহ ছাড়া কোনো স্রষ্টা আছে কী? যে তোমাদেরকে আকাশ ও জমিন হতে জীবিকা প্রদান করে। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো মা‘বূদ নেই।” (সূরা ফাতির, আয়াত: ৩)
অর্থাৎ জীবন্ত সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা শুধুমাত্র আল্লাহ। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,
“আল্লাহ সৃষ্টিকর্তাদের মধ্যে উত্তম সৃষ্টিকর্তা।” (সূরা আল-মুমিনূন আয়াত: ১৪)
অর্থাৎ পৃথিবীর মানুষও কিছু না কিছু সৃষ্টি করেন। তবে তারা যা সৃষ্টি করে তার থেকে সর্বোত্তম সৃষ্টিকারী হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ। সুতরাং আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন তাঁর অনুরূপ সৃষ্টি কখনোই মানুষ বা অন্য কোনো কথিত বাতিল ইলাহ সৃষ্টি করতে পারে না।
অতএব, আল্লাহ যা যে রূপ সৃষ্টি করেছেন এবং করতে পারেন, ঠিক একইরকম অন্য কেউ সৃষ্টি করে পারে এমন ধারণা পোষণ করাই হচ্ছে আল্লাহর সালে সৃষ্টিগত একত্বের সাথে শিরক। শিরকের বিরুদ্ধে আল্লাহর চ্যালেঞ্জ,
“হে লোক সকল! একটি উপমা বর্ণনা করা হলো, অতএব তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শোন; তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের পূজা কর, তারা কখনও একটি মাছি সৃষ্টি করতে পারবে না, যদিও তারা সকলে একত্রিত হয়। আর মাছি যদি তাদের কাছ থেকে কোন কিছু ছিনিয়ে নেয়, তবে তারা তার কাছ থেকে তা উদ্ধার করতে পারবে না, প্রার্থনাকারী ও যার কাছে প্রার্থনা করা হয়, উভয়েই শক্তিহীন। “(সূরা: হাজ্জ্ব, আয়াত: ৭৩)
খ) আল্লাহর রাজত্বের একত্বের সাথে শিরক: আল্লাহ হচ্ছেন সকল রাজত্বের মালিক। তাঁর হাতেই পুরো সৃষ্টি জগতের রাজত্ব। আল্লাহ বলেন,
“( আল্লাহ) সেই মহান সত্বা অতীব বরকতময়, যার হাতে রয়েছে সকল রাজত্ব। আর তিনি প্রতিটি বিষয়ের ওপর ক্ষমতাবান।” (সূরা আল-মুলক, আয়াত: ১)
অতএব পুরো সৃষ্টি জগতের রাজত্ব আল্লাহর। কেউ যদি আল্লাহর একছত্র রাজত্বে তাঁর সাথে কাউকে শরিক করে তাহলে তা হবে আল্লাহর সাথে শিরক।
গ) পরিচালনায় আল্লাহর একত্বের সাথে শারিক: আল্লাহ ব্যতীত সমগ্র জগতের আর কোনো দ্বিতীয় পরিচালক নেই। একমাত্র আল্লাহই পরিচালনা করেন সমগ্র বিশ্ব জগত। তাঁর আদেশ নির্দেশ এবং আইনেই চলছে, চলবে এবং চলতে হবে পুরো বিশ্ব জাহান। আল্লাহ বলেন,
“সাবধান! সৃষ্টি তাঁরই, এর উপর প্রভুত্ব চালাবার-একে শাসন করার অধিকারও একমাত্র তাঁরই। ” (সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৫৪)
অর্থাৎ, সমগ্র বিশ্ব জাহানের সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন আল্লাহ। আর এই বিশ্ব চলবেও একমাত্র আল্লাহর বিধানে তথা আইনে। এখন যদি ঈমানের দাবিদাররা দুনিয়ায় আল্লাহর আইনের সাথে বা পরিবর্তে অন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অনুসরণে দেশ পরিচালনা করে তবে তা হবে আল্লাহর বিধি বিধানের বিরুদ্ধে শিরক। আল্লাহ বলেন,
“নিশ্চয় আমি (হে রাসূল) আপনার প্রতি সত্য কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি মানুষের মধ্যে ফয়সালা করেন, যা আল্লাহ আপনাকে হৃদয়ঙ্গম করান।” (সূরা: আন নিসা, আয়াত: ১০৫)
অতএব, সৃষ্টি যার পরিচালনার আইন, বিচার, বিধি বিধান ও ক্ষমতাও তাঁর। এখন কেউ যদি আল্লাহর আইনের সাথে বা পরিবর্তে নিজেরাই আইন তৈরি করে বা অন্য কোনো উৎস থেকে আইন তালাশ করে তাহলে তা হবে সুস্পষ্ট রাষ্ট্রীয় শিরক।
আল্লাহর উলুহিয়্যাহর সাথে শিরক
আল্লাহ তাঁর বান্দা থেকে ইবাদত পাওয়ার একক এবং একমাত্র মালিক। মানুষ আল্লাহর জন্য যে ইবাদত করে সেই একই ইবাদত অন্য কারো জন্য করা যাবে না। যদি কেউ আল্লাহর ইবাদত, আল্লাহর ভয় বা আশা নিয়ে না করে অন্য কারো ভয়ে (ক্ষতির আশঙ্কায়) বা লৌকিক ভাবে অন্য কাউকে দেখানোর জন্য করা হয় তাহলে তা হবে শিরক। অথবা আল্লাহকে বিশ্বাস করে আল্লাহর জন্য ইবাদত না করে অন্য কারো মন জয়ের জন্য ইবাদত তথা সালাত, তাওয়াফ, দান, সদকা, মানত, কুরবানী ইত্যাদি করা হলে তা হবে সুস্পষ্ট শিরক।
“নিশ্চয় যে ব্যক্তি শিরকে লিপ্ত হবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। তার ঠিকানা জাহান্নাম। আর যালেমদের জন্য কোনো সাহায্যকারী নেই।” (সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৭২)
যুগে নবি রাসূলগণ এই তাওহিদুল উলুহিয়্যাহর দাওআতই সাধারণ মানুষকে দিয়ে এসেছিলেন। যারা আল্লাহ কে স্বীকারের পাশাপাশি অন্যান্য উপাস্যও তৈরি করেছিল। সুতরাং আল্লাহর জন্য নির্ধারিত অনির্ধারিত যেকোনো ইবাদতে অন্য কাউকে শরীক করা যাবে না। শরিক করার সাথে সাথে তা শিরকে পরিনত হবে।
উদাহরণ: সালাত, সিয়াম, হজ্জ্ব, যাকাত, কুরবানি ইত্যাদি আনুষ্ঠানিক ইবাদত সমূহ হচ্ছে একমাত্র আল্লাহর জন্য। অর্থাৎ আল্লাহর ভয় (জাহান্নাম) এবং আশা (জান্নাত) সহকারে তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এইসব ইবাদত করা।
কোনো ঈমানদার এইসব ইবাদত লোক দেখানোর জন্য অর্থাৎ সালাত, সিয়াম আদায় করছি লোকে পরহেজগার বলবে, হজ্জ্ব করছি লোকে হাজী বলবে, যাকাত, কুরবানি দিচ্ছি লোকে বড় দানবির বলবে এই উদ্দেশ্যে করে ; তাহলে তা হবে ছোট শিরক।
একইসাথে কোনো ঈমানদার যদি আল্লাহর কোনো বান্দাকে (জীবিত বা মৃত) খুশি বা সন্তুষ্ট করার জন্য (যেমন মাজারে) দান, সদকা, কুরবানি ইত্যাদি করবে তবে তা হবে তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ বিরোধী তথা বড় শিরক। আল্লাহ বলেন,
“(হে রাসূল) আপনি বলুন: আমার নামায, আমার কোরবাণী এবং আমার জীবন ও মরন বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে।” (সূরা: আল আনআম, আয়াত: ১৬২)
আল্লাহর আসমা ওয়াস সিফাতের সাথে শিরক:
সিফাত হলো গুণ। আসমা হলো নাম। আসমা ওয়াস সিফাত হলো, আল্লাহর গুণাবলী সম্বলিত নাম। অর্থাৎ আল্লাহ নিজেকে যেসব গুণাবলী সম্বলিত নামে নামকরণ করেছেন সেইসব নামে এবং গুণে তিনি একক এবং অদ্বিতীয় কতৃত্ববাদী। অর্থাৎ তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই এবং হতে পারে না।
যদি কেউ আল্লাহর এইসব গুণাবলী গুলো অন্য কারো কাছে আছে বলে মনে করে তবে তা হবে শিরক। অর্থাৎ আল্লাহর কোনো গুণে কাউকে ধারণা করা যাবে না। যেমন: সন্তান দেওয়ার মালিক (আশ শুরা :৪৯-৫০) রিজিক দেওয়ার মালিক (তালাক :২-৩,সাবা: ৩৯), বিপদে উদ্ধারকারী (আন আম :৬৩), কারো ভালো করার মালিক (তাওবা : ৫০- ৫১) ইত্যাদি সবই হচ্ছে আল্লাহর একমাত্র একক গুণ।
এখন কেউ যদি এইসব গুণ আল্লাহর কোনো বান্দার (অলি-আউলিয়ার) আছে বলে বিশ্বাস বা ধারণা করলে তা আল্লাহর তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাত বিরোধী হবে। এবং কেউ এমন করলে তা সরাসরি শিরক হবে।
উদাহরণ: সুফি সুন্নিদের আকিদা হচ্ছে তাদের পীর অলি আউলিয়ারা যেকোনো মানুষের ভালো মন্দ হায়াৎ রিজিক ইত্যাদি পরিবর্তন করার ক্ষমতা রয়েছে। অর্থাৎ তারা বিশ্বাস করে আল্লাহর পাশাপাশি তাদের পীর আউলিয়াদেরও বিভিন্ন ক্ষমতা আছে। যা দ্বারা তারা জীবিত কিংবা মৃত যেকোনো অবস্থায় তাদের ভক্ত মুরিদদের ভালো মন্দ ইত্যাদি করতে পারে।
তাই সুফি সুন্নি দাবিদারেরা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর নিজস্ব যেসব বিভিন্ন ক্ষমতা রয়েছে, তা তিনি তাঁর বিভিন্ন অলি আউলিয়াদের ভাগ করে দিয়েছেন। আর তারাও সময়ে অসময়ে তাদের ভক্ত মুরিদের সাহায্য সহযোগিতা করে তাদের উদ্ধার করেন।
এই যে বিশ্বাস সুফি সুন্নিরা ধারণ করে আছে, তা-ই হচ্ছে শিরক। যেখানে তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করছে। এবং পাশাপাশি তাঁর বান্দাদেরও ক্ষমতার মালিক সাব্যস্ত করে তাদের থেকে সাহায্য সহযোগিতা পাওয়ার আশা করছে।
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন যে, কিয়ামতের ময়দানে শিরককারী মুশরিককে আল্লাহ কখনোই ক্ষমা করবেন না। শিরক ছাড়া যেকোনো পাপ তিনি চাইলেই কিয়ামতে যেকোনো কাউকে ক্ষমা করে দিতে পারেন।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম কী কী ভাবে এবং কী কী কারণে আল্লাহর সাথে শিরক হয়। সুতরাং আমাদের ঈমানী দায়িত্ব হলো জীবনের সর্বাবস্থায় শিরক থেকে বেঁচে থাকা। যাতে করে দুনিয়া থেকে সঠিক ঈমান আকিদা নিয়ে কবরে যেতে পারি।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।
আরো পড়ুন-
- আদম আঃ এর সন্তানদের নামের তালিকা
- ইমাম বুখারীর জীবনী ও অবদান
- হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
- কুরআন কেন নাযিল হয়েছে
- আল্লাহ্র হিদায়াত পাওয়ার শর্তসমূহ কী
- কবরের প্রশ্ন এবং আমাদের অজ্ঞতা
- সেরা ইসলামিক বই–যা অবশ্যই পড়া উচিত
Amin
জাযাকাল্লাহ খাইরান